অনেক দিন থেকে শুনছিলাম কলকাতায় নতুন
এয়ারপোর্ট হচ্ছে। দিল্লীতে হয়ে গেছে। হায়দ্রাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই – সব শহরে এখন ঝকঝকে নতুন এয়ারপোর্ট। আমাদের
পোড়ার শহরে সেই আদ্যিকালেরটা কোনও রকমে চলছিল। ডোমেস্টিক টার্মিনালটা তাও কিছু
পদের, কিন্তু আন্তর্জাতিক টার্মিনালের তো খুবই করুণ অবস্থা।বিদেশ থেকে এলেই মনটা
খারাপ হয়ে যেত। মাঝে মাঝে
কিছু বিদেশী যাত্রীও আসতেন, তাঁরা কি ভাবতেন কে জানে? প্রায়ই শুনতাম এই তো আগামী মাসেই নতুন টার্মিনাল
চালু হয়ে যাচ্ছে। তারপর কোনও কারণে আবার পিছিয়ে যেত।
তারপর একদিন এল সেই শুভ দিন। ঘটা করে
উদ্বোধন করলেন রাষ্ট্রপতি। তার কিছুদিন পরে, মার্চ মাসের প্রথম দিকে খুব আশা নিয়ে নামলাম
কলকাতায়, কিন্তু কোথায় নতুন এয়ারপোর্ট? সেই পুরনো টার্মিনালেই নামলাম। নতুনটা নাকি পুরোপুরি তৈরি হয়নি, কিছু কাজ বাকি আছে, শুধু নামকা ওয়াস্তে এয়ার
ইন্ডিয়ার সবেধন নীলমণি একটি ফ্লাইট কোনও রকমে চলছে বা চালানো হচ্ছে। আবার হতাশা
এবং প্রতীক্ষা।
এপ্রিল মাসে আমেরিকা যাওয়ার কথা। আশায় বুক
বেঁধে রইলাম,- নিশ্চয়ই তত দিনে পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবে। প্রায় প্রত্যেকদিন খবরের কাগজ
খুলে নতুন এয়ারপোর্টের কোনও খবর আছে কি না দেখতাম। কাগজে নানা রকম খবর বেরোতো। বেশির ভাগই দুঃসংবাদ। নতুন টার্মিনাল চালু হয়ে গেছে বটে, কিন্তু যাত্রীরা একেবারেই খুশি নয়। টয়লেট
নোংরা, জানলার কাচ খুলে পড়ছে, ইউনিয়নের পোস্টার চারিদিকে, - ওদের নির্বাচন নাকি আসন্ন। কোনও এক সাংবাদিক
এক নেতাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, “আমাদের ছেলেরা কি একটু আধটু
আনন্দ করবে না?”
এও জানলাম যে নতুন এয়ারপোর্টের দৈনন্দিন কাজকর্মের
ভার এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা চলছিল। কিন্তু ইউনিয়ন প্রবল আপত্তি
জানিয়েছে। পুরনো টার্মিনালের কিছু কর্মী জোর করে ঢুকে পরেছে নতুন বিল্ডিঙে। কর্তিপক্ষ কিছুই করতে পারছেন না রাজনৈতিক চাপে। নতুন টার্মিনালের একদিকে
ডোমেস্টিক ফ্লাইট আরেকদিক থেকে ইন্টারনেশনল ফ্লাইট চলছে। ইন্টারনেশনল দিকটা নাকি
মোটামুটি পরিস্কার কারণ সে দিকে ফ্লাইট কম, তবে ডোমাস্টিকের দিকটার নাকি বেশ করুণ
অবস্থা।
অবশেষে এই এপ্রিলের ২১ তারিখ পৌঁছলাম নতুন টার্মিনালে, টার্মিনাল থ্রি - এমিরেটসের
ফ্লাইট ধরব বলে। অবশ্যই ইন্টারনেশনলের গেট দিয়ে। প্রথম দর্শণেই কিন্তু চোখ জুড়িয়ে
গেল। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে টার্মিনাল, একটা ঝকঝকে ভাব, চারিদিকে আলোর মালা, সারি
সারি চেকিং কাউন্টার, বিভিন্ন বিমান প্রতিষ্ঠানের অফিস। ট্রলিগুলোও নতুন। মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। বিদেশের যে কোনও এয়ারপোর্টের
সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে এখন আমাদের সাধের শহর।
তবে নিখুঁত বলা যাবে কি? না, তা বোধহয় নয়। আমরা
নিজেরাই যে নিখুঁত নই। আমাদের চারিত্রিক কিছু প্রতিফলন তো থাকবেই আমাদের কাজকর্মে,
তাই না? ট্রলিতে মালপত্র চাপিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ একটি লোক এসে আমার হাত থেকে
ট্রলিটা প্রায় কেড়েই নিল, “আমি নিয়ে যাচ্ছি স্যর”। আমি বারণ করাতে লোকটা খুব
বিরক্ত হয়ে চলে গেল। ভেতরে ঢোকার
পর আরও একজন এসে ট্রলির হ্যান্ডেল ধরে টানাটানি। তাকেও বারণ করলাম। বুঝলাম এরা সেই
লোক যারা পুরণো টার্মিনাল থেকে জবরদস্তি ঢুকে গেছে কিন্তু এখানে এদের কোনও কাজ
নেই।
সাইনবোর্ডগুলো ঠিকমত বসানো হয়নি। ডিপারচার
গেটগুলো খুঁজতে একটু অসুবিধে হয়। এয়ারব্রীজে ঢোকার রাস্তায় সুদৃশ্য পুরু কার্পেট;
কিন্তু জায়গায় জায়গায় স্যাঁতস্যাঁতে ছোপ, কোথাও বোধহয় জল লিক করছে। টয়লেটগুলো কিন্তু
ঝকঝকে পরিস্কার। হ্যান্ড-ড্রায়ার আছে। পেপার টাওয়েল ঠিক জায়গায় সাজানো। তা ছাড়া
একজন লোক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছে।
কাজটা সুন্দর শুরু হয়ছিল কিন্তু শেষ হয়নি।
তবে হবে নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে। আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন ভাবে রাজনীতি ঢুকেছে
যে সেখান থেকে নিস্তার পাওয়া খুব শক্ত। আমাদের অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ,
বাজার-হাট, খেলার মাঠ, - সব জায়গায় রাজনীতিই সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে। এয়ারপোর্টেরও
তা থেকে কোনও নিস্তার নেই। নেতারা যদি একটু সহযোগিতা করেন তবে নেতাজী সুভাষচন্দ্র
বসু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরও কল্লোলিনী তিলোত্তমা হতে পারে।
আপাততঃ “ভাল হয়েছে” বলতে পারছি না তবে বলতে
পারি যে “ভালই হয়েছে”, তবে “ভাল হত আরও ভাল হলে”।
নিউ জার্সি
২৬শে এপ্রিল ২০১৩
No comments:
Post a Comment