Thursday 24 November 2016

মুদ্রা রাক্ষস – ২০১৬

বেশ কয়েক বছর ধরে কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত আমি। মাসের প্রথমেই যে কোনও এটিএম থেকে টাকা তুলে নিই। বেশির ভাগ সময়েই ১০০০ বা ৫০০ টাকের নোট বেরোয় মেশিন থেকে। আগে বড় মাপের কেনা কাটা কার্ডেই সারতাম। কিন্তু তাতে প্রায়ই খুচরোর আকাল দেখা যেত। ছোট খাট কেনা কাটা , কলাটা, মুলোটা বা হকারের কাছে সেফটি পিন বা পায়জামার দড়ি কিনতে গেলে অসুবিধে হত। তাই মাস চারেক আগে এক গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হল; - এখন থেকে সব কেনাকাটা নগদেই সারতে হবে। সুযোগ মত ৫০০ ও ১০০০টাকার নোট ভাঙিয়ে নিতে হবে। তাতে হাতেনাতে ফল মিলল। রাতারাতি খুচরোর সমস্যা মিটে গেল।

৮ই নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘোষণার পর যখন আমার পরিচিত মহলে সবাই ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট গুনতে ব্যস্ত, তখন আমি ও আমার গিন্নীর জিম্মায় ৪০টি কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট, কিছু ৫০, একটি ২০ ও গোটা পনের ১০ টাকা। একটিও ১০০০ বা ৫০০ নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

কিন্তু সেই স্বস্তি স্থায়ী হল না।

পরের দিন ভোরবেলা কাকার ফোন। বৃদ্ধ কাকা ও কাকীমা থাকেন সল্ট লেকে। নিঃসন্তান। কাকীমা বেশ কয়েক বছর ধরে শয্যাশায়ী। বহুদিনের এক বিশ্বস্ত পরিচারিকা ও তার পরিবার বাড়িতে থেকেই দেখাশোনা করে। আমি ফোনে খোঁজ নিই প্রত্যেক দিন। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করে আসি।  কাকা খুব খুশি হন। সবার খোঁজ খবর নেন। কুশল জিজ্ঞাসা করেন। নিজের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। পরামর্শ চান। আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি রাখেন না। কাকীমার ঘরেও বসি কিছুক্ষণ। কথাবার্তা বিশেষ হয় না। স্নেহশীলা কাকীমা এখন সম্পূর্ণ স্মৃতিলুপ্তা।

তুই এক্ষুনি চলে আয়, খুব দরকার, - কাকার কন্ঠস্বরে মনে হল কোনও বিশেষ বিপদে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে পৌঁছে গেলাম সল্ট লেক। ভোর বেলা রাস্তায় ভীড় কম, বিশেষ সময় লাগল না। দরজায় বেল বাজাতেই কাকা নিজেই দরজা খুললেন। চোখে মুখে বিরাট উদ্বেগের ছাপ। আমায় দেখে কোন আপ্যায়নের চেষ্টা করলেন না, দরজা খুলে রেখেই চলে গেলেন ভেতরে।

ফিরে এলেন এক বিরাট মোটা খাম নিয়ে। কোনও রকম ভূমিকা ছাড়াই, সেই খাম আমার হাতে দিয়ে বললেন, - এই টাকাটা তুই পালটে দে; আমার পক্ষে ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়া সম্ভব নয়। খামের ভেতর সব কড়কড়ে হাজার টাকার নোট। বের করে গুনে আমি তো স্তম্ভিত, - এত নগদ টাকা কেউ বাড়িতে রাখে?

কাকা হতাশ মুখে জানালেন, - কি করব বল্‌? তোর কাকীমার তো এই অবস্থা! আমিও খুব একটা সুস্থ নই। হঠাৎ ডাক্তার বা হাসপাতালের দরকার হলে কি করব? আর তুই তো জানিস আমার কোনও কার্ড নেই, আমি ভাল চোখেও দেখিনা। তাই কিছু টাকা ঘরে রাখি।
বুঝলাম। এই বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্কে গিয়ে আমাকেই পাল্টাতেই হবে। কাকা জানালেন কোনও তাড়া নেই। দু-সপ্তাহের সংসারের খরচ আলাদা করে তোলা আছে ছোট নোটে। অসুবিধে হবে না।

আমার ব্যক্তিগত সঞ্চয় এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গচ্ছিত। সেখানে গিয়ে দেখি বিরাট লাইন। কোলাপসিবল গেটের সামনে এক বিশাল বপু দারোয়ান। গুনে গুনে লোক ঢোকাচ্ছে। ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের মধ্যে একজন বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোকের মোবাইলে ফোন করলাম। ধরলেন না।

আমাদের আবাসনের কাছে একটি বেসরকারী ব্যাঙ্কেও আমার কিছু লেনদেন হয়। সেখানেও ভীড়। ফোন করলাম। পরিচিত একটি মেয়ে জানাল, - এখন আসবেন না স্যার। এখানে যুদ্ধ চলছে। ক’টা দিন ধৈর্য ধরুন। ভীড় একটু হাল্কা হলে আমি নিজেই আপনাকে ফোন করব।

বাঙালী সমাজে উপদেষ্টার অভাব হয় না কখনও। আমার সমস্যার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন এক প্রতিবেশী, - ক্ষেপেছেন নাকি মশাই। এত টাকা জমা দিলে ইনকাম ট্যাক্স থেকে ধরবে আপনাকে।

তা কেন? আমি প্রতিবাদ জানাই। আড়াই লাখ পর্যন্ত কোনও ভয় নেই। আমার কাছে তো সেই তুলনায় অনেক কম টাকা।

আরে ছাড়ুন মশাই। গভার্নমেন্টের কিছু ঠিক আছে? এখন বলছে আড়াই লাখ। পরে দেখবেন এক লাখ বা পঞ্চাশ হাজার যারা দিয়েছে, তাদের এসে ধরছে। তার পরেই তিনি মোক্ষম বাণীটি ছাড়লেন, - আমার শালার বন্ধুর ভায়রা ভাইয়ের ভাগ্নে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, ইনকাম ট্যাক্স কনসালটেন্ট, খুব নাম করা, - ও বলেছে।

শুনে পিছিয়ে গেলাম। ওষুধের দোকানে পুরনো নোট নিচ্ছে শুনে চার মাসের ওষুধ কিনে ফেললাম। আমরা দু-জনই স্বাস্থ্যরক্ষার্থে একটু ওষুধ পত্রের ওপর নির্ভরশীল। পেট্রল পাম্পেও চলছে ৫০০ ও হাজার; গাড়ির ট্যাঙ্ক ফুল করে ফেললাম। কিছুটা কমল।

আমাদের আবাসনের কাছে বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক। একদিন দেখলাম তার একটির সামনে ছোট্ট লাইন, তাতে দু চারটি পরিচিত মুখ।  খোঁজ করে জানলাম ৪০০০ টাকা অব্দি পুরনো নোট পালটে দিচ্ছে। তবে পরিচয় পত্র লাগবে। তড়িঘড়ি বাড়ি গিয়ে আধার কার্ড ও তার  কপি নিয়ে এলাম। যা দিনকাল পড়েছে, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, - সব কিছুর কপি বাড়িতে রাখি। মিনিট চল্লিশেক লাইনে দাঁড়ানোর পর যখন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম, - শুনলাম ১০০ টাকার নোট নিঃশেষ। ২০ টাকার দুটো বান্ডিল নিতে হল। একটার আবার সীল ছেঁড়া। মৃদু প্রতিবাদ জানাতে কাউন্টার কর্মী ব্যাজার মুখে বললেন, - গুনে নিন। পেছনে লম্বা লাইন দেখে সাহস হল না। সবার চোখমুখের যা অবস্থা এখানে টাকা গুনতে বসলে আমার জ্যান্ত সমাধিস্থ হবার সম্ভাবনা প্রবল। মানে মানে বাড়ি ফিরলাম। না গুনি নি। যদি দেখি কম আছে তবে মনটা বড় খারাপ হয়ে যাবে। ঐ যে বলে না, - ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস।

এদিকে বাজার হাট করে আমারও রেস্ত ফুরিয়ে আসছে। মাছ, তরি-তরকারি, চাল, ডাল, ময়দা ইত্যাদি স্পেন্সার, বিগ বাজার ইত্যাদি আধুনিক বিপনিতে কার্ড ব্যবহার করে কাজ সারলাম ক’দিন। তবে ধোপা, খবরের কাগজ, পাউরুটি, ইত্যাদি ছোটখাটো বাজারের জন্য তো পকেটে হাত দিয়েই হয়। এক কাঁদি কলা কিনতে তো আর কার্ড ব্যবহার করা যায় না। তা ছাড়া আরও এক কান্ড হল। কাজের মেয়েটি একদিন ঘোষনা করলেন, - আগামী কাল কাজে আসতে দেরি হবে। কেন না, একজন দেখা করতে বলেছে, - ৫০০ টাকার নোট দিলে ৪টে ১০০ টাকার নোট দেবে। আমি ফতোয়া জারি করলাম, - কভি নেহি। আমি ভাঙিয়ে দেব। দিলাম। ফলে আরও দুটি ৫০০ টাকার নোট পকেটে ঢুকল। ‘অধিকন্তু ন দোষায়’ কথাটা কিন্তু সব সময় খাটে না।

অবশেষে ফোন এল, সেই বেসরকারী ব্যাঙ্ক থেকে। আমায় পরের দিন সন্ধ্যে ছটায় ব্যাঙ্কে যেতে বলা হল, - যখন ভীড় কমে আসবে। পরামর্শ মত গেলাম চেক বই পকেটে নিয়ে। পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকানো হল, গোপনে। সামনের দিকে তখনও খুব ভীড়। মনে হচ্ছিল যেন কোনও বেআইনি কাজ করতে ব্যাঙ্কে ঢুকছি। শুনলাম প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা।

অবশেষে কাকার অবশিষ্ট সম্পদ জমা হল আমার নামে। এবার সেই টাকা তুলে ফেরত দিতে হবে। সপ্তাহে ২৪ হাজারের বেশি তোলা যাবে না। ঠিক আছে কিস্তিতেই শোধ করা যাবে। কি আর করা। ব্যাঙ্ক কর্মী গোটা চারেক ২০০০ হাজার গছাতে চেয়েছিলেন। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। ঐ নোট কেউ নিচ্ছে না।

আবাসনের ভেতরেই একটি এটিএম। ৯ তারিখ থেকে বন্ধ। ভেতরে নিরাপত্তা কর্মী গভীর নিদ্রারত। একদিন সন্ধ্যায় মহা সোরগোল শুনে চমকে উঠলাম। জানলা দিয়ে দেখি আবালবৃদ্ধবনিতা রূদ্ধশ্বাসে ছুটছে। কি ব্যাপার? উত্তেজিত একজন জানালেন, - এটিএম খুলেছে। আমিও ছুটলাম। যা পাওয়া যায়। গিয়ে দেখি প্রায় কুড়িজন এর মধ্যেই লাইনে। বেশির ভাগই আমাদের আবাসিক। কিছু নিরাপত্তা রক্ষী ও গাড়ির চালকও আছেন। সব চেয়ে পেছনে আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক প্রতিবেশী ম্লান মুখ করে দাঁড়িয়ে। আমাকে লাইনে দাঁড়াতে দেখে একটু হাল্কা হেসে বললেন, - যাক আমি তবে আর লাস্ট নই। ভদ্রলোক খুবই উদ্বিগ্ন। বার্দ্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতা জনিত কারণে ব্যাঙ্কে যেতে পারেন নি, পকেট গড়ের মাঠ। এটিএম থেকে কিছু হাতে এলে কিছুটা সুরাহা হবে। বার বার জিজ্ঞেস করছেন এত লোক লাইনে দাঁড়িয়েছে, টাকা শেষ হয়ে যাবে না তো? বোঝালাম সেই সম্ভাবনা কম; এটিমে প্রচুর টাকা থাকে। আর মোটে ২০০০ করে তোলা যাচ্ছে। তা ছাড়া গুণে দেখা গেল ওনার সামনে ২৩ জন দাঁড়িয়ে। অতএব কোনও ভয় নেই। এক এক করে সবাই বেরিয়ে আসছে ২০ খানা করে কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট নিয়ে। সবার মুখে কেমন যুদ্ধ জয়ের হাসি। এরই মধ্যে আবার আতঙ্ক; ১০০ টাকা শেষ হয়ে যদি ২০০০ টাকার নোট বেরোয়, তবে? ২০০০ টাকার নোট তো এখন খোলামকুচি। কেউ নেয় না। যাদের কাছে আছে, তারা নোট হাতে নিয়ে সেলফি তোলে আর ফেসবুকে পোস্ট করে। না, সে রকম কিছু ঘটল না। আমিও অবশেষে ২০ টা ১০০ টাকার নোট হাতে নিয়ে এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে এলাম।

বেরিয়ে দেখি সেই ভদ্রলোক, যিনি লাইনে আমার সামনে ছিলেন, - তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মুখে সুখ ও তৃপ্তির হাসি। আমাকে দেখে বললেন, - এই টাকাগুলো হাতে পেয়ে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের এক সুখস্মৃতি অনুভব করছি, জানেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, - সে আবার কোন স্মৃতি। উনি স্বপ্নালু চোখে বললেন, ঐ যে যখন প্রথম চাকরির প্রথম মাইনে হাতে পেয়েছিলাম!

সত্যিই। খুব খাঁটি কথা।

কলকাতা
২৫শে নভেম্বর ২০১৬