ঘটনাটা আমার এক বন্ধুর মুখে শোনা; আজ থেকে প্রায় ষোলো সতেরো বছর আগে। একটি বারো তেরো
বছরের ছেলে, জন্ম বিদেশে। বিদেশের মাটিতেই বড় হচ্ছে
ধীরে ধীরে। ছেলেটি বয়সের তুলনায় বেশ চালাক চতুর। পড়াশোনায় ক্লাসে বেশ এগিয়েই থাকে।
মা বাবার দুঃখ একটাই, ছেলে বাংলা শিখছে
না। সঙ্গীত, সাহিত্য, সিনেমা সব কিছুতেই
উৎসাহ আছে; কিন্তু সবই ইংরিজিতে।
ছেলেটির মা, বাবা বহু দিন
বিদেশে, কিন্তু মনে প্রাণে খাঁটি বাঙালী। প্রত্যেক ছুটিতে
দেশে গিয়ে ব্যাগ ভর্তি বাংলা গানের ক্যাসেট বা সিডি, বাংলা বই এবং বাংলা সিনেমার ডিভিডি নিয়ে আসেন। সিনেমার ব্যাপারে কোনও বাছ
বিচার নেই। সব রকম ছবিই দেখেন। কিন্তু সিনেমা দেখতে বসলেই ছেলে ভীষণ হাসাহাসি করে।
নায়কদের চেঁচিয়ে সংলাপ বলা, ভারি শরীরে মার
পিট, - সব কিছুই নাকি হাস্যকর। শুধু হাসাহাসিই
নয়, সবার সামনে আবার নকল করে দেখায়, মা বাবা কি ধরনের সিনেমা দেখে। বাধ্য হয়ে মা বাবা ঠিক করলেন
যে ছেলে রাত্রে ঘুমোতে গেলেই নিজেদের শোবার ঘরে চুপচাপ বসে সিনেমা দেখবেন।
এক শনিবার রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ছেলেকে ঘুমোতে পাঠিয়ে
সদ্য আনা একটি ডিভিডি চালিয়ে বসলেন মা বাবা। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। মিনিট পাঁচেক পর
হঠাৎ দরজা খুলে ছেলের আগমন, শ্রীমানের নাকি
ঘুম আসছে না। টিভির পর্দায় চোখ পড়তেই সেই বক্রোক্তি, “ও বেঙ্গলি মুভি... এগেইন...”, মুখে বিদ্রূপের
হাসি, কোমরে হাত। মা বাবা প্রমাদ গুনলেন; সিনেমার দফারফা। ছেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল টিভির পর্দার
দিকে, কোমর থেকে হাত নেমে এল কয়েক মিনিট পর, গুটি গুটি পায়ে পেছনে এসে মা বাবার মাঝখানে বেশ সেঁধিয়ে গেল, চোখের দৃষ্টি টিভির পর্দায়। মা বাবা তো হতবাক, “সে কি রে? তুই বাংলা সিনেমা
দেখবি?”। ছেলে হাত তুলে ইশারায় মা বাবা কে চুপ
করতে বলে অস্ফুট কন্ঠে বলল, “ইয়েস, দিস ওয়ান ইজ ডিফারেন্ট”।
ছবিটি ছিল “উনিশে এপ্রিল”; পরিচালনা ঋতুপর্ণ ঘোষ। এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় ছবি। ছেলেটি ঠিকই ধরেছিল, সেই সময়ে পরিচালক হিসেবে তিনি ছিলেন ডিফারেন্ট। নব্বইয়ের
দশকে যখন নিম্ন মানের বাংলা ছবিতে বাজার ভরে যাচ্ছিল, সেই সময়ে বসন্তের বাতাসের মত তাঁর আবির্ভাব। তারপর একের পর
এক সব ক্লাসিক, - দহন, অসুখ, শুভ মহরৎ, উৎসব, বাড়িওয়ালী ... এক
সময়ে তো রটে গিয়েছিল যে ঋতুপর্ণর ছবিতে অভিনয় করলে জাতীয় পুরস্কার অবধারিত। ইন্দ্রাণী
হালদার, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, কিরণ খের সবাই তাঁর ছবিতে অভিনয় করেই পেয়েছেন জাতীয়
স্বীকৃতি। অভিনেতা প্রসেনজিৎকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি চোখের বালি ছবিতে। তার আগে, বলতে দ্বিধা নেই তাঁর অভিনয় আমার একবারেই ভাল লাগত না।
নির্ভেজাল সিনেমাপ্রেমীরা (ইংরিজিতে যাদের মুভি বাফ বলা হয়)
ভাল ভাল সিনেমার ডিভিডি সংগ্রহ করেন। এক মিউজিক স্টোরের কর্মচারীর কাছে শুনেছিলাম
যে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে ঋতুপর্ণর ছবির চাহিদা সত্যজিৎ রায়ের পরেই। কারণ তাঁর ছবির
আবেদন ছিল সব শ্রেণীর দর্শকের কাছে।
বিজ্ঞাপনের ছবি বানিয়েই নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, সত্যজিতের মতই। একবার এক টিভি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে
সিনেমা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সত্যজিতের ছবি দেখেই, এবং তাঁকেই গুরু বলে মানতেন। ছবি বানানোর কোনও প্রথাগত
শিক্ষা ছিল না। স্কুলের পড়া শেষ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পারেটিভ
লিটারেচার নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল। বাড়ীর চাপে অর্থেনীতি পড়তে বাধ্য হন।
পরবর্তী জীবনে এই নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। চোখের বালি শুরু করার আগে রবীন্দ্র
সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হয়েছিল। এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে পছন্দের সাবজেক্ট
নিয়ে পড়াশনা করলে এই পরিশ্রমটা করতে হত না।
এক সময়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গ্রীক থিয়েটারের ক্লাস করেছিলেন, সহপাঠী ছিলেন স্বয়ং অপর্ণা সেন।
বিতর্ক কোনও দিনই পিছু ছাড়েনি ঋতুপর্ণর। টিভির পর্দায়
প্রবীণা শিল্পীদের তুই-তোকারি করে প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। কিছু
ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছিলেন মানুষটি। তাঁর জন্য প্রচুর লাঞ্ছনা এবং গঞ্জনা
সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু মাথা নত
করেননি সমাজের কাছে। পরম সাহসে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সর্বসমক্ষে, নির্দ্ধিধায়।
সব দিক থেকে একটি ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বয়স মাত্র উনপঞ্চাশ; এর মধ্যেই সম্মান ও শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিলেন সৌমিত্র
চট্টোপাধ্যায়, দীপংকর দে এবং অমিতাভ বচ্চনের মত প্রবীণ
ও কিংবদন্তী শিল্পীদের।
এখন যেখানে আছি,
সেখানে বাংলা টিভি আসে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ইন্টারনেট খুলেই আকস্মিক
বজ্রপাতের মতই এই সংবাদ। অসুস্থ ছিলেন তাও জানতাম না।
বাংলা ছবির জগতে এক বিরাট অধ্যায়ের অবসান হল; অকালে।
সম্ভব হলে তাঁর ভাষাতেই জিজ্ঞেস করতাম, “ এই তুই এমন করে হঠাৎ চলে গেলি যে? তুই কি রাগ করেছিস?”
৩০ মে, ২০১৩
নিউ জার্সি
No comments:
Post a Comment