তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সেকেন্ড ইয়ার চলছে। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি;
সুন্দর ক্যাম্পাস। মেইন গেট দিয়ে ঢুকে দুটো সমান্তরাল রাস্তা। একদিকে সারি সারি
কলেজ, আরেক দিকে সব হস্টেল, সারি সারি আম গাছ, দুই রাস্তার মাঝখানে খেলার মাঠ, মাঠ
ঘিরে গ্যালারি। বেশ ছিল দিনগুলো। হৈ চৈ করে দিন কাটছিল। বিনোদন বলতে ছিল শুধু সিনেমা দেখা।
শহরে বেশ কয়েকটা সিনেমা হল ছিল। এতদিন পর নামগুলো আর মনে নেই। একবার খুব জাঁক
জমকের সঙ্গে একটি বাতানুকুল হলের উদ্বোধন
হয়েছিল। সেদিন আমাদের সে কি উত্তেজনা। মারামারি করে টিকিট কেটে জঘন্য একটা সিনেমা দেখেছিলাম।
সমস্যা ছিল একটাই। কলেজের মাইনে আর হস্টেলের খরচের পর
যেটুকু হাত খরচের টাকা বাঁচত, তাতে খুব একটা বিলাস বহুল জীবন কাটানো যেত না।
সিনেমা টিনেমা একটু নিয়ন্ত্রনে রাখতে হত। সিনেমার পর খুব ইচ্ছে করত কোনও
রেস্তোরাঁয় গিয়ে একটু খাওয়া দাওয়া করতে। সবার পকেট থেকে ঝেরে ঝুরে হিসেব করা হত। বেশির ভাগ দিনই বাজেটে কুলত না। নেশা
টেশার খপ্পরেও পড়েছিল কেউ কেউ। অবশ্য নেশা বলতে ছিল শুধু সিগারেটের নেশা। সেটাই ছিল
খুব দুঃসাহসী ব্যাপার; আর খরচ সাপেক্ষও বটে। এক প্যাকেটে ২০ টা পানামা সিগারেটের দাম
ছিল ৭৫ পয়সা। চারমিনারের দাম অবশ্য আরও কম।
হলের একতলায় সবচেয়ে সামনের সারির টিকিট পাওয়া যেত ষাট
পয়সায়। অর্থাভাব সত্ত্বেও সেখানে গিয়ে বসতে একটু সঙ্কোচ হত; হাজার হোক
ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস তো। ৬০ পয়সার ঠিক পেছনের সীটগুলোর দাম ছিল ১ টাকা ২৫
পয়সা। প্রায় দু প্যাকেট পানামার দাম। সেখানেই বসতাম। সপ্তাহে একটি করে সিনেমা দেখলে
মাসে ৫ টাকা। তাই ছিল আমাদের সিনেমা খাতে বরাদ্দ। কিন্তু প্রায়ই মাসে চারটের বেশি
সিনেমা দেখা হয়ে যেত। সাধারণতঃ আমরা শণিবার ইভিনিং বা নাইট শোতে সিনেমা দেখতাম।
কিন্তু প্রত্যেক রবিবার নুন শো তে পুরোন ইংরিজি ক্লাসিক দেখানো হত; ১ টাকা টিকিট। তাও
দেখতাম; লোভ সম্বরণ করতে পারতাম না। প্রচুর ভাল ভাল সিনেমা দেখেছি, ব্রিজ অন দি
রিভার কওয়াই, অল কোয়াইট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, টুয়েলভ অ্যাংরি মেন, অন দি
ওয়াটার ফ্রন্ট, রিয়ার উইনডো, ভার্টিগো, - সব এক টাকায়।
বলা বাহুল্য কয়েক দিন পর বাজেটে টান পড়তে শুরু করল।
মাসের শেষে প্রায়ই সিনেমা দেখা হত না। মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু দরাজ দিল বন্ধু
নিজেদের উদ্বৃত্ব বাজেট থেকে সিনেমার টিকিট কিনে দিত কিন্তু তার জন্য মূল্য আদায়
করে নিত। প্রায়ই ঘরে এসে না জিজ্ঞেস করে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে
মেজাজে ফুঁকতে ফুঁকতে বেরিয়ে যেত। কিচ্ছুটি বলা যেত না, কিছু বললেই “অ্যাই তোকে
সিনেমা দেখিয়েছি না”- বলে খেঁকিয়ে উঠত।
প্রত্যেক মাসের শুরুতে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতাম
মানি অর্ডারের জন্য। পোস্ট অফিসের পিয়ন সেটা জানত, এক টাকা বখশিশ জোগাড় করত সবার
কাছ থেকে। এত গুলো ছাত্র, প্রচুর পয়সা করত নিশ্চয়ই প্রত্যেক মাসে।
আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের হস্টেলে রুম গুলো ছিল ডাবল
সীটেড। সঞ্জয় আর বিভাস থাকত একটা ঘরে।
হরিহর আত্মা। আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে এক
মন্দির ছিল; বিড়লা মন্দির। আসলে বাবা বিশ্বনাথের মন্দির; বিড়লারা তৈরি করিয়ে
দিয়েছিলেন। মন্দিরে চার পাশে সুন্দর বাগান। আমরা যেতাম মাঝে মধ্যে। পরিবেশটা খুব
শান্ত, বেশ ভাল লাগত। সঞ্জয় আর বিভাস প্রত্যেক দিন যেত মন্দিরে; আর অনেকক্ষণ ধরে
প্রণাম করত। ওদের হস্টেলের খাবার পছন্দ
ছিল না। প্রায়ই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যেত আর বাইরে খেয়ে আসত। তার অবধারিত ফলাফল যা হবার তাই, মাসের ১৫
তারিখের মধ্যে দু-জনই নিঃস্ব। একদিন ওরা ঠিক করল যে সিনেমা দেখাটা বন্ধ করতে হবে। অভিভাবকরা
অত কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছেন পড়াশোনার জন্য, আর আমরা সেই কষ্টার্জিত পয়সা সিনেমা
দেখে ওড়াচ্ছি; খুব অন্যায়। বাইরে খাওয়ার ব্যাপারে ওদের আবার কোনও বিবেকের দংশন
ছিল না; কারণ মা বাবা বলেছেন ভাল করে খাওয়া দাওয়া করতে।
একদিন সান্ধ্য আড্ডায় সঞ্জয় আর বিভাস ঘোষণা করল যে
আগামী এক বছর ওরা কোনো সিনেমা দেখবে না। অকারনে
পয়সা খরচ বন্ধ। এখন শুধু পড়াশোনা। আরও জানালো যে পরের দিন সন্ধ্যেয় কলেজ থেকে
ফিরে, স্নান টান করে বাবা বিশ্বনাথের সামনে গিয়ে “অঙ্গীকার” করে আসবে। আমাদের
বন্ধুদের মধ্যে সুব্রত ছিল একটু মুরুব্বি আর মস্তান টাইপের। এলাহাবাদে বাড়ি,
হিন্দি মেশানো বাংলা বলত। শুনেই খেঁকিয়ে উঠল, “একদম বেকারকি বাত বলছিস। পুরো
বেইকুফি। আরে ইয়ার কেউ যদি তোদের সিনেমা দেখাতে চায়, তবে?” শুনে সঞ্জয় আর বিভাস
একটু মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, তাই তো। এটা তো ওদের মাথায় আসেনি। ব্যাপারটা তখনকার মত
সেখানেই ধামাচাপা পড়ল।
পরের সপ্তাহের রবিবার সকাল। আমরা দুপুরের খাওয়া
দাওয়ার আগে মন্দিরের বাগানে বসে আড্ডা মারছি। বেশ জমে উঠেছে। হঠাৎ দেখি সেই দুই মূর্তি
স্নান টান করে খুব গম্ভীর মুখে মন্দিরের ভেতরে ঢুকছে। বুঝলাম আজকে ওদের সেই
অঙ্গীকারের দিন। মিনিট পনের পর মন্দির থেকে বেরোতেই ওদের পাকরাও করা হল। যা
ভেবেছিলাম তাই, ওরা বাবা বিশ্বনাথের সামনে বলে এসেছে যে আগামী এক বছর ওরা “নিজের
পয়সায়” সিনেমা দেখবে না। আর আশ্চর্য্য, সত্যিই ওরা সিনেমায় যাওয়া বন্ধ করে দিল।
বন্ধুরাও তেমনি চালু, সবাই ঠিক করল যে কেউ ওদের সিনেমা দেখাবে না। প্রায় আট মাস এই
ভাবেই চলল। আমরা সিনেমা দেখে এসে ওদের শুনিয়ে নানা রকম আলোচনা করতাম। ওরা উদাস মুখ
করে বসে থাকত। কিছুতেই ওদের প্রলুব্ধ করা গেল না।
তারপর হঠাৎ একদিন সব ওলট পালট হয়ে গেল। তার জন্য দায়ী
বোম্বাই (তখনও মুম্বাই হয়নি) ফিল্ম জগতের বেতাজ বাদশা রাজ কপূর।
রাজ কপূর বোম্বাইয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তাঁর নতুন
সিনেমার কথা ঘোষনা করলেন। একমাস পরে ছবিটি মুক্তি পাবে। ছবির নাম সঙ্গম। প্রচুর
যত্নে এবং অজস্র অর্থব্যয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে। গানের দৃশ্যের স্যুটিং হয়েছে বিদেশের
নানা জায়গায়। ছবিতে আছেন রাজ কপূর নিজে আর আছেন রাজেন্দ্র কুমার ও বৈজয়ন্তিমালা। সিনেমার
বিপনন কাকে বলে সেটা রাজ কপূর খুব ভাল বুঝতেন। কয়েক দিনের মধ্যে সারা শহর জুড়ে বড়
বড় ব্যানার, আর খবরের কাগজে বড় বড়
বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেল। ডজন খানেক রিক্সা পোস্টারে ঢেকে, মাইক লাউড স্পীকার নিয়ে সারা
শহর টহল দিতে শুরু করল। রেডিও সিলোন থেকে ঘোষনা করা হল যে পরের বুধবারে শ্রোতাদের
অনুরোধে সঙ্গমের গান পরিবেশিত হবে। আমরা সন্ধ্যে সন্ধ্যে খাওয়া দাওয়া সেরে কমন
রুমে গিয়ে বসলাম। একটা মান্ধাতা আমলের রেডিও ছিল
সেখানে। প্রচন্ড ভীড়, ঠ্যালা ঠেলি। একটার পর একটা গান শুনলাম, বোল রাধা বোল, ও
মেহবুবা, ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পড়কার, দোস্ত দোস্ত না রহা, বুডঢ মিল গয়া ... তবে একথা বলতে পারি, গান গুলো
কিন্তু তখন খুব একটা ভাল লাগেনি। তবে সবগুলোই হিট হয়েছিল।
যথাসময় স্থানীয় এক সিনেমা থিয়েটার ঘোষনা করল অমুক
তারিখে সঙ্গম মুক্তি পাবে। তার দুদিন আগে অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে বিকেল পাঁচটা
থেকে। আর কাউকে দুটোর বেশি টিকিট দেওয়া হবে না। আমরা মোট দশজন ছিলাম। ঠিক হল পাঁচ
জন সকালে গিয়ে লাইন দেবে, দুপুরে অন্য পাঁচ জন গিয়ে দাঁড়াবে। ব্ল্যাকে টিকিট কাটা
চলবে না। কদিন ধরে প্রচুর জল্পনা, হৈ চৈ। এই প্রথম সঞ্জয় আর বিভাসকে দেখলাম একটু বিচলিত,
মুখ চুন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে খাবার সময় একটু আধটু খোঁজ খবর করত, কজন
যাচ্ছি, কত করে টিকিট। আমরা খুব একটা আমল দিতাম না।
ন্যায্য মুলে টিকিট কেনা হল। খুব উত্তেজিত আমরা সবাই।
নির্দিষ্ট দিনে হলে ঢুকলাম। হাউস ফুল। বাইরে জোড় কদমে ব্ল্যাক চলছে। এক একটা টিকিট
পাঁচ টাকা। প্রচন্ড মারামারি চলছে। সিনেমা শুরু হল। ইন্টারভেলে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি
এক অদ্ভুত দৃশ্য। আমাদের সামনে, ষাট পয়সার সীটের ঠিক পেছনে বসে আছে সঞ্জয় আর
বিভাস। ওদের আশে পাশে তাকালাম, আর কোনও সহৃদয় সহপাঠী চোখে পড়ল না, যারা কি না
টিকিট কিনে দিতে পারে। সবাই গিয়ে চড়াও হলাম। আমাদের দেখে দুজন খুব খুশি হল না, চোর
চোর মুখ করে বসে রইল। আমরা চেপে ধরলাম, কি রে কি হল তোদের সেই অঙ্গীকার? বাবা
বিশ্বনাথের সামনে করা অঙ্গীকার ভেঙ্গে ফেললি? মাথা গোঁজ করে বসে রইল দুজন। আমরাও
নাছোড়বান্দা। কিছুক্ষণ পরে সঞ্জয় তেড়ে উঠল, “কেন জ্বালাতন করছিস, সিনেমা দেখতে
এসেছিস, দেখ। শুধু অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো কেন...”। আমরাও ছাড়ব না, কে কিনে
দিয়েছে বলতেই হবে। ওরাও বলবে না। আমরা
অধৈর্য্য হয়ে উঠছি, ইন্টারভেল প্রায় শেষ হয় হয়। এমন সময় বিভাস একটু ফিঁক করে হেসে শুধু
চোখ দুটো তুলে বলল, “ওর টিকিট আমি কিনেছি, আমারটা ও”।
হলের লাইট নিবে গেল। ইন্টারভেল শেষ। সিনেমাও শেষ হল
এক সময়। বছরের বাকি চার মাস সঞ্জয় আর বিভাস এই নতুন ব্যবস্থাই বহাল রেখেছিল।
বিভাস আজীবন কলকাতাতেই চাকরি করে এখন টালিগঞ্জে
একটা ফ্ল্যাট নিয়ে অবসর জীবন কাটাচ্ছে।
সঞ্জয় কর্মজীবন পুনে, গুরগাঁও ইত্যাদি ঘুরে এখন টালিগঞ্জেই একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে,
বিভাসের বিল্ডিঙের থেকে মোটামুটি ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। প্রায় প্রত্যেক দিন এ ওর
বাড়িতে আড্ডা মারে, চা কফি খায়। আমিও কয়েকবার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছি ওদের
দৈনন্দিন আড্ডায়। ওরা প্রত্যেক দিন বিকেল বেলা হাঁটতে যায়। পাড়ায় একটা শিব মন্দির
আছে। প্রায়ই দেখা যায় দুজনে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ভক্তি ভরে প্রণাম করছে।
তবে নতুন কোনও অঙ্গীকারের কথা জানা যায় নি।
নিউ জার্সি - ২৩শে জুলাই ২০১৩
No comments:
Post a Comment