রবীন্দ্রসংগীতের
অনুষ্ঠান। হল ভর্তি লোক। এক বিখ্যাত শিল্পী গাইছেন। আর গাইছেন খুব জনপ্রিয়
গানগুলো, খুব দরদ দিয়ে। আপনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন। এমন সময় আপনার পাশে বসা এক
ভদ্রলোক, হয়তো আপনার পরিচিত, কিংবা অপরিচিত, তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে, হঠাৎ চোখ বুজে গাইতে শুরু করলেন
সেই একই গান, শিল্পীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে, আপনার কানের কাছে। ভদ্রলোক অত্যন্ত
সঙ্গীতানুরাগী, কিন্তু সুর তাল ইত্যাদির জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। মঞ্চে বসা শিল্পীর
গানের থেকে এই পাশে বসা দর্শকের বেসুরো গান অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠছে আপনার কানের
কাছে। ভদ্রতার খাতিরে আপনি বলতে পারছেন না যে আপনি সেই শিল্পীর গান শুনতে এসেছেন
ঐ শ্রোতাটির গান নয়। এরা সব তন্ময় শ্রোতা,
এদের পাশে আসন পড়লে আপনার অনুষ্ঠানের দফারফা।
যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা চেষ্টা করি একটু সামনের দিকে বসতে, যাতে শিল্পীকে একটু চাক্ষুষ দেখা যায়। অনেক সময় হয়তো প্রচন্ড লম্বা কোনও শ্রোতা সমনে বসে পড়লেন। পাশে মস্ত খোপাওয়ালা এক সুন্দরী। শিল্পী চলে গেলেন চোখের আড়ালে। আপনি দুজনের মাঝখানে একটা পজিশন নিলেন শিল্পীকে দেখার জন্য। কিন্তু বিধি বাম। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই দেখলেন সামনের দু-জন মাঝে মাঝেই কাছাকাছি মুখ এনে কথা বলছেন। হেসেও উঠছেন মাঝে মাঝে। মঞ্চে শিল্পী হয়তো গাইছেন বা সেতার বাজাচ্ছেন। তাতে হাস্য কৌতুকের তো কোনও অবকাশই নেই। কেন যে এঁরা হেসে ওঠেন কে জানে?
আর আছেন চঞ্চল বাবু। ইনি আবার আসনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। আধ ঘন্টা পরপর এনার হয় বাথরুম পায় বা তেষ্টা পায়। এনাদের সীটটা সাধারণতঃ খুব দুর্গম জায়গায় হয়; অনেককে মাড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে ইনি বেরোন এবং ঢোকেন। তবে মুখে ‘সরি’ বলেন।
যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা চেষ্টা করি একটু সামনের দিকে বসতে, যাতে শিল্পীকে একটু চাক্ষুষ দেখা যায়। অনেক সময় হয়তো প্রচন্ড লম্বা কোনও শ্রোতা সমনে বসে পড়লেন। পাশে মস্ত খোপাওয়ালা এক সুন্দরী। শিল্পী চলে গেলেন চোখের আড়ালে। আপনি দুজনের মাঝখানে একটা পজিশন নিলেন শিল্পীকে দেখার জন্য। কিন্তু বিধি বাম। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই দেখলেন সামনের দু-জন মাঝে মাঝেই কাছাকাছি মুখ এনে কথা বলছেন। হেসেও উঠছেন মাঝে মাঝে। মঞ্চে শিল্পী হয়তো গাইছেন বা সেতার বাজাচ্ছেন। তাতে হাস্য কৌতুকের তো কোনও অবকাশই নেই। কেন যে এঁরা হেসে ওঠেন কে জানে?
আর আছেন চঞ্চল বাবু। ইনি আবার আসনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। আধ ঘন্টা পরপর এনার হয় বাথরুম পায় বা তেষ্টা পায়। এনাদের সীটটা সাধারণতঃ খুব দুর্গম জায়গায় হয়; অনেককে মাড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে ইনি বেরোন এবং ঢোকেন। তবে মুখে ‘সরি’ বলেন।
একবার
আকাডমি অফ ফাইন আর্টসে নাটক দেখতে গেছি। শাঁওলী মিত্রের বিখ্যাত নাটক ‘নাথবতী
অনাথবৎ’। আগে দেখা ছিল না। নাটকটির পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বহুদিন পর মঞ্চস্থ
হচ্ছে। নাটকটির সংলাপ ক্ষুরধার; প্রত্যেকটি কথা কান পেতে শোনার মত। এক একটি
ক্লাইমেক্স আসছে, সেই মুহূর্তে হঠাৎ আপনার ঠিক সামনের দর্শকের গলা খুশ খুশ করে
উঠল, ‘খুক’। সংলাপটি আপনি আর শুনতে পেলেন না। পরের বার হলের বাঁদিক থেকে আবার
‘খুক’, - আরেকটি মোক্ষম সময়ে। এ খুক-খুক চলতেই লাগল, অবিরাম। বীতশ্রদ্ধ হয়ে এক
দর্শক তো চেঁচিয়েই উঠলেন, ‘বাইরে গিয়ে গার্গল করে আসুন’। এঁরা খুকখুকে
দর্শক।
আরেকটি
অভিজ্ঞতা। মধুসূদন মঞ্চে নাটক বেশ জমে উঠেছে, পটলবাবু ফিল্মস্টার। হঠাৎ হলের মাঝখান থেকে ভেসে উঠল এক শিশুর কান্না। নাটকের সংলাপ ডুবে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল এক মহিলার কন্ঠে
বাচ্চাকে শান্ত করার প্রচেষ্টা, অ, অ, অ ... । কিছুক্ষণ চলল
মা ও শিশুর যুগলবন্দী। সবাই বিরক্ত, কিন্তু কেউ কিছু বলতেও পারছে না। হাজার হোক,
দোষ তো আর শিশুটির নয়। এক সময়ে মঞ্চের দুই অভিনেতা অভিনয় বন্ধ করে হাত জোড় করে
দাঁড়ালেন। ইশারায় জানালেন বাচ্চাটিকে নিয়ে বাইরে যেতে। নাটক আবার শুরু হল ঠিকই,
কিন্তু তাল কেটে গেল, আর জমল না।
আমার
এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, যিনি খুব আড্ডাবাজ। অনর্গল কথা বলতেন। অন্যদের বিশেষ সুযোগ
দিতেন না। তাঁর কাছে আড্ডার স্থান, কাল, পাত্রের ভেদাভেদ ছিল না। একবার দেশ
বিখ্যাত এক গায়িকার আসরে আমার পাশে বসেছিলেন। গান শুরু হয়েছে, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের
মত সেই সঙ্গীত মুর্চ্ছনা উপভোগ করছেন। বন্ধুটি কানের পাশে মুখ নিয়ে আমাকে জানালেন,
‘এনার সঙ্গে মোহাম্মদ রফির বনিবনা হচ্ছে না জান তো’। আমি একটু ঘাড় নেড়ে, হাত তুলে
ইশারায় জানালাম গান শুনছি। বন্ধুটি দমলেন না মোটেই, কানের কাছে ফিশফিশ করে সদ্য এক
ফিল্ম ম্যাগাজিনে পড়া পুরো কাহিনি আমাকে শোনালেন। আমার অনীহা সম্পুর্ণ উপেক্ষা
করে। গান শোনা হল না। ইন্টারভেলে অন্য জায়গায় গিয়ে বসতে বাধ্য হলাম। বন্ধুপত্নী
একটু দূরে বসেছিলেন, অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বললাম তোমার বর গান শুনতে দেয়না
প্রচন্ড কথা বলে। ভদ্রমহিলা একগাল হেসে জানালেন সে জন্যই উনিও তাঁর স্বামীর পাশে
বসেন না। বন্ধুটির সঙ্গে বহুদিন যোগাযোগ নেই। তবে এই ধরণের আড্ডাবাজ শ্রোতা কিন্তু
অনেক আছেন।
প্রযুক্তির
আশীর্বাদের সঙ্গে কিছু অভিশাপও আছে। আজকাল এক জ্বালা হয়েছে মোবাইল ফোন। আমার
নিজেরও একটি আছে এবং বলতে বাধা নেই, যে জিনিসটা খুবই দরকারি আর আধুনিক জীবনযাত্রার
একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু কোনও অনুষ্ঠান চলাকালীন এই ছোট্ট যন্ত্রটি যথেষ্ট বিরক্তির
কারণ হতে পারে। আজকাল এই ছোট্ট ফোনে ক্যামেরাও থাকে। হঠাৎ দেখবেন মাথার ওপরে হাত
তুলে স্টিল ছবি বা ভিডিও তুলছেন আপনার সামনের দর্শকটি। উদ্যোক্তারা সব সময়ে
দর্শকদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, ফোনটি বন্ধ করে রাখতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা?
অনেকে আবার মাঝে মাঝে ই-মেল চেক করেন আবার পিপ পিপ করে উত্তরও দেন; অন্যান্য
দর্শকদের তোয়াক্কাও করেন না।
এ তো
গেল বড় বড় অনুষ্ঠানের দর্শকদের কথা। ছোটখাটো পাড়ার প্রোগ্রামে তো দর্শকের মনোযোগ
আশা করাই অন্যায়। ধরুন, পাড়ার পুজো অনুষ্ঠান, পাড়ার ছেলে মেয়েরা অনেক খেটে, প্রচুর
রিহার্সাল দিয়ে, খুব উৎসাহ নিয়ে স্টেজে উঠেছে। কিন্তু পাড়ার লোকেরা দর্শকের আসনে
বসে চুটিয়ে গল্প করছে। তবে, হ্যাঁ স্টেজের পর্দা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিতে
ভুল করেন না কেউ। আর বাচ্চাদেরকে “এই দারুন হয়েছে” বলতেও ভুল হয় না।
এই
ধরনের বিভিন্ন শ্রেণীর দর্শক নিয়েই আমাদের জীবন। এদের সঙ্গেই আমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আরেকটা ছোট্ট
ঘটনা বলে শেষ করছি।
আমারই এক
আত্মীয়া, খুব বন্ধুবৎসল, অতিথি পরায়ন এবং
পরোপকারী। সবাইকে নিয়ে হৈ চৈ করে থাকতে ভালবাসেন। আর খুব সিনেমা
দেখতে ভালবাসেন। কোনও নতুন ছবি এলে সবাইকে ফোন করেন, টিকিটের ব্যবস্থা করেন এবং
দলবল নিয়ে সিনেমা দেখতে যান। ছবি শুরু হতেই শুরু হয় ধারা বিবরণী। এ বাবা কি
বিচ্ছিরি একটা জামা পরেছে, এই লোকটাকে আমি দেখতে পারি না, একে কেন যে নেয়? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
হাঃ হাঃ (একটা হাসির দৃশ্য), দেখবি খুনটা এই করেছে বলে দিলাম, এর পর নিশ্চয়ই ভাব
হয়ে যাবে দেখিস ... অবিরাম চলতে থাকে। একদিন ধৈর্য হারিয়ে আমি বলতে বাধ্য হই যে এ রকম
করা উচিৎ নয়। এভাবে কথা বললে অন্য দর্শকের অসুবিধে হয়। শুনে আত্মীয়াটি প্রচন্ড চটে যান। শুনেছি আড়ালে আমাকে বেরসিক, অভদ্র টভদ্র বলেছেন। আজকাল আমাকে আর সিনেমা দেখতে ডাকেন না।
আমিও বেঁচে
গেছি।
নিউ জার্সি - ২৯ শে জুলাই ২০১৩
No comments:
Post a Comment