Wednesday 17 July 2013

স্মৃতিচারণ ১

ষাটের দশকের ঘটনা আমি তখন স্কুলে স্কুলের মাধ্যম বাংলা সব সাবজেক্টই বাংলায় পড়ানো হত। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভুগোল, - এমনকি ইংরিজিও। আমাদের ইংরিজি শিক্ষক ছিলেন গিরীন বাবু দারুণ দখল ছিল ভাষার ওপর। মাঝে মাঝে হঠাৎ পড়ার বই ছেড়ে উদাত্ত কন্ঠে শেক্সপীয়র থেকে নানা নির্বাচিত অংশ শোনাতেন। তারপর বাংলায় অনুবাদ করতেন, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত।
একটা আক্ষেপ ছিল গিরীন বাবুর প্রায়ই বলতেন যে আমাদের ইংরজি শিক্ষার পদ্ধতিটা ভুল কারণ আমরা ইংরিজি পড়তে শিখছি, লিখতে শিখছি কিন্তু বলতে শিখছি না স্কুলের পড়া শেষ করে যখন কলেজে যাব, তখন হঠাৎ করে ইংরিজি মাধ্যমের সম্মুখীন হয়ে বিপদে পড়ে যাব; বিশেষ করে যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করব। কলেজের অধ্যাপকরা ইংরিজিতেই কথাবার্তা বলবেন। কিছু প্রশ্ন করার থাকলে আমাদের ইংরিজিতেই করতে হবে। ইংরিজি বলার অক্ষমতা ঢাকতে আমরা হয়তো সঙ্কোচ করে চুপচাপ বসে থাকব এবং তাতে আমাদেরই ক্ষতি হবে।
একদিন ক্লাসে এসে গিরীন বাবু ঘোষনা করলেন যে আগামী সপ্তাহ থেকে ইংরিজি ক্লাসে আর বাংলা বলা চলবে না। এমন কি ছাত্রদের নিজেদের মধ্যে কোনও কথাবার্তা থাকলেও তা ইংরিজিতে বলতে হবে। স্পষ্ট নির্দেশ, - “নো বেঙ্গলি ইন ইংলিশ ক্লাস শ্যাল বি পারমিটেড”।  শুনে তো আমাদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। আমাদের মৃদু প্রতিবাদে কর্ণপাতই করলেন না গিরীন বাবু। বললেন, - এক সপ্তাহ সময় আছে, তোমরা নিজেদের মধ্যে অভ্যাস কর। রাস্তায় ঘাটে বা দোকানের সাইন বোর্ড দেখ, অনেক কিছু শিখতে পারবে। যাদের বাড়িতে ইংরিজি খবরের কাগজ আসে, তাদের বাংলা কাগজ না পড়ে ইংরিজি কাগজ পড়তে বললেন।  এবং এও বললেন যে কোনও প্রশ্ন থাকলে আগামী সপ্তাহের আগে ওনাকে নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞেস করতে পারি।
শুরু হল যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি। আমাদের বাড়িতে আনন্দ বাজার পত্রিকা আর স্টেটসম্যান দুটোই আসত। আমি আনন্দ বাজার ফেলে স্টেটসম্যান পড়তে শুরু করলাম। তাতে উলটো ফল হল। নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভয় আরও বেড়ে গেল।
আমরা যেই শহরে থাকতাম, সেটা ছিল এক শিল্প নগরী, এক বেসরকারি বিদেশী কম্পেনির পরিচালনায়। কম্পেনির প্রশাসন শহরটিকে খুব সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। জায়গায় জায়গায় নানা রকমের নোটিস টাঙিয়ে শহরকে সুন্দর রাখার আবেদন জানানো হত। যেমন,
এইখানে থুতু ফেলিও না – প্লীজ ডু নট স্পিট হিয়ার। এইখানে আবর্জনা ফেলিও না – প্লীজ ডু নট লিটার; ইত্যাদি
আমার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল দীপ্ত।  দীপ্ত কোথা থেকে একটা ছোট্ট নোট বই আর পেন্সিল জোগার করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত। যা দেখত টুকে রাখত। সেই নোটবই কাউকে দেখাতো না। একদিন টিফিনের সময় আমাদের আরেক বন্ধু দীপ্তর ব্যাগ খুলে কয়েক পাতা পড়ে ফেলে। সেখানে এই ধরনের সব নোটিস যত্ন করে লেখা ছিল। ক্লাসের কথাবার্তায় এই ধরনের নোটিস কি কাজে আসবে তখন আমরা বুঝতে পারিনি।
আমাদের স্কুলে আসার পথে, এক তেরাস্তা ছিল। তার একটি অপরিসর কোনে চারটি স্টীলের স্তম্ভের ওপর একটি ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার বসানো ছিল। আসা যাওয়ার পথে অনেকেই প্রকৃতির আহ্বান মেটাতে সেখানে কুকর্ম সারতেন। পাশ দিয়ে যাবার সময় নাকে কাপড় চেপে যেতে হত, এত দুর্গন্ধ। শহরের প্রশাসন সেখানে একটি নোটিস বসাতে বাধ্য হলেন। লেখা হল; - “এইখানে প্রস্রাব করিও না।” তার ঠিক নীচে ইংরিজিতে লেখা হল “কমিট নো নুইসেন্স”। একদিন দেখি স্কুল থেকে ফেরার পথে দীপ্ত ঐ নোটিসটা সযত্নে ওর নোট বইয়ে টুকছে। এবং সেটাই ওর কাল হল।
হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা চলছে। সেদিন ইংরিজি ফার্স্ট পেপার। তদারক করছেন স্বয়ং গিরীন বাবু। মাঝখানে জল টল খেতে হলে ইংরিজি বলতে হবে। ভয়ে আমরা তেষ্টা, বাথরুম সব চেপে বসে লিখে যাচ্ছি। এমন সময় দীপ্ত উঠে দাঁড়াল। গিরীন বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “স্যার আই ওয়ান্ট টু গো আউট”। গিরীন বাবু জানতে চাইলেন, “হোয়াই?”। দীপ্ত চারিদিকে তাকিয়ে সজোরে এবং সগর্বে বলল, “আই ওয়ান্ট টু কমিট নুইসেন্স”।
পরীক্ষার হল নিঃস্তব্ধ। গিরীনবাবু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন দীপ্তর দিকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন দীপ্তর কাছে, নিজের নিয়ম নিজেই ভেঙে নীচু গলায় পরিস্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলতে চাইছিস তুই?” দীপ্তর চোখমুখ বেশ শুকিয়ে গেছে ততক্ষণে; মিন মিন করে কি বলল শুনতে পেলাম না আমরা। গিরীনবাবু চোখের ইশারায় ওকে বাইরে যাবার অনুমতি দিলেন। সময় মত পরীক্ষা শেষ হল। হল ছাড়ার আগে গিরীনবাবু দীপ্তকে বলে গেলেন, “এর পর আমাকে না জিজ্ঞেস করে কোনও ইংরিজি কথা বলবি না”।
ক্লাসে ইংরিজি বলার নিয়মটা এর পর বহাল ছিল ঠিকই, কিন্তু অনেকটাই শিথিল হয়ে গিয়েছিল।
সম্প্রতি যোগাযোগ হয়েছিল দীপ্তর সঙ্গে বহু বছর পর।  সে এখন আমেরিকার অধিবাসী এবং নাগরিক। গড়গড় করে মার্কিনি উচ্চারণে ইংরিজি বলে।  পুরোনো স্মৃতির ভান্ডার ঘাটতে ঘাটতে সেই ঘটনা স্মরণ করে খুব হাসাহাসি হয় আমাদের মধ্যে। দীপ্তর একান্ত অনুরোধে তার আসল পরিচয় গোপন রাখা হল।
নিউ জার্সি - ১৭ই জুলাই ২০১৩ ইং

 

 

 

No comments:

Post a Comment