Wednesday 6 July 2022

অদ্ভুত সেই লোকটা

 

প্লেন দমদমের মাটি ছুঁতেই প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করল রজত। হাতে ধরে রইল। প্লেন থামলে ফোন অন করবে। অন্যান্য যাত্রীরা ততক্ষণে ফোন অন করে বেশ চেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। সীট বেল্ট খুলে, দাঁড়িয়ে উঠেছে। এক হাতে ফোন, অন্য হাতে ওপরের হ্যাচ খুলে ব্যাগ ট্যাগ বের করছে। খুব বিরক্ত বোধ করে রজত, ধৈর্যর ভীষণ অভাব এই লোকগুলোর। নামবে তো সবাই প্লেনের দরজা খুললে। রজত বসে থাকে সীটে, তাড়া নেই। প্লেন অবশেষে থামল। রজত ফোনটা অন করে, অপেক্ষা করে সিগনালের। প্লেনের দরজা খোলার পর যাত্রীরা নামতে শুরু করে। ভীড় একটু হাল্কা হতে, উঠে দাঁড়ায় রজত। লাগেজ বলতে শুধু একটা মোটা ব্রীফকেস, তাতে অফিসের ফাইলপত্র, শেভিং সেট,

টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, কলম আর একটা ছোট্ট ল্যাপটপ। জামা কাপড় নেই। কয়েক সেট জামা কাপড় বাড়িতে রাখা আছে, মায়ের যত্নে; একটা স্যুটও আছে। অফিসের কাজে প্রায়ই কলকাতা আসতে হয় রজতকে, তাই এই ব্যবস্থা।


অ্যারাইভাল লাউঞ্জে এসে প্রথমে একটা এসএমএস করল সোনালীকে। সোনালী রিমঝিমকেও জানিয়ে দেবে। রিমঝিম আবার বাবার কাছ থেকে এসএমএস না পেলে অভিমান করে। কিন্তু ও বোধহয় এখন কলেজে পৌঁছে গেছে, বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। এরপর বাড়িতে ফোন করল রজত, মা-ই ধরলেন,

‘কি রে এত দেরি? আমি তো সেই তখন থেকে তোর ফোনের জন্য বসে আছি’

‘না, কোথায় দেরি? ঠিক সময়ে তো এলাম, তোমার চিন্তা করাটা একটা বাতিক হয়ে যাচ্ছে’

‘এসেই ঝগড়া শুরু করলি, শোন পাবদা মাছ এনেছে তোর বাবা, বড়ি দিয়ে হাল্কা ঝোল করছি, দুপুরে খাবি তো?’

‘না, আমি সোজা অফিস যাচ্ছি, ওখানেই লাঞ্চ করব, তোমায় তো কাল বললাম’

‘ঠিক আছে, অফিসের পর তাড়াতাড়ি চলে আসিস, জহরও বলছে অফিস থেকে ফেরার সময় ফুলকপির শিঙারা নিয়ে আসবে, একসঙ্গে চা খাবে তোর সঙ্গে’

‘ও হ্যাঁ শোন মা, আমি আসার সময় একটু দীপকের বাড়ি হয়ে আসব, একটু দরকার আছে। জহরকে আমি ফোন করছি’

‘ঠিক আছে দেরি করিস না। সোনালীকে ফোন করেছিস?’

‘এসএমএস করেছি, পরে ফোন করব, ও এই সময়টা ব্যস্ত থাকে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে, ঠিক আছে মা, এখন রাখছি, বাবার সঙ্গে পরে কথা বলব, আমার অফিসের ড্রাইভার এসে গেছে’।


রামকিশোর পুরনো ড্রাইভার, সেন সাহেবকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে আসে, হাত থেকে ব্রীফকেসটা নেয়। গাড়ীতে উঠে দীপককে ফোন করল রজত। ওদের স্কুলের শতবার্ষিকী এ বছর, বিরাট অনুষ্ঠান। এই সুযোগে দীপক নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে একটা রিইউনিয়নের ব্যাবস্থা করছে নিজের বাড়িতে। সুবীর এসেছে আমেরিকা থেকে, নীলাঞ্জনের আজ বিকেলে দিল্লী থেকে পৌঁছনোর কথা, হিমাদ্রী আসবে কাতার থেকে। পার্থ তো এখন কলকাতায়ই থাকে, লন্ডন থেকে ফিরে এসে চেম্বার খুলে বেশ ভাল প্র্যাকটিস জমিয়ে নিয়েছে। অনেক দিন পর বেশ জমিয়ে আড্ডা হবে।

‘কি রে, পৌঁছে গেছিস?’ দীপকের গলা শোনা গেল

‘হ্যাঁ। জাস্ট গাড়িতে উঠেছি’

‘ম্যানেজ করলি তবে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নো বিগ ডীল’ রজত একটু হাল্কা হাসে

‘ঠিক আছে, বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় একটু ঘুরে যাস, সুবীরও আসবে, ব্যাটা আবার দাড়ি রেখেছে, আর মাথা পুরো কামানো’

‘বলিস কি রে?’

‘আয় দেখবি, একেবারে কিম্ভূতকিমাকার চেহারা করেছে। ক’দিন ম্যানেজ করলি?’

‘ধর পাঁচ দিন, আজ বুধবার, সোমবার মর্নিং ফ্লাইটে ফিরব, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা অফিস’

‘গুড, ভেরি গুড, তাড়াতাড়ি চলে আসিস’

‘হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে বেশিক্ষণ বসব না বুঝলি, মা আবার ওয়েট করে থাকবে’

‘ওকে নো প্রবলেম, সী ইউ দেন’

‘সী ইউ, বাই’


অফিসে সময়টা ঝড়ের মত কেটে গেল, পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে মীটিং, প্রেজ়েন্টেশন, ক্লায়েন্ট ফীডব্যাক ইত্যাদি। লাঞ্চ ব্রেকে কোনও রকমে সোনালীকে ফোন করে রিমঝিমকে ফোন করল, মেয়ের যা অভিমান। রিমঝিম ধরল না, বোধহয় ক্লাস চলছে, ফোন সাইলেন্ট মোডে আছে। ভালই হল, পরে মিসড কল দেখে বুঝবে বাবা ফোন করেছিল। মাঝখানে জহর ফোন করেছিল, খুব ইচ্ছে দাদাকে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা একটু ক্লাবে যাবে। বছর দুয়েক আগে কলকাতার এক অভিজাত ক্লাবের মেম্বার হয়েছে জহর। রজত বারণ করে, প্রথম দিনটা বাড়িতেই কাটানো উচিৎ। মা বাবা পথ চেয়ে বসে থাকবেন। বাবার সঙ্গেও মাঝে একবার কথা হয়ে গেছে। দীপক আরও একবার ফোন করল; ও চারটের মধ্যে বাড়ি চলে আসবে, সুবীর আসবে সাড়ে চারটে নাগাদ, তা ছাড়া পার্থ চেম্বারে যাওয়ার আগে একবার ঢুঁ মেরে যাবে বলেছে।


সোয়া চারটেতে রজত বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। একটু ক্লান্ত লাগছে। সেই ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সান্তাক্রুজ এয়ারপোর্ট, তারপর কলকাতার ফ্লাইট, সেখান থেকে সোজা অফিস, সারাদিন বেশ ধকল গেছে। অফিসের গাড়িটা রইল সঙ্গে, ড্রাইভার রামকিশোর সেন সাহেবের ডিউটি করতে ভালবাসে। সেন সাহেব ফিরে যাবার সময় দরাজ হাতে বকশিশ দিয়ে যান। দীপকের বাড়িটা অফিস থেকে বাড়ি যাওয়ার পথেই পড়ে, রামকিশোর চেনে।


দীপকের বাড়িতে পৌঁছতেই দীপক নিজেই দরজা খুলে দিল। সুবীর ও পার্থ বেশ জমিয়ে বসেছে। সুবীরকে দেখে আঁতকে উঠল রজত। প্রচন্ড মোটা হয়েছে, চুল আগেই বেশ পাতলা হয়ে আসছিল, এখন পুরো মাথা কামিয়ে ফেলেছে। তার মধ্যে আবার গোঁফ আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। পার্থ একই আছে, দু বছর আগে পার্থ যখন লন্ডন থেকে ফিরে এখানে ডাক্তারি শুরু করল, তখনও একবার দেখা হয়েছে। কিন্তু তারপর বার দুয়েক কলকাতায় এলেও ব্যস্ততার জন্য দেখা হয়নি, তবে ফোনে কথা হয়েছে।

‘কি হুলিয়া বানিয়েছিস রে?’ রজত জিজ্ঞেস করে সুবীরকে,

‘আর বলিস না, ডায়েটিং করেও কিছু হচ্ছে না’ সুবীর মুখটাকে করুণ করে ফেলে

‘শুধু খাওয়া কমালেই হবেনা গুরু, মাল খাওয়াটাও কমাতে হবে’ পার্থ টিপ্পনি কাটে

‘দেখ ডাক্তারি ফলাস না, কি খাবি বল, ঠান্ডা বীয়ার খাচ্ছি আমরা’ দীপক জিজ্ঞেস করে

‘না রে, বাড়ি যাইনি এখনও, আমাকে বরং একটু চা খাওয়া, নো মিল্ক, নো শুগার’ রজত জানায়

‘ঠিক আছে তোরা বোস, আমি বলে আসছি,’

‘রুবি কোথায়? আর রনি?’

‘রুবি এই সময়টা ছাত্র ছাত্রী নিয়ে ব্যস্ত থাকে, গান শেখায় জানিস তো?’

‘আর রনি?’

‘রনি ম্যাথস টিউশন নিতে গেছে, একটু দেরি হবে ফিরতে’ দীপক ভেতরে চলে যায়


আড্ডা জমে ওঠে। রুবি মাঝখানে এল একবার, আপ্যায়ন ঠিক মত হচ্ছে কি না তদারক করে গেল। ঠিক হল রবিবার সকালে দীপকের বাড়িতেই লাঞ্চে আসবে সবাই। সুবীর আর পার্থ সস্ত্রীক আসবে, হিমাদ্রীর ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মালাও এসেছে কাতার থেকে, কিন্তু মালার বাবার কদিন আগে একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, এখনও হাসপাতালে। নীলাঞ্জন একাই আসবে দিল্লী থেকে, রুমার একটা কনফারেন্স আছে, আসতে পারবে না। আর রজত তো একাই এসেছে; রিমঝিমের ক্লাস চলছে, সোনালী মেয়েকে একা ফেলে আসবে না।


‘এই শোন, তোদের একটা কথা বলতে ভুলে গেছি’ পার্থ বলে ওঠে

‘কি?’ সবাই তাকায় পার্থর দিকে

‘সেদিন হঠাৎ সুধা এসেছিল’

‘সুধা? সে আবার কে?”

‘আরে, আমাদের সুধা, সুধাকর, মনে নেই’

‘সুধাকর অধিকারি? সেই অদ্ভূত লোকটা? সে আবার কোত্থেকে উদয় হল? আর তোর কাছে?’

‘বলল কার কাছে খবর পেয়েছে আমি এখন কলকাতায় প্র্যাকটিস করছি। ওর হাঁটুতে একটা ব্যাথা  চলছে, খুঁড়িয়ে হাটছিল। এক্স-রে করতে বলেছি, মনে হয়না সিরিয়াস কিছু’

‘স্ট্রেঞ্জ, সেই সু-ধা-ক-র এতদিন পর, কোথায় আছে? করেই বা কি?’

‘রিমোট কোন একটা গ্রামে একটা স্কুল চালায় বলল’

‘স্কুল চালায়? সেই এলেম আছে না কি?’

‘তোকে ফীস দিয়েছে?’

‘যাঃ, ক্লাসমেট, ফী নেব কি?’

‘ঐ জন্যই তোর কাছে এসেছিল, বিনে পয়সার চিকিৎসা’ দীপক বলল

‘যাঃ, তা কেন হবে?’

‘কি রকম একটু পাগলাটে টাইপ ছিল, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াত, একদিন তো সারা রাত কোন একটা বস্তিতে রাত কাটিয়েছিল।’ রজত মনে করানোর চেষ্টা করে

‘হ্যাঁ স্কুল থকে বার কয়েক ওয়ার্নিংও দেওয়া হয়েছিল’

‘একজ়েক্টলি, একগাদা স্ট্রীট আর্চিন এনে হাজির করেছিল অ্যানুয়েল ডে’র দিন’

‘শুধু তাই নয় শুনেছিলাম ড্রাঙ্কও ছিল, রাইট?’

‘তাই তো শোনা গিয়েছিল’

‘স্কুলের পর ও প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছিল না?’ রজত জিজ্ঞেস করে

‘হ্যাঁ সাম হাও হায়ার সেকেন্ডারিতে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিল’ সুবীর মনে করায়

‘কি যেন একটা স্ক্যান্ডেল হয়েছিল না!’ পার্থ মনে করার চেষ্টা করে

‘দাঁড়া, পুরো ব্যাপারটা আমার মনে আছে। ঋষিকে মনে আছে তোদের?’ সুবীর বলে

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঋষিরাজ মিত্র, এলগিন রোডে সেই বিরাট বাড়ি’

‘হ্যাঁ, ঋষিদের সঙ্গে আমাদের একটা ফ্যামিলি কানেকশন ছিল। ওদের ছিল জয়েন্ট ফ্যামিলি, ওর এক খুড়তুতো বোন ছিল, খুব সুন্দর দেখতে’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে,- মৈত্রেয়ী। সত্যিই ফাটাফাটি দেখতে ছিল’ দীপক একবার ছদ্ম ভয়ে বাড়ির ভেতরে তাকিয়ে নিল। 

‘রাইট, কারেক্ট ক্লু দিলে ঠিক মনে পড়ে যায়, তোদের এখনও ছেলেমানুষী গেল না। দাঁড়া পুরো ঘটনাটা বলছি’ সুবীর গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে নেয়।

 

একে একে পুরো স্মৃতিচারণ করল সুবীর,-


ঋষিদের বাড়িতে খুব বড় করে সরস্বতী পূজো হত। প্রচুর লোক আসত। ঋষির বন্ধুরাও আসত দল বেঁধে। পার্থ, সুবীর, রজত, নীলাঞ্জন, হিমাদ্রী ও আরও অনেকে। সুধাকরও আসত; কিন্তু চুপচাপ বসে থাকত এক কোনায়। মাঝে মাঝে বেরিয়ে যেত, সিগারেট খেতে, কখনও বিড়িও। ঋষিদের  বেশ বড় পরিবার, সারা দিন ধরে খুব আড্ডা চলত। নাচ গানও হত সন্ধ্যে বেলা। ঋষিদের বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা, সেখানে প্যান্ডেল খাটিয়ে স্টেজ বেঁধে নানা অনুষ্ঠান হত। ঋষির বোনদের সঙ্গেও গল্প গুজবের বেশ সুযোগ ছিল। মৈত্রেয়ী ছিল সবচেয়ে সুন্দরী, কিন্তু ভীষন গম্ভীর, কারও সঙ্গে কথা বলত না। মনে হত খুব অহংকারি। একদিন স্কুলের পালা সাঙ্গ হল। বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল চারিদিকে। দীপক ল কলেজে, পার্থ গেল মেডিকেল কলেজে, সুবীর আই আই টি, রজত ইকনমিকস নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে, নীলাঞ্জন ও হিমাদ্রী যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল। সুধাকর গেল প্রেসিডেন্সিতে। সুধাকর এমনিতেই একটু আলাদা থাকত বন্ধুদের দল থেকে। রাজনীতি নিয়ে খুব তর্কাতর্কি করতে ভালবাসত। স্কুলে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না। কলেজে গিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল একদিন। মাঝে মধ্যে একটু আধটু খবর কানে আসত। শোনা গেল সুধাকর নাকি একটু উগ্রপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে। ক্লাসে আসছে না, প্রায়ই চলে যাচ্ছে গ্রামে গঞ্জে ফীল্ড ওয়ার্ক করতে। পরীক্ষাও না কি দিচ্ছে না। এমন সময় সেই অবিশ্বাস্য খবর কানে এল। সুধাকর নিখোঁজ; সেটা অবশ্য নতুন খবর নয়, কিন্তু সঙ্গে না কি ঋষির খুড়তুতো বোন মৈত্রেয়ীকেও পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থানা পুলিশ, চারিদিকে ছি ছি পড়ে গেল। একদিন কাগজেও বেরিয়েছিল। ঋষির ছোটকাকা বড় সরকারি অফিসার, নিজের ক্ষমতার জোড়ে খবরটা চেপে দেন। ওনারই উদ্দ্যোগে পুলিশ এক গন্ডগ্রাম থেকে সুধাকর এবং মৈত্রেয়ীকে উদ্ধার করে। না, এখানে একটু ভুল হল। মৈত্রেয়ীকে উদ্ধার করা হল, কিন্তু সুধাকরকে গ্রেফতার করা হল। প্রায় দিন সাতেক পুলিশ হেফাজতে ছিল সুধাকর। শোনা যায় বেশ মারধোর করেছিল পুলিশ। তবে কেস দাঁড় করাতে পারেনি; ঋষির ছোটকাকার যথেষ্ট চেষ্টা সত্ত্বেও। মৈত্রেয়ী বয়ান দিল যে সে নিজের ইচ্ছেয় সুধাকরের সঙ্গে গিয়েছিল।


‘সুধা কিন্তু এই ঘটনার পর কেমন যেন হারিয়ে গেল’ রজত বলল

‘কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল, শুনেছিলাম প্রাইভেটলি বিএসসি দিয়েছিল, বেশ কয়েক বছর পরে’

‘আমার সঙ্গে সুধার ছোড়দার দেখা হয়েছিল একবার, আমেরিকায় এসেছিলেন ছেলের কাছে, ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছিল’ সুবীর আবার জানাল

‘সুধার কথা হয়েছিল?’

‘জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিরক্ত হলেন, বললেন খবর রাখি না’

‘আর মৈত্রেয়ীর কোনও খবর?’

‘ওকে কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নেয় বাড়ির লোকেরা, শুনেছিলাম ওর এক পিসী ওকে লন্ডনে নিজের কাছে নিয়ে যান’

‘বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?’

‘সে রকমই তো শুনেছিলাম, ঐ মেয়ের বিয়ে আটকাবে নাকি’ সুবীর বলে

‘আর ঋষি কোথায় আজকাল?’

‘ক্যালিফোরনিয়ায় আছে, একটি চাইনিজ মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কারও সঙ্গে যোগযোগ নেই’ সুবীর জানায়

‘বেচারা সুধা’ পার্থ একটু আক্ষেপ করে

‘যাক গে, আপদ গেছে, এখন তোর কাছে না আবার চিকিৎসা করাতে আসে’ দীপক বলে

একটু চুপ করে থাকে পার্থ, তারপর বলে,

‘আমি বোধহয় একটা কেলো করেছি?’

‘কি করেছিস?’

‘ওকে বলেছি যে আমাদের গেট টুগেদারের কথা’

‘স্কুলের রি-ইউনিয়ন? ও আসবে না কি?’

‘না রে, সেই রি-ইউনিয়নে দেখলাম ওর কোনও ইন্টারেস্ট নেই, আমি ওকে আমাদের প্রাইভেট গেট টুগেদারের কথা বলেছি। ও আসতে চায়’

‘সেকি, কেন?’

‘বলছিল একটু দেখা হয়ে যেত সবার সঙ্গে, তবে বেশিক্ষণ থাকেতে পারবে না, ওকে আবার ট্রেন ধরে ফিরতে হবে’

‘কোথায় ফিরতে হবে?’

‘ঐ যেখানে ও একটা স্কুল চালায়, কোন এক রিমোট গ্রামে, এখান থেকে কিছুটা ট্রেন, কিছুটা বাস আর বাকিটা বলছিল সাইকেলে বা ভ্যান রিক্সায় যেতে হয়’

‘ওর স্কুল চলে কেমন করে, ফান্ডিং হয় কোথা থেকে?’

‘জানি না রে’

‘ডোনেশন চাইবে না তো?’

‘আমার মনে হয়, চাইবে এবং সে জন্যই দেখা করতে চায়’

‘না পার্থ বেশ বড় কেলো করেছিস’


হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে ওঠে রজত,

‘এই আমি উঠলাম, মা ফোন করতে শুরু করবে আর দেরি হলে’

‘ঠিক আছে, শনিবার দেখা হবে স্কুলের অনুষ্ঠানে’ সুবীর বলে

‘অ্যান্ড, রোববার দিন, এখানে’ দীপক জানায়

‘এই আমিও উঠি, দেখা হচ্ছে শনি ও রোববার দিন’ পার্থও উঠে দাঁড়ায়


গাড়িতে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জহরের ফোন এল,

‘এই দাদা, কোথায় তুই? মা প্রচন্ড চেঁচামেচি শুরু করেছে’

‘এই এসে গেছি, আর ঠিক দশ মিনিট’

‘এ দিকে শিঙারা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, ক্ষিদেও পেয়েছে’

‘ঠিক আছে, ধৈর্য ধর’ হাসল রজত

রাস্তায় ট্র্যাফিক, বাড়ী পৌঁছতে কুড়ি মিনিট লাগল। দরজা খুলে দিল জহর। মা, বাবা এগিয়ে এলেন, মনে হল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বড় ছেলে জন্য। পাপাই ছুটে এল জ্যেঠুর কাছে। শুধু রত্নাকে দেখা গেল না, নিশ্চয়ই ভাসুরের গলার আওয়াজ পেয়ে চায়ের জল চাপিয়েছে।


‘রিমঝিমের কি খবর?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন, অথচ সপ্তাহে কম করেও অন্ততঃ পাঁচ দিন কথা হয় নাত্নীর সঙ্গে,

‘ভাল আছে, পড়াশোনা আর নাচের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত’

‘আর সোনালী, ওর স্কুল কেমন চলছে? ক’জন ছাত্র ছাত্রী এখন?’

‘মন্দ নয়, প্রায় জনা পঁচিশ; আস্তে আস্তে বাড়ছে’

‘একা ম্যানেজ করছে?’

‘না এখন আরও দুজন মহিলা জয়েন করেছে। স্টুডেন্ট আরও আসবে, এখন এদের দেখে, অন্য কাজের মেয়েরাও নিজেদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসছে। আর ওদের খরচ তো নেই, পুরো ব্যাপারটাই চ্যারিটির ওপর চলছে’

‘আঃ এখন এসব রাখো তো’ মা একটু বিরক্তই হলেন

‘দাদাভাই, চা খেয়ে নাও, আমি বাথরুমে তোমার পায়জামা, পাঞ্জাবি আর তোয়ালে রেখে দিয়েছি’ রত্না ট্রে ভর্তি শিঙারা, ঘুগনি, ক্ষীরকদম্ব নিয়ে ঢোকে

‘তুই কি এখন চান করবি?’ জহর জিজ্ঞেস করে, ওর ইচ্ছে এখন দাদার সঙ্গে টানা গল্প করে

‘পাপাই বাবুর ক্রিকেট কেমন চলছে? রিমিদি বলল তুই না কি এখন ভাইস ক্যাপ্টেন’ 

‘সামনের বছর ক্যাপ্টেন হব’ পাপাই জানায় জ্যেঠুকে।


রাত সাড়ে এগারোটা অব্দি চলল, খাওয়া দাওয়া, আড্ডা। মাঝখানে সোনালী এবং রিমঝিমও অন লাইন এল, ভিডিও চ্যাট হল সবার সঙ্গে। মা বাবা খুব খুশি। মা তো বলেই দিলেন এবার পুজোয় সবাইকে একসঙ্গে কলকাতায় থাকতে হবে।


রবিবার দীপকের বাড়ি পৌঁছোতে প্রায় বারটা বেজে গেল। মায়ের মান ভাঙিয়ে আসতে দেরিই হল। এদিকে দীপক, সুবীর পার্থ ঘন ঘন ফোন করছে। রজত গিয়ে দেখল সবাই এসে গেছে। আজ রুবি দরজা খুলে দিল,

‘বাব্বাঃ, এত দেরি, সবাই এসে বসে আছে’

দীপকও এগিয়ে এল, হাতে বীয়ারের ঢাউস একটা মাগ।

‘আয় আয়, সবাই এসে গেছে। আর শোন, সেও এসেছে কিন্তু’- চকিতে একটু পেছনে তাকালো দীপক, ‘আর যা ভেবেছিলাম তাই, ডোনেশন...’ 

‘কে?’ কথাটা শেষ করতে পারল না রজত, ঘর শুদ্ধ লোক হৈ হৈ করে উঠল। পার্থ-সুপর্ণা, সুবীর-অমিতা, হিমাদ্রী-মালা আর নীলাঞ্জন।

‘আরে, দারুণ ব্যাপার, কত দিন পর আবার একসাথে হলাম বল তো?’

‘রজতদা, সোনালী এল না কেন?’ মালা জিজ্ঞেস করে,

‘মেয়ের পরীক্ষা সামনে। তোমার বাবা কেমন আছেন?’

‘কাল সকালে বাড়ি ফিরেছেন। পুরো রেস্টে থাকতে হবে এখন। নার্স রাখা হয়েছে দু-জন। আর বৌদি তো আছেই, দাদা ছুটি নিয়েছে ক’দিন’


প্রথমিক উচ্ছাসের মধ্যে ঘরের মধ্যে আরেকজনের উপস্থিতি খেয়াল করেনি রজত। এক কোনায় অপ্রতিভ মুখে দাঁড়িয়ে আছে একজন। পরনে হাল্কা নীল রঙের প্যান্ট আর ঘিয়ে রঙের বুশ শার্ট; পায়ে সাদামাটা পাম্প শু, মোজা নেই। মাথার চুল খুব ছোট করে ছাঁটা; দাড়ি গোঁফ কামানো। কাঁধে একটা মলিন ব্যাগ।


‘রজত না? চিনতে পারছিস? আমি সুধা, সুধাকর’

‘আরে সুধা, কি করে চিনব বল, কত বছর পর দেখা বল তো, স্কুল ছাড়ার পর তোর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কোথায় আছিস?’

‘আচ্ছা কি আশ্চর্য, তোমরা বসবে তো, না কি দাঁড়িয়েই থাকবে?’ রুবির কথায় সবাই বসল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বেশ বড় দীপকের ড্রইং রুম। 

‘রজতদা কি খাবে বল? চা, কফি বা অন্য কিছু?’

‘না, আজকে একটু বীয়ারই খাই’

‘গুড, আমি দিচ্ছি’ দীপক বলে

‘তুই কিন্তু একই রকম আছিস রজত। মুম্বাইয়ে আছিস শুনলাম’ সুধাকর জিজ্ঞাসা করে

‘হ্যাঁ, আর তুই?’

‘আমি থাকি অনেক দূরে, শেয়ালদা থেকে ...’

‘এই নে, তোর ড্রিঙ্ক, সুধা সত্যি তুই কিছু নিবি না?’ দীপক জিজ্ঞেস করে

‘স্যান্ডউইচ নিন একটা’ রুবি প্লেট বাড়িয়ে ধরে,

‘না, এই সময়টা আমি কিছু খাই না, সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু একটা খাই, তারপর সেই রাতে শোয়ার আগে’ 

‘বলিস কি রে, মাঝখানে আর কিচ্ছু না?’

‘জল খাই; এই তো খেলাম এক গ্লাস’ হাসল সুধাকর

‘তোর কি একটা দরকার আছে বলছিলি?’ সুবীর জিজ্ঞেস করে

‘হ্যাঁ আসলে আমি একটা স্কুল চালাই, আর স্কুলটাকে ঘিরে একটা কমিউন মত তৈরি হয়ে গেছে ধীরে ধীরে’

‘বলিস কি রে? ক’জন?’ নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করে

‘খুব একটা বেশি নয়, হলে ভাল হত, কিন্তু অত সামর্থ্য নেই, সেই জন্যই...’

‘কে দেখাশোনা করে?’

‘এই আমি আর আমার স্ত্রী’

‘স্ত্রী? বিয়ে করেছিস না কি?’

‘হ্যাঁ, এই ...’

‘সে কি, কোথাকার মেয়ে রে? তোর সেই গন্ডগ্রামের কোনও মেয়ে?’ দীপক টীপ্পনি কাটে,

‘আঃ ওনাকে কথা বলতে দাও না’ রুবি ধমকায় দীপককে...

‘যাক গে, তোর কি দরকার আছে বলছিলি?’ পার্থ মনে করায়

‘হ্যাঁ, আসলে আমার এই কাজটা পুরো চ্যারিটির ওপর চলে, সেদিন পার্থর চেম্বারে গিয়ে জানলাম তোরা সবাই একসঙ্গে হবি, ভাবলাম তোরা সবাই তো খুব সুপ্রতিষ্ঠিত, যদি কিছু সাহায্য করিস। অবশ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তোদের ওপর, আমি শুধু প্রস্তাবটা দিলাম, যদি তোদের অসুবিধে থাকে তবে আমি মোটেই জোড় করব না’

‘কত এক্সপেক্ট করছিস পার হেড’ নীলাঞ্জন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে

‘আমি কিছু এক্সপেক্ট কারছি না, তোরা যা পারিস’ আবার ম্লান হাসে সুধাকর

‘এক্স্যাক্টলি কি করিস তুই’

‘একটা স্কুল চালাই, একটু বাংলা, একটু অঙ্ক আর সামান্য ইংরিজি অক্ষর জ্ঞান শেখাই, দিনের বেলা ছোটরা, সন্ধ্যের দিকে কয়েকজন বয়স্ক লোকও আসে, তবে বেশিক্ষণ নয়, ইলেকট্রিসিটি তো নেই, আর কেরোসিনের ব্যবহারও একটু নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয়। আর একটু চাষবাসেরও ব্যবস্থা করেছি, অনেকটা কো-অপারেটিভ ফার্মিং-এর মত। চাষ বাসের প্রক্রিয়াও একটু আধুনিক করার চেষ্টা করছি’

‘ক’জন আছে তোর ফার্মে?’

‘ফার্ম ঠিক নয়। সতেরোটি পরিবার আছে এখন, বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় শ’খানেক লোক, রান্না বান্না একসাথেই হয়। কমিউনিটি কিচেন করা হয়েছে একটা’

‘বাবাঃ অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’ রুবি বলে বসে

‘আমার কাছে ছবি আছে দেখবেন?’ সুধাকর ব্যাগে হাত ঢোকায়

‘আরে না না’ রুবি একটু অপ্রস্তুত হয়’

‘দেখুন না’ সুধাকর একটা অ্যালবাম এগিয়ে দেয় রুবির দিকে

রুবি অ্যালবামের পাতা ওল্টায়, সুপর্ণা ও মালাও ঝুঁকে পড়ে অ্যালবামের পাতায়।

‘চেক নিবি?’ পার্থ জিজ্ঞেস করে

‘হ্যাঁ, তবে আমাদের ওখানে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। কলকাতায়ও একটা অ্যাকাউন্ট আছে। চেক এনক্যাশ হতে কিছু সময় লাগে। টাকা তুলতে কলকাতায় আসতে হয়’

‘তার মানে তুই ক্যাশ প্রেফার করিস?’ নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করে,

‘না তা নয়, যা তোদের সুবিধে, ক্যাশ হলে একটু সুবিধে হয় আর কি?’

‘একি? আপনার বৌ’এর ছবি নেই?’ হঠাৎ মেয়েদের সমবেত প্রশ্ন শোনা যায়,

‘না, এটাতে শুধু আমাদের কমিউনের ছবি কিছু আছে’

‘ক্যাশ তো সঙ্গে বিশেষ নেই’ একটু বিব্রত বোধ করে রজত

‘একটা উপায় আছে, যদি তোদের আপত্তি না থাকে ... ’ সুধাকরকে আবার একটু অপ্রতিভ দেখায়

‘কি?’ জিজ্ঞেস করে নীলাঞ্জন

‘দীপকের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে একটা এটিএম মেশিন আছে দেখলাম, যদি তোরা ...’

একটু মুখ ব্যাজার করে দীপক,

‘ঠিক আছে, তাই হোক, চল সবাই, কার্ড আছে তো সঙ্গে’ নীলাঞ্জন জিজ্ঞেস করে

‘আমি চেক বই নিয়ে এসেছি’ সুবীর অমিতার দিকে হাত বাড়ায়, অমিতা হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা চেক বই ও কলম বের করে,

‘চেকে তোর অসুবিধে হবে জানলে আমি ক্যাশ নিয়েই আসতাম, আসলে এখানকার অ্যাকাউন্টে আমার এটিএম কার্ডটা নেওয়া হয়নি, থাকি না তো।’

‘না না ঠিক আছে, কোনও অসুবিধে হবে না’

 

‘ঠিক আছে আমরা তবে নিয়ে আসছি’ পার্থ, দীপক, রজত এবং নীলাঞ্জন বেরিয়ে যায়।

‘আমি কি সঙ্গে আসব?’ সুধাকর জিজ্ঞেস করে,

‘না তুই দাঁড়া, আমরা এখুনি আসছি’ দীপক বলে, নীচে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একটু আলোচনা করা দরকার কত দেওয়াটা উচিৎ হবে, সুধাকর সঙ্গে থাকলে অসুবিধে।


সুবীর চেক লিখে সই করে, তুলে দেয় সুধাকরের হাতে। সুধাকর চেকের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকায় সুবীরের দিকে,


‘এত?’

‘ঠিকই আছে, ভাল কাজেই তো খরচ করবি তুই। তা ছাড়া আমার এই অ্যাকাউন্ট থেকে বিশেষ একটা খরচ হয় না,

‘অনেক অনেক ধন্যবাদ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ’ খুব কৃতজ্ঞ দেখায় সুধাকরকে, চেকটা খুব যত্ন করে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।

‘এর পর আবার এলে বৌকে নিয়ে আসবেন কিন্তু। আমরা আলাপ করব না?’ রুবি বলে

‘দেখি, ও আবার বিশেষ বেরোয় না।’

দরজা খোলাই ছিল, একে একে ঢুকল দীপক, রজত ও নীলাঞ্জন। প্রত্যেকের হাতে কিছু নগদ টাকা, একে একে এগিয়ে দেয় সুধাকরের দিকে, একটু অপ্রস্তুত হাসি সুধাকরের মুখে,


‘দাঁড়া, তোদের রসিদ কেটে দিচ্ছি’ ব্যাগের ভেতরে হাত ঢোকায় সুধাকর, এটা ওটা সরায়, ঘাঁটা ঘাঁটি করে,

‘রসিদের বইটা বোধহয় আনতে ভুলে গেছি রে’ আরও অপ্রস্তুত দেখায় সুধাকরকে,

‘যাক গে, পরে পাঠিয়ে দিস’ রজত বলে

‘হ্যাঁ তাই করতে হবে। দাঁড়া কাগজে লিখে নি, পরে পাঠিয়ে দেব’ মাটিতে প্রায় মিশে যায় সুধাকর


হঠাৎ যেন কোথাও একটা তাল কেটে যায়। চুপচাপ বসে থাকে সবাই। এক ফালি কাগজে কিছু লেখালেখি করে উঠে দাঁড়ায় সুধাকর,

‘আমি আজ উঠি রে’ তারপর একটু থেমে বলে ‘অনেক ধন্যবাদ তোদেরকে ...’

‘না না ঠিক আছে, তুই এত ফর্মালিটি করছিস কেন?’

‘না ফর্মালিটি নয়, মানে ... ইয়ে রিসিট বুকটা ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গেছি, আমি পোস্টে পাঠিয়ে দেব পার্থর ঠিকানায়’

ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় সুধাকর।


দীপক প্রথমে মুখ খোলে,

‘আর রিসিট? টাকাটা ওর পকেটেই গেল ভেবে নে। আমি শিওর, এই কমিউন টমিউন সব ভাঁওতা ...’

‘তুমি সব সময় নেগেটিভ সাইডটা দেখ কেন বল তো’ রুবি মুখ ঝামটা দেয়

‘দেখো ওকালতি করি, এসব আমার দেখা আছে’

‘ছাড় তো, হতেও পারে জেনুইন, এনি ওয়ে, উই হ্যাভ ডান আওয়ার বিট। এখন ইট ইজ় আপ টু সুধা। আমরা পুরনো বন্ধুকে ট্রাস্ট করেছি, সেটাই আমাদের ডিউটি ছিল। নাও লেটস হ্যাভ সাম ফান’ সুবীর ব্যাপারটা হাল্কা করার চেষ্টা করে।

‘তোমরা ড্রিঙ্ক শেষ কর, আমি লাঞ্চের ব্যাবস্থা করি।’

‘চেহারাটা কি রকম খারাপ হয়ে গেছে, তাই না?’

‘বেশ বুড়ো বুড়ো লাগছিল দেখতে’

‘আ হা হা, তোমাদের যেন ভরা যৌবন?’

‘যাক গে, আর তোর কি খবর বল সুবীর, কদিন আছিস?’


দারুন আড্ডা শুরু হল। সবারই কিছু কিছু অর্থদন্ড হয়েছে। দীপক মনে করে একদিকে ভালই হয়েছে, আর মুখ দেখাবে না সুধাকর, রিসিট টিসিটের কথা ভুলে যাওয়াই ভাল। মোটামুটি সবাই যেন মেনেই নিল দীপকের কথা। প্রচন্ড হৈ চৈ শুরু হল, জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হল, সুধাকরের কথা ভুলেই গেল সবাই।


মুম্বাই পৌঁছে দিন প্রথম সপ্তাহ অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। শনি এবং রবিবার ছুটি থাকে রজতের, কিন্তু অফিস যেতে হল। রিমঝিমের খুব ইচ্ছে ছিল বাবা কোলকাতা থেকে ফিরলে, উইক এন্ডে বাইরে লাঞ্চ করতে যাবে। সম্ভব হল না রজতের কাজের চাপে। বেশ একটু অভিমান হল মেয়ের। মেয়ের মান ভাঙাতে কথা দিল রজত যে সামনের শনিবার বাইরে কোথাও লাঞ্চে যাওয়া হবে। শুক্রবার সময় মত বাড়ি এল রজত। রাত্রে ডিনার টেবিলে বসে ঠিক হল ওহ-ক্যালকাটায় লাঞ্চে যাওয়া হবে শনিবার। রিমঝিমই প্রস্তাবটা দিল। পাপাই কোলকাতার ওহ-ক্যালকাটায় বার দুয়েক খেয়েছে, কাকামনি ও কাম্মার সঙ্গে, ফোন করে জানিয়েছেও রিমিদিকে।


খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়িই শুতে যাওয়া হল। পরের দিন তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। রিমঝিম চলে গেল নিজের ঘরে। সোনালীও নিজের দিকের বেডসাইড টেবিলের লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। রজত সেদিনের খবরের কাগজটা টেনে নিল। শুতে যাবার আগে কিছু একটা না পড়লে আবার রজতের ঘুম আসেনা।


হঠাৎ উঠে বসল সোনালী,

“এই সরি, তোমার একটা চিঠি এসেছে, ক্যুরিয়ারে, কোলকাতা থেকে”

“সে কি, কে পাঠিয়েছে?”

“তোমার বন্ধু পার্থ, আমি তোমাকে অফিসে ফোন করেছিলাম, তুমি মিটিঙে ছিলে, আমি আর মোবাইলে ফোন করিনি, সরি ...”

“কোথায় চিঠি?”

“তোমার বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে আছে” 


খাম ছিঁড়ে ভেতরের চিঠি বের করল রজত। শুধু চিঠি নয়, একটা রসিদও আছে সঙ্গে। ওপরে একটা ইয়েলো স্টিকার, তাতে পার্থর একটা ছোট্ট নোট,- 

‘সঙ্গের চিঠিটা একটি লোক দিয়ে গেছে, লোকটি সুধার গ্রাম থেকে এসেছিল। প্রত্যেকের নামে আলাদা চিঠি; চিঠিটা মন দিয়ে পড়িস।’

চিঠিটি একটি লেটারহেডে ইংরিজিতে টাইপ করা। পুরনো টাইপ রাইটার, কিছু অক্ষর ভাঙা। খুব সস্তার কাগজ মনে হচ্ছে। লেটারহেডে ইংরিজিতে লেখা রয়েছে,

 

ডঃ সুধাকর অধিকারী

ডিরেক্টর, আদর্শ কো-অপারেটিভ সোসাইটি

পোস্ট অফিস – কাশবনি


চিঠির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রজত। পাশে সোনালী চোখ বুজে শুয়ে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। চিঠিতে মন দেয় রজত,


প্রিয় মিঃ সেন,


প্রথমেই আমার স্বামীর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এই চিঠি তাঁরই লেখার কথা, কিন্তু অনিবার্য কারণ বশতঃ ওনাকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে যেতে হয়েছে।


আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার আর্থিক সাহায্যের জন্য। আমাদের এই প্রতিষ্ঠান আমাদের কিছু সঞ্চয় এবং আপনাদের মত কিছু মুষ্টিমেয় উদার বন্ধুর সাহায্যের ভিত্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে কিছু সরকারি এবং বেসরকারি ফান্ডিং পাবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। গত মাসে দিল্লীতে মিনিস্ট্রি অব রুরাল ডেভেলপমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সম্মেলনে গিয়েছিলেন আপনাদের বন্ধু; সেখানে ওনাকে আমাদের এই কাজের ওপর একটি পেপার প্রেজ়েন্ট করতে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। পেপারটি খুব সমাদৃত হয় এবং কিছু বিদেশী প্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁদের আমন্ত্রণে আগামী সপ্তাহে ব্রাসেলসে একটা সম্মলনে যাচ্ছেন আপনার বন্ধু। ভিসা এবং ফ্লাইট বুকিং সংক্রান্ত ব্যাপারে ক’দিনের জন্য দিল্লী যেতে হয়েছে। তাই এই চিঠি আমাকে লিখতে অনুরোধ জানিয়ে গেছেন।


আমাদের এই প্রকল্পটি একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। এটার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। আমার স্বামী ছাত্র জীবনে এই অঞ্চলে যাওয়া আসা করতেন এবং সীমিত ক্ষমতার মধ্যে এই অঞ্চলের মানুষদের নানা রকম সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। সেই সময় আমিও একবার ওনার সঙ্গে এসেছিলাম এবং এই নিয়ে একটা বিশ্রী রকমের রটনায় আমাকে দেশ ছাড়া হতে হয় এবং আমার স্বামীরও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। আমি লন্ডনে আমার লেখাপড়া শেষ করি। কয়েক বছর পর আপনার বন্ধুও অনেকটা আমার চেষ্টাতেই লন্ডন আসেন এবং তাঁর নিজের পড়াশোনা শেষ করেন। সেখানেই আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই এবং কয়েক বছর চাকরিও করি। খুব সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে দেশে ফিরি আমরা। ধীরে ধীরে গড়ে তুলছি আমাদের এই স্বপ্ন।  


যদি পারেন, একবার আসবেন, সপরিবারে। আসতে একটু কষ্ট হবে, কিন্তু ক’দিন থাকতে হয়তো খারাপ লাগবে না। জায়গাটা বড় শান্ত, বড় নিষ্পাপ।


আপনাকে আমার আলাদা ভাবে মনে পড়ছে না। তবে দেখলে নিশ্চয়ই চিনতে পারব। আপনারা আমার জ্যাঠতুতো দাদা ঋষিরাজ মিত্রর সঙ্গে আমাদের বাড়ী আসতেন, সরস্বতী পূজোর সময়। সেই সময় আপনার বন্ধু অর্থাৎ আমার স্বামীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়নি। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি দেখা এবং আলাপ হবে।


শুভেচ্ছা রইল।


সাঃ মৈত্রেয়ী

(ডঃ মৈত্রেয়ী মিত্র অধিকারী)


কিছুক্ষণ সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে রজত। পাশে সোনালী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু পরে চিঠিটা সযত্নে ভাঁজ করে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রেখে রিডিং লাইটটা নিবিয়ে দেয়। চোখ বোঁজে। 


কাল সকালে উঠেই পুরো ঘটনাটা বলতে হবে সোনালীকে। সোনালী বুঝবে ব্যাপারটা। আর কেউ যাক না যাক, রজত আর সোনালী যাবেই কাশবনি, সুধা আর মৈত্রেয়ীর স্বপ্নরাজ্যে।


বৈভব

নিউ টাউন। নতুন শহর গড়ে উঠছে পুরনো শহরের পাশে। ঝকঝকে চওড়া রাস্তা; নতুন নতুন আকাশ ছোয়াঁ বাড়ী, অফিস এবং শপিং মল। রাস্তায় আধুনিক গাড়ী; হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন বিদেশ। মসৃন রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে একটি দুধ সাদা গাড়ী – ‘বিএমডব্লিউ’; খুব কেতার গাড়ী এবং ভীষন দামি, ছন্দা বলেছিল। চালকের আসনে ধপধপে উর্দী এবং টুপি পরা একটি মাঝবয়সী লোক; ছন্দার খাস ড্রাইভার। ছন্দার বরের অন্য ড্রাইভার আছে। তিন তলা বাড়ীর সামনে বেশ কটা গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল। ক’জন ড্রাইভার আছে কে জানে?

মৃদু গুঞ্জনে এসি চলছে; ভেসে আসছে একটু হাল্কা সেতারের শব্দ, খুব আস্তে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ব্রততীর। ছন্দাকে বলেছিল ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবে। কোনও অসুবিধে হবে না। ছন্দা শুনতেই চাইল না। জোড় করে ড্রাইভার দিয়ে পাঠাল। গাড়ীটা নাকি সারাদিন প্রায় বসেই থাকে, ব্রততীকে পৌঁছে দেবার অজুহাতে একটু চলবে। এই গাড়ী নিয়ে পাড়ায় ঢুকতে একটু লজ্জাই করছে। পৌঁছনোর আগে হয়তো দীপ্তও বাড়ী পৌঁছে যাবে। ঠিক পেছনে লাগবে, “বড়লোক বান্ধবী” “গরীব স্বামী” -- , পারেও বটে দীপ্ত। সু্যোগ পেলেই পেছনে লাগে। একটু হাসিই পেল ব্রততীর। মনটা বোধহয় একটু হাল্কা হল।

ঘটনার সুত্রপাত মাস খানেক আগে। দুপুর একটা নাগাদ, পাশের বাড়ীর রুপার সঙ্গে সাউথ সিটি মলে এসেছিল ব্রততী। বাড়ীর কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যায়। কেনা কাটার বিশেষ কিছু ছিলনা। রুপা জোড় করল, “চল না ব্রততীদি, কিছু কেনার তো দরকার নেই, জাস্ট ঘুরে বেড়াব, এই একটু টাইম পাস”। রুপাটা খুব পারে টৈ টৈ করতে। মলে ঢুকলে কিছু একটা কেনা হয়েই যায়, দরকার না থাকলেও; কিংবা কিছু জিনিষ হঠাৎ দরকারি মনে হয়। সেদিনও তাই হল। দিদির শাশুরী অসুস্থ, আগামি কাল দেখতে যাবার কথা, একটা গেট-ওয়েল কার্ড কেনা হল, অথচ কোনও দরকার ছিলনা। মিন্টির খুব সফট টয় পছন্দ, তাও একটা কেনা হল যদিও মিন্টির ঘরে সফট টয়ের ছরাছরি। রুপা বেশ কিছু দামি পারফিউম কিনল।

শপিং মলের ফুড কোর্টটা বেশ আকর্ষনীয়, সব সময় বেশ একটা গমগমে ভাব। নানা রকমের কেনাকাটার পর সবাই এখানে বসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায়। ব্রততী এবং রুপাও এসে বসল কফি খেতে। রুপা অবশ্য শুধু কফিতে সন্তুষ্ট নয়,

- ব্রততীদি, লুচি মাংস খাবে? দারুণ করে, ঐ যে দেখছ স্পিরিট অফ বেঙ্গল, ওখানে।

- ও বাবা না, প্রচণ্ড স্পাইসি, আর মাংসের থেকে হাড়ই বেশি থাকে, আমি খেয়েছি

এমন কিছু স্পাইসি নয়, আর এক আধদিন খেলে কিছু হবে না। আর লোকগুলোকে চিনি আমি, বলে দেব ভাল ভাল পীস দিতে।

না রে রুপা তুই খা। আমার আজ ভাল লাগছে না। আমি বরং একটা পাপরি চাট নিচ্ছি। আর শোন আজ কিন্তু আমার টার্ন, আগের বার তুই দিয়েছিলি।

ও হো, তোমার মনেও থাকে বাবা, বড্ড হিসেব করে চল তুমি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে চল টোকেন কিনে নিয়ে আসি।


লুচি মাংস বেশ ভালই বাসে ব্রততী, কিন্তু খেলো না কিছুটা বিবেকের দংশনে। আসলে দীপ্ত প্রচন্ড  লুচিপ্রিয়, লুচি পেলে আর কিছুই চায়না। ইদানীং একটু প্রেশার ধরা পড়েছে, তাই ব্রততী একটু সাবধান হয়ে গেছে, আজকাল মাসে বড়জোড় এক দিন লুচি হয় বাড়িতে। আগে তো সব রবিবার সকালে লুচি আর আলুর তরকারি হত। আজকাল শুকনো রুটি করে, প্রচন্ড রেগে যায় দীপ্ত। দীপ্তর ওপর এত কড়াকড়ির পর বাইরে এসে নিজের আর লুচি খেতে মন চাইল না।


রুপা লুচি মাংস খেল বেশ তারিয়ে তারিয়ে, ব্রততী পাপরি চাট শেষ করল। কফি প্রায় শেষ হয়ে আসছে এমন সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ছন্দার সঙ্গে। মধুছন্দা, সেই কলেজের বন্ধু। ছন্দাই ডাকল,


ব্রততী না?


ছন্দাকে প্রথম চিনতে পারেনি ব্রততী, বেশ মোটা হয়েছে, পরনে দামি শাড়ি, একগাদা গয়না, হাতে একটা বাদামি রঙের ঢাউস ব্যাগ। দুপাশে দুজন সালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে, এই পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে, দুজনের দুহাতে অজস্র শপিং ব্যাগ।

 

একি ছন্দা, তুই?

এই একটু কেনা কাটা করতে এসেছিলাম। আসলে এই সাউথ সিটি মলে আমার আগে আসা হয়নি, বাড়ি থেকে অনেকটা দূর পড়ে। আজ ঠিক করলাম একটু ঘুরে যাই

কোথায় তোর বাড়ি?

বাগবাজারে আমার শশুর বাড়ি, তবে বছর তিনেক আগে আমরা রাজারহাটে শিফট করেছি। 

ও মা তাই, দাঁড়া আলাপ করিয়ে দিই, এ হচ্ছে রুপা, আমার প্রতিবেশি, আমরা একই বিল্ডিঙে থাকি, একই ফ্লোরে। আর এ হচ্ছে ছন্দা, মধুছন্দা, আমার কলেজের বন্ধু।


রুপা হাত তুলে নমস্কার করে। ছন্দা একটু মৃদু হাসে।


তুই কি এদিকেই থাকিস, জিজ্ঞেস করে ছন্দা

হ্যাঁ রে, কাছেই, হাঁটা পথ। যাবি? চল না একটু বসে যাবি। কতদিন দেখা হয়নি

ঠিক আছে চল। বেশিক্ষন বসব না কিন্তু, বাড়ি ফিরতে হবে।


ছন্দার গাড়িতেই সবাই এল ব্রততীর বাড়ি। ছন্দা মোবাইলে ফোন করার পাঁচ মিনিট পর গাড়ি এসে দাঁড়াল সাউথ সিটি মলের দোরগোড়ায়। বিরাট গাড়ি। মিৎশুবিশি পাজেরো, জানাল ছন্দা। ধবধবে সাদা পোষাকের ড্রাইভার। তিন সারি সীট। গাড়ির ভেতরটা কুলকুলে ঠান্ডা মাখানো, এসি চলছে। মাঝখানের সারিতে বেশ আরাম করেই বসল ছন্দা, ব্রততী ও রুপা। পেছনের সারিতে ছন্দার দুই সঙ্গিনী। মেয়ে দুটোর মুখে কোনও কথা নেই। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ছন্দার বডিগার্ড। রাস্তায় বেশ জ্যাম, ব্রততীদের বাড়ি পৌঁছতে পনেরো মিনিট লেগে গেল। হেঁটে পাঁচ সাত মিনিটেই পৌঁছনো যায়। 


রুপা চলে গেল নিজের ফ্ল্যাটে। বাড়ি পৌঁছে বাইরের ঘরে ছন্দাকে বাসাল ব্রততী। পাখাটা চালিয়ে দিল ফুল স্পীডে। এসি গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেন বেশি গরম লাগছে। ছন্দা ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে গালে কপালে ঘাম শুকিয়ে নিচ্ছে মাঝে মাঝে। সঙ্গের মেয়েদুটোকে ডাকতে হল না, নিজেরাই নেমে এল। পেছন পেছন এল কিন্তু ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল ঠিক দরজার বাইরে, যেন হুকুমের অপেক্ষায়। ছন্দাকে দেখে মনে হল এক বিলাস বহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দু গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে এল ব্রততী, ছন্দা অর্দ্ধেকটা খেয়ে বাকিটা নামিয়ে রেখে দিল। বসল না বেশিক্ষণ। বাড়িতে কাজ আছে বলে উঠে পড়ল। যাবার আগে ব্রততীর ফোন নাম্বার এন্ট্রি করে নিল নিজের মোবাইল ফোনে। ব্রততী এগিয়ে এল গাড়ী অব্দি। মাঝের সীটে এবার একা বসল ছন্দা। দুই সহচরী সেই পেছনের সীটেই। কয়েক মিনিট একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল ব্রততী। ছন্দাটা বেশ পালটে গেছে। ব্রততীর সঙ্গে বিশেষ অন্তরঙ্গতা না থাকলেও মোটামুটি বেশ ভালই ভাব ছিল। খুবই সাধাসিধে মেয়ে ছিল। এখন যেন চলনে বলনে একটা প্রাচুর্যের অহঙ্কার, কথা বার্তাও ঠিক স্বতস্ফূর্ত নয়, একটু আঢ়ষ্ট, মাপা মাপা। আর এত গয়নাগাঁটি পরে কেউ মলে আসে?


ছন্দা রওনা হতেই রুপা এসে হাজির। মনে হয় তক্কে তক্কে ছিল,


বসল না?

না, কাজ আছে বলল।

কাজ না হাতি, কিছু মনে করনা ব্রততীদি, একটু অদ্ভুত আছে কিন্তু তোমার বন্ধু। একটা কথা বলল না আমার সঙ্গে। আমি নমস্কার করলাম, ও কিন্তু করল না। 

নারে, আসলে একটু লাজুক জানিস তো,

লাজুক না হাতি। তুমি যাই বল না কেন, বেশ অহঙ্কারি আছে।

যাক গে ছেড়ে দে না, আর তো দেখা হবে বলে মনে হয়না। একটু শরবত খা।


ছন্দার সঙ্গে ঐ একদিনের দেখার স্মৃতি হয়তো হাল্কাই হয়ে যেত ধীরে ধীরে। কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে দুপুর বেলা হঠাৎ ফোন এল ছন্দার,


এই ব্রততী, সেদিন একটু তাড়া ছিল বেশি কথা বলতে পারিনি। তুই বরং পরের সোমবার চলে আয় আমার বাড়ি। বারোটা নাগাদ চলে আয়, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করব আর সারা দুপুর আড্ডা মারব।

নারে এমনিই যাব একদিন, খাওয়া দাওয়া কেন আবার?

তুই না করিস না, চলে আয় আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব।

না না শোন, গাড়ি পাঠতে হবে না। আমি এমনিই চলে যেতে পারব। কিছু অকেশন আছে কি? অনেকে আসছে?

না রে, শুধু তুই আর আমি। কোনও অকেশন নেই। সারে এগারোটায় আমার গাড়ি পৌঁছে যাবে

না ছন্দা, গাড়ি পাঠাস না। - এবার একটু জোড় দিয়েই বলে ব্রততী।

কেন? আচ্ছা ঠিক আছে।–একটু দমে যায় ছন্দা 

তোর বাড়ির ঠিকানাটা দে।


ঠিকানাটা একটা কাগজে টুকে রাখে ব্রততী। একটু কৌতুহলও হচ্ছিল ছন্দা সম্পর্কে। তাই রাজি হল। আশ্চর্য লাগছে। সাধারণতঃ বন্ধুরা বরদেরও নিয়ে আসতে বলে, নিজেদের বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। ছন্দা তো দীপ্তর নামও জিজ্ঞেস করল না। সেদিনও দীপ্ত সম্বন্ধে কিছু জানতে চায় নি। সত্যিই অদ্ভুত, রুপা ঠিকই খেয়াল করেছে। 


দীপ্ত বাড়ি এসে সব শুনে অবাকই হল।


এই ভর দুপুরে একা একা কোথায় যাবে তুমি? রাজারহাট বেশ নির্জন জায়গা। বড় বড় বাড়ি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু লোকজন বেশি থাকে না। ট্যাক্সি ঐ অসময়ে যেতে চাইবে কিনা কে জানে। আর ফেরার সময় ট্যাক্সি পাবার চান্স খুব কম।

বাস?

বাস রুটও বেশি নেই। কাগজে পড় না, পরিকাঠামোর অভাব ইত্যাদি।

তবে কি করব? না করে দেব। কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে

দেখি আমি কোনও ড্রাইভার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। আমাদের গাড়িতেই তোমাকে পৌঁছে দেবে। ফেরার সময় যদি ট্যাক্সি না পাও, ফোন করে দিও। আমিই তুলে নেব তোমাকে। আমি কিন্তু তোমার বন্ধুর বাড়ি ঢুকব না

ঠিক আছে

তোমার বন্ধু বেশ শাসালো পার্টি মনে হচ্ছে। গাড়ির অফার দিল যখন নিয়ে নিলেই পারতে। 


দীপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করে। উঁচু পোস্টে আছে। ইচ্ছে করলে অফিসের গাড়ি ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দেবে না। অফিস থেকে কোনও রকম ব্যক্তিগত সুবিধে নিতে চায় না দীপ্ত। অথচ ওর সহকর্মীরা অফিসের গাড়ি নিয়ে দীঘা বেড়াতে চলে যায়, মহিলারা শপিং করতে যায়। দীপ্ত অফিসের গাড়ি শুধু অফিসের কাজেই ব্যবহার করে। নিজের বা পরিবারের জন্য বরাদ্দ পাঁচ বছর আগে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কেনা একটি মারুতি অলটো। তবে এই সততার স্বীকৃতি আছে। কোথাও কোনও রকম দুর্নীতির আঁচ পেলে দীপ্তকেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংবাদ মাধ্যমও দীপ্তকে খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখে।


নির্দিষ্ট দিনে সময় মত পৌঁছে গেল ব্রততী। দীপ্তর অফিসের এক রিটায়ার্ড ড্রাইভার, এখন পার্ট টাইম গাড়ি চালান একটু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, পৌঁছে দিলেন ব্রততীকে, ঠিকানা দেখে একেবারে বাড়ির সদর অব্দি। এবং বসে রইলেন ব্রততী ভেতরে না ঢোকা অব্দি। পেল্লায় তিন তলা বাড়ি। বাড়ির সামনে বেশ কেতা দুরস্ত বাগান। সামনে বেশ কয়েকটি গাড়ি। গেটে খাকি পোষাকে সিকিউরিটি গার্ড। ব্রততীর নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। নাম শুনে সসভ্রমে গেট খুলে দিল, বোধহয় ছন্দা বলে রেখেছিল। দেয়ালে একটা সুইচ টিপে কথা বলল কারও সঙ্গে। এগিয়ে দিল সিড়ি অব্দি।


সিড়ির দিয়ে নেমে এল সেদিনের এক সালোয়ার কামিজ। আজও একই রকম পোষাক। একটু হাসল ব্রততীকে দেখে, কথা বলল না, ইশারা করল ওপরে উঠে আসতে। সাদা ধবধবে সিড়ি। ওপরে উঠে একটা লম্বা প্যাসেজ, বেশ চওড়া, দেয়ালে নানা রকমের পেইন্টিং, এক মাপের ফ্রেমে, সারি সারি। মাঝে মাঝে নানা কায়দার গাছ গাছালি। বেশ সুন্দর সাজানো, একটু বেশিই যেন সাজানো। মনে হয় এই সাজানোর মধ্যে আন্তরিকতার চেয়ে পেশাদারিত্বর ছাপ বেশি। প্যাসেজের ডান দিকে এক বিরাট মাপের ঘর, ভারি পর্দার ফাঁকে চোখে পড়ল বড় বড় সোফা সেট। বাঁ দিকে মনে হল বিরাট এক ডাইনিং হল। বসার ঘরের ঠিক পাশে একটা দরজা একটু ভেজানো, দরজায় মৃদু টোকা দেল মেয়েটি। ভেতর থেকে ছন্দার গলা শোনা গেল “আয়”।


ভেতরে ঢুকল ব্রততী। এ ঘরটাও বেশ বড়, সোফা সেট দিয়ে সাজানো, দেয়ালে বড় বড় ফ্রেমে কিছু ছবি। পেইন্টিং নয়, নানা রকম পারিবারিক ছবি মনে হল। প্রায় পুরো মেঝে জুড়ে কার্পেট। এসি চলছে। মাঝখানে এক বিরাট গদিওয়ালা চেয়ারে গা এলিয়ে, পা মুড়ে বসে আছে ছন্দা। আজকেও গায়ে বেশ ভারি ভারি গয়না। হাল্কা পারফিউমের গন্ধ। সামনে একটা বড় এলইডি টিভিতে কোনও একটা সিরিয়াল চলছে।


এসেছিস ব্রততী, বোস। বাড়ি খুঁজতে অসুবিধে হয়নি তো?

না রে খুব সহজেই পেয়ে গেছি। 

ব্রততী পাশের একটা চেয়ারে বসে। ছন্দা বসেই থাকে।

কি করে এলি, ট্যাক্সি?

না, গাড়িতেই, ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে গেছে।

গাড়িটা ছেড়ে দিলি?

হ্যাঁ, দীপ্তর মানে আমার বরের যদি দরকার হয়।

ও, কি খাবি বল, চা, কফি, কোল্ড ড্রিংক?

একটু পরে। এখন একটু জল খেতে পারি। কিন্তু ফ্রিজের না কিন্তু।

ঠিক আছে। 

এবার সালোয়ার কামিজের দিকে তাকালো ছন্দা,

রেবা, দু গ্লাস জল নিয়ে এসো।

আচ্ছা বৌদি।

আর শোনো। 

রেবা থেমে ঘুরে দাঁড়ালো।

টিভিটা বন্ধ করে দাও।

ছন্দার হাতের পাশেই একটা ছোট কাশ্মিরি টেবিলে টিভির রিমোট কন্ট্রোল। রেবা মৃদু পায়ে এসে রিমোট কন্ট্রোল তুলে টিভি অফ করে। বেরিয়ে যায়, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যায় সন্তর্পনে।


আজ তোর সঙ্গে আড্ডা মারব বলে আমার বরকে বলেছি অফিসে খেয়ে নিতে।

উনি রোজ বাড়িতেই খেতে আসেন বুঝি?

হ্যাঁ, এই নীচের তলায় তো অফিস। তবে প্রায়ই এদিক ওদিক যেতে হয়, সাইটে কাজ থাকে। আজ বলেছি খাবার নীচে পাঠিয়ে দেব। 

ওনার কি নিজের ব্যবসা?

ফ্যামিলি বিজ়নেস। আমার শশুর মশাই শুরু করেছিলেন। মারা গেছেন। এখন আমার বর আর ভাসুর দেখাশোনা করে।

তোর শাশুরি?

এখানেই থাকেন। ওপরে। খুব একটা নীচে নামেন না। দিনে একবার বাগবাজারের বাড়ি যান, বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মন্দির, প্রতি অমাবস্যায় কালীঘাট। এমনিতে খুব শক্ত পোক্ত। তবে সংসারের ভার আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। পুজো আর্চা নিয়ে থাকেন।

তোর জা আর ভাসুর?

ওরা বাগবাজারের পুরনো বাড়িতে আছে। বেশ বড় সাবেকি বাড়ি। আমার ভাসুর ঐ বাড়ি ছাড়তে চান না। শশুর মশাই সবাইকে নিয়ে এ বাড়ি আসতে চেয়েছিলেন, বড় ছেলে রাজি হয়নি। তা ছাড়া ছেলে মেয়েরা কাছাকাছি সব স্কুলে পড়ে।, আমার ভাসুর আর জা’ও একটু ধর্ম কর্ম নিয়ে থাকতে ভালবাসে।

তোর ছেলে মেয়ে?

এক ছেলে। দার্জিলিঙে আছে। বোর্ডিং স্কুল।


প্রায় একতরফাই কথা বকে যায় ছন্দা। বরের নাম দিব্যেন্দু। কয়েক পুরুষের ব্যবসায়ি পরিবার। দিব্যেন্দুর ঠাকুরদার আমলে তেলের কল, লোহা লক্করের আরত আর একটা প্রেস ছিল। এখনও আছে। সেগুলো ভাসুর দেখাশোনা করেন। এই কন্সট্রাকশনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন শশুর মশাই। সেটা রমরমিয়ে চলছে। দিব্যেন্দু নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এই ব্যবসাটা এখন একাই সামলাচ্ছে। ভাসুরের অফিস অন্য জায়গায়, মাঝে মাঝে কাগজপত্রে সই করতে আসেন। সব ব্যবসাতেই সমান ভাগ দুই ভাইয়ের।


ছন্দা ব্রততীর ক থা কিছুই জানতে চাইল না। ব্রততীও নিজে থেকে কিছু জানালো না। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগছিল এক তরফা কথায়। মনঃস্থির করে ফেলল এর পর কোনও যোগাযোগ রাখবে না। এই ছন্দা সেই কলেজের ছন্দা নয়। এই ছন্দা বিত্ত বৈভবে আপ্লুত এক বিলাসিনী।


রেবা এসে জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে এল ঠান্ডা বাদামের শরবত, সঙ্গে কিছু মিষ্টি। মিষ্টি খেল না ব্রততী। দুপুরে খাওয়ার কথা বলেছিল ছন্দা, এসব খেলে আর কিছু খাওয়া যাবে না পরে। ছন্দা একবার সেই সালোয়ার-কামিজ রেবাকে ডেকে খবর নিল শাশুরি খেয়েছেন কিনা। দেড়টা নাগাদ আবার রেবাকে ডাকল ছন্দা, বলল খাবার দিতে। মিনিট পনেরো পরে রেবা এসে খবর দিল খাবার দেওয়া হয়েছে। এই প্রথম উঠে দাঁড়ালো ছন্দা। চেয়ারের সামনেই এক জোড়া চটি রাখা ছিল, সে জোড়াই আবার নীচু হয়ে রেবা এগিয়ে দিল ছন্দার পায়ের কাছে। 


হাত ধুবি তো? 


ঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল ছন্দা। সামনেই একটা বাথরুম। রঙিন টাইল, দেওয়াল। একই রঙের তোয়ালের সেট, শাওয়ার কার্টেন। বেসিনের ওপরে রাখা লিকুইড সোপে হাত ধুল ব্রততী, তোয়ালেতে হাত মুছল।


ঢোকার সময় বাঁদিকে যে ঘরটা দেখেছিল, সেটাই খাবার ঘর। এখানেও এসি চলছে। মনে হয় পুরো বাড়িটাই এয়ার কন্ডিশনড। বিরাট লম্বা এক ডাইনিং টেবিল। মেহগিনি, জানালো ছন্দা। একদিকে টেবিলের মাথায় বসল ছন্দা। পাশে ব্রততী। বাড়িতে শাশুরীকে নিয়ে তিনজন লোক, এত বড় টেবিল তো ফাঁকাই পড়ে থাকে। 


এই ডাইনিং রুম রোজ ব্যবহার হয়না – ব্রততীর প্রশ্ন অনুমান করে জানালো ছন্দা। বেশি লোকজন থাকলেই এখানে খাওয়া দাওয়া হয়। কিচেনের পাশে একটা ছোট ডাইনিং রুম আছে, দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়া সেখানেই হয়।


টেবিলে বেশ বড় একটা রুপোর থালা ঘিরে গোটা দশেক রুপোর বাটি। সাবেকি কায়দায়। থালায় সুগন্ধী চালের ভাত, এক কোনায় নুন, সদ্য কাটা গন্ধ লেবু। বাটিতে শুক্তো, ছোলার ডাল, পেল্লাই সাইজের ভাজা পার্শে মাছ, এঁচোর ঘন্ট, ধোকার ডালনা, চিতল মাছের পেটি, সর্ষে ইলিশ, পাঁঠার মাংস, চাটনি ও মিষ্টি দৈ।


একটু পেছনে রেবা দাঁড়িয়ে। রেবার পাশে সেই দ্বিতীয় সালোয়ার কামিজকেও দেখা গেল। ব্রততী আর ছন্দা টেবিলের কাছে দাঁড়াতেই দুজনে এগিয়ে এসে চেয়ার দুটো একটু টেনে পিছিয়ে দিল বসার জন্য।


ব্রততী আঁতকে উঠল পদের বাহার দেখে,


আমি পারব না রে ছন্দা,  তুই তুলে নিতে বল। 

তুলতে হবে না। যা পারিস খা। জোড় করব না। আমাদের রাধুনি কিন্তু খুব ভাল। আগে এক বড় রেস্তোরাঁয় কাজ করত। আমার বর ওকে বাড়িতে কাজ দিয়ে নিয়ে এসেছে।


ব্রততী শুধু শুক্তো, ধোকার ডালনা আর ইলিশ মাছটা খেল। ছন্দা অবশ্য জোড় করল না খুব একটা। ছন্দা নিজে কিছুই খেল না, একটু পার্শে মাছ ভেঙে খেল শুধু। খুব নাকি মোটা হয়ে যাচ্ছে। কথাটা অবশ্য খুব মিথ্যে নয়, ব্রততী ভাবে, কলেজে পড়াকালীন বেশ ছিপছিপে রোগা ছিল ছন্দা। বেশ মিষ্টি চেহারা ছিল, ফ্যাশন ট্যাশন একেবারেই করত না। আর এখন? বেশ মোটা সোটা চকচকে চেহারা হয়েছে। পরনে দামি শাড়ি, গয়না। বাড়ির কাজকর্ম তো কিছুই করে বলে মনে হয় না।


হঠাৎ বাইরে থেকে এক উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেল, পুরুষ কন্ঠ,-

বৌদি কোথায়? আলমারির চাবি দিতে বল, জলদি

বলতে বলতেই একটি লোক ঘরে ঢোকে। বেশ লম্বা পেটানো চেহারা, ভুরু কুঁচকে প্রথমে ব্রততীকে দেখে তারপর ছন্দার দিকে তাকায়,

আলমারির চাবিটা দাও তাড়াতাড়ি

একটু হাসে ছন্দা,

আলাপ করিয়ে দিই, দিব্যেন্দু, আমার কর্তা। ব্রততী আমার কলেজের বন্ধু, সেদিন তোমাকে বলছিলাম না ...

দিব্যেন্দুর ডান রাতে একটা ফাইল, বাঁ হাতটা একটু তুলে হাল্কা নমস্কার জানায়

তাড়াতাড়ি কর দেরি হয়ে যাচ্ছে

দিব্যেন্দু বেরিয়ে যায়। একটু বিব্রত দেখায় ছন্দাকে,

দাঁড়া আসছি, 

ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে যায় ছন্দা, রেবাও ছোটে পেছনে।


কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে ছন্দা, মুখে একটু অপ্রস্তুত হাসি,

 

কিছু দরকারি কাগজ পত্র নিতে এসেছিল। খুব ব্যস্ত আছে জানিস, অফিসে উকিল বাবুর সঙ্গে জরুরি মীটিং চলছে। ব্যবসা চলাতে গেলে নানা রকম ঝামেলা তো লেগেই থাকে। পরে একদিন ভাল করে আলাপ করিয়ে দেব। এমনিতে খুব মজার লোক। মিষ্টি খেলিনা?

না রে আর পারব না।


বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নেয় ব্রততী। মনটা বিষিয়ে উঠেছে হঠাৎ। আর একদন্ড থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। অপমানিত লাগছে নিজেকে। একে এক তরফা গল্প, তার ওপর এই ব্যবহার। ঘড়ির দিকে তাকায় ব্রততী,


আমি এবার রওনা হব বুঝলি?

না রে, এখন যাবি কি? খেয়ে উঠেছিস একটু বিশ্রাম করে যা। চা, কফি কিছু খাবি?

ও বাবা, এর পর চা কফি খাবার জায়গা নেই। আসলে আমার বর অফিস থকে ফিরবে, আমার মেয়ের একটু দেরি হবে আজ, নাচের ক্লাস আছে।

দাঁড়া তোকে বাড়িটা একটু দেখাই, দিব্যেন্দু আর্কিটেক্টদের সঙ্গে বসে সব কিছু প্ল্যান করেছে।


এবারও ছন্দা ব্রততীর স্বামী সন্তান সম্বন্ধে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করল না। বাড়ি দেখালো ঘুরে ঘুরে। সারা বাড়িতে বিলাস এবং বৈভবের চিহ্ন। তিন তলায় নিয়ে গেল শাশুরির কাছে, মানুষটি ভাল, সাদা সিধে। মাঝারি মাপের একটা ঘরে বসে আছেন বিছানার ওপর। এ ঘরে এসি নেই, পাখা চলছে। বিছানার পাশে মোড়ায় বসে এক পঞ্চাশোর্দ্ধ মহিলা, বোধহয় শাশুরির পরিচারিকা গোছের কেউ।


শাশুরি যত্ন করে বসালেন। জিজ্ঞেস করলেন বাড়ির কথা, মেয়ের কথা, মা বাবা কোথায় আছেন ইত্যাদি। হঠাৎ মন ভাল হয়ে গেল ব্রততীর, বেশ অনেকক্ষণ গল্প করল বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে। ছন্দাকে মনে হল একটু অধৈর্য হয়ে উঠছে। শাড়ির আচলে কপালে ঘাম মুচ্ছে মাঝে মাঝে। খেয়াল করলেন শাশুরী,


খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে মা, যাও নীচে যাও। এখানে গরম লাগছে তোমাদের। আমার আবার ঐ মেশিনের ঠান্ডা সহ্য হয় না।

ব্রততী মৃদু আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছন্দা উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে,

হ্যাঁ মা, ব্রততীকে আবার ফিরতে হবে ...


নীচে নেমে এল দুজনে। ছন্দা চায়ের প্রস্তাব দিল আবার। কিন্তু আর বসতে চাইল না ব্রততী। এবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে, ছন্দা রেবাকে বলল ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ির ব্যবস্থা করতে। ব্রততী বারণ করেছিল, শুনলনা ছন্দা। ব্রততী এল গাড়ি অব্দি, পেছনে সেই দুই বডিগার্ড। ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। পেছনের সীটে উঠে বসল ব্রততী।


অনেকটা রাস্তা, রাস্তায় বার তিনেক ট্র্যাফিক জ্যামে আরও দেরি হল। বাড়ি পৌঁছে ড্রাইভার দরজা খুলে দিল, নেমে এল ব্রততী। নেমেই দেখল দীপ্ত গাড়ি থেকে নামছে। তখনই পৌঁছেছে। দীপ্তর চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত। হাঁ করে তাকিয়ে আছে গাড়ির দিকে। এই ভয়টাই করছিল ব্রততী, এখন হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আর পেছনে তো লাগবেই।


এই গাড়ি?

ওপরে চল, বলছি।


দীপ্ত পেছনে তাকায়, ছন্দার গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফ্ল্যাটে পৌঁছে আর সময় দেয় না দীপ্ত। বসতে না বসতেই জেরা শুরু হয়,


তুমি এই গাড়িতে কেন?

কেন মানে? ছন্দা এই গাড়িতে পাঠাল আমাকে।

ছন্দা? ছন্দা কি করে এই গাড়িতে তোমাকে পাঠায়?

কি মুশকিল? এটা ওদের গাড়ি আর ওরা খুব বড়লোক, তুমিই তো সেদিন বললে শাঁসালো পার্টি!

এটা ছন্দার গাড়ি?

হ্যাঁ মশাই, আর এই গাড়িতেই আমি ফিরেছি, দেখলে তো?

কে এই ছন্দা?

আচ্ছা বিপদ তো? কি আরম্ভ করেছ তুমি? ছন্দা আমার কলেজের বন্ধু। বলেছি তো তোমায়।

এ গাড়ির মালিক কে জানো?

মানে?

এ গাড়ি রাধাকৃষ্ণ ইন্টারন্যাশনাল কন্সট্রাকশন কোম্পানির গাড়ি। এটা কোম্পানির ক্লায়েন্টদের রিক্রিয়েশনের জন্য ব্যবহার হয়। এ গাড়ি আমি চিনি।

সে কি?

হ্যাঁ ম্যাডাম।

এ রকম দেখতে কি আর কোনও গাড়ি থাকতে পারে না?

না পারে না। গাড়ির নম্বরটা খেয়াল করেছ?

গাড়ির নম্বর?

হ্যাঁ, ১২৩৪। এ ধরণের নম্বর এমনিতে পাওয়া যায় না। কাঠখর পোড়াতে হয়। এ নম্বর আমার মুখস্থ। আচ্ছা এখন বলো তো, ছন্দার হাজ়ব্যান্ডের নাম কি?

দিব্যেন্দু, পুরো নাম জানিনা। 

ও মাই গড!


মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে পড়ে দীপ্ত।


কি হল?

শোনো তোমায় পুরো ব্যাপারটা বলছি। ভেরি কনফিডেনশিয়াল, কিন্তু তোমার এখন জানা দরকার। কিন্তু প্রথমে বলো, ছন্দা কি জানে, তুমি কে? মানে ও কি জানে তুমি আমার স্ত্রী?

না, ও তো তোমার কথা কিছু জিজ্ঞেসই করেনি।

আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে। এতদিন পর হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা। বাড়িতে নেমন্তন্ন?

তুমি কিন্তু ভীষন আবোল তাবোল বকছ!

ওকে। বলছি। মন দিয়ে শোনো। রাধাকৃষ্ণ ইন্টারন্যাশনাল কন্সট্রাকশন কোম্পানির মালিক দুই ভাই। বড় শুভেন্দু শেখর  এবং ছোট দিব্যেন্দু শেখর। ছোট ভাই চেয়ারম্যান, কোম্পানি ঐ চালায়। বাবা নবেন্দু শেখর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন। মারা গেছেন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠা নবেন্দু শেখরের হাতেই। ভালই চলছিল যতদিন বুড়ো বাবা বেচে ছিলেন। দিব্যেন্দু কর্ণধার হতেই বাঁকা রাস্তা ধরল। সব ডীটেলস বলতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে, তাই সংক্ষেপে বলছি, কয়েকটা খুব বড় সরকারি কাজ ওদের দেওয়া হয়েছিল। বেশির ভাগই হাইওয়ে এবং ব্রীজ। বড় মুনাফার আশায় দিব্যেন্দু কারচুপি শুরু করল যেমন বাজে মাল দেওয়া, হিসেবে গড়মিল দেখানো। প্রথম দিকে ধরা পড়েনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের অফিসাররাও তো ইনভলভড। সেই সময়টা প্রচুর টাকা কামিয়েছে কোম্পানি। কিন্তু লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ইদানিং কয়েকটা মেজর ইশুতে ফেঁসে গেছে। ব্রীজ একটা কোলাপস করেছে আদিবাসী অঞ্চলে, বেশ কিছু লোক মারা গেছে। হাইওয়ের যে অংশটা ওরা করেছিল, সেটা তিন জায়গায় ধসে গেছে। পার্লামেন্টে প্রচুর হৈচৈ হয়েছে এ নিয়ে। কাগজে দেখে থাকবে। গত মাসে ইনভেস্টিগেশন কমিটি বসানো হয়েছে। এর মধ্যেই রিপোর্ট বেরোবে। আর যেটা তোমার জানা দরকার সেটা হল যে আমি এই কমিটির চেয়ারম্যান।

বল কি?

তাই তো বলছি। ওদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সমস্ত সাক্ষীসাবুদ ওদের বিরুদ্ধে। বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।

কি হবে?

প্রথমে তো ওদের ব্ল্যাক লিস্ট করা হবে। আর কোনও কাজকর্ম ওরা পাবেনা। তাতে ওদের এই ব্যবসা উঠে যাবে। দ্বিতীয়তঃ ক্ষতিপুরণের সিদ্ধান্ত যদি হয়, তবে বিষয় সম্পত্তি ক্রোক হতে পারে। আর ফাইনালি, ক্রিমিনাল নেগলিজেন্সের জন্য জেলও হতে পারে।

এ মা। বেচারা ছন্দা!

সত্যি কি বেচারা? ভেবে দেখ তো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে তুমি কে সেটা জেনেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তোমাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। তোমার থ্রুতে আমাকে অ্যাপ্রোচ করার ইচ্ছে হয় তো।

অত সোজা নয়। তুমি আমাকে পুরো ব্যাপারটা বলে ভাল করেছ। আমি আর ওদেরকে কাছে ঘেঁসতে দেব না।

ঐ গাড়িতে যদি তোমাকে কেউ দেখে থাকে, তবে কিন্তু আমি একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ব। শত্রুর অভাব কিন্তু নেই আমার। এ ধরনের বেশ কিছু কেস হ্যান্ডেল করেছি আমি আর প্রচুর বন্ধু খুইয়েছি।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা কাকতালিয়।

কেন কি করে?

দেখো, সেদিন ছন্দা এখানে বেশিক্ষন বসল না। মনে হচ্ছিল এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে। যদি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আসত, তবে বসত এবং তোমার সঙ্গে আলাপ করে যেত। সত্যি কথা বলতে কি ও একবারের জন্যও তোমার বা মিন্টির কথা জিজ্ঞেস করল না। ওদের বাড়িতেও না।

তবে তোমাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেল কেন?

ওর বৈভব দেখাতে। সারাক্ষণ তো নিজেদের ব্যবসা আর ধন সম্পত্তির গল্পই করল। বাড়ি দেখালো ঘুরে ঘুরে। রাজকীয় কায়দায় খাওয়ালো...

সেটা অসম্ভব নয়। তবে সন্দেহ একটা থেকেই যায়।

আর দিব্যেন্দু, ছন্দার বর তো আমাকে পাত্তাই দিল না। যদি আমার পরিচয় জানত, তবে একটু খাতির করত আশা করি।

দিব্যেন্দুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে না কি?

হ্যাঁ কি সব কাগজ পত্র নিতে এসেছিল। আমার সঙ্গে তো ভাল ভাবে কথাই বলল না। আমার খুব খারাপ লেগেছে। তাই বলছি, যদি ও জানত আমি কে, তবে অত অভদ্র ব্যবহার করত না।

গুড পয়েন্ট। কোথায় দেখা হল?

আমরা তখন খেতে বসেছি। হঠাৎ হন্তদন্তঃ হয়ে ঢুকল, ঢুকেই বেশ কড়া মেজাজে ছন্দাকে বলল আলমারির চাবি দিতে। ছন্দা আলাপ করিয়ে দিল আমার সঙ্গে, ভাল করে আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। আমার খুব খারাপ লেগেছে ছন্দার বরের ব্যবহার। তবে খুব টেন্স মনে হচ্ছিল। পরে ছন্দা বলল যে কি একটা কেসের ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে মীটিং চলছে। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তোমার এই কেসটা নিয়েই হয়তো। 

হতে পারে, জানিনা। কিন্তু সাবধান। এর পরে যদি যোগাযোগ করে বলে দিও ব্যস্ত আছ।

ঠিক আছে তুমি চিন্তা কর না। বসো, আমি চা নিয়ে আসছি। একটু সময় দিতে হবে কিন্তু, আমার ফিরতে এত দেরি হবে বুঝতে পারিনি।


ব্রততী বেরিয়ে যায়, রান্নাঘরে ঢোকে। ছন্দাটার জন্যে খারাপই লাগছে। বেচারার তাসের ঘর ভেঙে পড়তে আর দেরি নেই। আবার অনুকম্পাও হচ্ছে এই ভেবে যে এত বর আর বরের ব্যবসার কথা বললি সারা দুপুর ধরে, কিন্তু তোর বরের ভবিষ্যৎ তো এখন আমার বরের হাতে।


চায়ের জল বসায় ব্রততী। একটু আলু বের করে ধুয়ে, ছাড়িয়ে কেটে রাখে এক পাশে। দেরাজ খুলে ময়দা বের করে। আজ একটু লুচি তরকারি করে দেবে চায়ের সঙ্গে। অনেক দিন বিকেলের জলখাবারে লুচি হয়নি। আজ একদিন হলে কিচ্ছু হবে না। এত লুচি খেতে ভালবাসে দীপ্ত।


************

























Saturday 12 September 2020

প্রলাপ: নানা রঙের দিনগুলি

প্রলাপ: নানা রঙের দিনগুলি: নানা রঙের দিনগুলি বাবা আসামে চাকরি করতেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন থাকতেন কলকাতা ও তার আশেপাশে। তাই বছরে একবার কলকাতা...

একটি সুপাত্র

 একটি সুদর্শন যুবক। পেটানো, মেদহীন চেহারা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। কলেজ জীবনে খেলাধূলো করেছে প্রচুর। নানা বিষয়ে পড়াশোনা ও জ্ঞান। বাংলা, হিন্দী, ইংরিজি সব ভাষাতেই সচ্ছন্দ। বয়সটা ঠিক জানিনা। পঁচিশ থেকে এই একত্রিশ বত্রিশের মধ্যে। এই ছেলের কি কোনও পাত্রী জুটবেনা? বা একটি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী বান্ধবী?

আপনারা বলবেন নিশ্চয়ই জুটবে। কিন্তু জোটেনি। ছেলেটি কিন্তু বাংলার গর্ব। পেশায় একজন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝে পিস্টল বা রিভলভার ব্যবহার করে, কিন্তু আসল অস্ত্র হল মগজাস্ত্র।

প্রদোষ মিত্র। বা আমাদের সবার প্রিয় ফেলুদা। সব ভাল কিন্তু কেমন যেন প্রেমহীন জীবন। এত লোকের সঙ্গে আলাপ, কত মক্কেল, প্রচুর অনুরাগী, কিন্তু কোথাও কোনও নায়িকার দেখা পাওয়া গেলনা। কিন্তু ফেলুদার পূর্বসুরীদের দেখুন। কিরিটী রায়ের একটি সুন্দরী স্ত্রী ছিল, - কৃষ্ণা। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ তো আত্মপ্রকাশের কিছু পরেই অর্থমনর্থম রহস্য সমাধান করে সত্যবতীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ব্যোমকেশ বাবু অবশ্য বিশেষ ভাগ্যবান। এক চিরকুমার বন্ধু আজীবন বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সংসারের দেখশোনা করে জীবন কাটিয়ে দিলেন।

কত লোকের সঙ্গে আলাপ ফেলুদার। কত বড় বড় শিল্পপতি, আইনজীবি, বিশাল জমিদার। কারও বাড়িতেই একটি সুলক্ষণা পাত্রী পাওয়া গেলনা। শুধু নায়িকা কেন? ফেলুদার জীবনে কোনও মাসীমারও আবির্ভাব হয়নি। বেশির ভাগ মক্কেল হয় অবিবাহিত কিংবা বিপত্নীক। যাঁরা বিপত্নীক, তাদের সবারই পুত্র সন্তান। অবিবাহিতদের ভাইপো বা ভাগ্নে। আশ্চর্য! কি কপাল! এত মক্কেল, পুলিস অফিসারদের সঙ্গে আলাপ, কিন্তু কারও বাড়িতেই তোপসের একজন বৌদি পাওয়া গেলনা। এই যে সিধু জ্যাঠা? তাঁর পরিচিত একটি সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েও কি ছিলনা? লালমোহন বাবুও বা কেমন? সাহিত্যিক মানুষ, - এই ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর তো নিতেই পারতেন।

অনেকে হয়তো বলবেন, - বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে? শার্লক হোমসেরও তো বিয়ে হয়নি। সে না হোক, ওদের সঙ্গে আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি মেলেনা। অবশ্য শুধু ফেলুদা কেন? অনেক বাঙালি হিরোই অবিবাহিত থেকে গেছেন। যেমন জয়ন্ত-মাণিক, বিমল-কুমার, দীপক চ্যাটার্জি-রতন লাল ইত্যাদি। তার আগে শ্রী পাঁচকড়ি দে দেবেন্দ্র বিজয় ও অরিন্দম বাবুর কথা বলেছিলেন। কিন্তু এঁদের সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনা। সবাইকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়েই বলছি, এঁদের মধ্যে শ্রী প্রদোষ মিত্রই সবচেয়ে সুপাত্র হিসেবে গন্য হবেন। ফেলুদার সত্যিই একটা বিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল।

ফেলুদার অভিভাবক বেঁচে থাকলে সবাই মিলে দাবী জানাতাম, - ফেলুদার বিয়ে দিন। এখন তো আর তা সম্ভব নয়।

এই একটা বাসনা অপূর্ণই থেকে গেল।

কলকাতা ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

Tuesday 23 July 2019

নানা রঙের দিনগুলি

নানা রঙের দিনগুলি

বাবা আসামে চাকরি করতেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন থাকতেন কলকাতা ও তার আশেপাশে। তাই বছরে একবার কলকাতায় আসা হতই। আমাদের স্কুল ছুটি হলে বাবাও ছুটি নিতেন, - হয় গরমে বা পূজোর সময়।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। আমার বছর দশেক বয়স। হাঁ করে কলকাতার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট দেখতাম।

সবসময়ের সাথী ছিল আমার মাস্তুতো ভাই। আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। কিন্তু ছোট হলে কি হবে, কলকাতার ছেলে যে। অনেক কিছু জানে। আমাকে অনেক কিছু শেখাতো, - “ঐ যে দেখছিস বাস, সব পাঞ্জাবী (শিখ) ড্রাইভার আর কনডাক্টার, ঐ বাসগুলো এমনি বাস। আর যেগুলো খুব নতুন আর ঝকমকে, সেগুলো স্টেট বাস। ড্রাইভার, কনডাক্টার সব বাঙালি।

কথাগুলো খুব খাঁটি। ডাঃ বিধান রায় তখন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। চালু করেছেন স্টেট ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন। আধুনিক বাস এল বাইরে থেকে। কর্মচারিরা বেশির ভাগ পূর্ব বাংলা থেকে আগত। দোতলা বাসে চড়ার খুব শখ ছিল। রাস্তায় বেরোলেই বাবাকে বলতাম, - দোতলা বাসে যাব। স্টেট বাসের গায়ে দরজার কাছে ইংরিজিতে লেখা থাকত, - Wait till the bus stops.  ঠিক নীচেই লেখা থাকত, - বাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এই নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হয়। অনেক বিদগ্ধ নাগরিক জানালেন যে বাংলা অনুবাদটি ভুল। আসলে লেখা উচিৎ, - বাস না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। অনেক তর্কাতর্কি লেখালেখির পর একজন জানালেন যে “বাস থামলে ওঠানামা করুন” লিখলে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকেনা। যাই হোক কর্তৃপক্ষ এসব তর্ক বিতর্কে কর্ণপাত করেন নি।

ট্রামে চড়ার আকর্ষণ ছিল খুব। বেশ ট্রেনের মত অথচ ট্রেন নয়। সামনের কামরা ছিল প্রথম শ্রেণী, গদি মোড়া আসন। পেছনেরটি দ্বিতীয় শ্রেণী, কাঠের আসন। ভাড়া কত ছিল জানিনা। আমি তো আর ভাড়া দিতাম না, বাবা দিতেন।

ট্যাক্সি ডাকলেই দাঁড়াতো। কখনও কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যাবনা বলতে দেখিনি। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বেশির ভাগ ছিলেন শিখ। শহরের পরিবহন অনেকটাই এঁরা নিয়ন্ত্রন করতেন।

১৯৬১ সালে স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় পড়তে আসি, সে কি আনন্দ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হই প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে। তখন ধীরে ধীরে স্কুলগুলোতে এগারো ক্লাস শুরু হচ্ছে। দশ ক্লাসের স্কুল ফাইনাল থেকে এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি। হায়ার সেকেন্ডারির পর বি-এ, বি-কম, বিএসসি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলের পড়াশোনা। যে সব স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি চালু হয়নি, তাদেরকে স্কুল ফাইনালের পর এক বছর প্রি-ইউনিভার্সিটি করতে হত।

সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হলেও হস্টেলে ঠাঁই হলনা। খোঁজ খবর করে এক জায়গার সন্ধান পাওয়া গেল। বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের মোড়ে অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে সীট খালি আছে। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হল। সেই বাড়ীটি এখনও আছে। তবে নাম পালটে গেছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রীটও আরও কয়েক বছর নাম পালটে বিধান সরণী হয়ে গিয়েছিল।

কলেজে যাবার জন্য মোড়ের মাথা থেকে ২বি বাস ধরতাম। চৌরঙ্গী রোড (তখনও জহরলাল নেহরু রোড হয়নি) আর পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে নেমে যেতাম। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর মুর্তি ছিল। মেট্রো রেলের কাজের সময় সেটি স্থানান্তরিত হয়। ভাড়া ছিল ২০ পয়সা। ক’দিন পর এক সহপাঠী জানালো যে আমি মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করছি। আমি যদি ২বি তে না এসে  ৮বি বাস ধরি, তবে পার্কস্ট্রীট আর সার্কুলার রোডের মোড়ে, মানে পার্কস্ট্রীটের অন্য প্রান্তে নামব। ভাড়া ১৫ পয়সা। আমার ৫ পয়সা বেঁচে যাবে। তার মানে সপ্তাহে, মানে ছ-দিনে ৩০ পয়সা। এক মাসে ১টাকা ২০ পয়সা। একটা সিনেমার টিকিট, তাও বেশ ভাল সীটে। দারুণ ব্যাপার।

কোনও নেশা ছিল না। তবে একটি বিলাসিতা রপ্ত করেছিলাম। শণিবার একটু আগে ছুটি হত। হস্টেলে ঢোকার মুখে একটা পান, বিড়ি সিগারেটের দোকান ছিল। তার কোনটারই আকর্ষণ আমার ছিলনা। তবে সেখানে বরফ ঠান্ডা কোকাকোলা পাওয়া যেত। একটি বোতলের দাম ২৫ পয়সা। হস্টেলে ঢোকার আগে এক বোতল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে, তারিয়ে তারিয়ে সেই ঠান্ডা পানীয় উপভোগ করতাম। সেই আনন্দ আর কোনও দিনও পাইনি।

রাত্রে দশটার সময় হস্টেলের লাইট নিবিয়ে দেওয়া হত। সকালে খুব ভাঙত কিছু বর্ষীয়ান কীর্তনিয়ার কল্যাণে। খোল করতাল নিয়ে সূর্যোদয়ের আগেই এঁরা বেরিয়ে পড়তেন রাস্তায়। উদাত্ত কন্ঠে গাইতেন, - রাধে রে গোবিন্দ রাধে, রাধে রে গোবিন্দ। সেই সুরের ঝংকার এখনও কানে লেগে আছে।

মাসে একটা সিনেমা দেখতাম। প্রত্যেকটি সিনেমা মুক্তি পেত কয়েকটি বিশেষ হলে। যেমন “রূপবাণী, অরুণা, ভারতী” বা “শ্রী, ইন্দিরা, প্রাচী” বা “মিনার, বিজলী, ছবিঘর”। বেশ ভীড় হত। ভাল সিনেমার রজত জয়ন্তী, সুবর্ণ জয়ন্তী সপ্তাহ ফলাও করে ছাপা হত খবরের কাগজে।
আইন শৃঙ্খলার সমস্যা বরাবরই ছিল। কিন্তু সেটা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না কখনও। একদিন হস্টেলের ঘরে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছি। হঠাৎ শুনলাম বাইরে প্রচুর সোরগোল, চিৎকার। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি দু-দলের মধ্যে প্রচন্ড মারামারি চলছে। সেকালে বোমাবাজি দেখিনি। সোডার বোতলই চলত বেশি। গন্ডগোল দেখলেই পান, সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়র দোকানদারেরা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেন। যাই হোক। মিনিট পনেরোর মধ্যে পুলিসের গাড়ি এসে পৌঁছল। লাফিয়ে নামল আধ ডজন কন্সস্টেবল, হাতে লাঠি, মাথায় লাল পাগড়ি। সঙ্গে এক সাদা উর্দি পরা অফিসার। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক শুনশান। যারা মারামারি করছিল তারা কর্পূরের মত উবে গেল। একজন কন্সস্টেবলকে দাঁড় করিয়ে ফিরে গেল পুলিসের গাড়ি। একটু পরে দেখি সেই একলা পুলিস সামনের এক ছোট্ট চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসেছেন। আমরা গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আলাপ জমালাম। জিজ্ঞেস করলাম, - আবার গোলমাল হলে আপনি একা কি করবেন? ভদ্রলোক হেসে বললেন, - আমি তো কিছু করব না। করবে তো এ; - বলে নিজের পাগড়ি দেখিয়ে দিলেন। এই পাগড়ি দেখলে কেউ কাছে আসার সাহস পাবে না। এমনি ছিল সেকালে পুলিসের দাপট। কিছুক্ষণ পরে পুলিস ভদ্রলোক পকেট থেকে ব্যাগ বের করে চায়ের দাম মেটালেন। দোকানদারও হাত পেতে পয়সা গুণে নিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই।

বেহালার পর্ণশ্রীতে থাকতেন আমার স্নেহশীলা বড়মাসী। বাড়ির জন্য মন কেমন করলে বাসে উঠে রওনা দিতাম। রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনে। তারাতলায় দেখতাম অজস্র কারখানা, সারি সারি। কখনও হাওড়া স্টেশনে উঠে চুুঁচুড়া, আমার মাতুলালয় ও জন্মস্থান। বর্দ্ধমানে কাকা থাকতেন, সেখানে যাওয়া হত মাঝে মাঝে।হাওড়ায় বা হাওড়া থেকে রেললাইনের দু-ধারে অজস্র কারখানা বা ইন্ডাস্ট্রি। পশ্চিম বঙ্গ তখন এক শিল্পোন্নত রাজ্য। ভাবতাম পড়াশোনা শেষ করে এখানে কোনও এক জায়গায় নিশ্চয়ই চাকরি পেয়ে যাব। সেটা আর সম্ভব হয়নি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যখন চাকরির খোঁজে রাস্তায় নামলাম, তখন সব কারখানা হয় বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার মুখে। সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে।

কলকাতা
২০ জুলাই ২০১৯

Saturday 6 January 2018

ভ্রান্তিবিলাস – এ যুগে

আচ্ছা দু-জন মানুষের কি এক চেহারা হতে পারে? আমি যমজ ভাই বোনদের কথা বলছিনা। আমি বলছি দু’টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অনাত্মীয় মানুষের কথা। আমরা যে সব কাহিনী টিভিতে বা সিনেমায় দেখি, - এই যেমন, উত্তম কুমারের ঝিন্দের বন্দী বা দেব আনন্দের হম দোনো। অদ্ভূত ব্যাপার, তাই না? এ সব ঘটনা বাস্তব জীবনে কখনও ঘটে না বলেই সবার ধারণা। কিন্তু আমার জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে আমার মনে হয় আমার মত চেহারার এক বা একাধিক লোক এই শহরেই আছে।

প্রথম থেকেই বলি।

আজ থেকে বছর ষাটেক আগের কথা। আমি তখন স্কুলে। বয়স ১০ বা ১২। আসামে থাকতাম। বাবার চাকরি ছিল সেখানেই। আমার ও আমার ছোট বোনের পূজোর ছুটি শুরু হলে বাবাও ছুটি নিতেন। আমরা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসতাম। এসে উঠতাম রাজাবাজারে আমার কাকার বাড়ি। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে বালিগঞ্জের ফার্ন রোডে আমার বড়ো পিসীমার বাড়ি। তারপর ক’দিন পর চুঁচুড়ায়, - আমার জন্মস্থান ও মাতুলালয়। সেখানে খুব ধুমধাম করে পূজো হত। পূজো শেষ হলে আবার কলকাতায়। আবার বড়ো পিসীমার বাড়ি, কাকার বাড়ি হয়ে ফেরত।

পিসীমার সহকারী ছিলেন হরিকাকা। হরিকাকা বহুদিন ধরে পিসীমার পরিবারে। তিনি সবার হরিকাকা। পিসেমশায়, আমার পিস্তুতো দাদা ও দিদি, আমার মা ও বাবা ও আমাদেরও তিনি হরিকাকা। তাঁর বয়স কেউ জানত না, একটু ন্যুব্জ, কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণকায় চেহারা। তাঁর তত্ত্বাবধানে আমার  বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। একদিন সকালে আমি হরিকাকার সঙ্গে বাজারে গেছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি, হরিকাকার শক্ত হাতে আমার হাত। এমন সময়, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোক, ফর্সা, লম্বা দোহারা চেহারা, পরনে ধবধবে ধুতি ও পাঞ্জাবী, আমায় দেখে একগাল হেসে বললেন ,- একি? তোমরা কলকাতায়? কবে এসেছো? মা, বাবা, বোন সবাই এসেছেন নিশ্চয়ই। আমি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির। অচেনা  লোক দেখে বাক্যিহারা হয়ে যাই, মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভদ্রলোকের আবার প্রশ্ন, - কেমন লাগছে কলকাতা? আমি মিনমিন করে বললাম, - ভাল লাগছে। এর পরের প্রশ্নে আমি একেবারে দিশাহারা। উনি জিজ্ঞেস করলেন, - দিল্লী থেকেও ভাল? দিল্লীতে আমার এক মাসী থাকতেন, সেখানে একবার যাওয়ার কথাবার্তা চলছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমি কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক আবার বললেন, - কি? দিল্লী ভাল না কলকাতা ভাল? আমি মিনমিন করে বললাম, - কলকাতা। ভদ্রলোক খুশি হয়ে থুতনি ধরে আদর করে চলে গেলেন। এর পর অবশ্য ওনার সঙ্গে দেখা হয়নি। উনি নিশ্চয়ই অন্য কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়েছিলেন।

পরবর্তী ঘটনা ঘটে অনেক দিন পরে। আশির দশকের প্রথম দিকে। বাবা কাজ থেকে অবসর নিয়ে তখন কলকাতায়। আমি সদ্য চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছি এক বছর আগে। প্রথম ছুটিতে দেশে ফিরেছি। খুব ফুরফুরে মেজাজে। কলকাতা পৌঁছেই বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে যোগাযোগ করছি। প্রথম ফোন করলাম দেবু মানে দেবরাজের বাড়ি। ফোন ধরল রত্না, দেবুর স্ত্রী। দেবুর মা হাসপাতালে। দেবু ছুটি নিয়েছে। ডাক্তার, বদ্যি, ওষুধ-পত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত। রত্না জানাল দেবুর বাড়ি আসার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে ভিজিটিং আওয়ারে হাসপাতালে গেলে দেখা হবে। রত্না জানিয়ে রাখবে আমার কথা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাসীমা খুব স্নেহশীলা। ছাত্রজীবনে অনেকবার দেবুর বাড়ির ছাদে আড্ডা মেরেছি। মাসীমা দফায় দফায় চা, জলখাবার পাঠাতেন।

ভাবলাম হাসপাতালে একা না গিয়ে আরও কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই। অনিন্দ্যকে ফোন করলাম। অনিন্দ্য ব্যস্ত মানুষ। এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কম বয়সে খুব উন্নতি করেছে। শহরের কয়েকটি তথাকথিত অভিজাত ক্লাবের সদস্য, গলফ-টলফ খেলে। পরের দিন রবিবার। অনিন্দ্য জানালো বিকেলের দিকে আমরা হাসপাতালে যাবো একসঙ্গে। ওকে ওর ক্লাব থেকে তুলে নিতে হবে, ওর ব্রিজ ম্যাচ আছে। ওর গাড়ি থাকবে না। গাড়ি নিয়ে শ্বেতা, মানে ওর স্ত্রী, বন্ধুদের নিয়ে শপিং-এ যাবে।

পরের দিন বিকেলের দিকে একটি গাড়ি ভাড়া করে আমি অনিন্দ্যর ক্লাবে পৌঁছলাম। অনিন্দ্যের নির্দেশ মত ক্লাবের রিসেপশনে গিয়ে ওর নাম বললাম। সেকালে তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা। রিসেপশনের ভদ্রলোক আমায় বসতে বললেন। সামনে কয়েকটি সোফা সাজানো ছিল, - গিয়ে বসলাম। হঠাৎ দেখি বছর পঁচিশের একটি ছেলে, গলায় টাই, বোধহয় ঐ ক্লাবেরই কর্মচারী, আমায় দেখে বলল, - গুড আফটারনুন। স্যর আপনি? আমি একটু ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে আবার প্রশ্ন, - অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম স্যর। আপনি কি এখন এখানে থাকেন না? আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার স্মৃতি হাতরে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কুল কিনারা পাচ্ছি না। মিনমিন করে জানালাম, - না এখন বাইরে থাকি। ছেলেটি একগাল হেসে বলল, - তাই আপনাকে আজকাল ক্লাবে দেখিনা। আমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করার আগেই অনিন্দ্য পৌঁছে গেল। ছেলেটি অনিন্দ্যকেও গুড আফটারনুন জানালো। অনিন্দ্য একটু মৃদু হেসে আমাকে বলল, - চল রওনা হই।

গাড়িতে উঠে অনিন্দ্যকে বললাম। কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বলল, - অন্য কারও সঙ্গে গোলমাল করেছে বোধহয়। যা নন-ডেসক্রিপটিভ চেহারা তোর!

যাক, সংক্ষেপে বলি মাসীমা মানে দেবুর মা সে যাত্রা সেরে উঠেছিলেন।

এবার তৃতীয় ঘটনা।

বছর পাঁচেক আগে কাজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরেছি। গিন্নীকে যথা সম্ভব সাহায্য করছি নতুন সংসার সাজিয়ে নিতে। সাংসারিক ব্যাপারে আমার কোনও রকম সুনাম নেই। যাই হোক, একদিন গিন্নীর দেওয়া লিস্ট পকেটে নিয়ে বাজারে বেরোলাম। আবাসনের পাশে আধুনিক শপিং মল। সেখানে বিশাল এক সুপার মার্কেট। কেনা কাটা করে বিল মেটাতে ডেবিট কার্ড বের করলাম। বিল হয়েছে ৮৩৮ টাকা। পেমেন্ট কাউন্টারের ছেলেটি কার্ড ঢুকিয়ে কি টেপাটেপি করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, - এরর মেসেজ আসছে স্যর। আমি দ্বিতীয় বার চেষ্টা করতে বললাম। এবার কোনও গোলমাল হলনা। বিল পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাগ হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পকেটে মোবাইল ফোন দু-বার কুঁক কুঁক করে উঠল, - বের করে দেখি ব্যাংক থেকে এসএমএস এসেছে, - ৮৩৮ টাকা দু-বার ডেবিট হয়ে গেছে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে দেখালাম। ছেলেটির তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা, - স্যর আপনার সামনেই তো এরর মেসেজ এসেছিল, আপনাকে তো দেখালাম। শেষ অব্দি ছেলেটিই বলল, - ম্যানেজারের কাছে যাই চলুন।

একটি মাঝারি আকারের সুসজ্জিত অফিস ঘরে ম্যানেজার আসীন। মহিলা বেশ আকর্ষণীয়া; বছর পঞ্চাশের মত বয়স। এককালে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন, - স্যর আপনি? বুঝলাম আবার সেই ভ্রান্তিবিলাস। ভদ্রমহিলা এক নাগারে বলে যাচ্ছেন – আমাকে চিনতে পারছেন না স্যর, আমি সেই যে মিউজিকাল ওয়ার্লডে ছিলাম। পার্ক স্ট্রীটে। আপনি ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল রেকর্ড কিনতে আসতেন। নতুন কিছু এলে আমি আপনাকে ফোন করে খবর দিতাম...। পার্ক স্ট্রীটের মিউজিকাল ওয়ার্লডে আমি এক আধবার গেছি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী গানের সিডি কিনতে। পাশ্চাত্য ধ্রূপদী সঙ্গীত আমি কস্মিন কালেও শুনিনি।  আমি একটু দেঁতো হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম এনার সাহায্য যখন দরকার তবে আমার আসল পরিচয় না দেওয়াই ভাল।

ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে এত খুশি হয়েছিলেন যে সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। আমাকে সযত্নে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে উনি বেশ কয়েকটা ফোন করলেন এদিন ওদিক। তিন দিন পর ৮৩৮ টাকা আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেল।

এখনও সেই সুপার মার্কেটে গেলে আমার সঙ্গে দেখা হয় মহিলার। আমি খুব ব্যস্ততার ভান করে পাশ কাটিয়ে সরে যাই।

এর পরের ঘটনা গত পূজোর সময়কার।

অষ্টমীর দিন সকালে কয়েক জন প্রবীণ নাগরিক কলকাতা শহরে বনেদি বাড়ির পূজো দেখতে বেরিয়েছিলাম। সবাই আমাদের আবাসনের। কয়েকটি অচেনা মুখও দেখলাম। আলাপ পরিচয় করে জানতে পারলাম এঁরা কলকাতায় থাকেননা। এঁদের ফ্ল্যাট বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে এখানে এসে ছুটি কাটিয়ে যান। সারা দিন ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে যখন ফিরে আসছি, আবাসনের কাছাকাছি এসে, আমাদের পাশের সীটে বসা দম্পতীর সঙ্গে আলাপ হল। বছর ষাটেক বয়স। প্রেসিডেন্সীতে সহপাঠি ছিলেন। এক সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। এখন দু-জনেই আমেরিকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বিষয় অর্থনীতি। দুই ছেলে সেদেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত।

ওনাদের পরিচয় নিয়ে আমি বললাম, - আচ্ছা এবার আমার পরিচয় দিচ্ছি। তাতে ওঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে ও শুনে আমার ভির্মি খাওয়ার মত অবস্থা। দুজনেই হাতজোড় করে সসম্ভ্রমে বলে উঠলেন, - লজ্জা দেবেন না স্যর, আপনাকে কে না চেনে, - কত অনুষ্ঠানে গান শুনেছি আপনার। আমার তখন হেঁচকি টেচকি উঠে ভয়ঙ্কর অবস্থা। ভাবলাম এ রকম ভাবে চলতে পারেনা। আসল পরিচয় দিয়ে দেওয়া উচিৎ , এবং এখনই। কিন্তু সেই সময়েই আমাদের গাইড বলে উঠলেন আপনাদের বাড়ি পৌঁছে গেছি, এবার আস্তে আস্তে নেমে যান। আমি সামলে উঠে কিছু বলার আগেই ওঁরা বাস থেকে নেমে গেলেন। আমার সঠিক পরিচয় আর দেওয়া হলনা।

পরে খোঁজ খবর করেছিলাম। শুনলাম ওঁরা আমেরিকায় ফিরে গেছেন। সামনের বছর এলেই ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসল পরিচয়টা দিতে হবে নইলে বিবেকের দংশনেই জ্বলে পুড়ে মরব।

আপনারা যারা আমাকে চেনেন তাঁদের অনুরোধ যদি আমার মত দেখতে কারও সঙ্গে আলাপ হয় যিনি শহরের কোনও অভিজাত ক্লাবের সদস্য, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীতের ভক্ত, সুগায়ক এবং ছোটবেলায় দিল্লীতে ছিলেন, তবে দয়া করে আমাকে জানাবেন।

শুভেচ্ছা রইল।

কলকাতা ৬ই জানুয়ারি ২০১৮ 


Monday 5 June 2017

আতাতুর্কের দেশে



যাত্রা হল শুরু
মুম্বাই থেকে বাহরেইন হয়ে গালফ এয়ারলাইন্সের প্লেন যখন ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে এসে নামল, তখন সকাল প্রায় দশটা চড়া রোদ উঁকি মারছে প্লেনের জানলা দিয়ে ক্লান্ত লাগছে খুব আগের দিন বিকেলে বেরিয়েছি কলকাতা থেকে, ইন্ডিগোর ফ্লাইটে মুম্বাই পৌঁছেছি  রাত আটটায়,- তারপর ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কেঠো চেয়ারে সারা রাত অপেক্ষা। ইস্তানবুলের প্লেন ছাড়ল ভোর সারে ছটায়। প্লেন থেকে নামার সময় মনে হচ্ছিল শরীর আর চলছে না।

ইস্তানবুল আতাতুর্ক বিমান বন্দর তুরস্কের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ত বিমান বন্দর। বেশ বড়, কিন্তু দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মত অত ঝকঝকে বা বিলাস বহুল নয়। ভিসা আগেই করা ছিল। ইমিগ্রেশনে বেশি সময় লাগল না। অনেকগুলো কাউন্টার। এক অতি সুদর্শণ যুবক কাগজ পত্র দেখে খুব গম্ভীর মুখে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে গুড মর্নিং, থ্যাঙ্ক ইউ ইত্যাদি বললাম কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম না। মনে হল কি জানি বাবা, এখানকার লোক বোধহয় এরকমই গোমড়ামুখো। পরে অবশ্য ধারণা পালটে গিয়েছিল। তুরস্কের লোকজন খুবই অমায়িক ও বন্ধুসুলভ। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

দশ জনের দল আমাদের। সবাই আমাদের আবাসনেরই বাসিন্দা এবং প্রবীন নাগরিক। প্রত্যেকের একটি করে মাঝারি সাইজের ব্যাগ। মালপত্র নিয়ে কাস্টমস ছাড়িয়ে বেরিয়ে দেখলাম দুটি কমবয়সী ছেলে হাতে বিরাট প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাতে বেশ স্পষ্ট হরফে বড় বড় করে লেখা টমাস কুক ওয়েলকামস দ্য গ্রুপ ফ্রম কোলকাট্টা (ইংরিজিতে লেখা বানান Kolkatta), - কবে যে লোকে আমাদের শহরের নামটা শুদ্ধ ভাবে লিখতে বা বলতে পারবে

ছেলে দুটি সাদর অভ্যর্থনা জানাল আমাদের একটি ভারতীয়, - নাম বলল সুর্জিৎ (সুরজিৎ), এখানেই থাকে স্ত্রী কন্যা থাকে দিল্লীতে দ্বিতীয় ছেলেটি স্থানীয়, - নাম ওসগুর, যে রকম ভাবে নামটা উচ্চারণ করল, - মনে হল পেটের ভেতর থেকে আর গলার গভীরতম জায়গা থেকে বেরোচ্ছে আমরা সবাই বার কয়েক চেষ্টা করে রণে ভঙ্গ দিলাম ওকে জানিয়ে দিলাম, - তোমায় ভাই আমরা অস্কার বলে ডাকবো ছেলেটি সহাস্যে রাজি হল।

সুরজিৎ জানালো আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে কারণ দিল্লী থেকে আরেকটা ফ্লাইটে আরও ছজন আসছেন ওঁরাও আমাদের দলে, দিল্লী থেকে বুক করেছেন অগত্যা এয়ার পোর্টে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই ঘন্টা খানেক পর দিল্লীবাসীদের সঙ্গে আমরা রওনা হলাম শহরের দিকে সুন্দর আরামদায়ক বাস, সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত

ইস্তানবুল – অতীত ও বর্তমান
সুরজিৎ ও অস্কার আমাদের গাইড প্রথমে সুরজিৎ, তারপর অস্কার মাইক হাতে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল এই ঐতিহাসিক শহরের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপ, দুটি মহাদেশে বিস্তৃত এই শহরের মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় দেড় কোটি। ঝকঝকে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় ছুটে চলেছি শহরের দিকে। ডুয়েল ক্যারেজওয়েরর মাঝখানের ডিভাইডারে সুন্দর ফুলের বাগান। সেই ফুল কেউ ছেঁড়ে না। শহরের সৌন্দর্যের ব্যাপারে নগরিকেরা খুব সচেতন।

রাস্তার ডিভাইডারে ফুলের বাগান

ইস্তানবুলের বর্তমান আধুনিক চেহারা দেখলে কে বলবে যে এই শহরেই রোম সম্রাট কনস্টানটাইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর রাজধানী, - কনস্টানটিনোপোল, ৩৩০ খৃষ্টাব্দে। অস্কার জানালো, এই শহরের ইতিহাস আরও পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে যে  তিন হাজার বছর আগেও এখানে এক প্রাচীন উপজাতির বসবাস ছিল। সেই সময়ের এর নাম ছিল লাইগস। পরবর্তী কালে গ্রীক সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এই শহর, নাম দেওয়া হয় বাইজান্টিয়াম। অত্যন্তঃ জটিল এই ইতিহাসের খুঁটিনাটি। আমরা খেই হারিয়ে ফেললাম। শুধু এইটুকু জানলাম যে পরবর্তী কালে এই শহর অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে ও ঘোষিত হয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। নাম হয় ইস্তানবুল। তবে ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজধানী স্থানান্তরিত হয় আঙ্কারা শহরে। ইস্তানবুল হারায় তার রাজনৈতিক গড়িমা। তবে এখনও এই শহরের বানিজ্যিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এখনও অক্ষুন্ন।

এই দেশের লোকেরা নিজেদের দেশকে বলে তুর্কিয়া। ইংরিজিতে বলে টার্কি। আমরা কেন তুরস্ক বলি সেই রহস্য ভেদ হলনা। আমাদের গাইড দু’জনও এ ব্যাপারের কোনও আলোকপাত করতে পারল না। দিল্লীবাসী আমাদের সহযাত্রীরাও জানালেন তুরস্ক শব্দ ওঁদের অপরিচিত। যাই হোক, এ নিয়ে আলোচনা আরেক দিন করা যাবে।
তুরস্কবাসীদের আচার ব্যবহার, চেহারা, পোষাক আষাক সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যমুখী। নারী ও পুরুষ গতানুতিক পশ্চিমী জামা কাপড়েই সচ্ছন্দ্য। কিন্তু এঁরা ধর্মপ্রাণ মুসলিম। এক’শ বছর আগেও এঁরা ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম খিলাফতের নাগরিক।

রাস্তার দু-ধারে একটু পর পরই চোখে পড়ে নানা আকারের মসজিদ। মসজিদের স্থাপত্য আমাদের পরিচিত স্থাপত্য থেকে একটু আলাদা। মসজিদের সামনে সুন্দর বাগান ও গাড়ি পার্ক করার সুব্যবস্থা। এখানে বলে রাখা ভাল যে তুর্কি স্থাপত্যের জগৎ জোড়া খ্যাতি ছিল এক কালে। ভারত ও উপমহাদেশের বহু শহরেও তার নিদর্শন রয়েছে।

মসজিদের স্থাপত্য একটু স্বতন্ত্র
রাস্তায় বেশ ভীড়। বুধবার, - কাজের দিন। শহরের কাছে এসে বাসের গতি কমে এলো। বেশ ট্র্যাফিক। অবশেষে পৌঁছোলাম হোটেলে। এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও স্নানাহার। হোটেলটি ইস্তানবুল শহরের কেন্দ্রেই। আশেপাশে অনেক দোকানপাট আর রেস্তোরাঁ।

বিকেলের দিকে মনে হল নতুন দেশে এসেছি যখন, হোটেলে বসে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে। দিল্লীবাসীরাও সাগ্রহে রাজি হলেন। আমাদের গাইডদ্বয়ও দেখলাম খুব উৎসাহী। যে বাসে করে এয়ারপোর্ট থেকে এসেছিলাম, সেই বাসটি হোটেলের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এটিই এখন আমাদের বাহন। বাসে উঠে বসলাম সবাই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম শহরটা, যতটা সম্ভব।

ইস্তানবুলের এক তৃতীয়াংশ লোক বাস করেন এশিয় অঞ্চলেবাণিজ্যিক কর্মকান্ড কিন্তু ইউরোপিয়ন অঞ্চলেই বেশিএশিয় অঞ্চল থেকে প্রচুর লোক প্রত্যেক দিন ইউরোপিও অঞ্চলে আসেন পেশাগত কারণে। এশিয়া আর ইউরোপিও অঞ্চলের মাঝখানে বয়ে চলেছে বসফরাস প্রণালী (Bosphorus Strait) স্বচ্ছ, পরিস্কার, টলটলে জলরাশি দেখলেই বোঝা যায়, এই প্রণালী খুব সযত্নে লালিত। জলে ভাসছে প্রচুর ছোট ও মাঝারি আকারের স্টীমার। তাতে রয়েছে লাঞ্চ, স্ন্যাক্স ও ডিনারের ব্যবস্থা। পর্যটকদের কাছে জায়গাটি খুব প্রিয়।

বসফরাস প্রণালী

আমাদের প্রশ্নের জবাবে অস্কার জানালো যে বসফরাস প্রণালীর একপ্রান্তে কৃষ্ণ সাগর (Black Sea) আর অন্য প্রান্তে মার্মারা সাগর (Sea of Marmara) এই সাগরেই অবস্থিত মার্মারা দ্বীপ, সেই নামেই সাগরের নাম এই দ্বীপেরমার্বেলজগদ্বিখ্যাত এবং মার্বেলের জন্যেই দ্বীপের নাম মার্মারা; - ওদের ভাষায় মার্বেলকে বলে মার্মারা! কি আশ্চর্য তাই না? মর্মরের সঙ্গে মার্মারার কি অদ্ভুত মিলতবে কি কোনও এক প্রাচীন যুগে সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক লেনদেন ছিল আমাদের দুই দেশের মধ্যে? তখনই কি আমাদের দেশবাসীরা এই দেশের নাম রেখেছিলেন তুরস্ক?

ইউরোপিয় অংশের বাণিজ্যিক অঞ্চল গমগম করছে পড়ন্ত বিকেলে। রাস্তার দু-পাশে অসংখ্য দোকানপাট, পর্যটকদের ভীড়ই বেশি। নানা রকম পণ্যতুরস্ক বেশ শিল্পোন্নত দেশ। এদের চর্ম ও বস্ত্র শিল্প পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের দলের মহিলারা সাগ্রহে ঢুকে গেলেন বিভিন্ন দোকানে। শুরু হল দরদাম। দোকানদারেরাও দেখলাম সাদরে নিমন্ত্রণ জানালেন সম্ভাব্য ক্রেতাদের।
 
রাস্তার দু-ধারে দোকান ও রেস্তোরাঁ
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা এইটুকুই। সন্ধ্যের পর সবাই দেখলাম খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন। একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম সবাই। বিছানায় পড়া মাত্রই গভীর নিদ্রা।

প্রাচীন স্থাপত্য
দ্বিতীয় দিন সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার উঠলাম বাসে। সুরজিৎ আর অস্কারও দেখলাম তৈরী। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থল হল সুলতান আহমেদ মসজিদ। সারা বিশ্বে এই মসজিদ “ব্লু মস্ক” বা নীল মসজিদ নামে পরিচিত। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত এই মসজিদ এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পর্যটন কেন্দ্র। এর ভেতরে ও বাইরের সাজ সজ্জা ও অলঙ্করণ থেকে এক নীলাভ দীপ্তি ভেসে আসে। সেই থেকেই এর নাম। ভেতর ও বাইরের সব সুক্ষ্ম কারুকার্য কিন্তু পুরোটা হাতে করা। এই মসজিদের আরও একটি বৈশিষ্ট হল এর ছ’টি মিনার, পাঁচটি বিশাল গম্বুজ ও আরও আটটি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ। দুর্ভাগ্য যে ক্যামেরায় ছ’টি মিনারের ছবি ফ্রেমে আনতে পারলাম না। তাই বাধ্য হয়ে পিকচার পোস্টকার্ড থেকে একটি ছবি দিলাম। অনন্য এর স্থাপত্য। ভেতরে চারদিকের দেওয়ালে অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি। এই বিশেষ স্থানটি একটি ধর্মীয় সৌহার্দেরও প্রতিক। ২০০৬ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এখানে এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। সঙ্গে ছিলেন এই মসজিদের ইমাম। দু-জনে এক সঙ্গে প্রার্থনা করেন এই ঐতিহাসিক মসজিদে।
   
নীল মসজিদ                                ছ’টি মিনার
Related image 
মসজিদের ভেতরে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম            ছাদ বা সিলিং-এ অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি

নীল মসজিদ থেকে হাঁটা পথে পৌঁছলাম আয়া সোফিয়া (তুর্কী উচ্চারণ) বা হ্যাগিয়া সোফায়া (Hagia Sophia)এই ঐতিহাসিক নীল মসজিদ থেকে অন্ততঃ এক হাজার বছর আগে নির্মিত। যাঁরা আধুনিক ইংরিজি সাহিত্য নিয়ে একটু আধটু চর্চা করেন তাঁরা নিশ্চয়ই “দা ভিঞ্চি কোড” খ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউনের “ইনফার্নো” পড়েছেন। সেই বইটিতে এই ভবনটির খুব বিশদ বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। এর একটি বৈশিষ্ট হল যে এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদের ধর্ম চর্চার জায়গা ছিল। আমাদের গাইড অস্কারের কাছে শুনলাম যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে এখানে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। পরে গ্রীক আমলে এখানে নতুন করে এক বিরাট গির্জা নির্মিত হয়, গ্রীক অরথোডক্স মতালম্বীদের তত্ত্বাবধানে। পরে কোনও এক সময়ে এটি রোমান ক্যাথলিকদের নিয়ন্ত্রনে আসে। পরবর্তী কালে যখন এই অঞ্চল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে, তখন এটি একটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়। আয়া সোফিয়ার স্থাপত্য শিল্প কিন্তু নীল মসজিদের কাছাকাছিও আসে না। দেখে কেমন যেন মনে হয় যে এটি বেশ জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছে। আমাদের মত অনভিজ্ঞ চোখেও ধরা পড়ে যে এর চারটি মিনার আলাদা ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মসজিদের ঐতিহ্য অনুযায়ী। এখন অবশ্য এটি আর মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। এটি এখন একটি মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা। নানা রকম অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরের দেওয়ালে এখনও রয়ে গেছে খ্রীস্টান ও ইসলামি সভ্যতার নানা কালজয়ী নিদর্শন।
আয়া সোফিয়া – মিনার গুলো পরে বসানো হয়েছে।

তুরস্কের ইতিহাসে অটোমান সাম্রাজ্য বা খিলাফতের প্রসঙ্গ আসবেই। এই “অটোমান” শব্দটির সম্বন্ধে কিছু  তথ্য জানাই এবারএই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওসমান গাজী বা প্রথম ওসমান। তাঁর নামেই এই বংশ বা সাম্রাজ্যের নাম। ব্যাকরণ-গত কারণে আরবরা ওসমান শব্দটির উচ্চারণ করেন ওথমান বা উথমান। এ রকম উদাহরণ প্রচুর আছে। যেমন আরবরা রমজানকে বলেন রামাদান বা আজানকে বলেন আদান। এই ওথমান বা উথমান থেকেই ইংরিজি ভাষায় অটোমান শব্দের উৎপত্তি। যেহেতু আমরা এই অঞ্চলের ইতিহাস শিখেছি ইংরেজদের কাছে, আমরাও এই অটোমান শব্দটি ব্যবহার করি। নিয়ম মত আমাদের কিন্তু ওসমান সাম্রাজ্যই বলা উচিৎ। কালক্রমে এই সাম্রাজ্যের বিরাট বিস্তৃতি ঘটে এবং এই বংশের সুলতানরা খলিফা বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান মুসলিম জগতে। ১৯২৪ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ওসমান বা অটোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

বাজার হাট - সংক্ষেপে শপিং
ইতিহাস সমৃদ্ধ যে কোনও দেশ বা শহরে অজস্র সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম দেখা যায়। গাইডরাও খুব উৎসাহের সঙ্গে সেখানে পর্যটকদের নিয়ে যান। কিন্তু যাঁদের ইতিহাসে সচেতনতা কম তাঁরা কিছুক্ষণ পরে অধৈর্য হয়ে পড়েন। তাই কয়েকজনের আগ্রহ সত্ত্বেও আমাদের দলের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্যের ইচ্ছেয় আমাদের গাইড বন্ধুরা আমাদের নিয়ে গেলেন এক বিশেষ আকর্ষনীয় জায়গায়। ইস্তানবুলের বিখ্যাত গ্র্যান্ড বাজারেএই বাজারের খ্যাতি জগৎ জোড়া। অস্কারের কাছে জানলাম যে প্রতি বছর নয় থেকে দশ কোটি লোক এখানে বাজার করেন। এই বাজারের আদলটা অনেকটা কলকাতার নিউ মার্কেটের মত, কিন্তু বিশাল। এ বাজার বহু পুরনো, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চলছে রমরমিয়ে। হেন জিনিষ নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। তুর্কীরা গর্ব করে বলে, - এটা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শপিং মল। কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়

সাহস করে একটা কথা বলেই ফেলি। এখানে ঢোকার পর দেখলাম মহিলাদের মুখ চোখ কেমন চকচক করে উঠল। কিন্তু তাঁদের কর্তারা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেলেনআমাদের এক বন্ধু তো আমার কানে ফিসফিস করে বলেই ফেললেন, - এবার হল, এখান থেকে কখন বেরোতে পারব তা ঈশ্বরই জানেন। দিল্লীবাসী এক সহযাত্রী বেশ সশব্দেই তাঁর ধরমপত্নীকে বললেন, - সুনো জি, ফজুলকী চীজ মত খরিদ না। কিন্তু সেই আবেদন মহিলাটির কানে পৌঁছল বলে মনে হল না।

মহিলারা নানা দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দোকানে ঢুকে গেলেন। সবার কাছেই কিছু তুর্কী মুদ্রা বা লিরা রয়েছে। এক তুর্কী লিরা আমাদের মুদ্রায় ২০ টাকার কাছাকাছ। ইউরোও চলে। শুরু হল শপিং। এখানে দেখলাম সবাই মোটামুটি ইংরিজি জানে। যথা সময় মহিলারা জানালেন এখানে সব কিছু নাকি খুব সস্তা। সেই শুনে কর্তারা প্রমাদ গুনলেন। অস্কার ও সুরজিৎ দু-জনেই সাবধান করে দিয়েছিল যে এখানে প্রচন্ড দরাদরি করতে হয়। কিন্তু কতটা দরাদরি করতে হয় তা আমি টের পেলাম একটু পরে। আগেই বলেছি এখানকার চর্মশিল্প খুব বিখ্যাত। এক দোকানদার একটি চামড়ার টুপি হাতে নিয়ে আমার পেছনে পড়ল। টেক স্যর ভেরি গুড স্যর করতে করতে আমার পিছু নিল। আমি টুপি পরি না; কাউকে পরানোর ইচ্ছেও আমার নেই। কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। ওর হাত থেকে বাঁচবার জন্য দাম জিজ্ঞেস করলাম, - বলল ওনলি হান্ড্রেড লিরা মানে আমাদের হিসেবে প্রায় দু-হাজার টাকা। আমি বললাম, - টু মাচ। লোকটি নিরাশ হল না, জিজ্ঞেস করল, - হাও মাচ ইউ পে? আমি ওকে কাটানোর জন্য বললাম, - পঁচিশ লিরা। লোকটা বিষন্ন মুখে বলল, - আই মেক বিগ লস। বাট ইউ মাই গেস্ট। আই গিভ ফর টুয়েন্টি ফাইভ। লোকটি আমার হাতে টুপিটা গুঁজে দিল। আমি বোকার মত পঁচিশ লিরা বের করে দিলাম। আমাকে টুপি পরানো যে এত সোজা আগে বুঝিনি কখনও

যাই হোক, অবশেষে গাইড দু’জনের তাড়ায় মহিলারা বাজারে ক্ষান্ত দিলেন। আমরাও কিচ্ছু জামা কাপড় কিনলাম, নাতি নাত্নীদের জন্য। আমাদের জন্য আর কিই বা নেব? আর দু-বাক্স টার্কিশ ডিলাইট কিনলাম। হালুয়া জাতীয় এই তুর্কী মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়; স্বর্গীয়।
 
              ইস্তানবুলের গ্র্যান্ড বাজার               নানা রকমের পসরা সজানো

এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে হোটেলে ফিরতে বেশ রাতই হল।

রাজকীয় আঙ্কারা
তৃতীয় দিন। সকাল বেলা উঠেই ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে ফেলতে হল। আজ ইস্তানবুলের হোটেল ছেড়ে আমরা বাসে রওনা হব আঙ্কারার উদ্দেশে। দূরত্ব সাড়ে চার’শ কিলোমিটার। যদিও খুব সুন্দর হাইওয়ে, কিন্তু ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার বেগে ছুটলেও পাঁচ ঘন্টা তো লাগবেই। তা ছাড়া মাঝে মাঝে বিরতিও দরকার, - খাওয়া দাওয়া, বাথরুম ইত্যাদির জন্য।

ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে উঠতে উঠতে প্রায় ন’টা বেজে গেল। আমরা অনেকেই গাইডদের পরামর্শ অনুযায়ী আটটায় তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম।  কিন্তু সব দলেই কিছু লোক থাকে যারা কখনই সময় মেনে চলে না। শুধু তাই নয়, দেরির জন্য দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা, ভাল সীট খালি নেই বলে মেজাজ দেখাতেও ছাড়ে না। কিছু করার নেই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলাই হল জীবনযাত্রার মন্ত্র।

অপূর্ব ছয়-লেনের হাইওয়ে। আমাদের বাস ছুটে চলেছে এক’শ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার গতিতে। তুরস্ক যে কতটা শিল্পোন্নত তার উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তার দু-ধারে। অসংখ্য কারখানা। একটার পর একটা। আর সব ক’টি ঝকঝকে তকতকে। তুরস্কের ইস্পাত, মোটর গাড়ি বা অটোমোবাইল, জাহাজ নির্মান সবই খুব উন্নত মানের। অস্কার জানালো তুরস্কে নির্মিত গাড়ির শতকরা ৮০ ভাগ রপ্তানী হয়।

আমাদের আঙ্কারা পৌঁছতে বিকেল ৪টে হয়ে গেল। মাঝখানে একটি ছোট্ট শহরে লাঞ্চ সারা হল অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কাবাব ও রুটি সহযোগে। তুর্কী কাবাব এক কথায় লা-জওয়াব।

হোটেল পৌঁছে সেই সন্ধ্যাটা দল বেধে খাওয়া দাওয়া আড্ডা মেরেই কেটে গেল। কোথাও আর বেরনো হল না, বাসের ড্রাইভারও খুব ক্লান্ত। বিশ্রাম দরকার। সুরজিৎ এসে জানিয়ে গেল আমরা যেন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে নি। পরের দিন আঙ্কারা শহরের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। আর দেখা হবে আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে।

আতাতুর্ক
চতুর্থ দিন। গত রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ায় সকালে সবাইকে খুব তরতাজা দেখাচ্ছিল। যথারীতি কয়েক জন বিশিষ্ট লেট-লতিফের কৃপায় বেরোতে বেরোতে সোয়া ন’টা হয়ে গেল।

প্রথম গন্তব্য স্থান মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের  সমাধিসৌধ। মুস্তাফা কামাল আধুনিক প্রজাতন্ত্রী তুরস্কের জনক। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তিনি দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত, আমৃত্যু তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর শাসন কালে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনেন। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়, - যার ফলে দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। নারী পুরুষের বিভেদ দূর করে, নারীদের পূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার দেওয়া হয়, - ফলস্বরূপ তুরস্কের মেয়েদের সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে, এমন কি সামরিক বাহিনীতেও। তাঁর এই অভূতপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে “আতাতুর্ক” বা তুরস্কের জনক হিসেবে সম্মানিত করা হয়।

সমধিসৌধের পরিবেশ খুব শান্ত ও গম্ভীর। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কৃষ্ণ বর্ণ অথবা শ্বেত শুভ্র পোষাকে পাহাড়ায় রত। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সবাই। চোখের পলক পর্যন্ত পড়েনা। ছবি তুললাম কিছু। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি একটা বাস এসে দাঁড়ালো। নেমে এলে দলে দলে ছাত্র ছাত্রীপ্রত্যেকের পরনে গ্র্যাজুয়েশন গাউন। সার বেঁধে দাঁড়ালো সবাই তারপর ধীর পদক্ষেপে ও নীরবে এগিয়ে গেল সৌধের দিকে। অস্কার জানালো এটি এখানকার একটি ঐতিহ্য। সদ্য স্নাতক বা গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের পর সোজা এখানে চলে আসেন আতাতুর্ককে সম্মান জানাতে।  সেদিন যারা গিয়েছিলেন তাঁরা সব সদ্য পাশ করা ডাক্তার অর্থাৎ মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট।

আতাতুর্ক এই সৌধেই সমাধিস্থ। নীরবে দর্শন করে বেরিয়ে এলাম আমরা।
 
 সমাধি সৌধের সামনে ছাত্ররা   সমাধির পাদদেশে পুষ্পস্তবক       অতন্দ্র প্রহরী

সমাধিসৌধের চত্ত্বরেই রয়েছে এক বিরাট সংগ্রহশালা। সেখানে তুরস্কের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের প্রচুর সাক্ষী অতি যত্নে রক্ষিত। সীমিত সময়ের মধ্যে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব ছিলনা। তবে তুরস্কের ইতিহাস নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে চান তবে এই সংগ্রহশালা একটি স্বর্ণখনি।

রাতের আহার সারলাম এক বিশেষ রেস্তোরাঁয়। স্থানীয় খাদ্যএর সঙ্গে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা ছিলসন্ধ্যেটা ভালই কাটল।

পাতাল নগরী
পঞ্চম দিন সকালে আবার তল্পি তল্পা গুটিয়ে রওনা হলাম। আবার খুব লম্বা সফর। প্রায় তিন’শ কিলো মিটার; অন্ততঃ ঘন্টা চারেক তো লাগবেই। গন্তব্য স্থান ক্যাপাডসিয়া, তুর্কী উচ্চারণে কাপাদকিয়া। আমাদের গাইড অস্কার ও সুরজিৎ দু-জনেই উচ্চারণ করল ক্যাপাডসিয়া। তাই আমিও তাই বলছি।

বিস্তৃত অঞ্চল। পর্যটকদের প্রিয় জায়গা। নামটা শুনেই মনে হয় এই অঞ্চলে এক কালে গ্রীক সভ্যতার প্রভাব ছিল। অস্কারকে জিজ্ঞেস করাতে জানালো শুধু এই অঞ্চলই নয়, তুরস্কের বহু জায়গায় গ্রীক ও তার পূর্ববর্তী রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবও রয়েছে।

ক্যাপাডসিয়া অঞ্চলের এক বিশেষ আকর্ষণ বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলের নীচে এক বিশাল ভূগর্ভস্থ শহর। মাটির নীচে অসংখ্য ঘর বাড়ি ও রাস্তা ঘাট। এই শহরের গোড়াপত্তন হয় রোমান অঞ্চলে। তখন খৃষ্ট ধর্মের শৈশবরোমান সম্রাটদের রোষে বহু খৃষ্ট ধর্মালম্বী পালিয়ে গিয়ে এই ভূগর্ভস্থ গহ্বরে লুকিয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে এখানে এক গোপন শহর গড়ে ওঠে। পরে রোমান সাম্রাজ্যের শক্তিক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের বাসিন্দারা ওপরে উঠে আসেন এবং ভূতলেও এই শহরের বিস্তার ঘটে। এক আশ্চর্য জায়গা এই ভূগর্ভস্থ শহর। এটা যে কেন সপ্তম আশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত নয় কে জানে। এখনও সেই শহর অটুট, যদিও পরিত্যক্ত। এত রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও এখনও নিখুঁত রয়েছে এই আশ্চর্য শহর।

এমন আকর্ষনীয় জায়গা; ঘুরে দেখতে কেটে গেল সারা দিন। গাইডের তাড়া খেয়েও কেঊ নড়ল না ওখান থেকে।


 
               পাথর কেটে শহর                       এই শহর মাটির তলায় বিস্তৃত

উষ্ণ প্রস্রবন
ষষ্ঠ দিনের সকালে মনে হল সবাই যেন খুব ক্লান্ত। আগের দিন প্রচুর হাঁটা হয়েছে। আমাদের দলের সবাই প্রবীন নাগরিক। হাঁটু, কোমর বহু ব্যবহারে জীর্ণ। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে একমত হল যে এ দেশে আসা উচিৎ ছিল কুড়ি বছর আগে, যখন শরীরে কিছু জোর ছিল।

আমাদের সম্মিলিত মতামত গাইডদের জানানো হল নেহাৎই ঠাট্টার ছলে। গাইডদ্বয় গম্ভীর মুখে আমাদের বক্তব্য শুনে নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করে নিল। কিছুক্ষণ পরে জানালো আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে এমন এক আকর্ষণীয় জায়গায় যেখানে সারাটা দিন খুব উপভোগ করব স্রেফ বিশ্রামের মাধ্যমে। জায়গাটির নাম পামুক্কলে। অস্কার জানালো তুর্কী শব্দ পামুক্কলের অর্থ কটন কাসল।

কেন এই নাম সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই। জায়গাটি হট স্প্রিং বা উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। ভূগর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত উষ্ণ জল বয়ে চলেছে অবিরাম। সেই জলস্রোতের সঙ্গে মিশ্রিত নানা রকম খনিজ পদার্থ মাটির ওপর কয়েক হাজার বছর ধরে স্তরে স্তরে জমে উঠেছে। এখন মাটির ওপর সাদা রঙে ঢেউ খেলানো সেই স্তর বা প্রলেপন দূর থেকে বিশাল তুলোর পাঁজার মত মনে হয়। তাই এই অঞ্চলের নাম পামুক্কলে বা কটন কাসল। সে এক অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মানতেই হবে যে প্রকৃতিই জগতের সবচেয়ে বড় শিল্পী।

হট স্প্রিং বা প্রস্রবণের জলের ধারাকে সিমেন্টের বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়েছে, অনেকটা বহমান সুইমিং পুলের মত। সেখানে গা ডুবিয়ে বসে ছিলেন অসংখ্য নারী পুরুষ। আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না কারণ আমরা তৈরি ছিলাম না। আগে জানা থাকলে সাঁতারের পোষাক নিয়ে আসতাম। যাই হোক, সেই অবস্থাতেই প্যান্ট গুটিয়ে বসে রইলাম হাঁটু অব্দি পা ডুবিয়ে। আঃ সে কি স্বর্গীয় অনুভূতি।

 
                      কটন কাসল                           উষ্ণ জলে গা ডুবিয়ে

এই অঞ্চলের আশেপাশে রয়েছে রোমান সভ্যতার প্রচুর নিদর্শন। সবই প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত। ইদানীং তুরস্ক সরকারের প্রত্নতাত্মিক বিশেষজ্ঞরা এই ঐতিহাসিক স্থানটির হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। ষাটের দশকে পর্যটকদের ভীড় দেখে এখানে বেশ কয়েকটি বড় হোটেল তৈরি হয়। হোটেলের মালিকরা এই উষ্ণ জলপ্রবাহের গতি পরিবর্তন করে হোটেলের সুইমিং পুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন যে তাতে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সরকারী আদেশে সব হোটেল ভেঙে দেওয়া হয়।

কুসাদাসি
সপ্তম দিন। আমাদের তুরস্ক ভ্রমণ শেষ পর্যায়ে। আমরা এসে পৌঁছলাম কুসাদাসি, সমুদ্রের উপকুলে ছবির মত এক সুন্দর শহর। এর বীচ বা সমুদ্র সৈকত খুব জনপ্রিয়। আমরা গাইডের মুখে শুনে অবাক হলাম যে এই শহরর জনসংখ্যা মোটে ৬৫ হাজার। কিন্তু গ্রীষ্মকালে টুরিস্টদের ভীড়ে এই সংখ্যা ৫ লক্ষতে গিয়ে দাঁড়ায়। অসংখ্য হোটেল, যা নাকি সারা বছর খালি পড়ে থাকে, কিন্তু টুরিস্ট মরশুমে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।

বিশাল এক বন্দর এই শহরের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। এখান থেকে ছাড়ে নানা রকম বাণিজ্যিক ও যাত্রী জাহাজ। এখন থেকেই শুরু হল আমাদের বেরানোর দ্বিতীয় পর্ব। সমুদ্র ভ্রমণ। ক্রুজ শিপে বিভিন্ন গ্রীক দ্বীপ ছুঁয়ে শেষে এথেন্স।

 
কুসাদাসি বন্দর

আমার এই কাহিনী তুরস্কেই সীমাবব্ধ থাক। গ্রীসের গল্প না হয় আরের দিন হবে। সংক্ষিপ্ত এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এইটুকুই বলতে পারি যে এক সপ্তাহের মধ্যে তুরস্কের মত ঐতিহাসিক দেশে ঘোরা বা দেশটিকে জানা সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় স্বল্প সময়ে আমাদের দেশের হৃদয়কে স্পর্শ করা। তবে যা পেয়েছি তাতে আমি নিজে খুব তৃপ্ত ও নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান বলে মনে করি।


***************