Monday 1 February 2016

কলেজ স্মৃতি - ১


১৯৬৭-এর ব্যাচ আমরা। বন্ধুরা প্রায় সবাই আমার মতই অবসরপ্রাপ্ত। ব্যতিক্রমও আছে। কয়েক জন আবার এখনও কন্সাল্টেন্সি করে যাচ্ছে। ওদের নাকি বাড়িতে বসে সময় কাটে না। যাই হোক, মাঝে মাঝেই আড্ডা বসে। হঠাৎ সবার বয়স কমে যায়, ভাষা হয়ে ওঠে অসংযতপ্রথম দিকে তো মহিলারা কানে আঙুল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন। এখন অবশ্য তাঁরাও খুব উপভোগ করছেন।

এই সব আড্ডায় স্মৃতিচারণ হয় খুব। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেরকমই দু-একটা ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছে করছে আজ। প্রথমেই বলে রাখি, ঘটনাগুলো বাস্তব, কিন্তু নামগুলো কাল্পনিক। এই সব ঘটনায় কুশীলব যাঁরা তাঁদের অনেকেই এখন সমাজে খ্যাতিমান লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। কেউ আবার মাঝে মাঝে টিভির পর্দায়ও আসেন বা প্রেস বিবৃতি দেন। তাই এঁদের সম্মানরক্ষার্থে নামগুলো গোপন রাখতে হচ্ছে।

১৯৬২ সালে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হই। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। সারা দেশ থেকে ছাত্র আসে। আমাদের হস্টেলে শ-দেড়েক ছাত্র ছিল। তার মধ্যে বাঙালীর সংখ্যা বোধহয় পনের ষোল। বাঙলার বাইরে বাঙালীদের মধ্যে বেশ একটা বন্ধন বা বন্ড তৈরি হয়। আমাদেরও হয়েছিল।

চারদিকে সারি সারি ঘর মাঝখানে বিরাট বাগান। চার কোনায় বেসিন, বাথরুম ও টয়লেট। হস্টেলের একপ্রান্তে থাকত আলোক। সবার প্রিয়, চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি আর পেটে নানা রকমের লোক ঠকানো বুদ্ধি। আলোকের ঘরের কাছে থাকত ভূপিন্দর শর্মা। দিল্লীর ছেলে, পঞ্জাবী ও সুদর্শন। লম্বা পেটানো চেহারা, ঢেউ খেলানো চুল, ফর্সা রঙ, - মনে হত সিনেমার হিরো। সগর্বে একদিন ঘোষণা করল সে নাকি স্টেট লেভেলে ফুটবল খেলে। দিল্লী স্টেটের হয়ে খেলেছে। আমরা ওর নাম শুনিনি শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। মাল ক্যাচ হয়ে গেল প্রথম প্র্যাকটিসের দিন। ঝকঝকে বুট আর দিল্লীর জার্সি নিয়ে মাঠে নেমে বলে কিক করতেই মাটিতে ধপাস। একটু পরেই বোঝা গেল খুব একটা বিশেষ খেলাধূলো করেনি কখনও। স্রেফ গুলতাপ্পি। দিল্লীর জার্সি নাকি পয়সা দিলেই রাস্তার দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু হুঙ্কার কমল না ভূপিন্দরের। সেদিন তো মুড ঠিক নহী হৈ, বলে বেরিয়ে গেল। আর কোনও দিন মাঠে আসেনি। মেজাজ কিন্তু কমল না। এমন ভাব করত যেন ও অন্য সবাই ওর তুলনায় নেহাৎই নিকৃষ্ট।

আলোক একদিন আড্ডায় জানাল ভুপিন্দরকে শায়েস্তা করতে হবে। কি করে জিজ্ঞেস করাতে একটু মুচকি হাসল।

একদিন একটি অলস রবিবারের সকাল চারিদিকে বেশ একটা হৈচৈয়ের পরিবেশ। কেউ আড্ডা মারছে, কেউ নুন-শো সিনেমা দেখার জন্য তৈরী হচ্ছে, অনেকে আবার স্নানটান সারার জন্য বাথরুমের দিকে এগোচ্ছে। ভূপিন্দরের বাথরুমে যাওয়াটা ছিল দেখার মত। গায়ে বিশাল ধবধবে তোয়ালের রোব, কাঁধে আরও একটা বিশাল তোয়ালে, হাতে সুগন্ধী সাবান, দামী শ্যাম্পুর শিশি। গুনগুন করতে করতে একটি খালি বাথরুমে গিয়ে ঢুকল ভূপিন্দর। কিছুক্ষণ পরে বিরাট আর্তনাদ। প্রায় লাফাতে লাফতে বেরিয়ে এল, মুখে অশ্রাব্য গালাগালি। সে এক অদ্ভূদ দৃশ্য, - মাথার বাঁ পাশে ছোট্ট একখানা টাক, একটাও চুল নেই। হস্টেলের সব ছাত্র তখন ছুটে ভূপিন্দরের সামনে। চ্যাঁচামেচি থামতে জানা গেল, শ্যাম্পুর শিশিতে কেউ হেয়ার রিমুভার রেখে দিয়েছে। ব্যাপারটা হস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট অব্দি পৌঁছল। অপরাধীকে ধরা গেল না। হস্টেল সুপার সব ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলেন দু ঘন্টা। কিন্তু রহস্যের সমাধান হল না। এর পর দু-মাস মাথায় টুপি পরে ঘুরত ভূপিন্দর।

বছর খানেক পর আবার এক আড্ডায় আলোককে ধরা হল, - কান্ডটা কি তোর? অস্বীকার করল না আলোক; ফিক করে একটু হাসল শুধু।

তবে এই ঘটনার পর আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গিয়েছিল ভূপিন্দর।

আলোক সরকারী চাকরী থেকে অবসর নিয়ে এখন দিল্লীর বাসিন্দা। সম্প্রতি এসেছিল কলকাতায়। এই ঘটনাটা মনে করাতে এক গাল হেসে বলল, বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল, বুঝলি। অতটা ঠিক হয়নি।

  

নিউ জার্সি ৩১শে জানুয়ারী ২০১৬  


No comments:

Post a Comment