Wednesday 15 February 2017

অনশন

অবসর জীবন। অখন্ড অবসর। স্কুল বা কলেজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে বেশ আড্ডা জমে মাঝে মাঝে। নানা রকম গাল গল্প, রাজনীতি এবং অবশ্যই স্মৃতিচারণ। এই সব আড্ডা থেকেই হঠাৎ ভেসে ওঠে বিস্মৃত কোনও ঘটনা।

দিল্লী থেকে এক বন্ধু এসেছিল সম্প্রতি। সস্ত্রীক। একদিন সকাল থেকে রাত অব্দি কাটালো আমাদের সঙ্গে। প্রচুর হৈ হৈ আড্ডা হল সারা দিন ধরে। উস্কে দিয়ে গেল কিছু কলেজ স্মৃতি। তারই একটা গল্প শোনাবো ভাবছি। তবে এই কাহিনীর যাঁরা মুখ্য চরিত্র তারা সবাই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই আসল নাম ধাম একটু গোপন রাখতে হচ্ছে।

রাজর্ষি দত্ত এই গল্পের নায়ক। নায়িকাও আছেন একজন; তাঁর কথায় পরে আসছি। এলাহাবাদের ছেলে রাজর্ষি। সেখানেই জন্ম, পড়াশোনা। মা বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা শহরের খ্যাতিমান ডাক্তার। বাবার ইচ্ছে ছিল, ছেলে ডাক্তার হবে ও বাবার প্রতিষ্ঠিত প্র্যাকটিস সামলাবে। রাজর্ষি ছোটবেলা থেকেই খুব খামখেয়ালী। হায়ার সেকেন্ডারিতে খুব ভাল ফল করে ঘোষণা করল ডাক্তারি পড়বে না, কেমিস্ট্রি পড়বে। স্নেহশীল বাবা ও মা রাজি হলেন। যথাসময়ে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পাশ করল রাজর্ষি। এর পর মাথা গেল বিগড়ে। কেমিস্ট্রি ভাল লাগছে না, তাই এম এস সি আর পড়বে না। শখ হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার হবে। মা বাবা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই বোঝানোর চেষ্টা করে বিফল হলেন।

বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে (বি এইচ ইউ) অ্যাপলাই করে, ইন্টারভিউ দিয়ে বেনারস ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হল রাজর্ষি; পাঁচ বছরের ইন্টিগ্রেটেড কোর্সে। আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি। বিপুল উদ্যমে র‍্যাগিং চলছে। আমাদের সময়ে র‍্যাগিং ব্যাপারটা খুব মজার ছিল। আজকাল যে সব ভয়াবহ ঘটনা কাগজে পড়ি সেই সময় তা ছিল অকল্পনীয়।

সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র আমরা; সদ্য সদ্য সিনিয়র হয়েছি। র‍্যাগিং-এর উৎসাহ খুব বেশি। যথারীতি রাজর্ষিরও ডাক পড়ল। মাথা গোঁজ করে রাজর্ষি সব আবদার অত্যাচার মেনে নিল।  গান গাইল, গানের তালে তালে নাচল। কিন্তু এও জানাতে ভুলল না যে ও আমাদের থেকে সিনিয়র এবং ওর স্কুলের বেশ কয়েকজন সহপাঠী আমাদেরই কলেজে পড়ে, ফোর্থ ইয়ারে।  সেই সহপাঠীদের একজনের আবার মস্তান হিসেবে হিসেবে বেশ নাম ডাক ছিল। সব কিছু জেনে বুঝে আমরা রাজর্ষিকে আর বেশি ঘাটালাম না।

ধীরে ধীরে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল রাজর্ষির সঙ্গে। দেখলাম ছেলেটির নানা বিষয়ে বেশ জ্ঞান আছে, আর পড়াশোনাও করেছে প্রচুর। এদিনে আবার নাটক, ডিবেট ইত্যাদিতেও বেশ পারদর্শী। রাজনীতিতে খুব উৎসাহ। ছাত্র রাজনীতিতেও ঢুকে গেল। এক কথায় বেশ প্রতিষ্ঠিত করে নিল নিজেকে। কিন্তু খামখেয়ালী স্বভাবটা আমাদের নজর এড়ালো না। ক্লাসে যেতোনা প্রায়ই, ক্যান্টিনে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের বাইরে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। চাল চলন অন্য সবার থেকে একটু আলাদা।

এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে রাজর্ষির কয়েক জন বন্ধু বি এইচ ইউ-তে এম এস সি পড়তে এসেছিল। তারা থাকত সাইন্স কলেজের হস্টেলে। রাজর্ষি প্রায়ই চলে যেত সেখানে আড্ডা মারতে। সেখানেই এক বন্ধুর মাধ্যমে উইমেন্স কলেজের কেমিস্ট্রির ছাত্রী কেতকী মল্লিকের সঙ্গে হঠাৎ একদিন আলাপ হয়ে গেল রাজর্ষির। আর প্রথম দর্শনেই প্রেম; কিন্তু এক তরফা, - রাজর্ষির দিক থেকে। থার্ড ইয়ার কেমিস্ট্রির ছাত্রী ফার্স্ট ইয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রকে একেবারেই পাত্তা দিল না।

এবার নায়িকা সংবাদ।

কেতকী মল্লিক ঝাঁসীর মেয়ে। অনর্গল হিন্দীতে কথা বলত। নিজের নামটাও বলত হিন্দী উচ্চারণে, - কেৎকী মলিক। এমন সুন্দর নামটাকে বিকৃত করে যে কি সুখ কে জানে? কেউ কোনও দিন ওর মুখে বাঙলা শোনেনি। সাজ গোজের বালাই নেই। শ্যামলা রঙ কিন্তু বেশ কাটা কাটা, বুদ্ধি দীপ্ত চেহারা। ছিপছিপে আর বেশ লম্বা, শুনেছিলাম পাঁচ ফুট সাত কি আট। পরনে হাল্কা রঙের সালোয়ার কামিজ, সাইকেল চালিয়ে চলাফেরা করত। কোনও দিন রিক্সায় বা বাসে দেখিনি।

রাজর্ষি তো প্রথম দিন থেকেই ফিদা। কিন্তু ওর প্রাণের কেৎকী ফিরেও তাকায় না। এক দিন নাকি বলেই দিল, - বচ্চে হো, পঢ়াইমে ধ্যান দো।

দিন গড়ায়, মাস গড়ায়, বছরও গড়িয়ে চলল। আমরা এক দিন ফোর্থ ইয়ারে পৌঁছলাম। রাজর্ষি থার্ড ইয়ারে। কেতকীর এম এস সি ফাইনাল। এতদিনে রাজর্ষির সঙ্গে ভাল পরিচয় হয়ে গেছে কেতকীর; কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কেতকী তত দিনে জেনে গেছে যে রাজর্ষি খুব একটা বাচ্চা নয়। কথাবার্তাও হয় দুজনে, - কিন্তু হিন্দীতে। উত্তর ও মধ্য ভারতের বাঙালিদের ঐ এক অভ্যাস। হিন্দীতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।

রাজর্ষি হাল ছাড়েনা। কেতকীও পাত্তা দেয় না। এই এক তরফা প্রেম কাহিনী চাউড় হয়ে গেল ক্যাম্পাসে। রাজর্ষির কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই আর কেতকীও উদাসীন। এই ভাবেই চলছিল। আমরাও ধীরে ধীরে নানা কাজে ও অকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

এমন সময় ঘটল এক ঘটনা।

ছাত্র আন্দোলনে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি হঠাৎ উত্তাল হয়ে উঠল। প্রায়ই স্ট্রাইক, মিছিল ইত্যাদি লেগে আছে। সাইন্স, আর্টস, কমার্স ও অ্যাগ্রিকালচার কলেজের ছেলেরা ভীষণ ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। মেয়েরাও। কেতকীও নাকি খুব সক্রিয়। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্ররা একটু যেন নির্লিপ্ত। তার জন্য বেশ কিছু কটু মন্তব্যও শুনতে হচ্ছে এখানে সেখানে। এমন সময় হঠাৎ খবর এল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রাজর্ষি দত্ত অন্যান্য কলেজের ছেলেদের সঙ্গে ভুখ হরতাল শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, রাজর্ষি না কি আমরণ অনশন করবে যদি কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের দাবী না মানেন।

শুরু হল এক নাটক। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আলোচনায় বসলেন। বেশ কিছু দাবী মেনে নেওয়া হল। একে একে সব ছাত্রই ফলের রস খেয়ে অনশন ভাঙল। কিন্তু একজন অটল। সে হল রাজর্ষি। সব দাবী না মানলে সে অনশন ভাঙবে না। কর্তৃপক্ষ খুবই উদ্বিগ্ন। ঠিক ক’দিন অনশন চলেছিল এখন মনে পড়ছে না কিন্তু খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল রাজর্ষি। খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন মা-বাবা এসে পৌঁছলেন এলাহাবাদ থেকে। কিন্তু রাজর্ষি অটল। একটা মাঝারি সাইজের হলে দুর্বল শরীর নিয়ে শুয়ে আছে রাজর্ষি। তাকে ঘিরে কিছু ছাত্র। মার কান্নাকাটি শুনেও রাজর্ষি অবিচল। বাবার মুখ থমথমে। ডাক্তার মানুষ। ছেলের পালস প্রেশার পরীক্ষা করে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

শেষে রাজর্ষিরই এক বন্ধু একটু ইতস্ততঃ করে প্রস্তাবটা দিল, - কেতকীকে ডাকলে কেমন হয়! কেতকীর অনুরোধ হয়তো ফেলতে পারবে না। প্রস্তাবটা মনে ধরল সবার।  রাজর্ষির মা-বাবাকে কিছু জানানো হল না অবশ্য। কেতকী এল বান্ধবীদের সঙ্গে। কিন্তু বরফ গললো না। রাজর্ষি করুণ চোখে তাকিয়ে রইল কেতকীর দিকে। কিন্তু ওকে টলানো গেল না।

এবার এক চরম নাটক।

পরের দিন সকালে কেতকী আবার এল। একা। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ আর হাতে একটা বোতল। মনে হল বোতলের ভেতর কমলা লেবুর রস আছে। বাইরে সাইকেল দাঁড় করিয়ে, হলে ঢুকল দৃপ্ত ভঙ্গীতে। ঢুকেই গম্ভীর গলায় আদেশ, - আপলোগ বহার জাইয়ে। সেই দৃঢ় ভঙ্গীর সামনে কারও কিছু বলার সাহস হল না। সবাই রাজর্ষিকে হলে একা রেখে বেরিয়ে এল চুপ চাপ। কেতকী ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করল। মিনিট দশেকের অপেক্ষা। বিরাট সাসপেন্স। কি হচ্ছে ভেতরে কে জানে। দরজা খুলল। আবার কেতকীর আদেশ সেই কঠোর কন্ঠে, - আপলোগ অন্দর আইয়ে। সবাই ভেতরে গিয়ে দেখে সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। বোতলে মুখ লাগিয়ে ফলের রস খাচ্ছে রাজর্ষি আর জুল জুল চোখে তাকিয়ে আছে কেতকীর দিকে। সবাই হতবাক। কি এমন হল যে এমন নরম হয়ে গেল রাজর্ষি। উত্তরটা জানা গেল দু-দিন পরে। বোতলটা রাজর্ষির পাশে রেখে, ব্যাগ থেকে একটা রাখী বের করেছিল কেতকী, - তারপর হুমকি, - আভি পি লে নহী তো রাখী পেহনা দুঙ্গী। তাতেই কাজ হয়। দুর্বল হাতে বোতল খুলে চুক চুক করে কমলা লেবুর রস খেতে শুরু করে আমাদের গল্পের হিরো।

উপসংহার

এই কাহিনী এখানে শেষ হলেই ভাল হত। কিন্তু  ধৈর্য ধরে যাঁরা এই কাহিনী পড়বেন, তাঁদের আরও কিছু কথা জানানো দরকার। রাজর্ষি আর কেতকী দু-জনেই রিটায়ার করে এখন নয়ডার বাসিন্দা। রাজর্ষি সরকারি চাকরি করত দিল্লীতে। কেতকীও দিল্লীরই কোনও একটি কলেজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিল। ওদের একমাত্র সন্তান পিতামহের আদর্শ অনুসরণ করে ডাক্তার হয়েছে। বিয়ে করেছে সহপাঠী এক পঞ্জাবী ছেলেকে। তাদের একটি ছেলেও আছে। মেয়ে, জামাই আর নাতি নয়ডাতেই থাকে, ওদের কাছেই। রাজর্ষি এখনও সেই রকম খামখেয়ালী, - মোবাইল ব্যবহার করে না। কেতকীর মোবাইল নাম্বার জোগাড় করেছি। কথাও হল একদিন।

আরও একটা কথা। ওরা আজকাল নিজেদের মধ্যে সব সময় বাঙলাতেই কথা বলে। খাঁটি, নির্ভুল ও নির্ভেজাল বাঙলা।

কলকাতা
১৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৭

Saturday 11 February 2017

মডেলস একজিবিশন

প্রেমনাথ ভার্গব। আমরা ডাকতাম প্রেম। আমাদের সহপাঠী। মাঝারি হাইট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। একটু দোহারা। পড়াশোনায় খারাপ নয় তবে আহামরিও কিছু নয়। ক্লাসের ফাঁকে ও ছুটির দিনগুলোতে লাইব্রেরিতে বসে থাকত আর নানা রকম বই ও ম্যাগাজিন পড়ত। টেক্সট বুকে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।  পপুলার মেকানিক্স নামে একটি ম্যাগাজিন প্রেমের খুব প্রিয় ছিল। গোগ্রাসে গিলত সেটাকে। শুধু তাই নয়, - কিছু যদি পছন্দ হয়ে গেলে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত।

প্রত্যেক বছর জানুয়ারী মাসে আমাদের কলেজে মডেলস একজিবিশন হত। সে এক এলাহী ব্যাপার। বড় বড় দুটো হল জুড়ে নানা রকম মডেল, - উৎসাহী ছাত্রদের ভীড়। উদ্বোধন করতেন স্বয়ং প্রিন্সিপাল, সঙ্গে সব রাশভারী প্রফেসরেরা। তাঁদের ইম্প্রেস করতে ছাত্রদের মধ্যে বেশ একটা রেষারেষি। তৃতীয় দিনে আসতেন ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যান্য ভিআইপিরা। ঐ একই দিনে এক ঝাঁক পায়রার মত হাজির হত উইমেন্স কলেজের ছাত্রীরা; বেশ সেজেগুজেই আসত। যাক গে, সে এক অন্য কাহিনী।

আমাদের সময় ১১ বছরের হায়ার সেকেন্ডারির পর পাঁচ বছরের ইন্টিগ্রেটেড কোর্স ছিল। প্রথম দু-বছর র্যা গিং ট্যাগিং সামলে থার্ড ইয়ারে একটু ধাতস্থ হয়ে বসেছি। এমন সময় প্রেমের মাথায় ভূত চাপল। সে ক্ষেপে উঠল এবার আমাদেরও মডেল বানাতে হবে। কি বানাবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। এবার আমাদের শুধু সহযোগিতা করতে হবে। রাজি হতেই হল। এত উৎসাহ ওর; নিরাশ করতে মন চাইল না।

কোনও একটা টেকনিকাল ম্যাগাজিন থেকে আইডিয়াটা পেয়েছে প্রেমনাথ। মডেলের নাম – অটোমেটিক কয়েন সর্টিং মেশিন। একটা ছোট সাইজের ড্রাম বা সিলিন্ডার ঘিরে একটা একটা হেলিক্যাল-শেপড স্লাইড; তার ওপর বিভিন্ন সাইজের খাঁজ কাটা। সিলিন্ডারের ওপরে একটা ফানেল; সেই ফানেলে নানা সাইজের কয়েন ঢোকানো হবে। ভেতরে একটা মোটর বসানো। সুইচ টিপে মোটর চালু করলে সিলিন্ডারে একটা কম্পন বা ভাইব্রেশন হবে। ফানেলের ভেতর রকমারি কয়েন ছেড়ে দিলে, ভাইব্রেশনে স্লাইড বেয়ে কয়েন গুলো নীচে নামবে ও খাঁজের মাপ অনুযায়ী নীচে নানা মাপের কৌটোতে জমা হবে। আহা মরি কিছু নয় কিন্তু আশ্চর্য, জিনিসটা বেশ কাজ করল। প্রেমকে বাহবা দিতেই হল। একবার কাজ শুরু করতেই সবারই উৎসাহ ছিল দেখার মত। সেই সময় একটা মান্ধাতা আমলের ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবিও তোলা হয়েছিল। কিন্ত অর্দ্ধ শতাব্দী পর সেই ছবি আর খুঁজে পাইনি। ছবিটা দিলে মোটামুটি বোঝানো যেত জিনিসটা কি।

একজিবিশনের প্রথম দিনই দেখা গেল, আমাদের স্টলের সামনে বেশ ভীড়। লোকে বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের মডেল দেখছে। বেশ একটু আশা হল; হয়তো একটা প্রাইজ পেয়েও যেতে পারি। ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড প্রাইজ ছাড়াও অনেক কনসোলেশন প্রাইজও ছিল।

কিন্তু সব চেয়ে বেশি ভীড় দেখলাম আমাদের এক বছরের সিনিয়র একটি গ্রুপের স্টলে। সেই গ্রুপের নেতা সুবোধ নিগম বলে একটি ছেলে। ওরা বানিয়েছে পোস্টকার্ড ডিস্পেনসিং মেশিন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় সেটি একটি অভূতপূর্ব উদ্ভাবন। মানতেই হল। এরা প্রাইজ পাবেই। অপূর্ব কাজ করছে সুবোধের মেশিন। সবাই মেশিনে পয়সা ঢুকিয়ে পোস্টকার্ড কিনছে। কিন্তু সুবোধের মুখ চোখ থমথমে। কেন বোঝা গেল না।

যথা সময় পুরস্কার ঘোষণা করলেন কর্তৃপক্ষ। আমাদের মডেল থার্ড প্রাইজ পেয়েছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাল্টিলেভেল ফ্লাইওভার পেয়েছে সেকেন্ড প্রাইজ। প্রচুর সান্ত্বনা পুরস্কার। আর যা ভেবেছিলাম আমরা সবাই, - সুবোধের মডেল ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। সুবোধের মুখ তখনো গম্ভীর, যেন কেঁদেই ফেলবে।

ব্যাপারটা বোঝা গেল পরের দিন।

সেই সময় পোস্টকার্ডের দাম ছিল পাঁচ পয়সা। সুবোধের মেশিনে পাঁচ পয়সার মাপের একটি খাঁজ বা স্লট কাটা ছিল। সেটাতে একটি মুদ্রা ঢোকালে, দু সেকেন্ডের মধ্যে একটা পোস্টকার্ড বেরিয়ে আসত। দিব্যি চলছিল। কাল হল একজিবিশন শুরু হওয়ার তিন দিন আগের একটি ঘোষণা। ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগ পোস্টকার্ডের দাম পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ছ-পয়সা করে দিলেন। বাধ্য হয়ে সুবোধদের গ্রুপকে একজিবিশনের আগের দিন পোস্ট অফিস থেকে ছ-পয়সা দামের পোস্টকার্ড কিনে আনতে হল। নিয়ম অনুযায়ী মেশিন চালু রাখতেই হয়েছিল। জনসাধারণ পাঁচ পয়সা দিয়ে ছ-পয়সার পোস্ট কার্ড নিয়ে চলে গেছে।

কলকাতা
১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭