Tuesday 23 July 2019

নানা রঙের দিনগুলি

নানা রঙের দিনগুলি

বাবা আসামে চাকরি করতেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন থাকতেন কলকাতা ও তার আশেপাশে। তাই বছরে একবার কলকাতায় আসা হতই। আমাদের স্কুল ছুটি হলে বাবাও ছুটি নিতেন, - হয় গরমে বা পূজোর সময়।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। আমার বছর দশেক বয়স। হাঁ করে কলকাতার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট দেখতাম।

সবসময়ের সাথী ছিল আমার মাস্তুতো ভাই। আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। কিন্তু ছোট হলে কি হবে, কলকাতার ছেলে যে। অনেক কিছু জানে। আমাকে অনেক কিছু শেখাতো, - “ঐ যে দেখছিস বাস, সব পাঞ্জাবী (শিখ) ড্রাইভার আর কনডাক্টার, ঐ বাসগুলো এমনি বাস। আর যেগুলো খুব নতুন আর ঝকমকে, সেগুলো স্টেট বাস। ড্রাইভার, কনডাক্টার সব বাঙালি।

কথাগুলো খুব খাঁটি। ডাঃ বিধান রায় তখন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। চালু করেছেন স্টেট ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন। আধুনিক বাস এল বাইরে থেকে। কর্মচারিরা বেশির ভাগ পূর্ব বাংলা থেকে আগত। দোতলা বাসে চড়ার খুব শখ ছিল। রাস্তায় বেরোলেই বাবাকে বলতাম, - দোতলা বাসে যাব। স্টেট বাসের গায়ে দরজার কাছে ইংরিজিতে লেখা থাকত, - Wait till the bus stops.  ঠিক নীচেই লেখা থাকত, - বাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এই নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হয়। অনেক বিদগ্ধ নাগরিক জানালেন যে বাংলা অনুবাদটি ভুল। আসলে লেখা উচিৎ, - বাস না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। অনেক তর্কাতর্কি লেখালেখির পর একজন জানালেন যে “বাস থামলে ওঠানামা করুন” লিখলে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকেনা। যাই হোক কর্তৃপক্ষ এসব তর্ক বিতর্কে কর্ণপাত করেন নি।

ট্রামে চড়ার আকর্ষণ ছিল খুব। বেশ ট্রেনের মত অথচ ট্রেন নয়। সামনের কামরা ছিল প্রথম শ্রেণী, গদি মোড়া আসন। পেছনেরটি দ্বিতীয় শ্রেণী, কাঠের আসন। ভাড়া কত ছিল জানিনা। আমি তো আর ভাড়া দিতাম না, বাবা দিতেন।

ট্যাক্সি ডাকলেই দাঁড়াতো। কখনও কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যাবনা বলতে দেখিনি। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বেশির ভাগ ছিলেন শিখ। শহরের পরিবহন অনেকটাই এঁরা নিয়ন্ত্রন করতেন।

১৯৬১ সালে স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় পড়তে আসি, সে কি আনন্দ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হই প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে। তখন ধীরে ধীরে স্কুলগুলোতে এগারো ক্লাস শুরু হচ্ছে। দশ ক্লাসের স্কুল ফাইনাল থেকে এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি। হায়ার সেকেন্ডারির পর বি-এ, বি-কম, বিএসসি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলের পড়াশোনা। যে সব স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি চালু হয়নি, তাদেরকে স্কুল ফাইনালের পর এক বছর প্রি-ইউনিভার্সিটি করতে হত।

সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হলেও হস্টেলে ঠাঁই হলনা। খোঁজ খবর করে এক জায়গার সন্ধান পাওয়া গেল। বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের মোড়ে অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে সীট খালি আছে। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হল। সেই বাড়ীটি এখনও আছে। তবে নাম পালটে গেছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রীটও আরও কয়েক বছর নাম পালটে বিধান সরণী হয়ে গিয়েছিল।

কলেজে যাবার জন্য মোড়ের মাথা থেকে ২বি বাস ধরতাম। চৌরঙ্গী রোড (তখনও জহরলাল নেহরু রোড হয়নি) আর পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে নেমে যেতাম। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর মুর্তি ছিল। মেট্রো রেলের কাজের সময় সেটি স্থানান্তরিত হয়। ভাড়া ছিল ২০ পয়সা। ক’দিন পর এক সহপাঠী জানালো যে আমি মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করছি। আমি যদি ২বি তে না এসে  ৮বি বাস ধরি, তবে পার্কস্ট্রীট আর সার্কুলার রোডের মোড়ে, মানে পার্কস্ট্রীটের অন্য প্রান্তে নামব। ভাড়া ১৫ পয়সা। আমার ৫ পয়সা বেঁচে যাবে। তার মানে সপ্তাহে, মানে ছ-দিনে ৩০ পয়সা। এক মাসে ১টাকা ২০ পয়সা। একটা সিনেমার টিকিট, তাও বেশ ভাল সীটে। দারুণ ব্যাপার।

কোনও নেশা ছিল না। তবে একটি বিলাসিতা রপ্ত করেছিলাম। শণিবার একটু আগে ছুটি হত। হস্টেলে ঢোকার মুখে একটা পান, বিড়ি সিগারেটের দোকান ছিল। তার কোনটারই আকর্ষণ আমার ছিলনা। তবে সেখানে বরফ ঠান্ডা কোকাকোলা পাওয়া যেত। একটি বোতলের দাম ২৫ পয়সা। হস্টেলে ঢোকার আগে এক বোতল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে, তারিয়ে তারিয়ে সেই ঠান্ডা পানীয় উপভোগ করতাম। সেই আনন্দ আর কোনও দিনও পাইনি।

রাত্রে দশটার সময় হস্টেলের লাইট নিবিয়ে দেওয়া হত। সকালে খুব ভাঙত কিছু বর্ষীয়ান কীর্তনিয়ার কল্যাণে। খোল করতাল নিয়ে সূর্যোদয়ের আগেই এঁরা বেরিয়ে পড়তেন রাস্তায়। উদাত্ত কন্ঠে গাইতেন, - রাধে রে গোবিন্দ রাধে, রাধে রে গোবিন্দ। সেই সুরের ঝংকার এখনও কানে লেগে আছে।

মাসে একটা সিনেমা দেখতাম। প্রত্যেকটি সিনেমা মুক্তি পেত কয়েকটি বিশেষ হলে। যেমন “রূপবাণী, অরুণা, ভারতী” বা “শ্রী, ইন্দিরা, প্রাচী” বা “মিনার, বিজলী, ছবিঘর”। বেশ ভীড় হত। ভাল সিনেমার রজত জয়ন্তী, সুবর্ণ জয়ন্তী সপ্তাহ ফলাও করে ছাপা হত খবরের কাগজে।
আইন শৃঙ্খলার সমস্যা বরাবরই ছিল। কিন্তু সেটা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না কখনও। একদিন হস্টেলের ঘরে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছি। হঠাৎ শুনলাম বাইরে প্রচুর সোরগোল, চিৎকার। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি দু-দলের মধ্যে প্রচন্ড মারামারি চলছে। সেকালে বোমাবাজি দেখিনি। সোডার বোতলই চলত বেশি। গন্ডগোল দেখলেই পান, সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়র দোকানদারেরা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেন। যাই হোক। মিনিট পনেরোর মধ্যে পুলিসের গাড়ি এসে পৌঁছল। লাফিয়ে নামল আধ ডজন কন্সস্টেবল, হাতে লাঠি, মাথায় লাল পাগড়ি। সঙ্গে এক সাদা উর্দি পরা অফিসার। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক শুনশান। যারা মারামারি করছিল তারা কর্পূরের মত উবে গেল। একজন কন্সস্টেবলকে দাঁড় করিয়ে ফিরে গেল পুলিসের গাড়ি। একটু পরে দেখি সেই একলা পুলিস সামনের এক ছোট্ট চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসেছেন। আমরা গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আলাপ জমালাম। জিজ্ঞেস করলাম, - আবার গোলমাল হলে আপনি একা কি করবেন? ভদ্রলোক হেসে বললেন, - আমি তো কিছু করব না। করবে তো এ; - বলে নিজের পাগড়ি দেখিয়ে দিলেন। এই পাগড়ি দেখলে কেউ কাছে আসার সাহস পাবে না। এমনি ছিল সেকালে পুলিসের দাপট। কিছুক্ষণ পরে পুলিস ভদ্রলোক পকেট থেকে ব্যাগ বের করে চায়ের দাম মেটালেন। দোকানদারও হাত পেতে পয়সা গুণে নিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই।

বেহালার পর্ণশ্রীতে থাকতেন আমার স্নেহশীলা বড়মাসী। বাড়ির জন্য মন কেমন করলে বাসে উঠে রওনা দিতাম। রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনে। তারাতলায় দেখতাম অজস্র কারখানা, সারি সারি। কখনও হাওড়া স্টেশনে উঠে চুুঁচুড়া, আমার মাতুলালয় ও জন্মস্থান। বর্দ্ধমানে কাকা থাকতেন, সেখানে যাওয়া হত মাঝে মাঝে।হাওড়ায় বা হাওড়া থেকে রেললাইনের দু-ধারে অজস্র কারখানা বা ইন্ডাস্ট্রি। পশ্চিম বঙ্গ তখন এক শিল্পোন্নত রাজ্য। ভাবতাম পড়াশোনা শেষ করে এখানে কোনও এক জায়গায় নিশ্চয়ই চাকরি পেয়ে যাব। সেটা আর সম্ভব হয়নি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যখন চাকরির খোঁজে রাস্তায় নামলাম, তখন সব কারখানা হয় বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার মুখে। সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে।

কলকাতা
২০ জুলাই ২০১৯

No comments:

Post a Comment