Tuesday 12 November 2013

ভাল মন্দ


প্রায় ৪৫/৪৬ বছর আগের ঘটনা আমি তখন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরির খোঁজে এক কথায় বেকার চুচুঁড়া আমার মামাবাড়ি; আর বর্ধমানে থাকতেন আমার কাকা মাঝে মধ্যেই হাওড়ায় ট্রেনে চেপে রওনা দিতাম একটু হাওয়া বদল করে আসতে

সকালে ফেরার পথে এক দঙ্গল কলেজের ছাত্রকে দেখতাম, কোলকাতার কলেজে পড়তে যাচ্ছে। মাঝখানের এক স্টেশন থেকে উঠতেন এক প্রবীন ভদ্রলোক, তাঁকে ছেলেরা সাদরে নিজেদের মধ্যে ডেকে নিত আর দারুণ জমিয়ে গল্প করত। পঞ্চাশোর্ধ সেই প্রবীন ভদ্রলোক সেই ছেলে ছোকরাদের সান্নিধ্য খুব উপভোগ করতেন বলেই মনে হত। এক দিনের কথোপকথন স্মৃতি থেকে নীচে তুলে দিচ্ছি।

-     কি মেসোমশাই, গত সপ্তাহে দেখিনি আপনাকে, কোথায় ছিলেন?

-     ছুটি নিয়েছিলাম, মেয়ের কাছে গিয়ে ছিলাম ক’দিন

-     ও তাই? কোথায় থাকেন আপনার মেয়ে?

-     গোবরডাঙা, জামাই সেখানকার কলেজে পড়ায়

-     তা এমনিই গিয়েছিলেন না কি কোনও অনুষ্ঠান ছিল।

-     না এমনি নয়, মেয়ে নতুন বাড়ি করেছে, গৃহপ্রবেশ ছিল

-     মেয়ে বাড়ি করেছে মানে মেয়ে-জামাই মিলে, তাই তো?

-     আরে আমার জামাই সারাদিন লেখাপড়া নিয়ে থাকে, ওর অত সময় কোথায়? যা করার আমার মেয়েই করে।

-     তাই?

-     হ্যাঁ হ্যাঁ; ওই জমি পছন্দ করা, জমি কেনা, বাড়ির নকশা সব আমার মেয়ের কাজ

-     আপনার জামাই কিছুই করেন না?

-     না, মাটির মানুষ আমার জামাই। ওই যে বললাম, - শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকে। খুব ভাল ছাত্র ছিল, এম এ তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। হীরের টুকরো জামাই পেয়েছি ভাই...

-     বাঃ

-     হ্যাঁ বাবা, যা করার আমার মেয়েই করে, জামাই পুরো সংসার আমার মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। সত্যিই হীরের টুকরো জামাই আমার ...

-     বা দারুণ। তা আপনার ছেলেও তো আপনার কাছাকাছি কোথায় থাকে বলেছিলেন...

-     ছেলের কথা আর বল না বাবা (ভদ্রলোককে হঠাৎ বেশ গম্ভীর দেখায়), ছেলেটা আমার গোল্লায় গেছে...

-     কেন মেসোমশাই, ও কথা বলছেন কেন?

-     আর কি বলব, ছেলেটা খালি বৌ-এর কথায় ওঠে আর বসে!!
 
কোলকাতা - ১২ নভেম্বর ২০১৩

Monday 11 November 2013

উদ্বেগ


সোমবার সন্ধ্যা

- কোথায় যাচ্ছিস?

- ফোরাম

- এখন?

- হ্যাঁ প্রিয়া, মিঠুন, তমাল,শর্বরী সবাই ওয়েট করছে?

- তোর তো মাস্টার মশাই আসার কথা এখন?

- আসবে না আজ ... মা আমার মোবাইলটা দেখেছো?

- আসবে না মানে? আজই তো আসার কথা।

- একটু আগে এস এম এস করেছে, ও ইয়েস... বাথরুমে!- রিঙ্কি ছুটল বাথরুমে

মাধুরী অবাক। মাস্টার মশাই না হোম ওয়ার্ক দিয়েছিল? রিংকি ঝড়ের বেগে ঢুকল ঘরে, হাতে ব্যাগ আর মোবাইল।
 

-      তোর হোম ওয়ার্ক?

-      ই-মেল করে দিয়েছি

-      কাকে?

-      রঞ্জনদাকে,

-      রঞ্জনদা?

-      ঐ তোমার মাস্টার মশাই ...

-      ও; কখন ফিরবি?

-      দেরি হবে। তোমরা খেয়ে নিও

-      খেয়ে নিও মানে? তুই রাত্রে খাবি না?

-      না ফুড কোর্টে খাব আমরা

-      আগে বলিসনি কেন?

-      একটু আগেই তো ঠিক হল

-      আমি কি সারা সন্ধ্যে একা বসে থাকব না কি? বাবারও দেরি হবে বলেছে...।

-      টিভি দেখো, বাবাকে ফোন করে বল তাড়াতাড়ি চলে আসতে 

সদর দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায় রিঙ্কি। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে মাধুরী। টিভি দেখার অভ্যেস খুব একটা নেই, বই পড়তে ভালবাসে ছোটবেলা থেকে। হাতের কাছে কোনও নতুন বইও নেই। সন্ধ্যে ছ’টা এখন, তার মানে শিকাগোতে এখন সকাল সাড়ে সাতটা। দিদিকে অন-লাইন পাওয়া যেতে পারে। কমপিউটার স্ক্রীনের সামনে গিয়ে দেখল, বেশ জ্বল জ্বল করছে, “দিদিমাসী”। 

মাধুরী ইংরিজি হরফে বাংলা টাইপ করল, “দিদি আছিস?”

বেশ কিছুক্ষণ কোনও সাড়া শব্দ নেই। মিনিট পাঁচেক পর উত্তর এল, 

-      সরি মাধু, রুম্পা ফোন করেছিল, জাস্ট গিয়ে পৌঁছেছে

-      কোথায়?

-      জেনিভা..

-      জেনিভা? হঠাৎ?  

-      কেন? বলিনি তোকে?

-      না তো?

-      ও তাই? আজকাল খুব ভুলে যাই জানিস

-      হঠাৎ জেনিভা? বেড়াতে?

-      হ্যাঁ, অনেক দিনের প্ল্যান

-      বন্ধু বান্ধবরা মিলে?”

-      না, শুধু রূম্পা আর স্টীভ

-      ও ...  

একটু অস্বস্তিতে পড়ে মাধুরী। কি বলবে বুঝতে পারে না। একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল, ‘ওরা বিয়ে করবে না?’ পাঁচ বছরের বড় দিদি প্রায় মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছিল, ‘ওরা যখন চায় করবে; সেটা ওদের ব্যাপার’। গা শির শির করে  ওঠে মাধুরীর। অসম্ভব। ও সব ওদেশে চলে। কিন্তু রিঙ্কি তো ভাববে এটাই স্বাভাবিক। রিঙ্কির সঙ্গে তো রুম্পার আবার নিয়মিত যোগাযোগ - ফেসবুকে।

কিছুক্ষণ পর দিদি ‘বাই’ করে দেয়, কাজে বেরোতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই দীপকের ফোন আসে; আরও দেরি হবে আসতে,-  মীটিং চলছে, কখন শেষ হবে ঠিক নেই। 

রাত সাড়ে আটটা। রিঙ্কি এখনও বাড়ি ফেরেনি। মোবাইলে চেষ্টা করল মাধুরী। মোবাইল সুইচড অফ। গেল কোথায় মেয়েটা? এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে মাধুরীর। আজকাল যা সব ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ খেয়াল হল, রিঙ্কি একবার ওর বন্ধু শর্বরীর নাম্বারটা মোবাইলে এনট্রি করে দিয়েছিল।  

একবার রিং হতেই ধরল শর্বরী, 

-      হ্যালো আন্টি, কেমন আছ?

-      আমি ভাল, এই তোরা কোথায়?

-      আমি? বাড়িতে...

-      সে কি? তুই ফোরামে যাসনি?

-      গিয়েছিলাম, ফিরে এসেছি – আমার সিনেমাটা দেখা

-      কি সিনেমা?

-      চেন্নাই এক্সপ্রেস

-      রিঙ্কি কোথায় রে? ফোন সুইচড অফ করে রেখেছে

-      ও তো সিনেমায় গেল। ন-টায় শেষ হবে। চিন্তা কর না আন্টি

-      আর কে কে গেছে রে?

-      এই তো কয়েক জন আমাদের ক্লাসেরই, আর রঞ্জন দা

-      রঞ্জন দা? তোদের ক্লাসের? দেখিনি তো কখনও

-      দেখনি মানে? – একটু কেমন যেন হেসে ওঠে শর্বরী - আরে আন্টি রিঙ্কিকে বাড়িতে যে পড়ায়, আমাদের সিনিয়র ...

-      ও আচ্ছা ঠিক আছে রে - হাত পা অসাড় হয়ে ওঠে মাধুরীর

-      বাই আন্টি, - ফোন ছেড়ে দেয় শর্বরী                                                                       

ধুপ করে সোফায় বসে পড়ে মাধুরী, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। প্রথম দিনই ছেলেটাকে ভাল লাগেনি। জিন্স আর টি-শার্ট পরা। মাস্টার মশাই টাইপ চেহারা নয়। আর রিঙ্কিও বেশ, অত নাম ধরে দাদা বলার কি আছে? বয়সে বড়, ‘স্যার’ বললে কি হয়? রিঙ্কির প্রফেসররা বললেন এম এস সি-তে নাকি খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। ভাল না ছাই! ভাল করলে কি চাকরি বাকরি না করে টিউশন করত।  

দরজায় ঘন্টি। ছুটে গিয়ে দরজা খুলল মাধুরী। আজ একটা এসপার ওসপার  করতেই হবে। না, রিঙ্কি নয়, দীপক ঢুকল, হাতে সেই মোটা ব্রীফকেসটা; তার মানে বাড়িতে কাজ নিয়ে এসেছে। 

-      শুনেছ তোমার মেয়ের কান্ড?

-      কি হল আবার?

-      মাস্টারের সঙ্গে সিনেমায় গেছে

-      কোন মাস্টার?

-      শোন মেয়ে কিন্তু কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে।

-      দেখ মাধু, আজ আর সীন কর না, আমার প্রচুর কাজ। কাল সকালেই হেড অফিসে সেলস রিপোর্ট পাঠাতে হবে। চিন্তা কর না। আমি হ্যান্ডল করব। প্রমিস।

-      কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু সিরি—

-      প্লীজ, মাধু। আজ নয়। আর আমি কিছু খাব না। মীটিঙে কফির সঙ্গে প্রচুর স্ন্যাক্স ছিল। 

পৌনে দশটায় ঢুকল রিঙ্কি। যেন কিছুই হয়নি। সোজা চলে গেল নিজের ঘরে। লাইট নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। দীপক ডাইনিং টেবিলের ওপর কাগজপত্র ছড়িয়ে, ল্যাপটপে কি সব টাইপ করে চলেছে। রাগে শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল মাধুরীর। রাতের খাবার সব ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ল। মাথাটা দপদপ করছে। ঘুম হবে কি না সন্দেহ। 

মঙ্গলবার সন্ধ্যা

 

সারাদিন চরম অশান্তিতে দিন কেটেছে। দীপক সকালে অফিস যাবার আগে বলে গেছে কোনও রকম অশান্তি না করতে। দাঁতে দাঁত চেপে রইল মাধুরী। রিঙ্কি একেবারে স্বাভাবিক। দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল, যেন কিছুই হয় নি। বেরনোর আগে দিব্যি বলে গেল যে ফিরতে দেরি হতে পারে। খুব বেশি দেরি হলে ফোন করে দেবে।

 

সাড়ে ছটা বাজে; এখনও কোনও ফোন আসেনি।  

 

দরজায় বেল। এলেন বোধহয় রাজকুমারী। ছুটে গিয়ে দরজা খুলল মাধুরী। দীপক ঢুকল। আজ হাতে ব্রীফকেস নেই, কিন্তু মুখ কেমন যেন গম্ভীর থমথমে। লক্ষণ ভাল নয়। মাধুরী দরজা বন্ধ করে বসল দীপকের সামনে, -

 

-      চা খাবে তো?

-      রিঙ্কি কোথায়? – হঠাৎ প্রশ্ন করে দীপক

-      ফেরে নি এখনও...

-      এখনও ফেরে নি? কলেজ তো অনেক আগে ছুটি হয়ে গেছে...

-      সে কথাই তো তোমাকে ...

-      রঞ্জনকে চেনো? – দীপক কথা শেষ করতে দেয় না মাধুরীকে।

-      রঞ্জন? হ্যাঁ ঐ যে ওর মাস্টার, ওর ব্যাপারেই তো... কেন কি হয়েছে?

-      এত কান্ড ঘটে গেল তোমার চোখের সামনে, আর তুমি জিজ্ঞেস করছ কি হয়েছে?

-      কেন? কি? কিছু শুনেছ তুমি? – হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে মাধুরীর

-      কি এমব্যারাসিং; আমি কিছুই জানি না। আর ঐ ভদ্রলোক দিল্লীতে বসে সব খবর রাখেন!

-      মানে? কার কথা বলছ?

-      তোমার ঐ রঞ্জনের বাবা। দিল্লী থেকে ফোন করেছিলেন আমাকে, আমার মোবাইলে। এই কিছুক্ষণ আগে।

-      কেন?

-      ছেলের বউ করতে চান তোমার মেয়েকে! বললেন সবই তো জানেন নিশ্চয়ই। তা, ওরা যখন চাইছে, আমরা আপত্তি করি কেন? আর আমি তো আকাশ থেকে...

-      সে কি? কে ভদ্রলোক?

-      ডঃ সুধাংশু মিত্র। স্বনামধন্য লোক, আরে কিছুদিন আগে কাগজে ছবি আর ইন্টারভিউ বেরিয়েছিল, মনে নেই? স্বামী স্ত্রী দুজনেই পদ্মভূষণ পেয়েছিলেন।

-      তাই নাকি? এ মা, আমি তো কিছুই...

-      তাই তো বলছি, চোখের সামনে ছেলেটা আসা যাওয়া করছে, আর তুমি কিচ্ছু জানো না, ভদ্রলোক যে কি ভাবলেন। যাক গে; ছেলে সামনের মাসে টেক্সাস অস্টিনে যাচ্ছে পিএইচডি করতে। আমরা যদি রাজি থাকি সামনের সপ্তাহে দু-জন আসবেন কলকাতায়, রিঙ্কিকে আশীর্বাদ করতে।

-      সত্যিইইই! এ বাবা... রিঙ্কিকে তো দেখেননি ওনারা!

-      না, - বললেন ছেলের ভাল লেগেছে সেটাই যথেষ্ট, আর ছবি দেখেছেন... আর ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, ওনারা রিঙ্কির সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছেন। এখন বল, কি বলব ওনাদের?

-      আরে এতে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে, এক্ষুনি ফোন করে বলে দাও... কি যে কান্ড কর না তুমি, - হঠাৎ খুব গদগদ দেখায় মাধুরীকে।

 

বুধবার সন্ধ্যা

 

সাড়ে সাতটা বাজে। কম্প্যুটারের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ায় মাধুরী। দিদিকে সুখবরটা দেওয়া হয়ে গেছে। রঞ্জনের মা বাবা রিঙ্কির পরীক্ষার পরেই বিয়েটা দিয়ে দিতে চান। দিদি তো খুব খুশি। বলল বিয়ের তারিখ ঠিক হলে জানাতে; সবাই আসবে। দিদি, প্রবীরদা, রুম্পা, সবাই। মাধুরী আবার স্টীভকেও নিয়ে আসতে বলে দিল। দিদি বলল কি জানি রে; ওদের ব্যাপার স্যাপার! এই প্রথম দিদিকে একটু আক্ষেপ করতে শুনল মাধুরী,- রুম্পাটা যে কি করছে? বিরক্ত লাগে মাঝে মাঝে বুঝলি, এই দেশটা না ...

 

দীপকের গায়ে আজ ইস্তিরি ভাঙা পায়জামা পাঞ্জাবি। সোফায় বসে ইন্ডিয়া টুডে পড়ছে আর ঘড়ি দেখছে ঘনঘন, -

 

-      কি তোমার রান্না কমপ্লিট?

-      হ্যাঁ, বিশেষ কিছু করিনি, রিঙ্কি বারণ করল। ছোলার ডাল নারকোল দিয়ে, মোচা ঘন্ট, ধোকার ডালনা আর সর্ষে ইলিশ, রঞ্জনের না কি খুব পছন্দ। আর মিষ্টি দই তো তুমি নিয়েই এসেছো।

-      এত দেরি করছে কেন? – আবার ঘড়ি দেখে দীপক

-      এমন কিছু দেরি হয় নি, মোটে তো সাড়ে আট-টা। দু-দিন পরে চলে যাবে ছেলেটা। একটু একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করবে না? তুমি এসব ব্যাপারে নাক গলিও না তো!

 কুয়েত - ১৫ জুলাই ২০১১