গৌতমদা আমার আত্মীয় নয়। জয়তীদিও নয়। ছোটবেলায়
এক পাড়ায় আমরা থাকতাম, সেই সুত্রেই হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। গৌতমদা ছিল আমাদের হিরো। ওদের
বন্ধুদের দলটা ছিল আমাদের থেকে বছর চার পাচেকের বড়, পাত্তা দিত না বড় একটা। সেই
সময়, ছেলে মেয়েদের মধ্যে সহজ মেলার বিশেষ সুযোগ ছিল না, কিন্তু পুজো বা অন্যান্য
পাড়ার অনুষ্ঠানে পাড়ার দাদা দিদিরা একসঙ্গে বসে গল্প করত জমিয়ে। জয়তীদিকে নিয়ে
গৌতমদার পেছনে লাগত সবাই মনে আছে। জয়তীদি এমনিতে খুব গম্ভীর, খুব বেশি কথা বলত না
কারও সঙ্গে। কিন্তু গৌতমদা কাছে থাকলে কেমন যেন উচ্ছল হয়ে উঠত। গৌতমদাও মাঝে মাঝে চোরা
চোখে তাকাত জয়তীদির দিকে। দুজনকে একসঙ্গে দেখেনি কেউ, শুধু একবার এক ঝলকের জন্য
আমি ওদের দেখে ছিলাম, সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যেবেলায়, মেয়েদের স্কুলের ঠিক পেছনে,
আবছা অন্ধকারে খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল দু-জনে। আমাকে দেখেই জয়তীদি ছিটকে
পেছনের দরজা দিয়ে স্কুলের ভেতরে চলে গেল। তারপর থেকেই কেমন যেন আমাকে এড়িয়ে চলত জয়তীদি।
গৌতমদা অবশ্য স্বাভাবিক ছিল।
পূজোর সময় নাটক,
নৃত্যনাট্য, আবৃত্তি ও গানের অনুষ্ঠান হত জমিয়ে। জয়তীদি বেশ ভাল গান গাইত, বেশির
ভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীত। একবার অষ্টমীর দিন সন্ধ্যায়, হারমোনিয়াম নিয়ে মাথা নীচু করে
গেয়েছিল, “তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম ...”। গান চলাকালীন
গৌতমদা যে অপলক তাকিয়ে ছিল গায়িকার দিকে সেটা কারও নজর এড়ায়নি। এ নিয়ে পাড়ায় একটু ফিসফাসও শুরু হয়েছিল। গৌতমদা
অবশ্য এ-সব নিয়ে মাথা ঘামাতো না। জয়তীদি কে দেখতাম রাস্তায় গৌতমদার মুখোমুখি হলে
মাথা নিচু করে চলে যেত, তাকাতো না কোনও দিকে।
বেশ ভালই দিন কাটছিল।
হঠাৎ একটা ঘটনা সব কিছু ওলট পালট করে দিল।
দত্ত কাকা ও সেন মেসো,
অর্থাৎ গৌতমদা এবং জয়তীদির বাবা একই সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। অফিসের কিছু একটা
অপ্রীতিকর ঘটনার দরুন দুজনের মধ্যে বেশ মনোমালিন্য হয় এবং সেটা পরিবার অব্দি গড়ায়।
দু-বাড়ির মধ্যে যাওয়া আসা বন্ধ হল। মুখ দেখাদেখিও
প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর
গৌতমদার বাবা একদিন বদলি হয়ে অন্য কোথাও
চলে গেলেন। শুনেছিলাম দিল্লীতে ওনার পোস্টিং হয়ছিল আর গৌতমদা সেখানেই কলেজে ভর্তি
হয়েছে। জয়তীদিও পরের বছর স্কুলের পাট চুকিয়ে কোলকাতায় কলেজে ভর্তি হল। ওদের দুজনের
কথা ভুলেই গেল সবাই। একদিন বিয়ে হয়ে
গেল জয়তীদির। পাত্র ব্যাঙ্গালোরে এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বিরাট চাকুরে, সদ্য
আমেরিকা থেকে ফিরেছে, সুদর্শন, খুব সুন্দর লাগছিল দুজনকে একসঙ্গে। জয়তীদিকে বেশ
খুশি খুশি মনে হচ্ছিল। খুব হৈ চৈ হল বিয়েতে। গৌতমদার কথা কারও মনে হলনা, আমারও না।
একদিন জয়তীদির বাবাও
রিটায়ার করে চলে গেলেন। একমাত্র মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে থাকে, শুনেছিলাম মেয়ের বাড়ির
কাছেই একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করে সেখানেই থাকতেন। ধীরে ধীরে সব
সম্পর্ক ছিন্ন’ হয়ে গেল।
তারপর কেটে গেছে বহু বছর।
মা, বাবা কেউ আর নেই এখন। আমি কলকাতায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। গরচা
রোডের একটি পুরোনো বাড়ির একতলায় থাকি, ভাড়া বাড়ি। এক মেয়ে পুনাতে পড়ছে। বাড়িতে শুধু আমি
এবং আমার স্ত্রী। স্বাস্থ্যরক্ষার খাতিরে নিয়ম করে সকালে হাঁটতে যাই, -লেকে অর্থাৎ
রবীন্দ্র সরোবরে। প্রচুর লোক হাঁটে সেখানে। এক সকালে লেক থেকে বাড়ির ফেরার মুখে হঠাৎ
গড়িয়াহাটের মোড়ে দেখা হয়ে গেল গৌতমদার সঙ্গে। চেহারা ভেঙেছে অনেকটাই, তবে এখনও বেশ
ভাল স্বাস্থ্য। বয়সের সঙ্গে বেশ একটা গাম্ভীর্যও
এসেছে দেখলাম তবে আগের মতই আন্তরিক। খবরাখবর নিলাম
এবং দিলাম। দিল্লীতে ছিল বহুদিন, রিটায়ার করেছে মাস ছয়েক আগে। একটি ছেলে,
আমেরিকায়। দিল্লীর পাট চুকিয়ে এখন ডোভার লেনে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। গেলাম একদিন। স্ত্রীর সঙ্গে
আলাপ করিয়ে দিল; বৌদি বলেই সম্বোধন করলাম। আমার সমবয়সী প্রায়। বেশ আলাপি মহিলা। বেশ
জমিয়ে গল্প করেন। ওনার সামনে বরং গৌতমদাকে একটু নিস্প্রভ মনে হল। জানালেন কোলকাতায় এসে হাঁটার রোগে ধরেছে গৌতমদাকে। ঝড়বৃষ্টিতেও ছাতা
হাতে হাঁটতে যায়। কিছুতেই আটকানো যায় না। প্রত্যেক
দিন যাবে, একদিনও বাড়িতে ধরে রাখা যায় না। একটু ম্লান হাসল গৌতমদা, বলল রিটায়ার
করেছি, শরীর স্বাস্থ্য একটু ভাল রাখতে হবে
না? হাঁটতে যাওয়ার অভ্যেস আমারও; এক সঙ্গে লেকে
হাঁটতে যাবার প্রস্তাব দিলাম, রাজি হল না। নানা ছুতো দেখিয়ে এড়িয়ে গেল। বৌদির
কাছেই জানলাম, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে কোনও একটা রাস্তার দোকান থেকে খুঁড়িতে চা খায় গৌতমদা প্রত্যেক
দিন তাড়িয়ে তাড়িয়ে, কেউ নাকি দেখেছে। শুনে আবার একটু ম্লান হাসল গৌতমদা, বলল সকাল
বেলার ফুটপাথের চায়ের একটা আলাদা স্বাদ আছে।
এই স্বাদ কোনও
পাঁচতারা হোটেলেও পাওয়া যাবে না।
একদিন সকালে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে লেকের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখলাম গৌতমদা বেশ দ্রুত রাসবিহারির দিকে হাঁটছে।
কি রকম একটা কৌতুহল হল, পিছু নিলাম সাবধানে, যেন দেখতে না পায়। দেশপ্রিয় পার্ক
ছাড়িয়ে, ল্যান্সডাইন রোডের ওপারে, ফুটপাথের ওপর একটা চা-ওয়ালার ত্রিপল দেওয়া
ছাউনির সামনে দাঁড়াল গৌতমদা। চা ওয়ালাকে কিছু বলতে হল না, নিজে থেকেই খুঁড়িতে চা ভরে
এগিয়ে দিল। সামনে একটা ছোট্ট বেঞ্চ, খুব একটা পরিস্কার নয়, সেখানেই বসল গৌতমদা।
সামনে শূন্য দৃষ্টি। ভোর বেলা, আশে পাশে লোক জন বিশেষ নেই। দোকানের সামনে একটা ঝা
তকতকে নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি; প্রত্যেক ফ্ল্যাটের সামনে বারান্দা। প্রায় সব বারান্দার
দরজা বন্ধ। শুধু তিন তলার বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে। সেদিকে তাকাতেই হঠাৎ বিবশ মনে হল
নিজেকে। এক প্রবীণা মহিলা, পরনে শাড়ি, যেন একটু অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নীচের
চা-ওয়ালার দিকে। চুলের এক ধারটা একটু পাকা, অনেকটা ইন্দিরা গাঁধীর মত। এত বছর পরে
দেখলাম, চিনতে অসুবিধে হল না একটুও।
একই রকম দেখতে আছে
জয়তীদি।
কুয়েত ১২ই মার্চ ২০১২
No comments:
Post a Comment