Thursday 24 October 2013

ভাতিছ গগন মাঝে


আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। নতুন সেশন শুরু হয়েছে। আর একটা বছর পার করলেই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরবোবেশ একটা মস্তান মস্তান ভাব। হাজার হোক কলেজে আমরা সবচেয়ে সিনিয়র। নতুন সেশন, যথারীতি ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের র‍্যাগিং চলছে। আমাদের সময় কিন্তু র‍্যাগিংটা ছিল একটা হালকা মজা; আজকাল যে সব বীভৎস ঘটনা শুনি তা আমাদের সময় অকল্পনীয় ছিল। অঘটন যে একেবারেই ঘটত না তা নয়, কিন্তু সে ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ খুব কড়া ব্যবস্থা নিতেন।

জুলাই মাসের ৯ তারিখে ক্লাস শুরু হত আমাদের। রবিবার পড়লে ১০ তারিখ। মোটামুটি মাস খানেক ধরে চলত র‍্যাগিং। ১৫ই অগাস্ট থেকে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেওয়া হত। অগাস্টের প্রথম দিকের এক রবিবার বিকেলে আমাদের হস্টেলের কমন রুমে সব ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের জড়ো করা হয়েছে। ফাইনাল র‍্যাগিং, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করে দেখাবে, গান, শের শায়েরি, আবৃত্তি, অভিনয় যা খুশি। যারা পারবে না তাদের হলের একটা কোনে দেয়ালের দিকে মুখ করে, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

এক এক করে সব ছেলের নাম ডাকা হচ্ছে। বেশ জমে উঠেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল।  ছেলেটির জামা কাপড় বেশ মলিন, চেহারায় একটা নিষ্পাপ সারল্য, দেখে মনে হয় কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছে। যথারীতি নিজের পরিচয় দিল; হিন্দিতে। আমাদের সহপাঠী কয়েক জনের ইংরিজি প্রশ্নের উত্তরে সবিনয়ে জানাল, “ক্ষমা কিজিয়েগা, মুঝে অংরেজি নহি আতী”“তব কয়া আতা হ্যায়”ছেলেটি মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল এই পরিবেশের সঙ্গে ও একদম মানিয়ে নিতে পারছে নাচারিদিকে সিনিয়রদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, তার মাঝে ফার্স্ট ইয়ারেরই আরেকটি ছেলে, বোধহয় বন্ধুর করুণ অবস্থা আর সহ্য করতে না পেরে পাশ থেকে বলে উঠল,  “উসে গানা আতা হ্যায়”। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, “কোই খাস নহি”আমরা বললাম, তোমাকে গাইতেই হবে।

কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটি। দেখে মনে হল হয়তো বা গাইবার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু গুনগুন করে সুরটা ঠিক করে নিল। তারপর হঠাৎ গলা ছেড়ে ধরল, ‘পুছো না কৈসে মৈনে রৈন বিতায়ী’, সে একবারে অবাক করা এক মসৃন গলা আর তেমনি সুরের জাদু। ধীরে ধীরে যখন গলা উঠল, ‘উতজল দীপক, ইত মন মেরা, ফির ভি না জায়ে মেরা ঘরকা অন্ধেরা’ আবার নেবে এল, ‘তড়পত-তরসত উমর গওয়াই’ – মনে হল যেন  ঘরের মধ্যে সুর ভাসছে। গান শেষ হল, চারিদিক নিঃস্তব্ধ কয়েক সেকেন্ড। তারপর পুরো কমন রুম ফেটে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে আমরা হাততালি দিলাম। কয়েক জন গিয়ে তো জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। তারপর যা হয়, ‘ঔর এক সুনাও’। ছেলেটি ততক্ষণে বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। একে একে গাইল, ‘দিলকা হাল সুনে দিলওয়ালা, অ্যায় মেরে প্যারে ওয়াতন, কৌন আয়া মেরা মনকে দ্বারে, ইয়ে রাত ভিগি ভিগি, তু প্যার কা সাগর হ্যায়, আ জা সনম মধুর চান্দনিমে হম’ – আসর জমে গেল। মাঝখান থেকে পরের ছেলেগুলোকে আর কিছুই করতে হল না। অনুরোধের পর অনুরোধ। এক সময়, রফি, কিশোর আর মুকেশের গানও গাইতে বলা হল। আর তখনই ছেলেটি হঠাৎ বেঁকে বসল। মাথা নীচু করে মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায় ঘোষণা করল, ‘ম্যায় ঔর কিসিকা গানা নহি গাতা’। আশ্চর্য, ছেলেটি মান্না দে ছাড়া কারও গান গাইবে না। কিছুতেই না। শুধু বলল ‘সবকো সম্মান করতা হুঁ, লেকিন গানা সির্ফ মান্নাজীকা-হি গাতা হুঁ’। সাংঘাতিক গোঁ, একেবারে গাঁওয়ার যাকে বলে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি শুধু মান্না দের ফ্যান। ছেলেটা উত্তরে বলল না আমি সবার ফ্যান, সবার গান শুনি। কিন্তু মান্নাজীর আমি ফ্যান নই, ভক্ত পুজারী।

সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ হল। ছেলেটি খুবই মুখচোরা, খুব একটা দেখা হত না। ওর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে খোঁজ খবর নিতাম। শুনলাম ছেলেটি পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে; শুধু কলেজ আর হস্টেল, হস্টেল আর কলেজে। কলেজের বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবার দেখলাম। স্টেজে উঠে দুটো গান গাইল, - পুছোনা কৈসে আর লগা চুনরিমে দাগ। সে কি সুরের মুর্চ্ছনা; কলেজের রাশভারী প্রফেসরদের দেখলাম গম্ভীর মুখ কিন্তু গানের সুরে সুরে দুলছেন।

দেখতে দেখতে বছর প্রায় শেষ হয়ে এল। পরীক্ষার আর মোটে দুমাস বাকি। জোর কদমে চলছে পড়াশোনা, হাজার হোক ফাইনাল ডিগ্রির ব্যাপার, একদম ফাঁকি দেওয়া চলবে না। এক রবিবার কলেজের লাইব্রেরিতে কিছু রেফারেন্স বই থেকে নোটস নিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর মনে হল কলেজ ক্যান্টিন থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসা যাক। ক্যান্টিনে ঢুকে দেখি সেই ছেলেটি, এক কোনায় একা বসে এক খাতা থেকে অন্য খাতায় কিছু টুকছে। বোধহয় কোনও ক্লাসে যেতে পারেনি, সহপাঠীর নোটস দেখে লিখে নিচ্ছে। আমি এক কাপ চা নিয়ে সোজা ছেলেটির সামনে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ আমাকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল। বললাম অনেক দিন থেকেই তোমার সঙ্গে একটু কথা বার্তা বলব ভাবছি। ছেলেটি দেখলাম আগের থেকে অনেকটা সাবলীল এবং আত্মবিশ্বাসী, বেশ ইংরিজিও বলছে মাঝে মাঝে। আমি ওকে বললাম যে আমিও মান্না দের একজন খুব বড় ফ্যান। শুনে ছেলেটি হাসল। আমি বললাম তুমি কি জানো যে মান্না-জী বাংলাতেও প্রচুর গান গেয়েছেন এবং জবরদস্ত সব গান। শুনে ছেলেটি গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরুর গায়ে হোঙ্গে”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সুননা চাহোগে?” ছেলেটি বলল নিশ্চয়ই, “সিখনা ভি চাহুঙ্গাআমি বললাম তোমাকে কি আমি দু একটা রেকর্ড কিনে দেব। ছেলেটি তখন একটু ম্লান হেসে ওর পুরো পারিবারিক পরিস্থিতির কথা জানাল।

বলল যে রেকর্ড বাজিয়ে শোনার আর্থিক ক্ষমতা ওর নেইগরীব কিসানের ছেলে। বাবার মতের বিরুদ্ধে পড়তে এসেছে। স্কুলের মাস্টারজীরা জোর করে পড়তে পাঠিয়েছেন। বাপু অনেকবার স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছিলেন। মাস্টারজীরা রুখে দাঁড়িয়ে আটকেছেনসেকেন্ডারি পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করায় স্টেট স্ক্ললারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছে। বাপুর ভয়ে ছুটিতে নিজের গাঁও পর্যন্ত যায় না, পাশে গ্রামে মামার বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রেকর্ড প্লেয়ার কেনা তো দুরের কথা গ্রামে বিজলীও নেই।

কথা শেষ করে হঠাৎ খাতাটা খুলে আমাকে বলল, “দো চার লাইন হমে বাতাইয়ে ম্যায় লিখ লেতা হুঁ, একদিন খুদ ম্যায় খরিদ লুঙ্গা”।  আমি সে যুগের কয়েকটি গানের লাইন আমার বেসুরো গলায় ওকে শোনাই,- ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাব তরঙ্গে”, রাধা চলেছে মুখটি ঘুরায়ে, ইত্যাদি। ছেলেটি সযত্নে লাইন গুলো লিখে নেয়। তারপর স্বপ্নাদিষ্ট চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে একদিন মান্না-জীসে মৈ জরুর মিলুঙ্গা।

এর পর আর কোনও দিন দেখা হয় নি ছেলেটির সঙ্গে। নামটাও ভুলে গেছি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এখন কোথায় আছে কে জানে? যে সময়কার কথা বললাম তখন ফার্স্ট ইয়ার আর ফাইনাল ইয়ারের মাঝে তফাৎটা খুব বেশি মনে হত। কিন্তু এখন এই বয়সে তিন চার বছরের ব্যবধানটা খুবই গৌন। সেও তো এখন আমার মত একজন প্রবীণ নাগরিক। মান্না দের বাংলা গানগুলো কি সংগ্রহ করেছিল? কে জানে?

মান্না-জীর সঙ্গে কি ওর দেখা হয়েছিল? তাও জানি না। যদি না হয়ে থাকে তবে আর হবেও না কোনও দিন।

 

কোলকাতা – ২৪ শে অক্টোবর ২০১৩

 

Friday 18 October 2013

প্রেম - সেকাল ও একাল


এক কিশোরী পাঠিকার অনুযোগ, “লেক নিয়ে কত কথা লিখলেন কিন্তু কোনও প্রেমিক যুগলকে নিয়ে লিখলেন না তো?”

“কিন্তু আমি তো প্রাতঃভ্রমন নিয়ে লিখেছি। ভোর বেলার কথা। তখন তো লেকে শুধু স্বাস্থ্যান্বেষীরা যান। প্রেমিকেরা তো সন্ধ্যের দিকে যায়, যখন লেক ফাঁকা হয়ে আসে। সেই সময়ে আমি থাকি না”

শুনে খুশি হল না মেয়েটি,-

“কেন?  লেক থেকে ফেরার পথে দেখলে তো পারতেন, দুই-বিনুনি করা মেয়েটি আর সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেটি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে, যাচ্ছে গানের দিদির কাছে গান শিখতে। বাস্‌, প্রেম শুরু। হতে পারে তো?”

উত্তর ছিল না আমার কাছে। অত সকালে দিদিমনিরা কি গান শেখান? তা ছাড়া আজকালকার প্রেমিক যুগলদের আমি চিনতে পারি না। দুটি ছেলে মেয়ে দিব্যি তুই তোকারি করতে করতে চলেছে; হাঁটা চলায় সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস, চোখে মুখে কোনও উদ্বেগের ছাপ নেই। কি করে বুঝব যে প্রেমিক প্রেমিকা?

পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল আমাদের জমানায়। তখনও প্রেমিক প্রেমিকারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত। কিন্তু চোখে মুখে একটু উদ্বেগের ছাপ, দৃষ্টি সতর্ক, - “এই ফুলুমাসী আসছে, তুমি পাশে হেঁটো না, একটু এগিয়ে যাও। উলটো ফুটপাথে চল, সামনে ভোম্বলকাকু দাঁড়িয়ে আছে”। প্রচন্ড বিধিনিষেধ। বিশেষ করে মেয়েদের। কে কখন দেখে ফেলবে আর লাগিয়ে দেবে মায়ের কাছে, বাস্‌ কাল থেকে বেরনো বন্ধ, - ছোড়দা পৌঁছে দেবে গানের ক্লাসে, অফিস থেকে ফিরে বাবা গিয়ে নিয়ে আসবে। তার থেকে অনেক নিরাপদ সেই সব জায়গায় দেখা করা যেখানে ঐ সব মাসী, মামারা থাকেন না। যেমন দুপুর বেলা ময়দানের গাছতলা,- সঙ্গে চিনেবাদাম। সন্ধ্যেবেলা লেক, যখন আবছা অন্ধকারে দূর থেকে কেউ চিনতেও পারবে না। যারা একটু দুঃসাহসী, তাদের জন্য ছিল স্যাঙ্গুভ্যালির পর্দা ঢাকা কেবিন বা কোন ফ্লপ সিনেমার খালি হলের ম্যাটিনি শো। তখন কোথায় ক্যাফে কফি ডে আর কোথায় শপিং মলের ফুড কোর্ট। আর পকেট তো গড়ের মাঠ।

ফুলুমাসী, ভোম্বলকাকুরা এখন সব বিলুপ্ত প্রজাতি। তাঁদের জায়গা নিয়েছেন মিষ্টি-মাসী আর সেন-আঙ্কেলরা। বেশ বুক ফুলিয়ে এঁদের সামনে দাঁড়ানো যায়, “হাই মিষ্টি-মাসী শপিং করতে বেড়িয়েছ? এ হচ্ছে রনি,- রনি, আমার মাসী”। রনি একগাল হাসল, “হাই মাসী”। মাসীও হাসলেন, “ও তুমিই রনি, খুব ভাল গীটার বাজাও শুনেছি? এক দিন যাব তোমাদের ব্যান্ডের গান শুনতে।” মাঝে মাঝে মনে হয় এই মিষ্টি-মাসীরা কি গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন না নিজেদের যৌবনের বাধা নিষেধ স্মরণ করে।

টেলিফোনে প্রেমালাপের জন্য কাঠখর পোড়াতে হত বিস্তর। বাড়ির ফোন বেশির ভাগ সময় “ডেড”, - কেবল-ফল্ট। তাও সব বাড়িতে ফোন ছিল না। হ্যাঁ, ফোনের অ্যাপ্লিকেশন করা ছিল; কিন্তু ফোন কবে পাওয়া যাবে তা শুধু ঈশ্বরই জানতেন। রীতিমত উৎসব হত বাড়িতে ফোন এলে। সোজাসুজি ফোনও করা যেত না, হয়তো ধরবেন প্রেমিকার বাবা নিজেই কিংবা গুঁফো জ্যাঠামশাই, “কাকে চাই?”। আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। খোশামদ করতে হত ছোট বোনকে, “দে না বাবা, ফোনটা লাগিয়ে, বলছি তো সিনেমার টিকিট কেটে দেব তোকে আর তোর দুই বন্ধুকে”।

আজকাল কত সুবিধে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন। ঝটপট টেক্সট মেসেজ। মা বাবারা কত উদার। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে দেশের; ছেলে মেয়েদের পকেটও বেশ ভারি।

আজকাল ছেলেমেয়েরা কি ভাষায় কথা বলে তাও জানি না। ওদের নিয়ে লিখব কি? তবে হ্যাঁ একটু আন্দাজ করেছিলাম নবীন সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর কল্যাণে। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোচ্ছিল “পালটা হাওয়া”। পেশাগত কারণে সময় পেতাম না বইটই পড়ার। গিন্নী পড়তেন নিয়ম করে। খুব পছন্দ হলে সুপারিশ করতেন। গিন্নীর প্রস্তাবেই পড়তে শুরু করি এবং পুরো মগ্ন হয়ে যাই লেখকের মুন্সীয়ানায়। এক সময় মনে হচ্ছিল এক নতুন প্রতিভার “আত্মপ্রকাশ” পড়ছি। গল্পের নায়ক রীপ, নায়িকা মৌনিকা। অভিনব নাম। তাদের ভাষা, জীবনযাত্রা, সম্পূর্ণ অপরিচিত। গল্পের শুরু থেকেই নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ। মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকে বলা হচ্ছে তাদের সোনালী দিনগুলোর কথা। ধীরে ধীরে বেশ জড়িয়ে পড়লাম গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে। এক সময় তো এমন অবস্থা হল যে গিন্নীকেই শাসালাম, “উপন্যাসের শেষে যদি রীপ আর মৌনিকার মিলন না হয় তবে এই লেখকের আর কোনও বই আমি স্পর্শও করব না”। যাক গে, শেষে দু-জনের মিলন ঘটিয়েছিলেন লেখক।

একটু বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আমার পরিচয় ঐ পালটা হাওয়ার মাধ্যমেই।

সব শেষে সত্য ঘটনা অবলম্বনে একটা গল্প বলি।

গড়িয়াহাট মোড়ের সন্ধ্যেবেলাগুলো ছিল খুব রোমান্টিক। ফুরফুরে হাওয়া, সারি সারি ঝলমলে দোকান পাট, হকারের দৌরাত্ম ছিল না, ছিল না বিশাল কদর্য এক উড়াল পুল। চার দিকে ছিল আলাদা আলাদা আড্ডা, বেশির ভাগই কলেজের ছাত্র আর কিছু সদ্য চাকরিতে ঢোকা কিছু এলেজিবল ব্যাচেলরের দল। আমাদেরও একটা আড্ডা ছিল। আমরা তখন ফাইনাল ইয়ারে, বেশ একটা মস্তান মস্তান ভাব। প্রায় প্রত্যেক দিনই দেখতাম তিনটি মেয়ে, দেখেই মনে হয় কলেজে পড়ে, হেঁটে বাড়ি ফিরত। বন্ধুদের একজনের, ধরা যাক তার নাম সঞ্জয়, একটি মেয়েকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু আলাপ করে কি করে? সাহস নেই যেচে গিয়ে কথা বলার। রোজ মেয়ে তিনটি হেঁটে চলে যায়, সঞ্জয়ের সাহস আর হয় না। আস্তে আস্তে শুরু হল টিটকিরি, “হিম্মত নেই, এসেছো প্রেম করতে”? একদিন খেপে উঠল সঞ্জয়। মেয়ে তিনটি অন্যদিনের মতই হেঁটে চলে গেল, হঠাৎ দেখি সঞ্জয়ও চলেছে পেছন পেছন। মনে হল যেন ডাকল মেয়েটিকে। আশ্চর্য, মেয়েটিও দাঁড়াল। সঙ্গের মেয়ে দুটিও দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু চার কদম এগিয়ে। সঞ্জয় কথা বলল মেয়েটির সঙ্গে মিনিট পাঁচেক। সেই গল্পের শুরু। সে গল্প শেষ হয় নি আজও। বছর চারেক আগে ওদের নাত্নীর অন্নপ্রাশনে গিয়েছিলাম। খুব হৈ চৈ হল। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সেদিন কি কথা বলেছিলিরে তোরা”?

দু-জনেই হাসল, বলল “মনে নেই”।

 সিদ্ধার্থ দেব
২০ অগাস্ট ২০১৩