Friday 5 February 2016

তুষারপাত


দেখতে বেশ ভাল লাগে। সাদা তুলোর মত গুড়িগুড়ি পড়ছে আকাশ থেকে আর সাদা হয়ে যাচ্ছে রাস্তা, গাছ, ও বাড়ির ছাদ। রাস্তায় রাখা গাড়ি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে বরফের নীচে। সাদা রঙের একটা বেশ স্নিগ্ধ ও পবিত্র ভাব আছে। জানলার পাশে বসে এই নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে বেশ লাগে আমি তো খুব উপভোগ করেছি

এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন এর আগে মরুঝড় দেখেছি আরব মুলুকে, প্রচন্ড হাওয়া আর সঙ্গে মরুভূমির বালির ঝটকা সয়ে গিয়েছিল পেশাগত কারণে বেরোতে হত তার মধ্যেই বেগতিক দেখলে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতাম শুধু আমি নই, সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত প্রচন্ড ঝটকায় কিছু বালির কণা ঢুকে যেত দরজা বা জানলার ফাঁক দিয়ে হলফ করে বলতে পারি সেই অভিজ্ঞতা মোটেই মধুর ছিল না

আমাদের মত পর্যটক বা অতিথিদের কাছে বরফ পড়ার দৃশ্য যতই মধুর হোক না কেন, স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখের নয় কারণ এর মধ্যেই কাজে বেরোতে হয়, বাচ্চাদের যেতে হয় স্কুলে জীবন তো আর থেমে থাকবে না

রাস্তাঘাট পরিস্কার করা শহরের প্রশাসনের কর্তব্য কিন্তু বাড়ির ভেতরের বরফ সরানোর দায়িত্ব বাড়ির লোকেদের সে এক এলাহি কান্ড প্রত্যেক বাড়িতে তোলা থাকে বেলচা, বেরিয়ে আসে এই বিশেষ সময়ে বেলচায় বরফ তুলে সরিয়ে রাখা বেশ পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ আমি একটু চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম কোমরে বেশ জোর লাগে আর আমার কোমর বেশ নড়বড়ে মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলনা

পরিবারের তরুণ প্রজন্ম বরফ সাফ করল, আমি জানলায় দাঁড়িয়ে ওদের উৎসাহ দিলাম। আর তো কিছু করার ছিল না আমার।
-
নিউ জার্সি - ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬
বাড়ির সামনের ছবি 

বাড়ির পেছন দিকের ছবি 

গাছগুলো মনে হয় ক্রীসমাস ট্রী 

বরফে ঢাকা গাড়ি 

অবশেষে সূর্য- ঝলমল করে উঠল চারিদিক

গাছের পাতায় সোনালী আভা 

রাস্তা থেকে বরফ সরানো হচ্ছে 

এবার বরফ পরিস্কারের পালা... 


বরফে বাচ্চাদের কি আনন্দ...

Wednesday 3 February 2016

ক্যাম্পাস স্মৃতি


শুভদীপ ছিল বেশ একটু হিরো টাইপের। উত্তম কুমারের মত চুল ছাঁটত। ইউনিভার্সিটির কাছে এক বিহারী নাপিতকে রীতিমত তালিম দিয়ে উত্তম ছাঁট দেওয়া শিখিয়েছিল। জামা কাপড়ে সব সময় ফিটফাট। ক্লাসে যেত একেবারে ইস্তিরি ভাঙা পোষাক পরে। কথা বলত আস্তে, অযথা চ্যাঁচাতো না। মাঝে মধ্যে কলকাতায় ফেলে আসা বান্ধবীদের কথা বলত। আমরা হাঁদার মত বড় বড় চোখ করে শুনতাম।

বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের আলাদা কলেজ ছিল। উইমেন্স কলেজ ও হস্টেল। ক্যাম্পাসে ঢুকেই বাঁ হাতে। উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। আমাদের হস্টেল ছিল ক্যাম্পাসের আরও ভেতরে। আমরা বাইরে যেতে হলে সাইকেলে যাওয়া আসা করতাম। পাচিল দেওয়া বিল্ডিঙের সামনে এলেই সাইকেল চলত খুব ধীরে। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয় যায়। হত না কখনই। তবে তার মধ্যেই শোনা যেত নানা রঙের প্রেম কাহিনী।

আমরা তখন থার্ড ইয়ার। শোনা গেল উইমেন্স কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে কলকাতা থেকে একটি বাঙালী মেয়ে এসেছে। ফিজিক্স অনার্স। দারুণ দেখতে। নাম মন্দিরা। তা দর্শণ হল একদিন। সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখিয়ে দিক একজন। সত্যিই আকর্ষণীয়া। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, কাটাকাটা চোখ মুখ, লম্বা পিঠ ভর্তি চুল, মুখে স্মিত হাসি।

তারপর একদিন কানে এল এক মোক্ষম খবর। শুভদীপকে নাকি মন্দিরার সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। প্রথমে ভাবা গিয়েছিল গুজব, পরে দেখা গেল খবরটা সত্যি। প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে দু-জনকে। তা ভাল। কিন্তু অভিযোগ আরেক জায়গায়। শুভদীপ নাকি মন্দিরা সঙ্গে থাকলে এমন ভাব করছে যে কাউকে চেনেই না। উদাস ভঙ্গী করে পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে, কারও সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে না। বন্ধুরা তো খচে বোম, - আরে একটু আলাপ করিয়ে দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? আরে বাবা তোর জিনিস তো তোরই থাকবে, আমরা তো শুধু একটু কথা বলব। বাড়ি থেকে এত দূরে একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে কার না ইচ্ছে করে? কিন্তু বিধি বাম। শুভদীপ আলাপ করাবে না।

আলোক নামল মাঠে, - নাঃ শুভদীপকে একটু উচিৎ শিক্ষা দেওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। একদিন সিনেমা দেখে ফিরছে এক দঙ্গল ছেলে। হঠাৎ চোখে পড়ল, রাস্তার পাশে এক রেস্তোরাঁয় শুভদীপ আর মন্দিরা বসে কফি খাচ্ছে। এখানে বলে রাখা ভাল, যে সেকালে এমন প্রকাশ্যে একটি যুগলের ঘুরে বেরানো বা রেস্তোরাঁয় যাওয়া একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল।

ওদের দেখেই সাইকেল থেকে নেমে পড়ল আলোক। দাঁড় করাল সবাইকে। টাকা পয়সা কার কাছে কি আছে বের কর তাড়াতাড়ি, - জোর হুকুম আলোকের, কন্ঠস্বর গম্ভীর। ঝেরে ঝুরে টাকা পাঁচেক বেরোলো। তারপর দৃপ্ত ভঙ্গীতে এগিয়ে গেল প্রেমিক যুগলের দিকে।

তারপরের ব্যাপার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। সোজা গিয়ে দাঁড়াল সামনে। মন্দিরার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সোজা শুভদীপকে বলল,

-   কোথায় থাকিস? তিন ধরে তোকে খুঁজছি

-   কেন? শুভদীপ একটু বিভ্রান্ত যেন

-   আরে তোর টাকাটা ফেরত দেব বলে

-   কিসের টাকা? শুভদীপের দৃষ্টি বিস্ফারিত

-   আরে ওই যে দাদের মলম কেনার পয়সাটা দিয়েছিলি। ওটা পাওয়া গেল না। দোকানদার বলল অত কড়া ওষুধ ওরা রাখে না আজকাল। তোকে অ্যালোপ্যাথি করাতে বলেছে।

শুভদীপের হাতে টাকা পাঁচটা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এল আলোক।

এর পর মন্দিরা আর শুভদীপকে আর একসঙ্গে দেখা যায়নি।

(স্বীকারোক্তিঃ রেস্তোরাঁর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি নই। এটি এক বন্ধুর কাছে শোনা)

   

নিউ জার্সি – ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

Monday 1 February 2016

জনৈক বৃদ্ধের কাহিনী


চোখে ঝাপসা দেখছিলাম বিশেষ করে বই বা কাগজ পড়ার সময় ভাবলাম পাওয়ার বেড়েছে গেলাম ডাক্তার বাবুর কাছে, চোখের ডাক্তার দেখে টেখে গম্ভীর মুখে জানালেন, - হুমম, ক্যাটারাক্টদু-চোখেই অপারেশন করে নতুন লেন্স বসাতে হবে

মনটা খারাপ হয়ে গেল বয়সটা যে কেন আজকাল এত ঘন ঘন জানান দিয়ে উঠছে কে জানে? ডাক্তার বাবু অভয় দিলেন, - খুবই সামান্য ব্যাপার মিনিট দশেক লাগবে, টেরই পাবেন না প্রথমে বাঁ চোখটা করব দশ দিন পরে ডান চোখ

এত ঘন ঘন, - আমি একটু উদ্বিগ্ন এবার একটু যেন বিরক্তই হলেন তরুণ ডাক্তারটি, - এত ভয় পাবার কি আছে? গড়ে গোটা দশেক অপারেশন করি আমি রোজ। 

কি আর করা? রাজি হলাম

বাঁ চোখের অপারেশন হল দেখলাম সত্যি খুবই সামান্য ব্যাপার ডাক্তার বাবু গল্প করতে করতে কাজ সেরে ফেললেন দেখলাম বাঁ চোখে বেশ পরিস্কার দেখছি সাহস সত্যিই বেড়ে গেল দশ দিন পর বুক ফুলিয়ে আবার হাজির হলাম ডাক্তার বাবুর ক্লিনিকে

প্রায় সাত জন রুগী বসে আছেন। আমি আজ ৬ নম্বরে। এখন প্রথম জনের অপারেশন চলছে। অপেক্ষারত একজন দেখলাম বেশ ভয়ে ভয়ে আছেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোক। দেখে মায়া হল। কেন যে এই বয়সে চোখের অপারশন করতে এসেছেন? বাড়ির লোকদেরও বলিহারী। কি দরকার ছিল এনার অপারেশনের? আর তো মোটে ক’টা দিন! ক’দিনই আর বাঁচবেন?

একটি কমবয়সী নার্স আমাদের দেখাশোনা করছেন। মাঝে মাঝে নিয়ম মত চোখে ড্রপ দিয়ে যাচ্ছেন। আর ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক নানা প্রশ্ন করে নার্সটিকে উত্যক্ত করছেন। শেষে নার্সটি একটু বিরক্ত হয়েই আমাকে দেখিয়ে ভদ্রলোককে বললেন, - কেন ভয় পাচ্ছেন? ওই ওনাকে দেখুন না। দশ দিন আগে বাঁ চোখে অপারেশন করিয়েছেন। আজ ডান চোখে করাবেন। ওনাকে দেখে কি মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুব ভয়ের?

ভদ্রলোক শুনে আমার পাশে এসে বসলেন। এবার আমার দিকে নিক্ষিপ্ত হল সব প্রশ্নবান। ধৈর্য না হারিয়ে ঠান্ডা মাথায় সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। একটু খারাপই লাগছিল। বৃদ্ধ বয়সে একটু নার্ভাস হওয়া তো স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তরের পর ভদ্রলোককে একটু যেন নিশ্চিন্ত মনে হল। অবশেষে ডাক এল ওনার। উঠে দাঁড়িয়ে আমার সামনে এসে নত হয়ে নমস্কার করে সশ্রদ্ধ কন্ঠে বললেন, - সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলাম জানেন। কিন্তু আপনার মত একজন প্রবীণ বয়ঃজ্যেষ্ঠ্ ব্যক্তির কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে এখন বেশ সাহস পাচ্ছি।

বেশ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে অপারেশন থিয়েটারের দিকে এগিয়ে গেলেন সেই “বৃদ্ধ” ভদ্রলোক।
   

নিউ জার্সি – ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৬