Sunday 25 December 2016

ফ্লুরি’স

এবার ক্রিসমাস বা বড়দিন পড়েছে রবিবারে। বিভিন্ন রবিবাসরীয়তে বড়দিনের মাহাত্ম্য ও পরম্পরা নিয়ে নানা রকম লেখা খুব উৎসাহ নিয়ে পড়লাম। অনেক অজানা তথ্য সামনে এল। আর জানতে পারলাম রঙীন পার্ক স্ট্রীটের বর্ণময় ইতিহাস। পার্ক স্ট্রীটের বড়দিন উৎসব কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

আমার ছোটবেলা কেটেছে বাঙলার বাইরে। পার্ক স্ট্রীট নিয়ে কোনও বাল্যস্মৃতি আমার নেই। যা আছে তা কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণের। স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম কলেজে ভর্তি হতে। খুব সখ ছিল কলকাতায় কলেজে পড়ব। ভর্তি হলাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। কলেজের হস্টেলে জায়গা হলনা। নাম লেখালাম অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে। বিধান সরণি ও বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। এখনও আছে, - তবে নাম পালটে হয়েছে ওয়াই এম সি এ।

মোড়ের মাথয় ২বি বাসে উঠে নেমে যেতাম পার্ক স্ট্রীট – চৌরঙ্গী রোডের মোড়ে। ভাড়া ছিল ২০ পয়সা। দান্ডিযাত্রারত গান্ধিজি তখন সেখানেই অবস্থান করতেন। পরে পাতাল রেল প্রকল্পের জন্য সেখান থকে অপসারিত হন।

পার্ক স্ট্রীট দিয়ে কোনও বাস চলত না। মোড় থেকে হেঁটে কলেজে পৌঁছতে মিনিট দশেক লেগে যেত। প্রথম দিকে যখন হেঁটে যেতাম, হাঁ করে দেখতাম চারদিক। সে এক স্বপ্ন রাজ্য। ঝকঝকে দোকান পাট, হোটেল আর রেস্তোঁরা। যত দূর মনে আছে, আমাদের ক্লাস শুরু হত সকাল দশটা নাগাদ। সেই সময় দোকান পাট সবে খুলছে, ক্রেতার সংখ্যা খুব কম। তবে একটি রেস্তোঁরা গমগম করত। নাম ফ্লুরি’স। অবাক হয়ে ভাবতাম সকাল বেলায় এত ভীড় কেন? কলকাতাবাসী কিছু সহপাঠীর কল্যাণে জানলাম এখানকার ব্রেকফাস্ট নাকি বিখ্যাত। সারা ভারতের এমন কি বিদেশের লোকরাও নাকি সেখানে প্রাতঃরাশ করতে আসেন। কে আসেন নি সেখানে? বড় বড় চিত্রতারকা, সঙ্গীত শিল্পী, ক্রিকেটার- রাজ কপূর, দিলীপ কুমার, কিশোর কুমার, পাতৌদির নবাব, শর্মিলা ঠাকুর, জয়সীমা। হাঁ করে শুনতাম আর জুলজুল করে দেখতাম কাচের বাইরে থেকে ভেতরের দৃশ্য। একটা চাপা স্বপ্ন বোধহয় জেগেও উঠেছিল, - যে একদিন এখানে আমিও ব্রেকফাস্ট করব।

সেন্ট জেভিয়ার্সের পড়াশোনা শেষ হল। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। পার্ক স্ট্রীট ও ফ্লুরিসের স্মৃতি ম্লান হয়ে গেল ধীরে ধীরে। চাকরীও পেলাম একদিন; আবার বাঙলার বাইরে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় বোধহয় তখন। কলকাতায় এসেছি ছুটি কাটাতে। মা বাবা তখন কলকাতাবাসী। মুক্তি পেল সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য। শংকরের উপন্যাস পড়া ছিল আগেই। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম ছবিটি। একটি দৃশ্যে রবি ঘোষ, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এসেছেন ফ্লুরিসে। অর্ডার দিয়েছেন চিকেন অমলেট। পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মনে হল তাই তো এখানে তো আমার ব্রেকফাস্ট করার স্বপ্ন ছিল। না সেবারও সম্ভব হয়নি।

সুযোগ এল বহু বছর পর। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। ছেলে কলকাতায় এসেছে সবার সঙ্গে দেখা করতে। বিদেশে জন্ম ও মানুষ। একদিন জিজ্ঞেস করে বসল, বাবা এখানে নাকি ফ্লুরিস নামে একটা খুব ভাল রেস্তোঁরা আছে, - খুব ভাল ব্রাঞ্চ পাওয়া যায়? আমার কলকাতার বন্ধুরা বলেছে।

গেলাম অবশেষে। সপরিবারে। ঢুকলাম। চারিদিক দেখলাম ভাল করে। ভেতর থেকে এই প্রথম দর্শন। খেলাম সেই ব্রেকফাস্ট। বেশ ভালই। কিন্তু সেই থ্রীল বা সেই শিহরণ অনুভব করলাম না তো। এত দিনের স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি? আসলে কৈশোরের সেই মনটা হারিয়ে গেছে কবে টেরই পাইনি।

কলকাতা – বড়দিন ২০১৬

Thursday 24 November 2016

মুদ্রা রাক্ষস – ২০১৬

বেশ কয়েক বছর ধরে কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত আমি। মাসের প্রথমেই যে কোনও এটিএম থেকে টাকা তুলে নিই। বেশির ভাগ সময়েই ১০০০ বা ৫০০ টাকের নোট বেরোয় মেশিন থেকে। আগে বড় মাপের কেনা কাটা কার্ডেই সারতাম। কিন্তু তাতে প্রায়ই খুচরোর আকাল দেখা যেত। ছোট খাট কেনা কাটা , কলাটা, মুলোটা বা হকারের কাছে সেফটি পিন বা পায়জামার দড়ি কিনতে গেলে অসুবিধে হত। তাই মাস চারেক আগে এক গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হল; - এখন থেকে সব কেনাকাটা নগদেই সারতে হবে। সুযোগ মত ৫০০ ও ১০০০টাকার নোট ভাঙিয়ে নিতে হবে। তাতে হাতেনাতে ফল মিলল। রাতারাতি খুচরোর সমস্যা মিটে গেল।

৮ই নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘোষণার পর যখন আমার পরিচিত মহলে সবাই ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট গুনতে ব্যস্ত, তখন আমি ও আমার গিন্নীর জিম্মায় ৪০টি কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট, কিছু ৫০, একটি ২০ ও গোটা পনের ১০ টাকা। একটিও ১০০০ বা ৫০০ নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

কিন্তু সেই স্বস্তি স্থায়ী হল না।

পরের দিন ভোরবেলা কাকার ফোন। বৃদ্ধ কাকা ও কাকীমা থাকেন সল্ট লেকে। নিঃসন্তান। কাকীমা বেশ কয়েক বছর ধরে শয্যাশায়ী। বহুদিনের এক বিশ্বস্ত পরিচারিকা ও তার পরিবার বাড়িতে থেকেই দেখাশোনা করে। আমি ফোনে খোঁজ নিই প্রত্যেক দিন। মাঝে মাঝে গিয়ে দেখা করে আসি।  কাকা খুব খুশি হন। সবার খোঁজ খবর নেন। কুশল জিজ্ঞাসা করেন। নিজের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। পরামর্শ চান। আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি রাখেন না। কাকীমার ঘরেও বসি কিছুক্ষণ। কথাবার্তা বিশেষ হয় না। স্নেহশীলা কাকীমা এখন সম্পূর্ণ স্মৃতিলুপ্তা।

তুই এক্ষুনি চলে আয়, খুব দরকার, - কাকার কন্ঠস্বরে মনে হল কোনও বিশেষ বিপদে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে পৌঁছে গেলাম সল্ট লেক। ভোর বেলা রাস্তায় ভীড় কম, বিশেষ সময় লাগল না। দরজায় বেল বাজাতেই কাকা নিজেই দরজা খুললেন। চোখে মুখে বিরাট উদ্বেগের ছাপ। আমায় দেখে কোন আপ্যায়নের চেষ্টা করলেন না, দরজা খুলে রেখেই চলে গেলেন ভেতরে।

ফিরে এলেন এক বিরাট মোটা খাম নিয়ে। কোনও রকম ভূমিকা ছাড়াই, সেই খাম আমার হাতে দিয়ে বললেন, - এই টাকাটা তুই পালটে দে; আমার পক্ষে ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়া সম্ভব নয়। খামের ভেতর সব কড়কড়ে হাজার টাকার নোট। বের করে গুনে আমি তো স্তম্ভিত, - এত নগদ টাকা কেউ বাড়িতে রাখে?

কাকা হতাশ মুখে জানালেন, - কি করব বল্‌? তোর কাকীমার তো এই অবস্থা! আমিও খুব একটা সুস্থ নই। হঠাৎ ডাক্তার বা হাসপাতালের দরকার হলে কি করব? আর তুই তো জানিস আমার কোনও কার্ড নেই, আমি ভাল চোখেও দেখিনা। তাই কিছু টাকা ঘরে রাখি।
বুঝলাম। এই বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যাঙ্কে গিয়ে আমাকেই পাল্টাতেই হবে। কাকা জানালেন কোনও তাড়া নেই। দু-সপ্তাহের সংসারের খরচ আলাদা করে তোলা আছে ছোট নোটে। অসুবিধে হবে না।

আমার ব্যক্তিগত সঞ্চয় এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গচ্ছিত। সেখানে গিয়ে দেখি বিরাট লাইন। কোলাপসিবল গেটের সামনে এক বিশাল বপু দারোয়ান। গুনে গুনে লোক ঢোকাচ্ছে। ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের মধ্যে একজন বিশেষ পরিচিত ভদ্রলোকের মোবাইলে ফোন করলাম। ধরলেন না।

আমাদের আবাসনের কাছে একটি বেসরকারী ব্যাঙ্কেও আমার কিছু লেনদেন হয়। সেখানেও ভীড়। ফোন করলাম। পরিচিত একটি মেয়ে জানাল, - এখন আসবেন না স্যার। এখানে যুদ্ধ চলছে। ক’টা দিন ধৈর্য ধরুন। ভীড় একটু হাল্কা হলে আমি নিজেই আপনাকে ফোন করব।

বাঙালী সমাজে উপদেষ্টার অভাব হয় না কখনও। আমার সমস্যার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন এক প্রতিবেশী, - ক্ষেপেছেন নাকি মশাই। এত টাকা জমা দিলে ইনকাম ট্যাক্স থেকে ধরবে আপনাকে।

তা কেন? আমি প্রতিবাদ জানাই। আড়াই লাখ পর্যন্ত কোনও ভয় নেই। আমার কাছে তো সেই তুলনায় অনেক কম টাকা।

আরে ছাড়ুন মশাই। গভার্নমেন্টের কিছু ঠিক আছে? এখন বলছে আড়াই লাখ। পরে দেখবেন এক লাখ বা পঞ্চাশ হাজার যারা দিয়েছে, তাদের এসে ধরছে। তার পরেই তিনি মোক্ষম বাণীটি ছাড়লেন, - আমার শালার বন্ধুর ভায়রা ভাইয়ের ভাগ্নে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, ইনকাম ট্যাক্স কনসালটেন্ট, খুব নাম করা, - ও বলেছে।

শুনে পিছিয়ে গেলাম। ওষুধের দোকানে পুরনো নোট নিচ্ছে শুনে চার মাসের ওষুধ কিনে ফেললাম। আমরা দু-জনই স্বাস্থ্যরক্ষার্থে একটু ওষুধ পত্রের ওপর নির্ভরশীল। পেট্রল পাম্পেও চলছে ৫০০ ও হাজার; গাড়ির ট্যাঙ্ক ফুল করে ফেললাম। কিছুটা কমল।

আমাদের আবাসনের কাছে বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক। একদিন দেখলাম তার একটির সামনে ছোট্ট লাইন, তাতে দু চারটি পরিচিত মুখ।  খোঁজ করে জানলাম ৪০০০ টাকা অব্দি পুরনো নোট পালটে দিচ্ছে। তবে পরিচয় পত্র লাগবে। তড়িঘড়ি বাড়ি গিয়ে আধার কার্ড ও তার  কপি নিয়ে এলাম। যা দিনকাল পড়েছে, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, - সব কিছুর কপি বাড়িতে রাখি। মিনিট চল্লিশেক লাইনে দাঁড়ানোর পর যখন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম, - শুনলাম ১০০ টাকার নোট নিঃশেষ। ২০ টাকার দুটো বান্ডিল নিতে হল। একটার আবার সীল ছেঁড়া। মৃদু প্রতিবাদ জানাতে কাউন্টার কর্মী ব্যাজার মুখে বললেন, - গুনে নিন। পেছনে লম্বা লাইন দেখে সাহস হল না। সবার চোখমুখের যা অবস্থা এখানে টাকা গুনতে বসলে আমার জ্যান্ত সমাধিস্থ হবার সম্ভাবনা প্রবল। মানে মানে বাড়ি ফিরলাম। না গুনি নি। যদি দেখি কম আছে তবে মনটা বড় খারাপ হয়ে যাবে। ঐ যে বলে না, - ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস।

এদিকে বাজার হাট করে আমারও রেস্ত ফুরিয়ে আসছে। মাছ, তরি-তরকারি, চাল, ডাল, ময়দা ইত্যাদি স্পেন্সার, বিগ বাজার ইত্যাদি আধুনিক বিপনিতে কার্ড ব্যবহার করে কাজ সারলাম ক’দিন। তবে ধোপা, খবরের কাগজ, পাউরুটি, ইত্যাদি ছোটখাটো বাজারের জন্য তো পকেটে হাত দিয়েই হয়। এক কাঁদি কলা কিনতে তো আর কার্ড ব্যবহার করা যায় না। তা ছাড়া আরও এক কান্ড হল। কাজের মেয়েটি একদিন ঘোষনা করলেন, - আগামী কাল কাজে আসতে দেরি হবে। কেন না, একজন দেখা করতে বলেছে, - ৫০০ টাকার নোট দিলে ৪টে ১০০ টাকার নোট দেবে। আমি ফতোয়া জারি করলাম, - কভি নেহি। আমি ভাঙিয়ে দেব। দিলাম। ফলে আরও দুটি ৫০০ টাকার নোট পকেটে ঢুকল। ‘অধিকন্তু ন দোষায়’ কথাটা কিন্তু সব সময় খাটে না।

অবশেষে ফোন এল, সেই বেসরকারী ব্যাঙ্ক থেকে। আমায় পরের দিন সন্ধ্যে ছটায় ব্যাঙ্কে যেতে বলা হল, - যখন ভীড় কমে আসবে। পরামর্শ মত গেলাম চেক বই পকেটে নিয়ে। পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকানো হল, গোপনে। সামনের দিকে তখনও খুব ভীড়। মনে হচ্ছিল যেন কোনও বেআইনি কাজ করতে ব্যাঙ্কে ঢুকছি। শুনলাম প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা।

অবশেষে কাকার অবশিষ্ট সম্পদ জমা হল আমার নামে। এবার সেই টাকা তুলে ফেরত দিতে হবে। সপ্তাহে ২৪ হাজারের বেশি তোলা যাবে না। ঠিক আছে কিস্তিতেই শোধ করা যাবে। কি আর করা। ব্যাঙ্ক কর্মী গোটা চারেক ২০০০ হাজার গছাতে চেয়েছিলেন। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম। ঐ নোট কেউ নিচ্ছে না।

আবাসনের ভেতরেই একটি এটিএম। ৯ তারিখ থেকে বন্ধ। ভেতরে নিরাপত্তা কর্মী গভীর নিদ্রারত। একদিন সন্ধ্যায় মহা সোরগোল শুনে চমকে উঠলাম। জানলা দিয়ে দেখি আবালবৃদ্ধবনিতা রূদ্ধশ্বাসে ছুটছে। কি ব্যাপার? উত্তেজিত একজন জানালেন, - এটিএম খুলেছে। আমিও ছুটলাম। যা পাওয়া যায়। গিয়ে দেখি প্রায় কুড়িজন এর মধ্যেই লাইনে। বেশির ভাগই আমাদের আবাসিক। কিছু নিরাপত্তা রক্ষী ও গাড়ির চালকও আছেন। সব চেয়ে পেছনে আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক প্রতিবেশী ম্লান মুখ করে দাঁড়িয়ে। আমাকে লাইনে দাঁড়াতে দেখে একটু হাল্কা হেসে বললেন, - যাক আমি তবে আর লাস্ট নই। ভদ্রলোক খুবই উদ্বিগ্ন। বার্দ্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতা জনিত কারণে ব্যাঙ্কে যেতে পারেন নি, পকেট গড়ের মাঠ। এটিএম থেকে কিছু হাতে এলে কিছুটা সুরাহা হবে। বার বার জিজ্ঞেস করছেন এত লোক লাইনে দাঁড়িয়েছে, টাকা শেষ হয়ে যাবে না তো? বোঝালাম সেই সম্ভাবনা কম; এটিমে প্রচুর টাকা থাকে। আর মোটে ২০০০ করে তোলা যাচ্ছে। তা ছাড়া গুণে দেখা গেল ওনার সামনে ২৩ জন দাঁড়িয়ে। অতএব কোনও ভয় নেই। এক এক করে সবাই বেরিয়ে আসছে ২০ খানা করে কড়কড়ে ১০০ টাকার নোট নিয়ে। সবার মুখে কেমন যুদ্ধ জয়ের হাসি। এরই মধ্যে আবার আতঙ্ক; ১০০ টাকা শেষ হয়ে যদি ২০০০ টাকার নোট বেরোয়, তবে? ২০০০ টাকার নোট তো এখন খোলামকুচি। কেউ নেয় না। যাদের কাছে আছে, তারা নোট হাতে নিয়ে সেলফি তোলে আর ফেসবুকে পোস্ট করে। না, সে রকম কিছু ঘটল না। আমিও অবশেষে ২০ টা ১০০ টাকার নোট হাতে নিয়ে এটিএম বুথ থেকে বেরিয়ে এলাম।

বেরিয়ে দেখি সেই ভদ্রলোক, যিনি লাইনে আমার সামনে ছিলেন, - তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। মুখে সুখ ও তৃপ্তির হাসি। আমাকে দেখে বললেন, - এই টাকাগুলো হাতে পেয়ে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের এক সুখস্মৃতি অনুভব করছি, জানেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, - সে আবার কোন স্মৃতি। উনি স্বপ্নালু চোখে বললেন, ঐ যে যখন প্রথম চাকরির প্রথম মাইনে হাতে পেয়েছিলাম!

সত্যিই। খুব খাঁটি কথা।

কলকাতা
২৫শে নভেম্বর ২০১৬

Thursday 1 September 2016

শপিং - আমেরিকান স্টাইল

বেশ কয়েক মাস আমেরিকায় কাটিয়ে এলাম। মেয়ে-জামাই, ছেলে-বৌ আর অবশ্যই নাতি-নাত্নীদের সাহচর্যে। যাবার আগে কিছু ডলার নিয়ে গিয়েছিলাম, - যদি কখনও দরকার হয়। দিনকাল পাল্টেছে। বিদেশী মুদ্রা এখন খুব সহজলভ্য। মনে আছে ১৯৭৭ সালে একবার লন্ডন যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুসারে যা পেয়েছিলাম, তাতে কোনও রকমে ট্যাক্সি ভাড়াটা দেওয়া যায়। খরচ বাঁচাবার জন্য অচেনা জায়গায় টিউব রেলে হোটেলে পৌঁছেছিলাম। হোটেলের খরচাটা স্থানীয় অফিস থেকে দেওয়া হয়েছিল। ফাঁকা পকেট নিয়ে সেই আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা।

যাই হোক, এবার আমেরিকা যাত্রায় যা নিয়ে গিয়েছিলাম, পুরোটা খরচ হয়নি। ব্যাঙ্কে ফেরত দিয়েছি। যে দামে কিনেছিলাম তার থেকে কম দাম পেলাম। বিদেশী মু্দ্রার ব্যবসা এ ভাবেই চলে। নিজেদের জন্য বিশেষ কিছু কেনা হয়নি। কিই বা কিনব এই বয়সে। নাতি-নাত্নীদের আব্দার মেটাতে কিছু কেনা কাটা হয়েছে, ওদের মা-বাবাদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে (ভীষণ আস্কারা দিচ্ছ ইত্যাদি)। এই ক্ষুদে গুলো যদি দাদু-দিদা/ঠাম্মার সঙ্গে আব্দার না করে তবে কার সঙ্গে করবে? ওদের আব্দার মেটানোটা এখন আমাদের এক বিশাল আনন্দের খোরাক।

দেশে ফেরার আগে একটা মলে গিয়ে কিছু কেনাকাটা হল। এক বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। নানা রকমের পণ্য। বাচ্চাদের ফ্রক, শার্ট, ইত্যাদি কেনা হল। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে, হঠাৎ কিছু টি-শার্টের দিকে চোখ পড়ে গেল। নানা রকম রঙের ও মাপের। আমি আবার ঈশ্বরের কৃপায় একটু বিশাল বপু। আমার মাপের পছন্দ মত জামা কাপড় পাওয়া একটু দুষ্কর। কিন্তু ঐ দেশে শুধু বিশাল কেন, বিশালতর মানুষেরও অভাব নেই। আমার মাপের বেশ নানা রঙের ও কায়দার টি-শার্ট আছে দেখলাম। পছন্দ মত নিয়েই নিলাম খান দুয়েক। বিপণি-বালিকা জানালেন “সেল” চলছে, তাই প্রায় ২৫% ছাড়। মোবাইল ফোনের ক্যালকুটারে দাম গুলো ৬৮ দিয়ে গুণ করে দেখলাম, দেশের হিসেবেও বেশ সস্তাই পড়ছে।

যথা সময়ে দেশে ফিরে সব গুছিয়ে তুললাম আলমারিতে। দিন তিনেক আগে হঠাৎ খেয়াল হল, - তাই তো ওগুলো তো পরাই হচ্ছে না। বের করলাম একটি। কিন্তু পরতে গিয়ে দেখি, বেশ কুঁচকে আছে। ভাবলাম একটু ইস্তিরিটা বুলিয়ে দিই। ইস্তিরি গরম করে শার্টটা সযত্নে মেলে দিলাম ইস্তিরি টেবিলের ওপর। গলার কছে পিঠের দিকে লেবেলটা চোখে পড়ল, - এই প্রথম।

জ্বল জ্বল করছে ছোট্ট একটি লেখা,  - “মেড ইন ইন্ডিয়া”।

কলকাতা - ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৬

Friday 19 August 2016

হেমন্ত - অঞ্জন দত্তের নতুন ছবি

অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ছবি – হেমন্ত। শেক্সপীয়ারের হ্যামলেটের বাংলা সংস্করণ, আধুনিক যুগের পটভূমিতে। ছবিটি নিয়ে আগ্রহ ছিল খুব। অঞ্জন দত্তর ছবি আমার ভাল লাগে, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।

পরিচিতরা বলেছিলেন ছবিটি নাকি চলছে না। এক সপ্তাহও হয়নি মুক্তি পেয়েছে কিন্তু হল ফাঁকা যাচ্ছে। এ রকম তো হওয়ার কথা নয়। শেক্সপীয়ার অবলম্বনে গল্প। সফল ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা অভিনয় করেছেন। নাম ভূমিকায় পরমব্রত। বন্ধু হীরকের (হোরেশিও) ভূমিকায় যীশু। গার্গী রায়চৌধুরী হয়েছেন গায়ত্রী (রাণিমা গার্ট্রুড) আর কাকা কল্যাণের (ক্লডিয়াস) ভূমিকায় শাশ্বত।

ছবিটি দেখেই ফেললাম। ডেনমার্কের বদলে অগ্রদূত ফিল্ম ইন্ড্রাস্টি হচ্ছে এই ছবির সাম্রাজ্য। তারই মালিকানা নিয়ে ক্ষমতার লড়াই। শেক্সপীয়ারের আদি গল্পে নিহত রাজার প্রেতাত্মা এসে পুত্রকে প্রতিশোধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত। একবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় এক অজানা ফোন নাম্বার থেকে এসএমএস আসত হেমন্তের কাছে। খোজ খবর করে দেখা গেল সেই নাম্বারের কোনও অস্তিত্বই নেই।

অভিনয়ে কোনও ত্রুটি নেই। হেমন্তর জটিল মানসিকতা ফুটিয়ে তুলতে প্রায় সফল পরমব্রত। “প্রায়’ বলছি তার কারণ শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ ও অস্থিরতা (টু বি অর নট টু বি, দেয়ার ইজ সামথিং রটন ইন দ্য স্টেট অফ ডেনমার্ক, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ ... ইত্যাদি) ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। শুনেছিলাম বিলেতে শুধু শেক্সপীয়ারের নাটকের জন্য আলাদা নাট্যদল থাকে। তাদের আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরমব্রত খুব শক্তিশালী অভিনেতা তবে কিছু কিছু জায়গায় একটু অতিনাটকীয় মনে হয়েছে। যীশু অনবদ্য। শ্বাশ্বত তো যে কোনও ভূমিকায় সমান দক্ষ। গার্গীকেও সুন্দরী লাস্যময়ী রাণির ভূমিকায় সুন্দর মানিয়েছে।

ছবি শুরু হল। দর্শকের আসনে সব মিলিয়ে সাত বা আট জন। মাল্টিপ্লেক্সের প্রেক্ষাগৃহ প্রায় ফাঁকা। ছবি সুন্দর এগিয়ে চলল, আবিষ্ট হয়ে দেখলাম। বিপত্তি শুরু হল বিরামের পর। গল্প আর এগোয় না।  হঠাৎ গল্পের গতি প্রচন্ড শ্লথ হয়ে গেল, এগোতে লাগল ধাক্কা খেতে খেতে। দর্শকদের অনেকেই সজোরেই বিরক্তি প্রকাশ করলেন। এটাই ছবিটির দুর্বলতা। মনে হয় অঞ্জন দত্ত নিজের মন ও অনুভূতির আয়নায় হ্যামলেটের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে চাইছিলেন। কিন্তু সাধারন দর্শকবৃন্দ তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ছবিটি প্রায় পৌনে তিন ঘন্টার। বর্তমান যুগের এই দ্রুতলয়ের জীবনযাত্রার দিনে জনসাধারণের ধৈর্য ও সময়ের অভাব খুব বেশি।

বোধহয় সেখানেই মার খেয়েছে এই অনবদ্য প্রয়াস।

কলকাতা ২০ অগাস্ট ২০১৬


Thursday 18 August 2016

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও কলকাতা

প্রায় দু-দশক পরে গতকাল (১৬ই অগাস্ট ২০১৬) মহাজাতি সদনে ঢুকলাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি আয়োজিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান ‘বর্ষামঙ্গল’ উপলক্ষ্যে। এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে আছেন উস্তাদ সাবীর খান, উস্তাদ রজা আলী খান, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। এই তিন জন হলে উপস্থিত ছিলেন।

পরিবেশিত হল একটি সুন্দর গীতি আলেখ্য, - মালহার রাগে রচিত। শিল্পীরা সব নতুন কিন্তু খুব প্রতিশ্রুতি পূর্ণ। পরিচালনায় ছিলেন পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর পুত্রবধু মন্দিরা শর্মা লাহিড়ী। সুন্দর সরোদ বাজালেন সুনন্দ মুখোপাধ্যায়, - সেই মালহার  রাগ।

মহাজাতি সদনকে খুব সুন্দর সাজানো হয়েছে। চারিদিক ঝকঝকে। নতুন কার্পেট ও চেয়ার। বেশ ভোল পালটে দেওয়া হয়েছে। টয়লেট বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আশা করি এ রকমই থাকবে ভবিষ্যতেও। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে অনেকেই বললেন এর কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের ও সরকারের শীর্ষস্থানে যিনি আছেন, তাঁর। সাংস্কৃতিক জগতে মুখ্যমন্ত্রী এখন অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তবে ক্ষোভের কথা অর্দ্ধেকের বেশি হল খালি ছিল। ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় হয়তো বাড়ি থেকে বেরোননি অনেকে। উস্তাদ সাবীর আলী প্রকাশ্যেই বললেন যে এককালে এই মহাজাতি সদনের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে দর্শক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিস ডাকতে হত। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের দর্শকরা কি পালটে যাচ্ছেন? তাই যদি হয় তবে তা খুব পরিতাপের কথা।

হয়তো নবীন শিল্পী বলে দর্শকদের মধ্যে তেমন সাড়া জাগেনি? এক উদ্যোক্তার এই দাবী নস্যাৎ করে উস্তাদ রজা আলী খান জানালেন যে তার পিতা উস্তাদ মনাওয়ার আলী খান এখানেই তাঁর সঙ্গীত জীবনের ‘শুরুয়াত’ করেন। দর্শকের ভীড় বাইরের ট্রাম লাইন অব্দি পৌঁছে গিয়েছিল। অবশ্য মনাওয়ার আলীর খানের কথা আলাদা। সেই ‘নবীন শিল্পীর’ বংশ পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল।

শেষ কথাটি বললেন সাবীর আলি। করজোড়ে দর্শকদের কাছে আবেদন করলেন, - ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে। একে বাঁচিয়ে রাখবেন। আপনারাই পারবেন। আমি এখনও মনে করি যে কলকাতা হল ক্লাসিকাল মিউজিকের সুপ্রীম কোর্ট।’

কলকাতা ১৭ই অগাস্ট ১৯১৬

Saturday 28 May 2016

দেবাঃ ন জানন্তি

গৃহস্থালীর কাজ আমার একেবারেই আসেনা এটা আমার একটি বিরাট অক্ষমতা আমার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব আছেন যাঁরা রান্নাবান্না জানেন, ঘরদোর পরিস্কার রাখেন, এক কালে ছেলেমেয়েদের সামলেছেন, আর এখন নাতি-নাত্নীদের সামলান তাঁরা নমস্য ব্যক্তি।

তবে চেষ্টা আমি করেছি। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে যখন চাকরি নিয়ে বিদেশে যাই, তখন “কাজের লোক”-এর অভাবটা খুব বুঝতে পেরেছিলামগিন্নীর ওপর তখন প্রচন্ড চাপ। বাচ্চারা খুব ছোট। আমি অফিসে চলে যেতাম, গিন্নীকে একহাতে সব সামলাতে হতবড়টি তখন স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ওকে তৈরি করা, খাওয়ানো ইত্যাদি বাড়তি কাজ তো আছেই। সেই সময় আমি খুব আন্তরিক ভাবে বাড়ির কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতামকিন্তু নেহাৎই দুর্ভাগ্য, দিন তিনেক পর আদেশ জারি হল যে আমি আর যাই করি না কেন, হেঁসেলে যেন না ঢুকি। কারণ আমি নাকি সেখানে কাজের থেকে অকাজটাই বেশি করি। কি আর আর করা, সেই আদেশ, শাপে বর ভেবে শিরধার্য করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। ঘরদোর পরিষ্কার ইত্যাদির ব্যাপারে অবশ্য বিশেষ কোনও অভিযোগ ছিল না।

তবে ছুটির দিনে মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের বিনোদনের জন্যেই ঘোষণা করতাম, আজ বাবা ব্রেকফাস্ট বানাবে; ইংলিশ ব্রেকফাস্ট! ছেলেমেয়েরা প্রচন্ড হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাত। কারণ বাবা বেশ “হেল্প” করার সুযোগ দেয়। মা দেয় না। মহা সমারোহে শুরু হত ব্রেকফাস্ট প্রকল্প। সবার ভাগে দুটো করে ডিম, - কারও ফ্রাই, কারও অমলেট, কারও হাফ বয়েল, ইত্যাদি। ছেলে তখন খুবই ছোট, ব্যপারটা ঠিক বুঝত না, কিন্তু বেশ মজার একটা ঘটনা ঘটছে সেটা বুঝতে পারত। দিদির সঙ্গে সঙ্গে লাফাত খুব। তারপর টেবিল ম্যাট, প্লেট, কাটা, চামচ, ছুরি সাজিয়ে, গ্লাসের ভেতর ভাঁজ করে ন্যাপকিন, সামনে পাউঁরুটি টোস্ট, বিভিন্ন জ্যাম, জেলি, মাখন। সঙ্গে বেকড বীন্স, সসেজ, কাচের জাগে অরেঞ্জ জুস ইত্যাদি। এলাহী কান্ড এরপর মেয়ের সুউচ্চ ঘোষণা, ব্রেকফাস্ট রেডিইইইইইই।।

সবাই হৈহৈ করে বসা হতশুধু একজনই একটু অসন্তুষ্ট! কারণ এরপরেই নাকি হেঁসেল পরিষ্কারের পালা। আমি হলফ করে বলতে পারি যে খুব সযত্নে রান্নাঘর সাফ করা সত্ত্বেও গিন্নীমাকে খুশি করা যেতনা। যাই হোক, দেখতে দেখতে আমার এই অপারগতা  ছড়িয়ে গেল স্থানীয় বাঙালি সমাজে এক সঙ্গে আড্ডাতে বসলেই শুরু হতজানো তো আমার বরের কান্ড…… কি নোংরা করে রাখে কল্পনা করতে পারবে না প্রথম কদিন একটু আত্মগ্লানিতে ভুগতাম, - তারপর খেয়াল করলাম এই সংগ্রামে আমি একা নই, প্রচুর সমব্যথী আছেন কারণ আমার কেলেঙ্কারীর গল্প শেষ হতে হতেই অন্য কোনও মহিলার গল্প শুরু হত, আরে আমার কর্তা কি করেছে জানো তো ………

দেখলাম এ যাকে বলে, “ঘর ঘর কি কহানী এসব গায়ে না মাখাই উচিৎ

তখন সুদূর বিদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি গিয়ে পৌঁছয়নি ছেলেমেয়েরা খুবই ছোট; পড়াশোনার চাপ বিশেষ নেই সন্ধ্যায় বা ছুটির দিনে সকালে, এর ওর বাড়ি গিয়ে আড্ডা মারার একটা রেওয়াজ ছিল “প্রবাসে বাঙালি মাত্রেই সজ্জন” প্রায়ই যে বাড়িতে আড্ডা বসত সেখানে খাওয়া দাওয়া করেই আসা হত বাড়িতে যা আছে তাই দিয়ে বেশ পরিতৃপ্তি করে খেয়ে চলত দীর্ঘ্য আড্ডা কখনও বা বসিয়ে দেওয়া হত স্রেফ সেদ্ধ ভাত বেশ কাটছিল দিনগুলো

একদিন সপ্তাহান্তের ছুটির দিন বেশ একটা অলস সকাল গিন্নী জানালেন, - বাজার হাটের দরকার নেই বাড়িতে তরি, তরকারি, মাছ ইত্যাদি যথেষ্ট মজুদ আছে কারও বাড়ি গিয়ে আড্ডা মারা যেতে পারে সমবয়সী এক দম্পতির সঙ্গে সম্প্রতি বেশ ভাল ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ফোন করতেই তাঁরা সাদরে আমন্ত্রন জানালেন কিন্তু আমি আবার কি খেয়ালে সকালেইবাবা ব্রেকফাস্ট বানাবেঘোষণা করে বসে আছি

সব মিটিয়ে নতুন বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতে বেশ দেরিই হয়ে গেল সাদরে বৈঠকখানায় বসিয়ে বন্ধুপত্নী একটু মৃদু অনুযোগ করলেন দেরি করে পৌঁছনোর জন্য ব্যাস, গল্প শুরু, - আর বল কেন? সকালে উঠে বাপ আর ছেলেমেয়েরা মিলে লঙ্কাকান্ড; সব গুছিয়ে, পরিষ্কার করে আসতে আসতে দেরিই হয়ে গেল বলে পুরো ঘটনা, সবিস্তারে বর্ণনা করা হল কিন্তু তারপর যা ঘটল তা সম্পূর্ণ অভাবিত

বন্ধুপত্নী সব শুনে অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে চোখেমুখে ভর্ৎসনার ছাপ স্পষ্ট, বেশ কঠিন স্বরে জানালেন - এটা কিন্তু খুব অন্যায়; বিদেশ-বিভূইঁয়ে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হয়এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। তারপর আমার গিন্নীর দিকে তাকিয়ে সমবেদনার সুরে বললেন, - আমার বর কিন্তু ও’রম না, ও যা হেল্প করে আমাকে,- বলে সপ্রেম দৃষ্টিতে পাশে উপবিষ্ট স্বামীর দিকে তাকালেন। স্বামীটিও নববধুর মত সুমিষ্ট হেসে প্রেমমদির চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আমার প্রতি এক অনুকম্পার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। নাঃ, এর একটা হেস্তনেস্ত আজ করতেই হবে। গিন্নীর দিকে একটু ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। সারা মুখ থমথমে, কালবৈশাখীর পূর্বাভাস।

হঠাৎ যেন তাল কেটে গেল। আড্ডাও আর যেন এগোচ্ছে না। গিন্নী চুপ মেরে গেছেন। বন্ধু ও বন্ধুপত্নী নানা রকম কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু জমছে না। কোথায় যেন একটু ছন্দপতন হয়ে গেছে।

মিনিট পনেরো পর, গিন্নী হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, একটু ফ্যাকাশে হেসে বললেন - আজ চলি ভাই, একটু বাজারে যেতে হবে।

সে কি? বেশ অবাক হলেন নতুন বান্ধবী,  এই তো এলে? খাওয়া দাওয়া করে যাও......

না ভাই, আরেক দিন হবেখ’ন, - বলে আমার দিকে স্পষ্ট ইশারা, - এবার উঠে পড়।

কি আর করা? কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। ছেলেমেয়েদের ডাকলাম। ওরাও দেখলাম  ঘোর বিস্মিত,- সবে খেলা জমে উঠেছে, এই অবস্থায় বেরিয়ে আসাটা ওদের একেবারেই মনঃপূত হয়নি। ওদের তীব্র প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে এবং তথাকথিত বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর বিভ্রান্ত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলাম।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথেই বিস্ফোরণ, - কি বলল শুনলে? ন্যাকামোর একটা সীমা আছে ...... (একটু ভেঙিয়ে) ... আমার বর ও’রম না! যাঃ যাঃ, তোর বর কেমন জানা আছে। মেনিমুখো কোথাকার... আরে পুরুষ মানুষ হবে পুরুষ মানুষের মত ... তা না... শুধু শুধু বউয়ের আঁচল ধরে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করা... এই ধরণের পুরুষ আমার দু চক্ষের বিষ। শাড়ি পরে থাকলেই পারে...

বাক্যস্রোত আর শেষ হয়না। বেগতিক দেখে নিয়ে গেলাম বেশ একটা নামী রেস্তোঁরায়। সেখানে গিয়ে লাঞ্চ টাঞ্চ খেয়ে মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হলছেলেমেয়েরাও মহা খুশি।

আমি আর সাহস করে রাগের কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। কারণ মহিলাটি যা বলেছিলেন তাই তো আকছার শুনতে হত আমায়। ব্যাপারটা রহস্যই ছিল বেশ কিছুদিনঅবশ্য পরে এক আত্মীয়া খুব প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, - ওসব তোরা বুঝবি না, যা মোটা মাথা তোদের! ব্যাপারটা খুব সিম্পল, আমার বরকে আমি যা খুশি তাই বলতে পারি, এটা আমার রাইট। কিন্তু অন্য কেউ বলে দেখুক তো, জিভ উপড়ে নেব।

স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম!
“কিছুটা কাল্পনিক”



 নিউ জার্সি ২৮শে এপ্রিল ২০১৬

Sunday 24 April 2016

তোমারে সেলাম

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি তখন উত্তাল। অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনে তোলপাড় পুরো ক্যাম্পাস। কি কারণে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটা এতদিন পর আর মনে করতে পারছি না। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল এক দিন। প্রশাসন থেকে ঘোষণা করা হল, University will be closed sine die. এক নতুন শব্দগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হলাম। মানে ও উচ্চারণ নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ালো।
আমি আর আমার কয়েক জন বন্ধু তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়িমুখো হলাম। এমন উপরি ছুটি, - ছেড়ে দেওয়া যায় না। মা-বাবাকে সন্তুষ্ট রাখতে কিছু বই খাতাও নেওয়া হল সঙ্গে। কিন্তু বিধি বাম; সপ্তাহ দুয়েক পর চিঠি চলে এল, ক্যাম্পাস খুলছে, ছাত্র ছাত্রীরা যেন পত্রপাঠ ফিরে আসে। আজ এত বছর পর ভাবতে খুবই অবাক লাগে, কি পরিমান প্রশাসনিক সংগঠন থাকলে এভাবে প্রত্যেকটি ছাত্র ছাত্রীকে আলাদা ভাবে চিঠি দেওয়া যায়।
মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। মা-বাবারা অবশ্য খুশি হলেন খুব। হবেনই তো। ছেলে মেয়ের পড়াশোনায় ব্যাঘাত কোনও মা বাবার কাছেই কাম্য নয়।
নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছলাম ক্যাম্পাসে। ক্লাস শুরু হল। কিন্তু শান্তি এল না। আবার স্ট্রাইক, ক্লাস বয়কট, ভুখ হরতাল। আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে উপাচার্য ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাস জুড়ে শুরু হল উৎসব। বাজি পুড়ল, ফেস্টুন উড়ল। কিন্তু অনিশ্চয়তা থেকেই গেল।
বি এইচ ইউ একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সব প্রান্ত থেকে এমন কি বিদেশেরও প্রচুর ছাত্র ছাত্রী পড়তে আসে এখানে। এই অস্থিরতার সংবাদ পৌঁছে গেল দেশের কোনায় কোনায় এবং সংবাদ মাধ্যমে। অবশ্য সংবাদ মাধ্যম বলতে তো সেকালে শুধু খবরের কাগজ ও আকাশবাণী। প্রত্যেক হস্টেলের কমন রুমে একটি করে রেডিও থাকত। খুব ভীড় হতে শুরু করল সংবাদ পাঠের সময়। আমাদের হস্টেলের রেডিওটি ছিল আবার এক বিশেষ মেজাজের। চুপচাপ থাকতেই ভালবাসত বেশি। অন করে দু-গালে দুটি চড় মারলে তবে মুখ খুলত।
একদিন সন্ধ্যায় কমন রুম থেকে শোনা গেল এল বিপুল হর্ষধ্বনি। যারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আড্ডা মারছিলাম, ছুটে গেলাম সেদিকে। আনন্দের কারণটা বুঝলাম। এইমাত্র ঘোষণা করা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার নতুন উপাচার্য নিযুক্ত করেছেন। শীঘ্রই কার্যভার গ্রহণ করতে আসছেন ডঃ ত্রিগুণা সেন।
ক’দিন ধরেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে কেন্দ্রীয় সরকার নানা নাম বিবেচনা করছেন। ছাত্রদের মধ্যে সব চেয়ে গ্রহণযোগ্য নাম ছিল ডঃ ত্রিগুণা সেন। দক্ষ প্রশাসক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি তখনই দেশবিখ্যাত।
তবে কিছু প্রবীণ অধ্যাপক ও প্রশাসনের চাঁইদের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ চোখে পড়ল না। অনেকে তো গোপনে বলেই ফেললেন, - ইয়ে বনারস হ্যায় ভাই, যাদবপুর নহী।
নির্ধারিত দিনে ডঃ সেনের ট্রেন এসে পৌঁছল বারাণসী স্টেশনে। রেজিস্ট্রার ও প্রশাসনের অন্যান্য কর্তারা দুধ সাদা অ্যাম্বেসেডর নিয়ে পৌঁছলেন কিন্তু স্টেশনে ঢুকতে পারলেন না। স্টেশন চত্বরে তখন শুধু কালো কালো মাথা। কয়েক শ’ ছাত্র এসেছে উপাচার্যকে অভ্যর্থনা জানাতে। ছাত্র নেতাদের কয়েকজন হাত জোড় করে দাঁড়াল ডঃ সেনের সামনে। কি কথা হল জানিনা, আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম একটু দূরে। কোথা থেকে একটা খোলা জীপ জোগার করা হয়েছিল। সেখানেই বসানো হল নতুন উপাচার্যকে। পেছনে কয়েক শ সাইকেলের মিছিল। প্রশাসনের চাঁইরা কাছেই ঘেসতে পারলেন না।
ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে থামল মিছিল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য মদন মোহন মালব্যর মূর্তির সামনে উপাচার্য নামলেন। মুখে স্মিত হাসি। কোনও উৎকন্ঠা বা নার্ভাসনেসের নামগন্ধ নেই। একটা বেদীর ওপরে উঠে একটি ছোট্ট ভাষণ দিলেন, - সবার সহযোগিতা কামনা করলেন। ওনাকে সসম্মানে পৌঁছে দেওয়া হল ওনার আবাসনে।
তারপর যা হল সেটা এক স্বপ্নের মত। বা বলা যেতে পারে ম্যাজিক। বিশদ বিবরণে যাব না, আর সব কথা মনেও নেই। মাঝে মাঝেই শোনা যেত আজ ভিসিকে দেখা গেছে কোনও হস্টেলে ছাত্রদের সঙ্গে চা খাচ্ছেন। কখনও বা খেলার মাঠে। আমাদের কলেজে এসে ছাত্রদের সম্বোধিত করলেন একদিন, ছাত্র ও অধ্যাপকদের ভিড়ে উপচে পড়ল অ্যাসেম্বলি হল। আমাদের বার্ষিক মডেলস একজিবিশনেও এলেন এক দিন; নিজে ইঞ্জিনীয়ার, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন সব কিছু। মাস খানেকের মধ্যে ক্যাম্পাসে আশ্রমের শান্তি। নিয়মিত ক্লাস শুরু হল। আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেল। সবাই বেশ খুশি। অধ্যাপকদেরও গাম্ভীর্যের ফাক দিয়ে বেরিয়ে এক পরম পরিতৃপ্তির হাসি। কি করে সেটা সম্ভব হয়েছিল, তা আজও জানিনা।
বেশি দিন ছিলেন না ডঃ সেন। কয়েক মাস পর, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ডেকে পাঠালেন উপাচার্যকে। শিক্ষা দফতরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। ইউনিভার্সিটিতে শোকের ছায়া। ছাত্ররা ঘেরাও করল ডঃ সেনের বাড়ি, - আপকো জানে নহী দেঙ্গে। আবার মুখে সেই স্মিত হাসি, আবার সস্নেহে বোঝালেন ছাত্র নেতাদের। একটি দৃশ্য এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিতে। ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে মারকুটে ছাত্র নেতারা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে ডঃ সেনের সামনে, চোখে জল, বলছে, হমে ছোড়কে মত যাইয়ে আপ।
নির্দিষ্ট দিনে স্টেশনের দিকে রওনা হল গাড়ি আর সাইকেলের কনভয়। এবার মিছিলে সামিল হলেন প্রশাসক ও অধ্যাপকেরাও। কিছু ছাত্র রাস্তায় শুয়ে রইল, মিছিল এগোতে দেবেনা। সেটা অবশ্য একটা প্রতীকি প্রতিবাদ ছিল। কিছুক্ষণ পর কনভয় রওনা হল স্টেশনের দিকে। সেই খোলা জীপ, পেছনে কয়েকটি গাড়ি ও অজস্র সাইকেল।
সসম্মানে বিদায়ী ভাইস চ্যান্সেলরকে দিল্লিগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হল।
কোন ম্যাজিকে ডঃ সেন অশান্ত ক্যাম্পাসে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, - সেটা আজও এক রহস্য।
দেশের আর কোনও ভাইস চ্যান্সেলরের এই কৃতিত্ব আছে কিনা আমার জানা নেই।
নিউ জার্সি ২৩ শে এপ্রিল ২০১৬

Tuesday 12 April 2016

দশানন


ক’দিন ধরে একটু রাবণ চর্চ্চায় জড়িয়ে পড়েছি। সূত্রপাত কয়েক মাস আগে। বৈবাহিক সম্পর্কে এক নিকট আত্মীয়র ছেলের বিয়ে হল। বউটি বেশ, সদ্য ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা শেষ করেছে, খুব মিশুকে। আজকালকার মেয়ে, সেকালের বউদের মত দামী শাড়ি, একগাদা গয়না পরে, ঘোমটা দিয়ে ঘুরে বেরায় না। ঘরোয়া পোষাকে বেশ দাপিয়ে বেড়ায় বাড়ির ভেতরে।

আমার থেকে বয়সের তফাৎ প্রায় অর্দ্ধ শতাব্দীর। কিন্তু খুব ভাব হয়ে গেল আমার সঙ্গে। ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করে দিল। একদিন সকালে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, - পিসেমশাই, তোমার দাঁত মাজতে কতক্ষণ লাগে। আমি বললাম, ঠিক জানিনা রে, তবে মিনিট পাঁচেক লাগে নিশ্চয়ই।

হুম্ম্ম্ , তার মনে রাবণের কতক্ষণ লাগত?

আমি কিছু না ভেবেই বললাম, - দশটা মাথা যখন, অন্ততঃ পঞ্চাশ মিনিট লাগত তো নিশ্চয়ই।

হল না। ফেল্‌। কুড়িটা হাত না? ডান হাতগুলোতে ব্রাশ নিয়ে একসঙ্গে মাজত। ঐ পাঁচ মিনিটই লাগত।

বুঝলাম দাদাগিরির গুগলি জাতীয় প্রশ্ন ছিল, আমি ধরতে পারিনি। সেই ছোটবেলার ডিম সেন্ধর গল্পের মত। ১টা ডিম সেদ্ধ হতে যদি ৫ মিনিট লাগে, ১০টা ডিম সেদ্ধ হতে কত সময় লাগবে?

ঠকে গেলাম এক পুঁচকে মেয়ের কাছে।

এর ক’দিন পর একটা হোয়াটসঅ্যাপ এল। এক বন্ধু একটি প্রশ্ন পাঠিয়েছে। ওষুধের পাতায় ১০ টা ক’রে ওষুধ থাকে কেন? কেন ৭টা বা ১২টা নয়। উত্তরটা নীচে দেওয়া ছিল; স্ক্রল করে দেখতে হবে। তাই করলাম। গিয়ে দেখি, রাবণের একবার মাথা ধরেছিল, সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে। দুচ্ছাই, - মেজাজটা খিঁচড়ে গেল।

ক’দিন পর আবার এক হোয়াটসঅ্যাপ! এক উত্তর প্রদেশী বন্ধুর কাছ থেকে। রাবণ মহাবীর ছিলেন কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রজীর কাছে পরাস্ত হন। কেন? আবার সেই স্ক্রল করে উত্তর, - রাবণের ভাই রাবণকে ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু রামের ভাই সর্বক্ষণ পাশে ছিল। ভ্রাতৃপ্রেমের মহিমা।

এই রাবণ-চর্চায় জর্জরিত অবস্থায় হঠাৎ একটা গল্প মনে এল। সেই গল্পটাই বলতে চাইছি।

লঙ্কাকান্ড ঘটে গেছে সেই কোন যুগে! সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। রাম সেই কবে ফিরে গেছেন বৈকুন্ঠে। রাবণও সব পাপস্খলনের পর এখন স্বর্গবাসী। রামের সঙ্গে এখন খুব সদ্ভাব, প্রায়ই এক সঙ্গে আড্ডা মারেন দু-জনে। রাম, সাক্ষাৎ বিষ্ণু, - খুব স্নেহের চোখে দেখেন রাবণকে। মাঝে মাঝে এক সঙ্গে পুষ্পকে চড়ে বেড়াতে যান এদিন সেদিক।

একদিন, শ্রীরাম জিজ্ঞেস করলেন, কি ভায়া, কলকাতা দেখেছো, কখনও? চল ঘুরে আসি এবার। পূজোর সময় যাব। খুব হৈ চৈ হয় সেই সময়ে।
- পূজোর সময়?
- হ্যাঁ। আর জান তো, এই পূজো আমিই শুরু করেছিলাম। মা দূর্গাকে অকালে, অবেলায় ঘুম থেকে তুলে... হতচ্ছারা বাঙালিগুলো বলে এটা নাকি ওদের পূজো…
- হ্যাঁ জানি জানি, কেন পূজো করেছিলেন তাও আমি জানি, - অভিমানী মুখ করলেন রাবণ
- আহা, সে তো অনেক পুরনো কথা, সেসব কথা মনে রেখ না ভায়া, সব চুকে বুকে গেছে। চল ঘুরে আসবে। ভাল লাগবে খুব খাওয়া দাওয়া হয়, খুব সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো হয় পুরো শহর…
- না আমি যাব না। আমি জানি ঐ শেষ দিনে আমার একটা অদ্ভূতুরে পুতুল বানিয়ে সেটাকে জ্বালানো হয়…
- আহা, বড় ছেলেমানুষী করছ। তোমাকে তো আর সরাসরি জ্বালায়  না। ঠিক আছে আমরা নয় তার আগেই ফিরে আসব। নবমীর দিন যাই চল, সেদিন অনেক জায়গায় মাংস খাওয়া হয়
- তাই? এবার রাক্ষস রাজের চোখ চকচক করে উঠল

তাই ঠিক হল। অবশেষে মহানবমীর দিন ভোর রাতে রাম আর রাবণ এসে পৌঁছলেন কলকাতা শহরে। ভোর রাত তখনও আলো জ্বলছে সব প্যান্ডেলে। চোখ জুড়িয়ে গেল রাবণের।

সারাদিন ঘোরা হল প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। দিনের শেষে দুজনেই খুব ক্লান্ত। ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। কোথাও গিয়ে কিছু খেলে হত। শ্রীরামচন্দ্রের মাথায় একটা আইডিয়া এল। পূজোর সময় বড় বড় রেস্তোরাঁয় খুব ভাল বাঙালি ভোজন থাকে। সেখানেই যাওয়া যাক।

বেশ তাই হোক। - রাজি হলেন রাবণ

মধ্য কলকাতার এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ সামনে এসে পৌঁছলন দু-জনে। অবশ্যই মন্ত্রবলে। রাম গটগট করে ভেতরে ঢুকলেন। পেছনে রাবণ। ভেতরে কাউন্টারের সামনে এক বেশ সুন্দরমত দিদিমণি। রাম কিছু জিজ্ঞেস করলেন। হেসে মিষ্টি করে উত্তর দিলেন দিদিনণি। রাম হেসে মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। রাবণের মুখ চূণ। বিরস মুখে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

পরের দিন বিষ্ণুলোকে বিশ্রামরত রাম। মুখে তৃপ্তির হাসি। নারদকে বলছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। বিশেষ করে বাঙালি ভোজনের তো উচ্চ প্রশংসা। সে কি রাজকীয় আয়োজন। নারকোল কুচি দিয়ে ছোলার ডাল, আলু পোস্ত, মোচা ঘন্ট, ধোকার ডালনা, পার্শে মাছ ভাজা, চিতল মুইঠ্যা, সর্ষে ইলিশ, কসা মাংস, লুচি, পোলাও, চাটনি, মিষ্টি দই, কড়াপাকের সন্দেশ আর মিষ্টি পান। আঃ অপূর্ব। রাবণটা যে কেন চলে গেল কে জানে?

- খুব দাম নিশ্চয়ই, - নারদ জিজ্ঞাসা করলেন।
- এমন খুব একটা বেশি নয়, ৭০০ টাকা মোটে। অত খাবার একটু দাম তো হবেই। আর কত বিখ্যাত রেস্তোরাঁ, - সেটা দেখবি তো!
- তা ঠিক, - স্বীকার করলেন নারদ।

বিষ্ণুলোক থেকে বেরিয়ে নারদ গেলেন রাবণের প্রাসাদে। রাবণের মন মেজাজ ভাল নেই। গম্ভীর মুখে বসে আছেন। নারদকে দেখে মুখ ব্যাজার করলেন।

- কি ভাই, কাল আপনি না খেয়ে চলে এলেন? প্রভু তো খুব তৃপ্তি করে খেয়েছেন।
- হ্যাঁ, প্রভু তো তৃপ্তি করে খাবেনই। ওনার আবার কি?
- কেন? কি ব্যাপার? আপনি খেলেন না কেন?
- ভীষন এক্সপেনসিভ, - মানে খুব দাম … মুখ ভেটকে বললেন রাবণ
- সে কি প্রভু যে বললেন খুব সস্তা
- সে তোমার প্রভুর জন্য সস্তা হতে পারে। আমার জন্য নয়… এবার বেশ রেগেই গেলেন রাবণ
- সে কি? আপনি তো প্রচুর সোনাদানার মালিক!
- আরে ছাড় তো তোমার সোনাদানা...
- একটু বুঝিয়ে বলবেন?
- বুঝিয়ে বলার কি আছে? তোমার প্রভু রেস্তোরাঁর এক দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করলেন কত দাম পড়বে।
- তো?
- দিদিমণি বলল ৭০০ টাকা পার হেড। আমি শুনেই পালিয়ে এসেছি।

*******
জার্সি সিটি – ১১ই এপ্রিল ২০১৬


Thursday 7 April 2016

বিদেশে স্বজন

দিনের জন্য জার্সি সিটিতে এসেছি ছেলের বাড়ি ছেলের বিয়ের পর এই প্রথম এলাম ওর সংসারে সকাল বেলা ছেলে ও বৌমা দুজনেই কাজে বেরিয়ে যায় আমরা বুড়ো বুড়ী একটু হাঁটতে যাই ফিরে এসে গিন্নী ছেলে-বৌএর জন্য একটু রান্নাবান্না করে রাখেন আমি টিভি দেখি নির্বাচনের মরশুম, বেশ সময় কেটে যায় আধুনিক প্রযুক্তির মহিমায় সব ভারতীয় ইংরিজি, হিন্দি ও বাংলা চ্যানেল এখানে পাওয়া যায় আজকাল

আজ অফিসে পৌঁছে ছেলে ফোন করল যে এসি মেনটেনেসের জন্য কেউ আসবে আসার আগে ফোন করবে ফোন এল ১১টা নাগাদ কন্ঠস্বর শুনে মনে হল ভারতীয় জিজ্ঞেস করলাম হ্যাঁ যা ভেবিছিলাম, তাই পরের প্রশ্ন , - ইন্ডিয়ার কোথায়? উত্তর শুনে তো আমি থ ক্যালকাটা তারপর নিজেকে শুধরে স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, কলকাতা ব্যাস আত্মপরিচয় দিলাম নাম জিজ্ঞেস করলাম সুরজিৎ অনেক্ষণ ফোনে কথা হল অবশ্যই বাংলায় অনেক বিষয় নিয়ে আড্ডা হল, ফোনেই। ছেলেটি বিশেষ লেখাপড়া করেনি। অনেক ঘাটের জল খেয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। এখন মেকানিকের কাজ করে।  আমি বললাম , চলে এসো, সামনা সামনি গল্প করা যাবে। সুরজিৎ জানাল, আধঘন্টার মধ্যেই আসছে।

আমি চানটান করে তৈরি হয়ে নিলাম। আধঘন্টা পর দরজায় বেল। খুব আশা নিয়ে দরজা খুলে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। এক বিশাল লম্বা সর্দারজী, পরণে খাকি কাভারঅল। হাতে যন্ত্রপাতির বাক্স।

ইয়েস, - আমি জিজ্ঞেস করলাম। লোকটি একগাল হেসে বলল, সুরজিৎ স্যার। একটু আগে কথা হল ফোনে।

আমি আরও হতভম্ব।

তুমি?

সর্দারদা পুত্তর এক হাত জিভ কেটে, সলজ্জ হেসে বলল, - ভুল হয়ে গেছে স্যার। সব সময়ে এই ভুলটা করি। বাংলা কথা শুনে এক্সাইটেড হয়ে বলতেই ভুলে গেছি, আমি আসলে পঞ্জাবি পরিবারের ছেলে।

তাই? আমি তো অবাক,  এত ভাল বাংলা?

আরও চওড়া হাসল সুরজিৎ। ভবানীপুরে বাড়ি স্যার। ওখানেই জন্ম, বড় হওয়া, পড়াশোনা।

কিন্তু তোমার কথা শুনলে তো পুরোপুরি বাঙালি মনে হয়!


সেটা স্যার আমি পঞ্জাবি বললেও আমাকে বাঙালি মনে হয়, আমার আত্মীয় স্বজনরা তো তাই বলেন, - সলজ্জে জানাল সুরজিৎ।

   
জার্সি সিটি ৫ এপ্রিল ২০১৬

Thursday 31 March 2016

“দাও ফিরে সে অরণ্য”


আমেরিকা; বাংলায় আমরা বলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম ধনাঢ্য দেশ, প্রাচুর্যের দেশ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক এখানে এসে বসবাস করছেন, এই দেশের নাগরিক হয়েছেন। বস্তুতঃ এই দেশ অভিবাসিক বা ইমিগ্রান্টদেরই দেশ। এই বিশাল ভূমির আদিবাসীরা আজ প্রান্তিক। তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কোণেতারা নিজের দেশে প্রায় অবাঞ্ছিত। যাই হোক, তাদের নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে।

আধুনিক জীবনযাপনের আকর্ষণে বা নিজেদের স্বপ্ন সফল করতেই নানা দেশের লোকেরা আসেন এখানে। এখানে জীবনযাত্রার মান উন্নত। জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও অভাব নেই। মধ্যবিত্ত ভারতীয় ও বাঙালি পরিবারের অনেকেই আজ এই দেশের নাগরিক।

সেই রকমই এক বন্ধুর বাড়িতে বসে আড্ডা হচ্ছিল বন্ধুটি বহুদিন আমেরিকাবাসী সেই দেশেরই এক দায়িত্বশীল নাগরিক সম্প্রতি কাজ থেকে অবসর নিয়েছে বিশাল বাড়ি সামনে পেছনে বাগান বাড়ির সংলগ্ম তিন খানা গ্যারাজ নিজের গাড়ি, বন্ধুপত্নী ও বন্ধুকন্যার আরও দুখানা গাড়ি চারদিকে সচ্ছল জীবনের ছবি

সেই আড্ডাতেই উঠে এল এক অদ্ভূত জনগোষ্ঠীর কাহিনী। এই প্রাচুর্যের হাতছানি উপেক্ষা করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী এই সমাজ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। এরা থাকে শহর থেকে দূরে; সম্পূর্ণ নিজেদের জগতে। এরা আধুনিক জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সযত্নে এড়িয়ে চলে। এদের কথা শুনেছিলাম বহুদিন আগে। কিন্তু সম্যক কোনও ধারণা ছিলনা।

সম্প্রতি খুব কাছ থেকে এদেরকে দেখার সুযোগ পেলাম। কাছ থেকে দেখেছি, কিন্তু জেনেছি বলতে পারব না। কারণ তার জন্য কিছু মেলামেশার দরকার। আর এদের সঙ্গে মেলামেশার কোনও সুযোগই নেই। কারণ এরা স্বেচ্ছায় নিজেদের সরিয়ে রেখেছে তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে।

এই জনগোষ্ঠী অ্যামিশ (Amish) নামে পরিচিত এরা এক বিশেষ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোক। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর অত্যাচারে এরা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় আশ্রয় নেয়। এদের ঐতিহাসিক পরিচয়ে আর গেলাম না। কারণ সেই জ্ঞান আমি অর্জন করতে পারিনি।

একদিন সুযোগ বুঝে পৌঁছলাম অ্যামিশদের বসতিতে বা অ্যামিশ ভিলেজে। স্থানীও প্রশাসন সেখানে দেখি বেশ একটা পর্যটন অফিস খুলে রেখেছে। প্রচুর লোক দেখতে আসে, তাই কিছু অর্থ উপার্জন হয়। এ ছাড়া কোনও সরকারী অনুদান বা ভর্তুকি অ্যামিশরা নেন না। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।


অ্যামিশ ভিলেজের প্রবেশ পথ।

আমাদের সঙ্গে একজন গাইড দেওয়া হল। মহিলা, নাম স্যালী, হাতে মাইকপ্রায় গোড়ালি অব্দি লম্বা স্কার্ট ও মাথা ঢাকা। বিবাহিতা অ্যামিশ মহিলারা এরকম পোষাকই পরেন। মহিলা জন্মসূত্রে একজন অ্যামিশ কিন্তু উনি ব্যক্তিগত কারণে সমাজ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কি কারণ বলতে চাইলেন না। একটু মৃদু হাসলেন শুধু। কিন্তু তা সত্ত্বেও উনি যখন এই অঞ্চলে আসেন, তখন এখানকার রীতি নীতি মেনে চলেন।

একটা মিনিবাসে বসলাম। বেশ ছড়ানো অঞ্চল। সুন্দর পাকা রাস্তা। চারিদিকে শস্য ক্ষেত, ছোট ছোট  দোকান ও কারখানা। মাঝে মাঝে বেশ সুন্দর গোছানো বাড়ি। কিছুই অস্বাভাবিক চোখে পড়ল না। স্যালী অর্থাৎ সেই গাইড মহিলা কিছু বৈশিষ্ট্যর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।




আমাদের গাইডের সঙ্গে

প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে তা হল প্রত্যেক বাড়ির সংলগ্ন একটি গ্যারাজ আছে, যেমনটি থাকে যে কোনও আমেরিকান বাড়িতে। গ্যারাজে গাড়িও আছে। কিন্তু সে গুলো ঘোড়ার গাড়ি। অশ্বচালিত শকট! বাড়ির এককোনায় ঘোড়াগুলো বাঁধা। বাড়িগুলোয় কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, নেই কোনও টেলিফোন। এরা মোবাইলও ব্যবহার করেনা, - আমাদের গাইড জানালেন। তবে তিন চারটে বাড়ির পর একটি করে ফোন বুথ আছে। খুবই সাধারণ। চারিদিকে টিনের ছাউনি। ছাদও টিনের। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ ফোন ব্যবহার করেনা।

খুব কৌতূহল হল এদের বাড়ির ভেতরটা দেখার। একটু ইতস্ততঃ করে বাসনা ব্যক্ত করলাম স্যালীকে। উনি হেসে বললেন এদের বাড়িতে অপরিচিতদের ঢোকা একেবারেই অসম্ভব। তাই অ্যামিশ অঞ্চলের এক কোণায় এদের জীবনযাত্রার নমুনাস্বরূপ একটি মডেল রাখা হয়েছে। সেখানে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। তাঁদের চার মেয়ে বিয়ের পরে শশুরবাড়ির বাসিন্দা। তাদের অনুমতি নিয়ে এই বাড়িটি ট্যুরিস্টদের দেখানো হয়।

বাড়িটি খুবই সাধারন ভাবে সাজানো। কিন্তু খুব গোছানো। কিন্তু বাড়ির ভেতরে একটি ফ্রিজ দেখে চমকে উঠলাম। সে কি? এই তো দিব্যি ফ্রিজ আছে দেখছি, তবে না বললেন এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই? একটি হাসলেন স্যালী, কাছে ডেকে নিয়ে দেখালেন যে সত্যিই নেই। এই প্রাচীন ফ্রিজটি কেরোসিনে চলে। একটি ওয়াশিং মেশিনও আছে। সেটিও হাতল ঘুরিয়ে চালাতে হয়। ছাদ থেকে যে আলো ঝুলছে বা ঘরের কোনায় যে ল্যাম্পস্ট্যান্ড তাতেও মোমবাতি লাগানো রান্নার উনুনও আছে, কয়লা বা কেরোসিনে চলে। গ্যাসের লাইন নেই। নেই জলের লাইনও। টিউব ওয়েল আছে সব বাড়িতে।

  
 
                           অ্যামিশের সংসার। কেরোসিনে চলে ফ্রিজ। হাতল ঘুরিয়ে ওয়াশিং মেশিন।

আমাদের আগেই সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল যেন আমরা খুব কাছে গিয়ে কারও ছবি তোলার চেষ্টা না করি। তবে দূর থেকে তোলা যেতে পারে। কোন অ্যামিশ পুরুষ বা মহিলা ক্যামেরার দিকে তাকাবে না কখনও। খুবই পরিতাপের বিষয়, খুব একটা ছবি তাই তোলা গেল না।

প্রত্যেক বাড়ির সংলগ্ন একটি আস্তাবল। খুব যত্ন সহকারে অশ্ব পরিচর্যা এদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। এরা মোট বইতে, গাড়ি টানতে, এমন কি চাষের কাজেও ঘোড়া ব্যবহার করে। প্রত্যেকটি পরিবারেই পাঁচ ছটি করে ঘোড়া আছে। ঘোড়ার যত্নের জন্য আস্তাবলে এলাহি ব্যবস্থা।

 
   
                            আস্তাবল                                               চাষের ঘোড়া

সব কিছুই কি রকম যেন অবাস্তব মনে হচ্ছিল বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন যাপন কি সম্ভব? বিশেষ করে এই আধুনিক যুগে ধরে নিলাম এদের খাদ্য সামগ্রী এরা নিজেরাই উৎপাদন করে, কিন্তু স্কুল কলেজে যায় যখন?

একগাল হাসলেন স্যালী বললেন, - একটু ধৈর্য ধরে শোনো, সব বলছি ঠিক প্রশ্নই করেছ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা তো যায় না একটু আধটু তো যোগাযোগ তো রাখতেই হয় এই যে বসতি দেখছো, এ ছাড়াও কিন্তু অন্যান্য জায়গায়ও আছে অ্যামিশদের বিভিন্ন শাখা প্রশাখাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে গেলে তো বেরোতেই হয় নিজেদের ডেরা থেকে। আর ঘোড়ার গাড়ি চড়ে কত দূর আর যাওয়া যায়তাই এদের ট্রেনে বা বাসে চাপতেই হয়। গাড়িও চড়ে যদি দরকার হয়, তবে এরা গাড়ি চালায় না কখনও। আর স্কুল কলেজের কথা বলছ? এদের নিজস্ব স্কুল আছে। ৬ বছর বয়সে এরা স্কুলে ঢোকে। এদের শেখানো হয় ইংরিজি, কিছু ইতিহাস, ধর্ম ও বিভিন্ন জীবিকা; যেমন কারিগরী, কিছু কাঠের বা লোহার কাজ, সেলাই ইত্যাদি। পড়াশোনা শেষ হয় অষ্টম শ্রেণী (এইটথ স্ট্যান্ডার্ড) শেষ হলে। কলেজ শিক্ষার চলনই নেই। অ্যামিশ সমাজে এর বেশি পড়াশোনার দরকার পড়েনা। ১৪ বছর বয়সে লেখাপড়া শেষ করে যে যার জীবিকা শুরু করে এই সমাজের মধ্যেই। স্কুলে পড়ানোর দায়িত্ব মোটামুটি মেয়েরাই পালন করে। স্কুলে মানবিকতা, সরল জীবন যাপন, সহমর্মিতা ইত্যাদির ওপর খুব জোর দেওয়া হয়।



ক্লাস রুম

 

                 পরিবারের গাড়ি                                       খোলা গাড়ি; অবিবাহিতরা ব্যবহার করে।

প্রায় ঘন্টা খানেক ঘোরার পর হঠাৎ মনে হল, এত ধর্মনিষ্ঠ জীবন যাপন এদের, কিন্তু কোনও গির্জা বা চার্চ তো চোখে পড়ল না। এবার একটু সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন স্যালি, - বাঃ তোমার তো বেশ ভাল নজর দেখছি। ঠিকই ধরেছ। এখানে কোনও চার্চ নেই। এরা নিয়ম করে এক সপ্তাহ অন্তর কারও বাড়িতে জমায়েত হয় প্রার্থনার জন্য। সেখানেই সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।

আরও প্রশ্ন জাগছিল মনে। এই যে এই অঞ্চলে যে চওড়া রাস্তা বা যেই বিস্তৃত জমিতে এদের চাষবাস, তাতে তো সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয় নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, - বললেন স্যালিদিতে হয় বৈকি। দেয়ও এরা। দেশের বা রাজ্যের যা আইন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কিন্তু সরকার থেকে কোনও সুবিধা এর নেয়না। কোনও সোশাল সিকিউরিটি বেনিফিট বা সরকারি অনুদানও নেয়না

প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরই লম্বা দাড়ি গোঁফ, - বিবাহিত পুরুষদের চিহ্ন অবিবাহিত পুরুষদের দাড়ি গোঁফ কামানো। বিবাহিতা মহিলাদের মাথা ঢাকা, কুমারীদের মাথা উন্মুক্ত। পথে একটি অ্যামিশ দোকান চোখে পড়ল। সেখানে বাস থামালেন স্যালী। ভয়ে ভয়ে কিছু ছবিও তুলে ফেললাম। নানা রকম পন্য সাজানো। সবই হাতে তৈরি। কৃষিকাজে কোন রাসায়নিক এরা ব্যবহার করেনা। তাই বাইরের জগতে এদের কৃষিজাত দ্রব্যের চাহিদা বেশ। নিজেদের সমাজের চাহিদা মিটিয়ে কিছু বাচলে সেটা বাইরের বিক্রি করতে শুরু করেছে ইদানীং। তাতে একটু যোগাযোগ বাড়ছে বাইরের জগতের সঙ্গে। ফলস্বরূপ একটু আধটু ফোনের ব্যবহার চালু হয়েছেব্যবসার খাতিরে মোবাইল ফোন ও ই-মেলেরও ব্যবহার শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন অব্দি নিজেদের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়নি একেবারেই।


                                                   উইন্ডমিল

মাম, লুক, আ উইন্ডমিল! পেছনে বসা একটি বাচ্চার চিৎকার শুনে বাইরে তাকালাম। তাই তো! এটা তো এতক্ষণ খেয়াল করিনি। আসলে রাস্তার দু-দিকেই নানা রকম বিস্ময় ছড়িয়ে, বাঁদিকে তাকালে ডান দিকের কিছুই দেখা হয়না। বাচ্চাটি ঠিকই দেখেছে। শস্যক্ষেতের ভেতর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি উইন্ডমিল। স্যালীর দিকে তাকালাম, উনি দেখি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাসছেন। মাইক হাতে নিয়ে আবার বললেন,- নিজেদের চাহিদা মেটাতে এরা ছোটখাট কারখানা চালায়, লোহার, কাঠ, চাষবাসের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। কাজের সুবিধের জন্য মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেই বিদ্যুৎ এরা নিজেরাই তৈরি করে নেয়। উইন্ডমিলের যন্ত্রপাতিও এরা নিজেরাই তৈরি করে।
আরও একটি তথ্য জানালেন স্যালী। এদেশে আজকাল বিকল্প শক্তি বা অল্টারনেটিভ এনার্জির চাহিদা হয়েছে। অনেক বাড়ির ছাদেই আজকাল দেখা যায় বিভিন্ন মাপের সৌর প্যানেল। বায়ু শক্তি বা উইন্ড এনার্জি সম্বন্ধেও বাড়ছে লোকের কৌতূহল। এই ব্যাপারে অ্যামিশদের সাফল্য অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাই এদের তৈরি উইন্ডমিলেরও একটা বাজার তৈরি হয়েছে।


অ্যামিশ দোকানের সামনে কিছু পর্যটক

 

   
দোকানদার ও তার মেয়ে

সবই তো বুঝলাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো রয়েই গেল! অসুখ বিসুখ হলে কি করে এরা? প্রশিক্ষিত ডাক্তার তো নেই এদের! স্যালীর দেখলাম ধৈর্য আছে। প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন হাসিমুখে। বললেন, এদের জীবন যাত্রা এমন যে কোনও বড় অসুখ এদের সাধারণতঃ হয় না। কোনও নেশাও নেই। মদ্যপান নিষিদ্ধ। ধূমপান নিষিদ্ধ নয় কিন্তু তামাক নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়। সরল টেনশন মুক্ত জীবন। তবে ছোট খাট অসুখ তো হতেই পারে। তার জন্যে নানা রকম ভেষজ চিকিৎসার প্রচলন আছে। যদি নেহাৎ কোন বড় অসুখের খপ্পরে পড়ে কেউ তবে সমাজের অনুমতি নিয়ে বাইরের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যায়। খরচটা সমাজ থেকেই দেওয়া হয়।

অবশেষে আমাদের মিনিবাস ফিরে এল। সফর শেষ হল আমাদের। কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছিল সব কিছু। যখন সারা পৃথিবী প্রযুক্তির মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে, তখন এই জনগোষ্ঠী আঁকড়ে ধরে আছে অষ্টাদশ শতাব্দীকে। ক’দিন থাকবে এই সমাজ কে জানে? অনেক কথাই বলেননি স্যালী। অনেকেই হয়তো বেড়িয়ে এসেছে এই সমাজ থেকে। যেমন নিজে বেড়িয়ে এসেছেন স্যালী। এখন নাকি আমেরিকায় এদের সংখ্যা প্রায় ২,৫০,০০০-এর মত। কিন্তু এরা নাকি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। কিসের মোহে কে জানে? এদের পরিবার খুব বড় হয়। প্রত্যেক পরিবারে সাত আট জন সদস্য। কাজিনদের মধ্যে বিবাহ সমাজে স্বীকৃত। এত ছোট সমাজ। এদের সঙ্গে মাস খানেক থাকতে পারলে খুব ভাল হত। কিন্তু তা সম্ভব নয়।

ফেরার পথে হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই কবির কটি কথা, যাঁকে ছাড়া আমাদের জীবন অন্ধকার -

দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব--
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন...

************