শুভদীপ ছিল বেশ একটু হিরো টাইপের। উত্তম কুমারের
মত চুল ছাঁটত। ইউনিভার্সিটির কাছে এক বিহারী নাপিতকে রীতিমত তালিম দিয়ে উত্তম ছাঁট
দেওয়া শিখিয়েছিল। জামা কাপড়ে সব সময় ফিটফাট। ক্লাসে যেত একেবারে ইস্তিরি ভাঙা
পোষাক পরে। কথা বলত আস্তে, অযথা চ্যাঁচাতো না। মাঝে মধ্যে কলকাতায় ফেলে আসা
বান্ধবীদের কথা বলত। আমরা হাঁদার মত বড় বড় চোখ করে শুনতাম।
বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের আলাদা
কলেজ ছিল। উইমেন্স কলেজ ও হস্টেল। ক্যাম্পাসে ঢুকেই বাঁ হাতে। উঁচু পাচিল দিয়ে
ঘেরা। আমাদের হস্টেল ছিল ক্যাম্পাসের আরও ভেতরে। আমরা বাইরে যেতে হলে সাইকেলে
যাওয়া আসা করতাম। পাচিল দেওয়া বিল্ডিঙের সামনে এলেই সাইকেল চলত খুব ধীরে। যদি কারও
সঙ্গে দেখা হয় যায়। হত না কখনই। তবে তার মধ্যেই শোনা যেত নানা রঙের প্রেম কাহিনী।
আমরা তখন থার্ড ইয়ার। শোনা গেল উইমেন্স কলেজের ফার্স্ট
ইয়ারে কলকাতা থেকে একটি বাঙালী মেয়ে এসেছে। ফিজিক্স অনার্স। দারুণ দেখতে। নাম
মন্দিরা। তা দর্শণ হল একদিন। সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখিয়ে দিক একজন।
সত্যিই আকর্ষণীয়া। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, কাটাকাটা চোখ মুখ, লম্বা পিঠ ভর্তি চুল,
মুখে স্মিত হাসি।
তারপর একদিন কানে এল এক মোক্ষম খবর। শুভদীপকে
নাকি মন্দিরার সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। প্রথমে ভাবা গিয়েছিল গুজব, পরে দেখা গেল
খবরটা সত্যি। প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে দু-জনকে। তা ভাল। কিন্তু অভিযোগ আরেক
জায়গায়। শুভদীপ নাকি মন্দিরা সঙ্গে থাকলে এমন ভাব করছে যে কাউকে চেনেই না। উদাস
ভঙ্গী করে পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে, কারও সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে না।
বন্ধুরা তো খচে বোম, - আরে একটু আলাপ করিয়ে দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? আরে বাবা
তোর জিনিস তো তোরই থাকবে, আমরা তো শুধু একটু কথা বলব। বাড়ি থেকে এত দূরে একটি
সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে কার না ইচ্ছে করে? কিন্তু বিধি বাম। শুভদীপ আলাপ
করাবে না।
আলোক নামল মাঠে, - নাঃ শুভদীপকে একটু উচিৎ
শিক্ষা দেওয়া দরকার হয়ে পড়েছে। একদিন সিনেমা দেখে ফিরছে এক দঙ্গল ছেলে। হঠাৎ চোখে
পড়ল, রাস্তার পাশে এক রেস্তোরাঁয় শুভদীপ আর মন্দিরা বসে কফি খাচ্ছে। এখানে বলে
রাখা ভাল, যে সেকালে এমন প্রকাশ্যে একটি যুগলের ঘুরে বেরানো বা রেস্তোরাঁয় যাওয়া
একটা দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল।
ওদের দেখেই সাইকেল থেকে নেমে পড়ল আলোক। দাঁড়
করাল সবাইকে। টাকা পয়সা কার কাছে কি আছে বের কর তাড়াতাড়ি, - জোর হুকুম আলোকের,
কন্ঠস্বর গম্ভীর। ঝেরে ঝুরে টাকা পাঁচেক বেরোলো। তারপর দৃপ্ত ভঙ্গীতে এগিয়ে গেল
প্রেমিক যুগলের দিকে।
তারপরের ব্যাপার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। সোজা
গিয়ে দাঁড়াল সামনে। মন্দিরার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সোজা শুভদীপকে বলল,
- কোথায়
থাকিস? তিন ধরে তোকে খুঁজছি
- কেন?
শুভদীপ একটু বিভ্রান্ত যেন
- আরে
তোর টাকাটা ফেরত দেব বলে
- কিসের
টাকা? শুভদীপের দৃষ্টি বিস্ফারিত
- আরে
ওই যে দাদের মলম কেনার পয়সাটা দিয়েছিলি। ওটা পাওয়া গেল না। দোকানদার বলল অত কড়া
ওষুধ ওরা রাখে না আজকাল। তোকে অ্যালোপ্যাথি করাতে বলেছে।
শুভদীপের হাতে টাকা পাঁচটা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এল
আলোক।
এর পর মন্দিরা আর শুভদীপকে আর একসঙ্গে দেখা
যায়নি।
(স্বীকারোক্তিঃ রেস্তোরাঁর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী
আমি নই। এটি এক বন্ধুর কাছে শোনা)
নিউ জার্সি – ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
No comments:
Post a Comment