প্লেন দমদমের মাটি ছুঁতেই প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করল রজত। হাতে ধরে রইল। প্লেন থামলে ফোন অন করবে। অন্যান্য যাত্রীরা ততক্ষণে ফোন অন করে বেশ চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সীট বেল্ট খুলে, দাঁড়িয়ে উঠেছে। এক হাতে ফোন, অন্য হাতে ওপরের হ্যাচ খুলে ব্যাগ ট্যাগ বের করছে। খুব বিরক্ত বোধ করে রজত, ধৈর্যর ভীষণ অভাব এই লোকগুলোর। নামবে তো সবাই প্লেনের দরজা খুললে। রজত বসে থাকে সীটে, তাড়া নেই। প্লেন অবশেষে থামল। রজত ফোনটা অন করে, অপেক্ষা করে সিগনালের। প্লেনের দরজা খোলার পর যাত্রীরা নামতে শুরু করে। ভীড় একটু হাল্কা হতে, উঠে দাঁড়ায় রজত। লাগেজ বলতে শুধু একটা মোটা ব্রীফকেস, তাতে অফিসের ফাইলপত্র, শেভিং সেট,
টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, কলম আর একটা ছোট্ট ল্যাপটপ। জামা কাপড় নেই। কয়েক সেট জামা কাপড় বাড়িতে রাখা আছে, মায়ের যত্নে; একটা স্যুটও আছে। অফিসের কাজে প্রায়ই কলকাতা আসতে হয় রজতকে, তাই এই ব্যবস্থা।
অ্যারাইভাল লাউঞ্জে এসে প্রথমে একটা এসএমএস করল সোনালীকে। সোনালী রিমঝিমকেও জানিয়ে দেবে। রিমঝিম আবার বাবার কাছ থেকে এসএমএস না পেলে অভিমান করে। কিন্তু ও বোধহয় এখন কলেজে পৌঁছে গেছে, বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। এরপর বাড়িতে ফোন করল রজত, মা-ই ধরলেন,
‘কি রে এত দেরি? আমি তো সেই তখন থেকে তোর ফোনের জন্য বসে আছি’
‘না, কোথায় দেরি? ঠিক সময়ে তো এলাম, তোমার চিন্তা করাটা একটা বাতিক হয়ে যাচ্ছে’
‘এসেই ঝগড়া শুরু করলি, শোন পাবদা মাছ এনেছে তোর বাবা, বড়ি দিয়ে হাল্কা ঝোল করছি, দুপুরে খাবি তো?’
‘না, আমি সোজা অফিস যাচ্ছি, ওখানেই লাঞ্চ করব, তোমায় তো কাল বললাম’
‘ঠিক আছে, অফিসের পর তাড়াতাড়ি চলে আসিস, জহরও বলছে অফিস থেকে ফেরার সময় ফুলকপির শিঙারা নিয়ে আসবে, একসঙ্গে চা খাবে তোর সঙ্গে’
‘ও হ্যাঁ শোন মা, আমি আসার সময় একটু দীপকের বাড়ি হয়ে আসব, একটু দরকার আছে। জহরকে আমি ফোন করছি’
‘ঠিক আছে দেরি করিস না। সোনালীকে ফোন করেছিস?’
‘এসএমএস করেছি, পরে ফোন করব, ও এই সময়টা ব্যস্ত থাকে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে, ঠিক আছে মা, এখন রাখছি, বাবার সঙ্গে পরে কথা বলব, আমার অফিসের ড্রাইভার এসে গেছে’।
রামকিশোর পুরনো ড্রাইভার, সেন সাহেবকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে আসে, হাত থেকে ব্রীফকেসটা নেয়। গাড়ীতে উঠে দীপককে ফোন করল রজত। ওদের স্কুলের শতবার্ষিকী এ বছর, বিরাট অনুষ্ঠান। এই সুযোগে দীপক নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে একটা রিইউনিয়নের ব্যাবস্থা করছে নিজের বাড়িতে। সুবীর এসেছে আমেরিকা থেকে, নীলাঞ্জনের আজ বিকেলে দিল্লী থেকে পৌঁছনোর কথা, হিমাদ্রী আসবে কাতার থেকে। পার্থ তো এখন কলকাতায়ই থাকে, লন্ডন থেকে ফিরে এসে চেম্বার খুলে বেশ ভাল প্র্যাকটিস জমিয়ে নিয়েছে। অনেক দিন পর বেশ জমিয়ে আড্ডা হবে।
‘কি রে, পৌঁছে গেছিস?’ দীপকের গলা শোনা গেল
‘হ্যাঁ। জাস্ট গাড়িতে উঠেছি’
‘ম্যানেজ করলি তবে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নো বিগ ডীল’ রজত একটু হাল্কা হাসে
‘ঠিক আছে, বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় একটু ঘুরে যাস, সুবীরও আসবে, ব্যাটা আবার দাড়ি রেখেছে, আর মাথা পুরো কামানো’
‘বলিস কি রে?’
‘আয় দেখবি, একেবারে কিম্ভূতকিমাকার চেহারা করেছে। ক’দিন ম্যানেজ করলি?’
‘ধর পাঁচ দিন, আজ বুধবার, সোমবার মর্নিং ফ্লাইটে ফিরব, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা অফিস’
‘গুড, ভেরি গুড, তাড়াতাড়ি চলে আসিস’
‘হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে বেশিক্ষণ বসব না বুঝলি, মা আবার ওয়েট করে থাকবে’
‘ওকে নো প্রবলেম, সী ইউ দেন’
‘সী ইউ, বাই’
অফিসে সময়টা ঝড়ের মত কেটে গেল, পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে মীটিং, প্রেজ়েন্টেশন, ক্লায়েন্ট ফীডব্যাক ইত্যাদি। লাঞ্চ ব্রেকে কোনও রকমে সোনালীকে ফোন করে রিমঝিমকে ফোন করল, মেয়ের যা অভিমান। রিমঝিম ধরল না, বোধহয় ক্লাস চলছে, ফোন সাইলেন্ট মোডে আছে। ভালই হল, পরে মিসড কল দেখে বুঝবে বাবা ফোন করেছিল। মাঝখানে জহর ফোন করেছিল, খুব ইচ্ছে দাদাকে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা একটু ক্লাবে যাবে। বছর দুয়েক আগে কলকাতার এক অভিজাত ক্লাবের মেম্বার হয়েছে জহর। রজত বারণ করে, প্রথম দিনটা বাড়িতেই কাটানো উচিৎ। মা বাবা পথ চেয়ে বসে থাকবেন। বাবার সঙ্গেও মাঝে একবার কথা হয়ে গেছে। দীপক আরও একবার ফোন করল; ও চারটের মধ্যে বাড়ি চলে আসবে, সুবীর আসবে সাড়ে চারটে নাগাদ, তা ছাড়া পার্থ চেম্বারে যাওয়ার আগে একবার ঢুঁ মেরে যাবে বলেছে।
সোয়া চারটেতে রজত বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। একটু ক্লান্ত লাগছে। সেই ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সান্তাক্রুজ এয়ারপোর্ট, তারপর কলকাতার ফ্লাইট, সেখান থেকে সোজা অফিস, সারাদিন বেশ ধকল গেছে। অফিসের গাড়িটা রইল সঙ্গে, ড্রাইভার রামকিশোর সেন সাহেবের ডিউটি করতে ভালবাসে। সেন সাহেব ফিরে যাবার সময় দরাজ হাতে বকশিশ দিয়ে যান। দীপকের বাড়িটা অফিস থেকে বাড়ি যাওয়ার পথেই পড়ে, রামকিশোর চেনে।
দীপকের বাড়িতে পৌঁছতেই দীপক নিজেই দরজা খুলে দিল। সুবীর ও পার্থ বেশ জমিয়ে বসেছে। সুবীরকে দেখে আঁতকে উঠল রজত। প্রচন্ড মোটা হয়েছে, চুল আগেই বেশ পাতলা হয়ে আসছিল, এখন পুরো মাথা কামিয়ে ফেলেছে। তার মধ্যে আবার গোঁফ আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। পার্থ একই আছে, দু বছর আগে পার্থ যখন লন্ডন থেকে ফিরে এখানে ডাক্তারি শুরু করল, তখনও একবার দেখা হয়েছে। কিন্তু তারপর বার দুয়েক কলকাতায় এলেও ব্যস্ততার জন্য দেখা হয়নি, তবে ফোনে কথা হয়েছে।
‘কি হুলিয়া বানিয়েছিস রে?’ রজত জিজ্ঞেস করে সুবীরকে,
‘আর বলিস না, ডায়েটিং করেও কিছু হচ্ছে না’ সুবীর মুখটাকে করুণ করে ফেলে
‘শুধু খাওয়া কমালেই হবেনা গুরু, মাল খাওয়াটাও কমাতে হবে’ পার্থ টিপ্পনি কাটে
‘দেখ ডাক্তারি ফলাস না, কি খাবি বল, ঠান্ডা বীয়ার খাচ্ছি আমরা’ দীপক জিজ্ঞেস করে
‘না রে, বাড়ি যাইনি এখনও, আমাকে বরং একটু চা খাওয়া, নো মিল্ক, নো শুগার’ রজত জানায়
‘ঠিক আছে তোরা বোস, আমি বলে আসছি,’
‘রুবি কোথায়? আর রনি?’
‘রুবি এই সময়টা ছাত্র ছাত্রী নিয়ে ব্যস্ত থাকে, গান শেখায় জানিস তো?’
‘আর রনি?’
‘রনি ম্যাথস টিউশন নিতে গেছে, একটু দেরি হবে ফিরতে’ দীপক ভেতরে চলে যায়
আড্ডা জমে ওঠে। রুবি মাঝখানে এল একবার, আপ্যায়ন ঠিক মত হচ্ছে কি না তদারক করে গেল। ঠিক হল রবিবার সকালে দীপকের বাড়িতেই লাঞ্চে আসবে সবাই। সুবীর আর পার্থ সস্ত্রীক আসবে, হিমাদ্রীর ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মালাও এসেছে কাতার থেকে, কিন্তু মালার বাবার কদিন আগে একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, এখনও হাসপাতালে। নীলাঞ্জন একাই আসবে দিল্লী থেকে, রুমার একটা কনফারেন্স আছে, আসতে পারবে না। আর রজত তো একাই এসেছে; রিমঝিমের ক্লাস চলছে, সোনালী মেয়েকে একা ফেলে আসবে না।
‘এই শোন, তোদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছি’ পার্থ বলে ওঠে
‘কি?’ সবাই তাকায় পার্থর দিকে
‘সেদিন হঠাৎ সুধা এসেছিল’
‘সুধা? সে আবার কে?”
‘আরে, আমাদের সুধা, সুধাকর, মনে নেই’
‘সুধাকর অধিকারি? সেই অদ্ভূত লোকটা? সে আবার কোত্থেকে উদয় হল? আর তোর কাছে?’
‘বলল কার কাছে খবর পেয়েছে আমি এখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করছি। ওর হাঁটুতে একটা ব্যাথা চলছে, খুঁড়িয়ে হাটছিল। এক্স-রে করতে বলেছি, মনে হয়না সিরিয়াস কিছু’
‘স্ট্রেঞ্জ, সেই সু-ধা-ক-র এতদিন পর, কোথায় আছে? করেই বা কি?’
‘রিমোট কোন একটা গ্রামে একটা স্কুল চালায় বলল’
‘স্কুল চালায়? সেই এলেম আছে না কি?’
‘তোকে ফীস দিয়েছে?’
‘যাঃ, ক্লাসমেট, ফী নেব কি?’
‘ঐ জন্যই তোর কাছে এসেছিল, বিনে পয়সার চিকিৎসা’ দীপক বলল
‘যাঃ, তা কেন হবে?’
‘কি রকম একটু পাগলাটে টাইপ ছিল, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত, একদিন তো সারা রাত কোন একটা বস্তিতে রাত কাটিয়েছিল।’ রজত মনে করানোর চেষ্টা করে
‘হ্যাঁ স্কুল থকে বার কয়েক ওয়ার্নিংও দেওয়া হয়েছিল’
‘একজ়েক্টলি, একগাদা স্ট্রীট আর্চিন এনে হাজির করেছিল অ্যানুয়েল ডে’র দিন’
‘শুধু তাই নয় শুনেছিলাম ড্রাঙ্কও ছিল, রাইট?’
‘তাই তো শোনা গিয়েছিল’
‘স্কুলের পর ও প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছিল না?’ রজত জিজ্ঞেস করে
‘হ্যাঁ সাম হাও হায়ার সেকেন্ডারিতে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিল’ সুবীর মনে করায়
‘কি যেন একটা স্ক্যান্ডেল হয়েছিল না!’ পার্থ মনে করার চেষ্টা করে
‘দাঁড়া, পুরো ব্যাপারটা আমার মনে আছে। ঋষিকে মনে আছে তোদের?’ সুবীর বলে
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঋষিরাজ মিত্র, এলগিন রোডে সেই বিরাট বাড়ি’
‘হ্যাঁ, ঋষিদের সঙ্গে আমাদের একটা ফ্যামিলি কানেকশন ছিল। ওদের ছিল জয়েন্ট ফ্যামিলি, ওর এক খুড়তুতো বোন ছিল, খুব সুন্দর দেখতে’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে,- মৈত্রেয়ী। সত্যিই ফাটাফাটি দেখতে ছিল’ দীপক একবার ছদ্ম ভয়ে বাড়ির ভেতরে তাকিয়ে নিল।
‘রাইট, কারেক্ট ক্লু দিলে ঠিক মনে পড়ে যায়, তোদের এখনও ছেলেমানুষী গেল না। দাঁড়া পুরো ঘটনাটা বলছি’ সুবীর গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে নেয়।
একে একে পুরো স্মৃতিচারণ করল সুবীর,-
ঋষিদের বাড়িতে খুব বড় করে সরস্বতী পূজো হত। প্রচুর লোক আসত। ঋষির বন্ধুরাও আসত দল বেঁধে। পার্থ, সুবীর, রজত, নীলাঞ্জন, হিমাদ্রী ও আরও অনেকে। সুধাকরও আসত; কিন্তু চুপচাপ বসে থাকত এক কোনায়। মাঝে মাঝে বেরিয়ে যেত, সিগারেট খেতে, কখনও বিড়িও। ঋষিদের বেশ বড় পরিবার, সারা দিন ধরে খুব আড্ডা চলত। নাচ গানও হত সন্ধ্যে বেলা। ঋষিদের বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা, সেখানে প্যান্ডেল খাটিয়ে স্টেজ বেঁধে নানা অনুষ্ঠান হত। ঋষির বোনদের সঙ্গেও গল্প গুজবের বেশ সুযোগ ছিল। মৈত্রেয়ী ছিল সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু ভীষন গম্ভীর, কারও সঙ্গে কথা বলত না। মনে হত খুব অহংকারি। একদিন স্কুলের পালা সাঙ্গ হল। বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল চারিদিকে। দীপক ল কলেজে, পার্থ গেল মেডিকেল কলেজে, সুবীর আই আই টি, রজত ইকনমিকস নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে, নীলাঞ্জন ও হিমাদ্রী যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল। সুধাকর গেল প্রেসিডেন্সিতে। সুধাকর এমনিতেই একটু আলাদা থাকত বন্ধুদের দল থেকে। রাজনীতি নিয়ে খুব তর্কাতর্কি করতে ভালবাসত। স্কুলে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না। কলেজে গিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল একদিন। মাঝে মধ্যে একটু আধটু খবর কানে আসত। শোনা গেল সুধাকর নাকি একটু উগ্রপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে। ক্লাসে আসছে না, প্রায়ই চলে যাচ্ছে গ্রামে গঞ্জে ফীল্ড ওয়ার্ক করতে। পরীক্ষাও না কি দিচ্ছে না। এমন সময় সেই অবিশ্বাস্য খবর কানে এল। সুধাকর নিখোঁজ; সেটা অবশ্য নতুন খবর নয়, কিন্তু সঙ্গে না কি ঋষির খুড়তুতো বোন মৈত্রেয়ীকেও পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থানা পুলিশ, চারিদিকে ছি ছি পড়ে গেল। একদিন কাগজেও বেরিয়েছিল। ঋষির ছোটকাকা বড় সরকারি অফিসার, নিজের ক্ষমতার জোড়ে খবরটা চেপে দেন। ওনারই উদ্দ্যোগে পুলিশ এক গন্ডগ্রাম থেকে সুধাকর এবং মৈত্রেয়ীকে উদ্ধার করে। না, এখানে একটু ভুল হল। মৈত্রেয়ীকে উদ্ধার করা হল, কিন্তু সুধাকরকে গ্রেফতার করা হল। প্রায় দিন সাতেক পুলিশ হেফাজতে ছিল সুধাকর। শোনা যায় বেশ মারধোর করেছিল পুলিশ। তবে কেস দাঁড় করাতে পারেনি; ঋষির ছোটকাকার যথেষ্ট চেষ্টা সত্ত্বেও। মৈত্রেয়ী বয়ান দিল যে সে নিজের ইচ্ছেয় সুধাকরের সঙ্গে গিয়েছিল।
‘সুধা কিন্তু এই ঘটনার পর কেমন যেন হারিয়ে গেল’ রজত বলল
‘কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল, শুনেছিলাম প্রাইভেটলি বিএসসি দিয়েছিল, বেশ কয়েক বছর পরে’
‘আমার সঙ্গে সুধার ছোড়দার দেখা হয়েছিল একবার, আমেরিকায় এসেছিলেন ছেলের কাছে, ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছিল’ সুবীর আবার জানাল
‘সুধার কথা হয়েছিল?’
‘জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিরক্ত হলেন, বললেন খবর রাখি না’
‘আর মৈত্রেয়ীর কোনও খবর?’
‘ওকে কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নেয় বাড়ির লোকেরা, শুনেছিলাম ওর এক পিসী ওকে লন্ডনে নিজের কাছে নিয়ে যান’
‘বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?’
‘সে রকমই তো শুনেছিলাম, ঐ মেয়ের বিয়ে আটকাবে নাকি’ সুবীর বলে
‘আর ঋষি কোথায় আজকাল?’
‘ক্যালিফোরনিয়ায় আছে, একটি চাইনিজ মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কারও সঙ্গে যোগযোগ নেই’ সুবীর জানায়
‘বেচারা সুধা’ পার্থ একটু আক্ষেপ করে
‘যাক গে, আপদ গেছে, এখন তোর কাছে না আবার চিকিৎসা করাতে আসে’ দীপক বলে
একটু চুপ করে থাকে পার্থ, তারপর বলে,
‘আমি বোধহয় একটা কেলো করেছি?’
‘কি করেছিস?’
‘ওকে বলেছি যে আমাদের গেট টুগেদারের কথা’
‘স্কুলের রি-ইউনিয়ন? ও আসবে না কি?’
‘না রে, সেই রি-ইউনিয়নে দেখলাম ওর কোনও ইন্টারেস্ট নেই, আমি ওকে আমাদের প্রাইভেট গেট টুগেদারের কথা বলেছি। ও আসতে চায়’
‘সেকি, কেন?’
‘বলছিল একটু দেখা হয়ে যেত সবার সঙ্গে, তবে বেশিক্ষণ থাকেতে পারবে না, ওকে আবার ট্রেন ধরে ফিরতে হবে’
‘কোথায় ফিরতে হবে?’
‘ঐ যেখানে ও একটা স্কুল চালায়, কোন এক রিমোট গ্রামে, এখান থেকে কিছুটা ট্রেন, কিছুটা বাস আর বাকিটা বলছিল সাইকেলে বা ভ্যান রিক্সায় যেতে হয়’
‘ওর স্কুল চলে কেমন করে, ফান্ডিং হয় কোথা থেকে?’
‘জানি না রে’
‘ডোনেশন চাইবে না তো?’
‘আমার মনে হয়, চাইবে এবং সে জন্যই দেখা করতে চায়’
‘না পার্থ বেশ বড় কেলো করেছিস’
হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে ওঠে রজত,
‘এই আমি উঠলাম, মা ফোন করতে শুরু করবে আর দেরি হলে’
‘ঠিক আছে, শনিবার দেখা হবে স্কুলের অনুষ্ঠানে’ সুবীর বলে
‘অ্যান্ড, রোববার দিন, এখানে’ দীপক জানায়
‘এই আমিও উঠি, দেখা হচ্ছে শনি ও রোববার দিন’ পার্থও উঠে দাঁড়ায়
গাড়িতে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জহরের ফোন এল,
‘এই দাদা, কোথায় তুই? মা প্রচন্ড চেঁচামেচি শুরু করেছে’
‘এই এসে গেছি, আর ঠিক দশ মিনিট’
‘এ দিকে শিঙারা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, ক্ষিদেও পেয়েছে’
‘ঠিক আছে, ধৈর্য ধর’ হাসল রজত
রাস্তায় ট্র্যাফিক, বাড়ী পৌঁছতে কুড়ি মিনিট লাগল। দরজা খুলে দিল জহর। মা, বাবা এগিয়ে এলেন, মনে হল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বড় ছেলে জন্য। পাপাই ছুটে এল জ্যেঠুর কাছে। শুধু রত্নাকে দেখা গেল না, নিশ্চয়ই ভাসুরের গলার আওয়াজ পেয়ে চায়ের জল চাপিয়েছে।
‘রিমঝিমের কি খবর?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন, অথচ সপ্তাহে কম করেও অন্ততঃ পাঁচ দিন কথা হয় নাত্নীর সঙ্গে,
‘ভাল আছে, পড়াশোনা আর নাচের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত’
‘আর সোনালী, ওর স্কুল কেমন চলছে? ক’জন ছাত্র ছাত্রী এখন?’
‘মন্দ নয়, প্রায় জনা পঁচিশ; আস্তে আস্তে বাড়ছে’
‘একা ম্যানেজ করছে?’
‘না এখন আরও দুজন মহিলা জয়েন করেছে। স্টুডেন্ট আরও আসবে, এখন এদের দেখে, অন্য কাজের মেয়েরাও নিজেদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসছে। আর ওদের খরচ তো নেই, পুরো ব্যাপারটাই চ্যারিটির ওপর চলছে’
‘আঃ এখন এসব রাখো তো’ মা একটু বিরক্তই হলেন
‘দাদাভাই, চা খেয়ে নাও, আমি বাথরুমে তোমার পায়জামা, পাঞ্জাবি আর তোয়ালে রেখে দিয়েছি’ রত্না ট্রে ভর্তি শিঙারা, ঘুগনি, ক্ষীরকদম্ব নিয়ে ঢোকে
‘তুই কি এখন চান করবি?’ জহর জিজ্ঞেস করে, ওর ইচ্ছে এখন দাদার সঙ্গে টানা গল্প করে
‘পাপাই বাবুর ক্রিকেট কেমন চলছে? রিমিদি বলল তুই না কি এখন ভাইস ক্যাপ্টেন’
‘সামনের বছর ক্যাপ্টেন হব’ পাপাই জানায় জ্যেঠুকে।
রাত সাড়ে এগারোটা অব্দি চলল, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা। মাঝখানে সোনালী এবং রিমঝিমও অন লাইন এল, ভিডিও চ্যাট হল সবার সঙ্গে। মা বাবা খুব খুশি। মা তো বলেই দিলেন এবার পুজোয় সবাইকে একসঙ্গে কলকাতায় থাকতে হবে।
রবিবার দীপকের বাড়ি পৌঁছোতে প্রায় বারটা বেজে গেল। মায়ের মান ভাঙিয়ে আসতে দেরিই হল। এদিকে দীপক, সুবীর পার্থ ঘন ঘন ফোন করছে। রজত গিয়ে দেখল সবাই এসে গেছে। আজ রুবি দরজা খুলে দিল,
‘বাব্বাঃ, এত দেরি, সবাই এসে বসে আছে’
দীপকও এগিয়ে এল, হাতে বীয়ারের ঢাউস একটা মাগ।
‘আয় আয়, সবাই এসে গেছে। আর শোন, সেও এসেছে কিন্তু’- চকিতে একটু পেছনে তাকালো দীপক, ‘আর যা ভেবেছিলাম তাই, ডোনেশন...’
‘কে?’ কথাটা শেষ করতে পারল না রজত, ঘর শুদ্ধ লোক হৈ হৈ করে উঠল। পার্থ-সুপর্ণা, সুবীর-অমিতা, হিমাদ্রী-মালা আর নীলাঞ্জন।
‘আরে, দারুণ ব্যাপার, কত দিন পর আবার একসাথে হলাম বল তো?’
‘রজতদা, সোনালী এল না কেন?’ মালা জিজ্ঞেস করে,
‘মেয়ের পরীক্ষা সামনে। তোমার বাবা কেমন আছেন?’
‘কাল সকালে বাড়ি ফিরেছেন। পুরো রেস্টে থাকতে হবে এখন। নার্স রাখা হয়েছে দু-জন। আর বৌদি তো আছেই, দাদা ছুটি নিয়েছে ক’দিন’
প্রথমিক উচ্ছাসের মধ্যে ঘরের মধ্যে আরেকজনের উপস্থিতি খেয়াল করেনি রজত। এক কোনায় অপ্রতিভ মুখে দাঁড়িয়ে আছে একজন। পরনে হাল্কা নীল রঙের প্যান্ট আর ঘিয়ে রঙের বুশ শার্ট; পায়ে সাদামাটা পাম্প শু, মোজা নেই। মাথার চুল খুব ছোট করে ছাঁটা; দাড়ি গোঁফ কামানো। কাঁধে একটা মলিন ব্যাগ।
‘রজত না? চিনতে পারছিস? আমি সুধা, সুধাকর’
‘আরে সুধা, কি করে চিনব বল, কত বছর পর দেখা বল তো, স্কুল ছাড়ার পর তোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কোথায় আছিস?’
‘আচ্ছা কি আশ্চর্য, তোমরা বসবে তো, না কি দাঁড়িয়েই থাকবে?’ রুবির কথায় সবাই বসল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বেশ বড় দীপকের ড্রইং রুম।
‘রজতদা কি খাবে বল? চা, কফি বা অন্য কিছু?’
‘না, আজকে একটু বীয়ারই খাই’
‘গুড, আমি দিচ্ছি’ দীপক বলে
‘তুই কিন্তু একই রকম আছিস রজত। মুম্বাইয়ে আছিস শুনলাম’ সুধাকর জিজ্ঞাসা করে
‘হ্যাঁ, আর তুই?’
‘আমি থাকি অনেক দূরে, শেয়ালদা থেকে ...’
‘এই নে, তোর ড্রিঙ্ক, সুধা সত্যি তুই কিছু নিবি না?’ দীপক জিজ্ঞেস করে
‘স্যান্ডউইচ নিন একটা’ রুবি প্লেট বাড়িয়ে ধরে,
‘না, এই সময়টা আমি কিছু খাই না, সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু একটা খাই, তারপর সেই রাতে শোয়ার আগে’
‘বলিস কি রে, মাঝখানে আর কিচ্ছু না?’
‘জল খাই; এই তো খেলাম এক গ্লাস’ হাসল সুধাকর
‘তোর কি একটা দরকার আছে বলছিলি?’ সুবীর জিজ্ঞেস করে
‘হ্যাঁ আসলে আমি একটা স্কুল চালাই, আর স্কুলটাকে ঘিরে একটা কমিউন মত তৈরি হয়ে গেছে ধীরে ধীরে’
‘বলিস কি রে? ক’জন?’ নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করে
‘খুব একটা বেশি নয়, হলে ভাল হত, কিন্তু অত সামর্থ্য নেই, সেই জন্যই...’
‘কে দেখাশোনা করে?’
‘এই আমি আর আমার স্ত্রী’
‘স্ত্রী? বিয়ে করেছিস না কি?’
‘হ্যাঁ, এই ...’
‘সে কি, কোথাকার মেয়ে রে? তোর সেই গন্ডগ্রামের কোনও মেয়ে?’ দীপক টীপ্পনি কাটে,
‘আঃ ওনাকে কথা বলতে দাও না’ রুবি ধমকায় দীপককে...
‘যাক গে, তোর কি দরকার আছে বলছিলি?’ পার্থ মনে করায়
‘হ্যাঁ, আসলে আমার এই কাজটা পুরো চ্যারিটির ওপর চলে, সেদিন পার্থর চেম্বারে গিয়ে জানলাম তোরা সবাই একসঙ্গে হবি, ভাবলাম তোরা সবাই তো খুব সুপ্রতিষ্ঠিত, যদি কিছু সাহায্য করিস। অবশ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তোদের ওপর, আমি শুধু প্রস্তাবটা দিলাম, যদি তোদের অসুবিধে থাকে তবে আমি মোটেই জোড় করব না’
‘কত এক্সপেক্ট করছিস পার হেড’ নীলাঞ্জন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে
‘আমি কিছু এক্সপেক্ট কারছি না, তোরা যা পারিস’ আবার ম্লান হাসে সুধাকর
‘এক্স্যাক্টলি কি করিস তুই’
‘একটা স্কুল চালাই, একটু বাংলা, একটু অঙ্ক আর সামান্য ইংরিজি অক্ষর জ্ঞান শেখাই, দিনের বেলা ছোটরা, সন্ধ্যের দিকে কয়েকজন বয়স্ক লোকও আসে, তবে বেশিক্ষণ নয়, ইলেকট্রিসিটি তো নেই, আর কেরোসিনের ব্যবহারও একটু নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয়। আর একটু চাষবাসেরও ব্যবস্থা করেছি, অনেকটা কো-অপারেটিভ ফার্মিং-এর মত। চাষ বাসের প্রক্রিয়াও একটু আধুনিক করার চেষ্টা করছি’
‘ক’জন আছে তোর ফার্মে?’
‘ফার্ম ঠিক নয়। সতেরোটি পরিবার আছে এখন, বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক লোক, রান্না বান্না একসাথেই হয়। কমিউনিটি কিচেন করা হয়েছে একটা’
‘বাবাঃ অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’ রুবি বলে বসে
‘আমার কাছে ছবি আছে দেখবেন?’ সুধাকর ব্যাগে হাত ঢোকায়
‘আরে না না’ রুবি একটু অপ্রস্তুত হয়’
‘দেখুন না’ সুধাকর একটা অ্যালবাম এগিয়ে দেয় রুবির দিকে
রুবি অ্যালবামের পাতা ওল্টায়, সুপর্ণা ও মালাও ঝুঁকে পড়ে অ্যালবামের পাতায়।
‘চেক নিবি?’ পার্থ জিজ্ঞেস করে
‘হ্যাঁ, তবে আমাদের ওখানে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। কলকাতায়ও একটা অ্যাকাউন্ট আছে। চেক এনক্যাশ হতে কিছু সময় লাগে। টাকা তুলতে কলকাতায় আসতে হয়’
‘তার মানে তুই ক্যাশ প্রেফার করিস?’ নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করে,
‘না তা নয়, যা তোদের সুবিধে, ক্যাশ হলে একটু সুবিধে হয় আর কি?’
‘একি? আপনার বৌ’এর ছবি নেই?’ হঠাৎ মেয়েদের সমবেত প্রশ্ন শোনা যায়,
‘না, এটাতে শুধু আমাদের কমিউনের ছবি কিছু আছে’
‘ক্যাশ তো সঙ্গে বিশেষ নেই’ একটু বিব্রত বোধ করে রজত
‘একটা উপায় আছে, যদি তোদের আপত্তি না থাকে ... ’ সুধাকরকে আবার একটু অপ্রতিভ দেখায়
‘কি?’ জিজ্ঞেস করে নীলাঞ্জন
‘দীপকের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে একটা এটিএম মেশিন আছে দেখলাম, যদি তোরা ...’
একটু মুখ ব্যাজার করে দীপক,
‘ঠিক আছে, তাই হোক, চল সবাই, কার্ড আছে তো সঙ্গে’ নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করে
‘আমি চেক বই নিয়ে এসেছি’ সুবীর অমিতার দিকে হাত বাড়ায়, অমিতা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা চেক বই ও কলম বের করে,
‘চেকে তোর অসুবিধে হবে জানলে আমি ক্যাশ নিয়েই আসতাম, আসলে এখানকার অ্যাকাউন্টে আমার এটিএম কার্ডটা নেওয়া হয়নি, থাকি না তো।’
‘না না ঠিক আছে, কোনও অসুবিধে হবে না’
‘ঠিক আছে আমরা তবে নিয়ে আসছি’ পার্থ, দীপক, রজত এবং নীলাঞ্জন বেরিয়ে যায়।
‘আমি কি সঙ্গে আসব?’ সুধাকর জিজ্ঞেস করে,
‘না তুই দাঁড়া, আমরা এখুনি আসছি’ দীপক বলে, নীচে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একটু আলোচনা করা দরকার কত দেওয়াটা উচিৎ হবে, সুধাকর সঙ্গে থাকলে অসুবিধে।
সুবীর চেক লিখে সই করে, তুলে দেয় সুধাকরের হাতে। সুধাকর চেকের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকায় সুবীরের দিকে,
‘এত?’
‘ঠিকই আছে, ভাল কাজেই তো খরচ করবি তুই। তা ছাড়া আমার এই অ্যাকাউন্ট থেকে বিশেষ একটা খরচ হয় না,
‘অনেক অনেক ধন্যবাদ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ’ খুব কৃতজ্ঞ দেখায় সুধাকরকে, চেকটা খুব যত্ন করে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।
‘এর পর আবার এলে বৌকে নিয়ে আসবেন কিন্তু। আমরা আলাপ করব না?’ রুবি বলে
‘দেখি, ও আবার বিশেষ বেরোয় না।’
দরজা খোলাই ছিল, একে একে ঢুকল দীপক, রজত ও নীলাঞ্জন। প্রত্যেকের হাতে কিছু নগদ টাকা, একে একে এগিয়ে দেয় সুধাকরের দিকে, একটু অপ্রস্তুত হাসি সুধাকরের মুখে,
‘দাঁড়া, তোদের রসিদ কেটে দিচ্ছি’ ব্যাগের ভেতরে হাত ঢোকায় সুধাকর, এটা ওটা সরায়, ঘাঁটা ঘাঁটি করে,
‘রসিদের বইটা বোধহয় আনতে ভুলে গেছি রে’ আরও অপ্রস্তুত দেখায় সুধাকরকে,
‘যাক গে, পরে পাঠিয়ে দিস’ রজত বলে
‘হ্যাঁ তাই করতে হবে। দাঁড়া কাগজে লিখে নি, পরে পাঠিয়ে দেব’ মাটিতে প্রায় মিশে যায় সুধাকর
হঠাৎ যেন কোথাও একটা তাল কেটে যায়। চুপচাপ বসে থাকে সবাই। এক ফালি কাগজে কিছু লেখালেখি করে উঠে দাঁড়ায় সুধাকর,
‘আমি আজ উঠি রে’ তারপর একটু থেমে বলে ‘অনেক ধন্যবাদ তোদেরকে ...’
‘না না ঠিক আছে, তুই এত ফর্মালিটি করছিস কেন?’
‘না ফর্মালিটি নয়, মানে ... ইয়ে রিসিট বুকটা ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গেছি, আমি পোস্টে পাঠিয়ে দেব পার্থর ঠিকানায়’
ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় সুধাকর।
দীপক প্রথমে মুখ খোলে,
‘আর রিসিট? টাকাটা ওর পকেটেই গেল ভেবে নে। আমি শিওর, এই কমিউন টমিউন সব ভাঁওতা ...’
‘তুমি সব সময় নেগেটিভ সাইডটা দেখ কেন বল তো’ রুবি মুখ ঝামটা দেয়
‘দেখো ওকালতি করি, এসব আমার দেখা আছে’
‘ছাড় তো, হতেও পারে জেনুইন, এনি ওয়ে, উই হ্যাভ ডান আওয়ার বিট। এখন ইট ইজ় আপ টু সুধা। আমরা পুরনো বন্ধুকে ট্রাস্ট করেছি, সেটাই আমাদের ডিউটি ছিল। নাও লেটস হ্যাভ সাম ফান’ সুবীর ব্যাপারটা হাল্কা করার চেষ্টা করে।
‘তোমরা ড্রিঙ্ক শেষ কর, আমি লাঞ্চের ব্যাবস্থা করি।’
‘চেহারাটা কি রকম খারাপ হয়ে গেছে, তাই না?’
‘বেশ বুড়ো বুড়ো লাগছিল দেখতে’
‘আ হা হা, তোমাদের যেন ভরা যৌবন?’
‘যাক গে, আর তোর কি খবর বল সুবীর, কদিন আছিস?’
দারুন আড্ডা শুরু হল। সবারই কিছু কিছু অর্থদন্ড হয়েছে। দীপক মনে করে একদিকে ভালই হয়েছে, আর মুখ দেখাবে না সুধাকর, রিসিট টিসিটের কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। মোটামুটি সবাই যেন মেনেই নিল দীপকের কথা। প্রচন্ড হৈ চৈ শুরু হল, জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হল, সুধাকরের কথা ভুলেই গেল সবাই।
মুম্বাই পৌঁছে দিন প্রথম সপ্তাহ অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। শনি এবং রবিবার ছুটি থাকে রজতের, কিন্তু অফিস যেতে হল। রিমঝিমের খুব ইচ্ছে ছিল বাবা কোলকাতা থেকে ফিরলে, উইক এন্ডে বাইরে লাঞ্চ করতে যাবে। সম্ভব হল না রজতের কাজের চাপে। বেশ একটু অভিমান হল মেয়ের। মেয়ের মান ভাঙাতে কথা দিল রজত যে সামনের শনিবার বাইরে কোথাও লাঞ্চে যাওয়া হবে। শুক্রবার সময় মত বাড়ি এল রজত। রাত্রে ডিনার টেবিলে বসে ঠিক হল ওহ-ক্যালকাটায় লাঞ্চে যাওয়া হবে শনিবার। রিমঝিমই প্রস্তাবটা দিল। পাপাই কোলকাতার ওহ-ক্যালকাটায় বার দুয়েক খেয়েছে, কাকামনি ও কাম্মার সঙ্গে, ফোন করে জানিয়েছেও রিমিদিকে।
খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়িই শুতে যাওয়া হল। পরের দিন তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। রিমঝিম চলে গেল নিজের ঘরে। সোনালীও নিজের দিকের বেডসাইড টেবিলের লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। রজত সেদিনের খবরের কাগজটা টেনে নিল। শুতে যাবার আগে কিছু একটা না পড়লে আবার রজতের ঘুম আসেনা।
হঠাৎ উঠে বসল সোনালী,
“এই সরি, তোমার একটা চিঠি এসেছে, ক্যুরিয়ারে, কোলকাতা থেকে”
“সে কি, কে পাঠিয়েছে?”
“তোমার বন্ধু পার্থ, আমি তোমাকে অফিসে ফোন করেছিলাম, তুমি মিটিঙে ছিলে, আমি আর মোবাইলে ফোন করিনি, সরি ...”
“কোথায় চিঠি?”
“তোমার বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে আছে”
খাম ছিঁড়ে ভেতরের চিঠি বের করল রজত। শুধু চিঠি নয়, একটা রসিদও আছে সঙ্গে। ওপরে একটা ইয়েলো স্টিকার, তাতে পার্থর একটা ছোট্ট নোট,-
‘সঙ্গের চিঠিটা একটি লোক দিয়ে গেছে, লোকটি সুধার গ্রাম থেকে এসেছিল। প্রত্যেকের নামে আলাদা চিঠি; চিঠিটা মন দিয়ে পড়িস।’
চিঠিটি একটি লেটারহেডে ইংরিজিতে টাইপ করা। পুরনো টাইপ রাইটার, কিছু অক্ষর ভাঙা। খুব সস্তার কাগজ মনে হচ্ছে। লেটারহেডে ইংরিজিতে লেখা রয়েছে,
ডঃ সুধাকর অধিকারী
ডিরেক্টর, আদর্শ কো-অপারেটিভ সোসাইটি
পোস্ট অফিস – কাশবনি
চিঠির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রজত। পাশে সোনালী চোখ বুজে শুয়ে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। চিঠিতে মন দেয় রজত,
প্রিয় মিঃ সেন,
প্রথমেই আমার স্বামীর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এই চিঠি তাঁরই লেখার কথা, কিন্তু অনিবার্য কারণ বশতঃ ওনাকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে যেতে হয়েছে।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার আর্থিক সাহায্যের জন্য। আমাদের এই প্রতিষ্ঠান আমাদের কিছু সঞ্চয় এবং আপনাদের মত কিছু মুষ্টিমেয় উদার বন্ধুর সাহায্যের ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে কিছু সরকারি এবং বেসরকারি ফান্ডিং পাবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। গত মাসে দিল্লীতে মিনিস্ট্রি অব রুরাল ডেভেলপমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সম্মেলনে গিয়েছিলেন আপনাদের বন্ধু; সেখানে ওনাকে আমাদের এই কাজের ওপর একটি পেপার প্রেজ়েন্ট করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। পেপারটি খুব সমাদৃত হয় এবং কিছু বিদেশী প্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁদের আমন্ত্রণে আগামী সপ্তাহে ব্রাসেলসে একটা সম্মলনে যাচ্ছেন আপনার বন্ধু। ভিসা এবং ফ্লাইট বুকিং সংক্রান্ত ব্যাপারে ক’দিনের জন্য দিল্লী যেতে হয়েছে। তাই এই চিঠি আমাকে লিখতে অনুরোধ জানিয়ে গেছেন।
আমাদের এই প্রকল্পটি একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। এটার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। আমার স্বামী ছাত্র জীবনে এই অঞ্চলে যাওয়া আসা করতেন এবং সীমিত ক্ষমতার মধ্যে এই অঞ্চলের মানুষদের নানা রকম সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। সেই সময় আমিও একবার ওনার সঙ্গে এসেছিলাম এবং এই নিয়ে একটা বিশ্রী রকমের রটনায় আমাকে দেশ ছাড়া হতে হয় এবং আমার স্বামীরও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। আমি লন্ডনে আমার লেখাপড়া শেষ করি। কয়েক বছর পর আপনার বন্ধুও অনেকটা আমার চেষ্টাতেই লন্ডন আসেন এবং তাঁর নিজের পড়াশোনা শেষ করেন। সেখানেই আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই এবং কয়েক বছর চাকরিও করি। খুব সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে দেশে ফিরি আমরা। ধীরে ধীরে গড়ে তুলছি আমাদের এই স্বপ্ন।
যদি পারেন, একবার আসবেন, সপরিবারে। আসতে একটু কষ্ট হবে, কিন্তু ক’দিন থাকতে হয়তো খারাপ লাগবে না। জায়গাটা বড় শান্ত, বড় নিষ্পাপ।
আপনাকে আমার আলাদা ভাবে মনে পড়ছে না। তবে দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারব। আপনারা আমার জ্যাঠতুতো দাদা ঋষিরাজ মিত্রর সঙ্গে আমাদের বাড়ী আসতেন, সরস্বতী পূজোর সময়। সেই সময় আপনার বন্ধু অর্থাৎ আমার স্বামীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়নি। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি দেখা এবং আলাপ হবে।
শুভেচ্ছা রইল।
সাঃ মৈত্রেয়ী
(ডঃ মৈত্রেয়ী মিত্র অধিকারী)
কিছুক্ষণ সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে রজত। পাশে সোনালী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু পরে চিঠিটা সযত্নে ভাঁজ করে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে রিডিং লাইটটা নিবিয়ে দেয়। চোখ বোঁজে।
কাল সকালে উঠেই পুরো ঘটনাটা বলতে হবে সোনালীকে। সোনালী বুঝবে ব্যাপারটা। আর কেউ যাক না যাক, রজত আর সোনালী যাবেই কাশবনি, সুধা আর মৈত্রেয়ীর স্বপ্নরাজ্যে।