Monday 29 July 2013

দর্শকের রকমফের

রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান। হল ভর্তি লোক। এক বিখ্যাত শিল্পী গাইছেন। আর গাইছেন খুব জনপ্রিয় গানগুলো, খুব দরদ দিয়ে। আপনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন। এমন সময় আপনার পাশে বসা এক ভদ্রলোক, হয়তো আপনার পরিচিত, কিংবা অপরিচিত, তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে, হঠাৎ চোখ বুজে গাইতে শুরু করলেন সেই একই গান, শিল্পীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে, আপনার কানের কাছে। ভদ্রলোক অত্যন্ত সঙ্গীতানুরাগী, কিন্তু সুর তাল ইত্যাদির জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। মঞ্চে বসা শিল্পীর গানের থেকে এই পাশে বসা দর্শকের বেসুরো গান অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠছে আপনার কানের কাছেভদ্রতার খাতিরে আপনি বলতে পারছেন না যে আপনি সেই শিল্পীর গান শুনতে এসেছেন ঐ শ্রোতাটির গান নয়।  এরা সব তন্ময় শ্রোতা, এদের পাশে আসন পড়লে আপনার অনুষ্ঠানের দফারফা।

যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা চেষ্টা করি একটু সামনের দিকে বসতে, যাতে শিল্পীকে একটু চাক্ষুষ দেখা যায়। অনেক সময় হয়তো প্রচন্ড লম্বা কোনও শ্রোতা সমনে বসে পড়লেন। পাশে মস্ত খোপাওয়ালা এক সুন্দরী। শিল্পী চলে গেলেন চোখের আড়ালে। আপনি দুজনের মাঝখানে একটা পজিশন নিলেন শিল্পীকে দেখার জন্য। কিন্তু বিধি বাম। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই দেখলেন সামনের দু-জন মাঝে মাঝেই কাছাকাছি মুখ এনে কথা বলছেন। হেসেও উঠছেন মাঝে মাঝে। মঞ্চে শিল্পী হয়তো গাইছেন বা সেতার বাজাচ্ছেন। তাতে হাস্য কৌতুকের তো কোনও অবকাশই নেই। কেন যে এঁরা হেসে ওঠেন কে জানে?

আর আছেন চঞ্চল বাবু। ইনি আবার আসনে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। আধ ঘন্টা পরপর এনার হয় বাথরুম পায় বা তেষ্টা পায়। এনাদের সীটটা সাধারণতঃ খুব দুর্গম জায়গায় হয়; অনেককে মাড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে ইনি বেরোন এবং ঢোকেন। তবে মুখে ‘সরি’ বলেন

একবার আকাডমি অফ ফাইন আর্টসে নাটক দেখতে গেছি। শাঁওলী মিত্রের বিখ্যাত নাটক ‘নাথবতী অনাথবৎ’। আগে দেখা ছিল না। নাটকটির পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বহুদিন পর মঞ্চস্থ হচ্ছে। নাটকটির সংলাপ ক্ষুরধার; প্রত্যেকটি কথা কান পেতে শোনার মত। এক একটি ক্লাইমেক্স আসছে, সেই মুহূর্তে হঠাৎ আপনার ঠিক সামনের দর্শকের গলা খুশ খুশ করে উঠল, ‘খুক’। সংলাপটি আপনি আর শুনতে পেলেন না। পরের বার হলের বাঁদিক থেকে আবার ‘খুক’, - আরেকটি মোক্ষম সময়ে। এ খুক-খুক চলতেই লাগল, অবিরাম। বীতশ্রদ্ধ হয়ে এক দর্শক তো চেঁচিয়েই উঠলেন, ‘বাইরে গিয়ে গার্গল করে আসুন’এঁরা খুকখুকে দর্শক।

আরেকটি অভিজ্ঞতা। মধুসূদন মঞ্চে নাটক বেশ জমে উঠেছে, পটলবাবু ফিল্মস্টার হঠাৎ হলের মাঝখান থেকে ভেসে উঠল এক শিশুর কান্নানাটকের সংলাপ ডুবে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল এক মহিলার কন্ঠে বাচ্চাকে শান্ত করার প্রচেষ্টা, অ, অ, অ ...কিছুক্ষণ চলল মা ও শিশুর যুগলবন্দী। সবাই বিরক্ত, কিন্তু কেউ কিছু বলতেও পারছে না। হাজার হোক, দোষ তো আর শিশুটির নয়। এক সময়ে মঞ্চের দুই অভিনেতা অভিনয় বন্ধ করে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন। ইশারায় জানালেন বাচ্চাটিকে নিয়ে বাইরে যেতে। নাটক আবার শুরু হল ঠিকই, কিন্তু তাল কেটে গেল, আর জমল না।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, যিনি খুব আড্ডাবাজ। অনর্গল কথা বলতেন। অন্যদের বিশেষ সুযোগ দিতেন না। তাঁর কাছে আড্ডার স্থান, কাল, পাত্রের ভেদাভেদ ছিল না। একবার দেশ বিখ্যাত এক গায়িকার আসরে আমার পাশে বসেছিলেন। গান শুরু হয়েছে, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মত সেই সঙ্গীত মুর্চ্ছনা উপভোগ করছেন। বন্ধুটি কানের পাশে মুখ নিয়ে আমাকে জানালেন, ‘এনার সঙ্গে মোহাম্মদ রফির বনিবনা হচ্ছে না জান তো’। আমি একটু ঘাড় নেড়ে, হাত তুলে ইশারায় জানালাম গান শুনছি। বন্ধুটি দমলেন না মোটেই, কানের কাছে ফিশফিশ করে সদ্য এক ফিল্ম ম্যাগাজিনে পড়া পুরো কাহিনি আমাকে শোনালেন। আমার অনীহা সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে। গান শোনা হল না। ইন্টারভেলে অন্য জায়গায় গিয়ে বসতে বাধ্য হলাম। বন্ধুপত্নী একটু দূরে বসেছিলেন, অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বললাম তোমার বর গান শুনতে দেয়না প্রচন্ড কথা বলে। ভদ্রমহিলা একগাল হেসে জানালেন সে জন্যই উনিও তাঁর স্বামীর পাশে বসেন না। বন্ধুটির সঙ্গে বহুদিন যোগাযোগ নেই। তবে এই ধরণের আড্ডাবাজ শ্রোতা কিন্তু অনেক আছেন।

প্রযুক্তির আশীর্বাদের সঙ্গে কিছু অভিশাপও আছে। আজকাল এক জ্বালা হয়েছে মোবাইল ফোন। আমার নিজেরও একটি আছে এবং বলতে বাধা নেই, যে জিনিসটা খুবই দরকারি আর আধুনিক জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু কোনও অনুষ্ঠান চলাকালীন এই ছোট্ট যন্ত্রটি যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হতে পারে। আজকাল এই ছোট্ট ফোনে ক্যামেরাও থাকে। হঠাৎ দেখবেন মাথার ওপরে হাত তুলে স্টিল ছবি বা ভিডিও তুলছেন আপনার সামনের দর্শকটি। উদ্যোক্তারা সব সময়ে দর্শকদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান, ফোনটি বন্ধ করে রাখতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা? অনেকে আবার মাঝে মাঝে ই-মেল চেক করেন আবার পিপ পিপ করে উত্তরও দেন; অন্যান্য দর্শকদের তোয়াক্কাও করেন না।

এ তো গেল বড় বড় অনুষ্ঠানের দর্শকদের কথা। ছোটখাটো পাড়ার প্রোগ্রামে তো দর্শকের মনোযোগ আশা করাই অন্যায়। ধরুন, পাড়ার পুজো অনুষ্ঠান, পাড়ার ছেলে মেয়েরা অনেক খেটে, প্রচুর রিহার্সাল দিয়ে, খুব উৎসাহ নিয়ে স্টেজে উঠেছে। কিন্তু পাড়ার লোকেরা দর্শকের আসনে বসে চুটিয়ে গল্প করছে। তবে, হ্যাঁ স্টেজের পর্দা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিতে ভুল করেন না কেউ। আর বাচ্চাদেরকে “এই দারুন হয়েছে” বলতেও ভুল হয় না।

এই ধরনের বিভিন্ন শ্রেণীর দর্শক নিয়েই আমাদের জীবন এদের সঙ্গেই আমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আরেকটা ছোট্ট ঘটনা বলে শেষ করছি

আমারই এক আত্মীয়া, খুব বন্ধুবৎসল, অতিথি পরায়ন এবং পরোপকারী সবাইকে নিয়ে হৈ চৈ করে থাকতে ভালবাসেন। আর খুব সিনেমা দেখতে ভালবাসেন। কোনও নতুন ছবি এলে সবাইকে ফোন করেন, টিকিটের ব্যবস্থা করেন এবং দলবল নিয়ে সিনেমা দেখতে যান। ছবি শুরু হতেই শুরু হয় ধারা বিবরণী। এ বাবা কি বিচ্ছিরি একটা জামা পরেছে, এই লোকটাকে আমি দেখতে পারি না, একে কেন যে নেয়? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ (একটা হাসির দৃশ্য), দেখবি খুনটা এই করেছে বলে দিলাম, এর পর নিশ্চয়ই ভাব হয়ে যাবে দেখিস ... অবিরাম চলতে থাকে। একদিন ধৈর্য হারিয়ে আমি বলতে বাধ্য হই যে এ রকম করা উচিৎ নয় এভাবে কথা বললে অন্য দর্শকের অসুবিধে হয় শুনে আত্মীয়াটি প্রচন্ড চটে যান শুনেছি আড়ালে আমাকে বেরসিক, অভদ্র টভদ্র বলেছেন আজকাল আমাকে আর সিনেমা দেখতে ডাকেন না
আমিও বেঁচে গেছি
নিউ জার্সি - ২৯ শে জুলাই ২০১৩

Friday 26 July 2013

আশা আকাঙ্ক্ষা


 আজ সকালে কেমন একটা আলসেমি লাগছেমনে হয় আরোও কিছুক্ষণ ঘুমোতে পারলে বেশ ভাল হত। মাঝে মাঝে কেন যে এমন হয়। অথচ রাতে বেশ জমিয়ে ঘুম হয়েছে। মন্দিরা কখন শুতে এসেছে টেরই পায়নিসাধারণতঃ মন্দিরা শুতে না আসা অব্দি একটু আধঘুমেই থাকে প্রবীর। মন্দিরা বেশ দেরি করে শুতে আসে। টিভি সিরিয়ালের পোকা। হিন্দি, বাংলা কিছুই বাদ দেয়না। এই একটা ব্যাপারে স্বামী স্ত্রী’র মধ্যে বেশ অমিল রয়েছে। সিরিয়াল দেখলে প্রবীরের মাথা ধরে।  প্রবীর যে টিভি দেখেনা তা নয়, নিউজ চ্যানেল, টক শো, ক্রিকেট গোগ্রাসে গেলে। 

হঠাৎ চটকা ভেঙে গেল প্রবীরের, বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা ছোট্ট অ্যালার্ম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে, ছ’টা পঁচিশ হয়ে গেছে। দেরি হয়ে গেল, রাস্তায় পুরো ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে পড়তে হবে। 

সকালে এই সময়টায় তিতলি অন-লাইন আসে। প্রবীরের স্টাডির এক কোনায় মন্দিরার কম্পিউটার, টেবিল টপ। ল্যাপ টপে সুবিধে পায় না মন্দিরা। নিউ জার্সিতে এখন রাত ন’টা, সারা দিন ক্লাস করে এইসময়টা তিতলি মায়ের সংগে একটু চ্যাট করে। বেশির ভাগই ঘরোয়া কথাবার্তা, কি খেলি, বাইরের খাবার খাসনা, একটু সেদ্ধ ভাত ফুটিয়ে নিস না কেন এইসব। পড়াশোনার কথাবার্তা সব বাবার সঙ্গে, প্রবীর অফিস থেকে ফেরার পরে; তিতলির ওখানে তখন সকাল; কিন্তু খুব একটা কথা হয়না তখন, ক্লাসের তাড়া থাকে। প্রবীর চায়-না মাস্টার্সের পর ওখানে চাকরিতে ঢোকে তিতলি। চলে আসুক এখানে। যদি পি এইচ ডি করতে চায় তো আলাদা কথা। 

মন্দিরা ঘড়ির দিকে তাকায়। আজ একটু দেরি করছে প্রবীর। দেরি হলেও মন্দিরা কখনও ডেকে দেয়না প্রবীরকে। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, একদিন দেরি হ’লে কিচ্ছু হবেনা। 

চ্যাট শেষ করে উঠে দাঁডায় মন্দিরা। তিতলিও ‘বাই’ করে দিয়েছে ততক্ষণে। মন্দিরা মাঝে মাঝে ভাবে, তিতলির কোনও ছেলের সঙ্গে ভাব টাব হয়েছে কি না কে জানে। হলে যেন একটা বেশ ভাল বাঙালি ছেলের সঙ্গে হয়। এক আধবার জিজ্ঞেস করেছে তিতলিকে। “মাআআআ ... তোমার না ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড”, উড়িয়ে দিয়েছে মেয়ে। 

প্রবীরের গলা শোনা যায় “ভরতদা একটু চা হবে না কি?”   

ভরত সব সময় দাদাবাবুর জন্য রেডি, আজ নয়, গত চল্লিশ বছর ধরে। যখন প্রবীরদের ভবাণীপুরের বাড়ীতে প্রথম আসে, তখন ভরতের বয়স কুড়ি বাইশ, আর প্রবীরের চোদ্দ। বাবা মারা যাবার পর, মা ক’দিনের জন্য পুনা চলে গেলেন দিদির কাছে। সেই বাড়ীতে থাকতে চাইলেন না। সে প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। প্রবীর তখন একডালিয়ার এই ফ্ল্যাটটা বুক করেছিল কিন্তু ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভারের আগে একদিন মা’ও চলে গেলেন। পুনা থেকে রবিনদার ফোন এল, দিদি তো কথাই বলতে পারলনা। ভরতকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এল সবাই

ভরত এক কাপ চা নিয়ে সোজা বেডরুমে ঢুকে গেল। সকালের প্রথম কাপ চা প্রবীর এখানে বসেই খায়।মন্দিরা সেদিনের টেলিগ্রাফটা নিয়ে ঢোকে। 

“কি বলল তিতলি?”

“বিশেষ কিছু না, সামনের উইকএন্ডে নিউ ইয়র্ক যাবে বলছিল”।

“একা?”—প্রবীর খবরের কাগজটা হাতে নিতে নিতে মুখ তুলে তাকায়

না না, বন্ধুদের সঙ্গে” মন্দিরা অভয় দেয়।

“কোন বন্ধু? কোন দেশী?”

“অত জানিনা, মেয়েকে বাইরে পাঠিয়েছো, এখন এসব ভেবে কি হবে ?” 

কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা শেষ করে নামিয়ে রাখে প্রবীরতারপর সোজা আবার বাথরুমে ঢুকে যায়। স্নান টান সেরে এবার অফিসের জন্য তৈরি হবে। ভরত ঘরে ঢোকে। চায়ের কাপটা তুলে নেয়।

আজকাল আর নিজে গাড়ী চালায় না প্রবীর, বিশেষ করে অফিস যাওয়ার সময়। ট্রাফিকের যা অবস্থা, অফিস পৌঁছতে পৌঁছতে টেনশন হয়ে যায়, কাজে মন বসেনা। 

একডালিয়া থেকে ক্যামাক স্ট্রীট খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু যদি বাড়ী থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়, পাক্কা চল্লিশ মিনিটের ধাক্কা। পথে দু-দুটো ফ্লাইওভার, একটাও কাজে আসেনা। গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে গিয়ে আবার লোয়ার সার্কুলার রোডের ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে ক্যামাক স্ট্রীট, ওপর দিয়ে হুশ হুশ করে গাড়ী বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ বালীগঞ্জ ফাঁড়িতেও আনেকক্ষণ দাড়াঁতে হল। অফিসে পৌঁছে প্রবীর অভ্যেস মত প্রথমেই কম্প্যুটার অন করে। দিনের প্রথম কাজ ই-মেল চেক করা। মুম্বাই হেড অফিস আধ ঘন্টা পরে খোলে তার মানে সাড়ে নটায়, আর বন্ধ হয় সাড়ে পাঁচটায়, আধ ঘন্টা পরে। হেড অফিস খোলার আগেই সব মেলের উত্তর দিয়ে দেয় প্রবীর। আজ প্রায় গোটা বারো মেল ইন বক্সে। একটা মেল দেখে  একটু অবাকই হয়, মেলটা মেহতার কাছ থেকে। রাকেশ মেহতা  মার্কেটিং ডিরেক্টর, খুব একটা নেট স্যাভি নয়। সোজা ফোন তুলে কথা বলতে ভালবাসে। পারত পক্ষে ই-মেল পাঠায়না। মেহতার ই-মেল আসলে মেহতার সেক্রেটারি পাঠায়, আর সবাই সেটা জানে। মেহতা কেয়ার করে না। মেহতার আমলে কম্পেনির সেল দ্বিগুন হয়ে গেছে পাঁচ বছরে। “বি এট ইয়োর ডেস্ক অ্যাট ওয়ান, উইল কল”; আর কিছু লেখেনিবি এট ইয়োর ডেস্ক, এই মোবাইল ফোনের আমলে ডেস্কে থাকার যে দরকার নেই, সেটা কে বোঝাবে মেহতাকে। কতগুলো ব্যাপারে মেহতা সেই মধ্যযুগে, অথচ অত্যন্ত সফল মার্কেটিং ডিরেকটর। প্রবীরের একটা গুপ্ত বাসনা ছিল একদিন ওই চেয়ারে বসার। কিন্তু দুজনে সমবয়সী, একই বছরে রিটায়ারমেন্ট। তা ছাড়া মেহতারও প্রমোশন পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই কারণ, এম ডি রঙ্গরাজনের বয়স আরও কম। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে এমডি হয়েছে পাঁচ বছর আগে। আইআইএম আহমেদাবাদের এমবিএ। ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হয়ে শুরু, খুব কম সময়ে পৌঁছে গেছে শিখরে। ধনবান ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। বড় দুই ভাই পারিবারিক ব্যাবসা সামলায়, রঙ্গা সেদিকে যায়নি। চেন্নাইয়ের নামকরা পরিবার। এক কাকা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন একসময়ে। প্রবীর কাজে মন দিল, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কোনও লাভ নেই। তা ছাড়া এখন ছাপ্পান্ন চলছে, আর চার বছর চাকরি আছে, এখন আর তল্পি তল্পা গুটিয়ে মুম্বাই যাবার কোনও অর্থ হয় না। ডিরেক্টরদের ফ্ল্যাট গুলো খুবই পশ এরিয়াতে, কিন্তু খুব ছোট। একডালিয়ার ষোলশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট মুম্বাইয়ে নেহাতই স্বপ্ন। বিশেষ করে অভিজাত অঞ্চলে। মেহতা তো যখন তখন ফোন করতে পারে। আগাম নোটিস দেওয়ার দরকার কি? বোধহয় আসন্ন বোর্ড মিটিং নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। আস্তে আস্তে ফাইলে ডুবে গেল প্রবীর। 

প্রবীর রওনা হতেই বাথরুমে ঢুকে গেল মন্দিরা। বরাবরই সকালে স্নানের অভ্যেস। স্নানের আগে শুধু এক কাপ চা খায়। স্নানের পর মিনিট দশেক ঠাকুর ঘরে কাটায়, একটু ধূপ জ্বালায়, আরতি করেবেশীক্ষণ নয়। এসব খুব একটা আসেনা মন্দিরার। শুধু শাশুড়ীর কথা ভেবেই এসব করাদশটার মধ্যে তৈরি হতে হয়, তারপর মায়েরা সব এক এক করে আসতে আরম্ভ করে। মন্দিরা ঠাকুর ঘরে ঢুকলেই ভরত এক স্লাইস পাঁউরুটি টোস্টারে ঢুকিয়ে দেয় আর একটা শশা চার ফালি করে কেটে রাখে। কেটলিতে দুকাপ আন্দাজ জল বসিয়ে দেয়। 

ড্রইংরুমে বসেই প্রাতঃরাশ সারে মন্দিরা। টিভিটা অন করে একটু চ্যানেল সার্ফ করে। ভরত এসে কাপ প্লেট নিয়ে যায়। তিতলি আমেরিকা চলে যাবার পর মন্দিরার সময় কাটতে চাইত না। মন খারাপ করে বসে থাকত সারাদিন। তখন প্রবীরই প্রস্তাবটা দেয়, “গান শিখেছিলে একসময়, এখন শেখাও না কেন?” বিল্ডিঙের কাছে বিরাট স্কুল। মায়েরা বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সারা দিন এখানে ওখানে বসে থাকে। অনেকে সারাদিন ফুটপাথেও বসে থাকে। প্রবীরের পরামর্শ মতই কয়েকটা হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করতেই মন্ত্রের মত কাজ হল। “দেখলে তো মার্কেটিং স্কিল?”- মন্দিরা মনে মনে হাসে প্রবীরের কথা ভেবে, মার্কেটিং ম্যানেজার নিজের এলেম দেখাচ্ছে। এতজন মা আগ্রহ দেখাল, সবাইকে নেওয়া গেল না। ছ’জনকে নিয়ে শুরু করেছিল মন্দিরা, এখন দশ জন আসে। ঘন্টা দুয়েক বেশ সময় কেটে যায় গান শিখিয়ে। কয়েকজনের তো ভীষন আগ্রহ। শেখানো হয়ে গেলে মন্দিরা ওদের বসিয়ে রাখে, নিজের স্বার্থে। কোল্ড ড্রিঙ্ক, কফি, চা, মাঝে মাঝে কিছু টায়ের ব্যবস্থাও করে। সবই ভরত করে দেয়। মন্দিরার চেয়ে ছোট সবাই, বেশ হাসিখুশি। বেশ সময়টা কেটে যায়। এর মধ্যে আবার শ্যামলী মেয়েটিকে বেশ ভাল লাগে মন্দিরার। বেশ স্মার্ট ঝকঝকে মেয়েটি। শ্যামলীর একটি ভাই আছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকেসদ্য সদ্য জর্জটাউন ইউনিভারসিটি থেকে পিএইচডি করেছে। মন্দিরা দেখেনি ছেলেটিকে, তবে ওর দিদির কাছে গল্প শুনেছে খুব। ছেলেটি মনে হয় খুব ভাল। তবে হাইট কিরকম কে জানে? তিতলি পাঁচ ফুট পাঁচশ্যামলী খুব একটা লম্বা নয়, তবে খুব শার্প চেহারা। অনেক দিনই ভেবেছে মেয়েটিকে একটা প্রস্তাব দিয়ে দেখবেপ্রবীরের মতামতও চেয়েছিল, প্রবীর এক কথায় নাকচ করে দিয়েছে। জানা নেই শোনা নেই, কোনও খোঁজ খবর না নিয়ে, শুধু কোথাকার এক দিদির ভরসায় মেয়ের সম্বন্ধ করলেই হল। বিয়ে কোনও ছেলেমানুষী ব্যাপার নয়মন্দিরার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রবীর বোধহয় মেয়েকে কাছ ছাড়াই করতে চায়না 

দুটো নাগাদ মায়েরা সবাই বেরিয়ে গেল, স্কুল ছুটীর সময় হয়ে গেছে। এখন মন্দিরার একটু গড়িয়ে নেওয়ার সময়। ড্রইং রুমের সোফাতেই টান টান হয় মন্দিরা। ঘুমোয় না, একটু ঝিমোয় – টিভি অন থাকে। ভরতও এই সময় একটু বিশ্রাম করে, কিচেনের পাশে ভরতের নিজস্বঃ ঘর, একটা খাট, তোষক, বিছানা ও বালিশ  

মেহতা কথা মত একটার সময়ই ফোন করে।

-      হাই প্রবীর, হোয়াটস নিউ? হাও ইজ় ম্যান্ডি? জানকী সে’স হাই।

একটু খুশী খুশী ভাব মেহতার গলায়। একটু নিশ্চিন্ত হয় প্রবীর। এক সময় একই সঙ্গে হেড অফিসে পোস্টেড ছিল দু’জন, বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল দুজনের। মেহতা কম্পেনিতে একটু সিনিয়র। জানকী একটু বয়সে বড়, কিন্তু বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল মন্দিরার সঙ্গে। এখনও মাঝে ফোনে কথা হয় দুজনে। মেহতা তিতলির কথাও জিজ্ঞেস করল। একথা ওকথার মধ্যে হঠাৎই আসল কথাটা তুলল,

-      লাইক টু কাম টু বম্বে, আই মীন মুম্বাই?

-      মুম্বাই? ক’দিনের জন্য?

-      সে ফোর টু সিক্স ইয়ারস, একটু যেন হাসল মেহতা।

-      হোয়াট আর য়্যু টকিং আবাউট? হোয়াট ফর?

-      হে ইউ নীড টু টেক ওভার ফ্রম মি বাডি,- এবার একটু গম্ভীর শোনাল মেহতাকে

-      কেন? তুমি কোথায় যাচ্ছ?

-      লুক প্রবীর, ইট ইজ ভেরি কনফিডেনশিয়াল। কেউ জানেনা এখনও, ওনলি রঙ্গা আর আমি। এখন তুমি জানবে। আই অ্যাম টেকিং ওভার ফ্রম রঙ্গা।

-      কেন? রঙ্গা কোথায় যাচ্ছে?-প্রবীর হতবাক।

-      হি ইজ জয়েনিং দি সেন্ট্রাল গভার্নমেন্ট, মিনিস্ট্রি অফ ফাইনান্স অ্যাজ অ্যান এডভাইসরইউ নো হিজ কানেকশন।

-      কিন্তু এরকম ল্যুক্রেটিভ জব ছেড়ে?

-      কাম অন প্রবীর, মানি ইজ নট হিজ প্রবলেম। হি হ্যাজ প্লেন্টি ওফ ইট। ইটস দি পজিশন।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে প্রবীর, একটু ধাতস্থ হতে চেষ্টা করে।

-      লুক প্রবীর তোমার ভারবাল কনকারেন্স পেলেই আমি, রঙ্গাকে জানিয়ে দেব। দু সপ্তাহ পরে বোর্ড মিটিঙে পাস হয়ে যাবে।

-      ওকে, বলল প্রবীর।

-      থ্যাঙ্কস একটু হাসল মেহতা, এন্ড বাই দি ওয়ে, কংগ্র্যাচুলেস্নন্স।

-      ওহ ইয়েস একটু সামলে নিল প্রবীর, সেম টু ইউ।

ফোন রেখে দিল মেহতা। 

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল প্রবীর। ব্যাপারটা গোপনীয়, কাউকে বলা যাবে না, এক যদি মন্দিরাকে জানানো যেত! কিন্তু মন্দিরা এখন নিশ্চই ছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত। মন্দিরা শুনলে ভীষণ খুশি হবে কিন্তু এখন ফোন করা উচিত হবে না। কাজে আর মন বসবে না আজ। প্রবীর মুম্বাই চলে গেলে, এখানকার দায়িত্ব কে নেবে? এ ব্যাপারে পরে মেহতার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। প্রবীর অভ্যাস বশতঃ ফাইল খোলে আবার। ডিরেক্টরের পার্কস প্রচুর। দুখানা গাড়ি, একটা নিজের একটা ফর ফ্যামিলি। ফুললি ফার্নিশড এয়ার কন্ডিশনড ফ্ল্যাটএকটু ছোট হয়তো, কিন্তু সো হোয়াট,  মন্দিরার নিজের ব্যবহারের জন্য আলাদা গাড়ী থাকবে। কিন্তু মন্দিরা সময় কাটাবে কি করে? দিদি, রবীনদা পুনাতে, মাঝে মাঝে বেশ যাওয়া যাবে, ওঁরাও আসতে পারেন শণি রবিবারে, একটু ঘন ঘন দেখা হবে, ভালই তো। মন্দিরার সঙ্গে একটু আলোচনা হওয়া দরকার ছিল। 

স্কুলের মায়েরা একসঙ্গেই বেরিয়ে গেল সবাই। মন্দিরা ঘরটাকে গুছিয়ে নেয়। অগোছালো বাড়ী মন্দিরা সহ্য করতে পারেনা। কপাল ভাল প্রবীর, তিতলি এমনকি ভরতদাও খুব গোছানো। এই সময়টা খবরের কাগজদুটো ভাল করে পড়ে মন্দিরা, ইংরিজি, বাংলা দুটোইচারটে নাগাদ বেহালায় ফোন করে রোজ, মা এই সময়টা দিবানিদ্রা সেরে এক কাপ চা নিয়ে বসেন। মা, বাবা একা থাকেনদিনে একবার ফোন করে খোঁজ খবর নেয় মন্দিরা। মাঝে মাঝে দুবার তিনবারও ফোন হয়ে যায়। একবার রিং হতেই মা ফোন ধরল। 

-      কি রে? তিতলির সঙ্গে কথা হল আজ?- মা’র প্রথম প্রশ্ন

-      হ্যাঁ, ভালই আছে? তোমাদের কি খবর? বাবা সকালে গিয়েছিল, প্রেশার দেখাতে?

-      গিয়েছিল মানে, ঠেলে পাঠাতে হয়েছে।

-      প্রেশার নর্মাল?

-      হ্যাঁ। এই রোববার আসবি? গত সপ্তাহে তো এলি না?

-      কি করব? প্রবীরের কলেজের বন্ধুরা হঠাৎ এসে গেল, ওদের সেই আমেরিকার বন্ধু এসেছে।

-      রোববার আয়, ভাল ইলিশ উঠেছে তোর বাবা বলছিল, বলল ওদের আসতে বল। জানিস তো বাজারের ব্যাপারে তোর বাবার কোন আলসেমি নেই।

-      দেখি তোমার জামাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি,

-      দেখ। আর শোন, সন্তুবাবু বলছিলেন আজকাল তোদের কম্পিউটারে সব পাত্র পাত্রী হয়েছে। একটু দেখ না। একটু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?- মা রোজ ঘুরে ফিরে রোজ তিতলির বিয়ের কথা তুলবেই।

-      ইন্টারনেট। আমি জানি, ওসব সাইটের কথা। কিন্তু কি করব? তোমার জামাইকে তো জানো, পড়াশোনা শেষ না হলে ও কিছু করবে না।

ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছে মন্দিরা, ভেতর থেকে হঠাৎ মোবাইলটা বেজে ওঠে। টেলিমার্কেটিং নিঃসন্দেহে, বিরক্ত লাগে অসময়ে।

-      তুমি চিন্তা করনা মা, সব কিছুর একটা সময় আছে –

মোবাইলটা বেজেই চলেছে, লোকগুলোর কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই।

-      আহা আমি তো এখনই বিয়ে দিতে বলছিনা, খোঁজ খবর করে রাখতে ক্ষতি কি? বিয়েটা পড়াশোনা শেষ হলেই হবে’খন – মা যেন নাছোড়বান্দা

-      তোমার হাঁটুর ব্যথা কেমন, কথা ঘোরায় মন্দিরা

-      হাঁটুর ব্যথা তো আমার নিত্য সঙ্গী, মলম লাগিয়ে যাচ্ছি

-      শুধু মলম লাগালে হবে না, তোমার একটু হাঁটা দরকার - মোবাইলটা ক্ষান্ত দিল অবশেষে। 

একটু পরে মন্দিরাও ফোন রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পরে প্রবীর ফিরবে। অফিস থেকে এসে প্রবীর কিছু খায় না শুধু এক কাপ কফি ছাড়া। তাই ব্যস্ততার কিছু নেই। মাঝে মাঝে বেশ দেরী করে, তবে দেরী হলে ফোন করে জানিয়ে দেয় প্রবীর। এখনও ফোন করেনি যখন, তবে মনে হয়, সময় মতই ফিরবে আজ। 

অফিস থেকে ফেরার সময় প্রত্যেক দিন জ্যামের মুখে পড়তে হয়। সারিদিন অফিসের ক্লান্তির পর এই ভীড়, শব্দ, ধোঁয়া – বিরক্ত লাগে। এত বড় খবরটা এখনও কাউকে বলা হয়নি। মন্দিরাকে ফোন করে পেল না।ল্যান্ডলাইন বিজি, মোবাইলটা বেজে গেল, নিশ্চয়ই মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল। পরে একটা মীটিং-এ ব্যস্ত হয়ে গেল, আর ফোন করা হয়নি। একবার ভাবল গাড়ী থেকেই ফোন করে, কিন্তু রামবিলাসের হাত স্টীয়ারিং-এ থাকলে কি হবে, কান খাড়া, কাল সকালেই খবর চাউড় হয়ে যাবে। চোখ বুজে সীটে গা এলিয়ে দেয় প্রবীর, এসি চলছে, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড দিয়ে গাড়ী ছুটছে, একডালিয়া পৌঁছতে বেশী সময় লাগল না। রামবিলাস গাড়ি পার্ক করে, প্রবীর নেমে একটু দাঁড়ায়। রামবিলাস গাড়ী লক করে চাবিটা প্রবীরের হাতে দিয়ে, একটা ছোট সেলাম দিয়ে চলে যায়। প্রবীর লিফটের দিকে এগোয়। নিজের মনেই একটু হাসে একটা দারুন সারপ্রাইজ দেওয়া যাব আজ মন্দিরাকে। বাইরে কোথাও ডিনারে গেলে হয়, বেশ একটা সেলিব্রেশন হয়ে যাবে। 

আজ দুবার বেল দিতে হল। ভরত দরজা খুলে দিল। একটু অবাকই হল প্রবীর। সাধারণতঃ মন্দিরাই দরজা খোলে। লিভিং রুমে ঢুকেই মন্দিরার গলা শুনতে পেল প্রবীর। উলটো দিকে তাকিয়ে ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে মন্দিরা, ইংরিজিতে,-

-      ওকে শিওর, প্লীজ কাম, উই উইল বি ভেরি হ্যাপি...হোয়াই নট দিস ইয়ার...অফ কোর্স, আংকল উইল বি হ্যাপি টু...উই ক্যান কাম টু ডেলহি টু মীট ইয়োর প্যারেনটস...ওকে ফর শিওর... ইয়েস বাই... টেক কেয়ার ... কিরে আগে বলিসনি কেন? কবে আলাপ হল...

হঠাৎ পেছন ফিরে প্রবীরকে দেখতে পেল মন্দিরা

-      এই বাবা এসেছে... কথা বলবি? হ্যাঁ এই তো এখানেই... ওমা কেন? আচ্ছা ঠিক আছে, পরে বলিস কিন্তু...

এক গাল হাসল মন্দিরা, ফোনটা রেখে দিল। 

-      শুনছো তোমার মেয়ের কাণ্ড,

খুব উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে হঠাৎ মন্দিরাকে।

-      কেমন নিজে নিজে সব ঠিক করেছে। বেশ ভাল ছেলেটি জান? দিল্লীর ছেলে, বাবা আইআইটির প্রফেসর, মাও কোনও একটা কলেজে পড়ান, শিক্ষিত পরিবার।

অনর্গল কথা বলে যায় মন্দিরা,

-      জান তো একটু একটু বাংলা বোঝে বলল। তিতলি কাল তোমার সঙ্গে কথা বলবে। একটু লজ্জা পাচ্ছিল তোমার সঙ্গে কথা বলতে। বাঙালি হ লে ভাল হত, ছেলেটা কিন্তু বেশ ভাল, তুমি একটু কথা বললে ভাল লাগত। আমি তিতলিকে ছবি পাঠাতে বলেছি। ডিসেমবরে আসবে, দিল্লীতে ক’দিন থেকে এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যাবে। 

প্রবীর হতবাক, কিছু বলে না, ভেবে পায়না কি বলবে। মন্দিরা হঠাৎ কেমন যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। প্রবীর শ্যু র‌্যাকের সামনে জুতো খোলে, চটি পায় দিয়ে বেডরুমে ঢুকে যায়। ক্লসেট থেকে পায়জামা, পাঞ্জাবি বের করে বাথরুমে ঢোকেবেসিনে জল খুলে অনেকক্ষণ মুখে ঝাপটা দেয়, কিছুক্ষণ পরে মাথাটা যেন একটু ঠান্ডা হয়। জামাকাপড় পালটে বেরিয়ে এসে, বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আবার মন্দিরার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ কানে আসে। বেহালায় মা’র সঙ্গে কথা বলছে মন্দিরা, 

-      মা, ওসব আজকাল কেউ দেখেনা, তোমাদের পাড়ার নীহারবাবুর ছেলের বউ তো গুজরাতি, কেমন সুন্দর সংসার করছে ......মা, দেখো এককালে কিন্তু বাঙাল ঘটিরও বিয়ে হত না, এখন তো কেউ খেয়ালই করেনা। দিনকাল পালটে গেছে মা, আগে ছেলেটিকে দেখো, আলাপ কর... না এখন কাউকে বল না, আগে আলাপ করি, ছেলেটির মা বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করি তারপর দেখা যাবে, আর তিতলিও এখন কাউকে বলতে বারণ করেছে ... আরে বাবাকে বলবে না কেন? অদ্ভুত কথা বল মাঝে মাঝে...। 

প্রবীর বিছানার ওপর বসে পরে, চোখ বুজে আসে, মাথাটা আবার কেমন ঝিম ঝিম করছে। দুহাত দিয়ে মাথার দুপাশটা চেপে ধরে। মন্দিরা এখন ওর বাবার সঙ্গে কথা বলছে। নিজেকে সামলে নেয় প্রবীর। একদিনে অনেকখানি বদলে গেল জীবনটামন্দিরা ফোন রেখে দিলে, গিয়ে কথা বলতে হবে। জানতে হবে তিতলি কি কি বলল, ছেলেটিই বা কি বলল? ছেলেটির নাম কি? সব খবরাখবর নিতে হবে। তা ছাড়া মন্দিরাকে তো নিজের উন্নতির কথাও বলা হয়নি। উঠে দাঁড়ায় প্রবীর, ধীরে ধীরে এগোয় পাশের ঘরের দিকে। মন্দিরা বাবার সঙ্গে কথা বলছে,- 

-      ঠিক বলেছ বাবা, আমিও তো তাই বলছি। ওরা সুখী হলেই হল ... তুমি মাকে একটু বুঝিয়ে বল। ... না ঐ একমাত্র ছেলে, একমাত্র সন্তান, তিতলির মতই। আমি এরমধ্যেই ওর মা’র সংগে একবার...

 

প্রবীর মন্দিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। মন্দিরা ভুরু দুটো ওপরে তুলে জানতে চায় কি হয়েছে। প্রবীর ইশারায় জানায় একটু দরকারি কথা ছিল। মন্দিরা থামে,

 

-      বাবা এক মিনিট। কি হয়েছে?

-      মন্দিরা, আই আলসো হ্যাভ আ গুড নিউজ!

-      কি? তাড়াতাড়ি কর, বাবা অপেক্ষা করছেন।

-      আই এম আ ডিরেকটর নাও, মার্কেটিং... আজ অফিসে জানিয়েছে

-      ও কংগ্র্যাচুলেশনস।

-      মুম্বাই মুভ করতে হবে

-      তাই? গ্রেট, কবে যাচ্ছ?

-      দেখ, মন্দিরা ...

-      ঠিক আছে একটু পরে কথা বলছি ... হ্যাঁ বাবা, না ও একটা অফিসের কথা বলছিল। না না তেমন কিছু না, আমি এরমধ্যেই ছেলেটির মা বা বাবার সঙ্গে কথা বলব। ওনারা যদি এখানে আসতে রাজি হন, তবে তোমাদের সঙ্গেও আলাপ হয়ে যাবে ... 

অনর্গল কথা বলে চলেছে মন্দিরা। হঠাৎ যেন খুব ক্লান্ত লাগছে প্রবীরের। ক্ষিদেও যেন নেই। একটু শুয়ে থাকলে বোধহয় ভাল লাগবে। তিতলির পুরো ব্যাপারটা এখনও জানা হয়নি। মন্দিরার ফোন যে কখন শেষ হবে?

সোফায় বসে গা এলিয়ে দেয় প্রবীর। অপেক্ষা করে মন্দিরার জন্য।

কুয়েত - ২৪ শে জুলাই ২০০৯