Saturday 17 August 2013

পেঁয়াজ মাহাত্ম্য


পেঁয়াজ দুর্মূল্য। ষাট থেকে সত্তর টাকা কিলো চলছে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন পুজোর আগে এক’শ টাকায় গিয়ে পৌঁছবে। বাড়ি বাড়ি কম পেঁয়াজে বা বিনা পেঁয়াজে রান্না হচ্ছে। মোটামুটি সাত্ত্বিক আহার। খুবই সুসংবাদ। বাঙালী আজীবন বদহজমের শিকার। পেঁয়াজ পেট গরম করে, সে কথা শিশুরা অব্দি জানে। সরকার যদি রসুনের দামটা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন তবে তো সোনায় সোহাগা। পেঁয়াজ রসুন ছাড়া হাল্কা স্বাস্থ্যসম্মত আহার করে শরীর ও মন বেশ চনমনে হয়ে উঠবে। বাঙালী আবার দেশ গড়ার কাজে ঝাপিয়ে পড়বে। এটি একটি নিঃশব্দ বিপ্লব। প্রত্যেক বিপ্লবে কিছু লোককে চরম আত্মত্যাগ করতে হয়। সাধারণ মানুষের জীবনেও কিছু কিছু পরিবর্তন আসে।

বাঙালীর আদি ও অকৃত্তিম জলখাবার হল তেলেভাজা। অফিস থেকে ফিরে এক কাপ গরম চা আর এক বাটি মুড়ির সঙ্গে গরম গরম বেগুনি আর পেঁয়াজি; আঃ। কিংবা কোনও ছুটির দিনে বৃষ্টির মাঝে দফায় দফায় চা আর তেলে ভাজা  সমেত আড্ডা! তার কোনও তুলনা আছে? সেই ঐতিহ্যময় তেলেভাজা শিল্প এখন চরম সঙ্কটে। পাড়ায় পাড়ায় তেলেভাজা দোকানের সামনে নোটিস, - পেঁয়াজি নাই। কি আর করা? ইংরিজিতে খুব সুন্দর একটা কথা চালু আছে, - কোল্যাটারেল ড্যামেজ। কোনও বৃহৎ কাজে ছোট খাট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। আর তা ছাড়া তেলেভাজার সেই গৌরব তো অনেক আগেই অস্তমিতঃ। বাঙালীর প্রিয় স্ট্রীট-ফুড এখন তেলে ভাজা নয়। সেই স্থান অনেকদিন আগেই অধিকার করেছে, রোল। অফিসের টিফিন টাইমে বা অফিস  থেকে ফেরার পথে বাবু বিবিরা গোগ্রাসে এগ-চিকেন, এগ-মাটনের স্বাদ উপভোগ করেন। অবশ্য তাতেও পেঁয়াজের একটা ভূমিকা আছে, কিন্তু তা নিতান্তই গৌণ। আর রোল শিল্পও তার গুরুত্ব হারাচ্ছে শুনেছি। বিশ্বায়নের হাত ধরে পৌঁছে গেছে  পিৎজা, বার্গার ইত্যাদি। সেই সব সুখাদ্যে পেঁয়াজের কতটা অবদান সেটা আমার জানা নেই।

আর সত্যি কথা বলতে কি পেঁয়াজ কিছু অনর্থেরও মূলও বটে। মনে আছে সেই নিষ্পাপ ভাল ছেলেটির কথা, যে দোষের মধ্যে একটু পেঁয়াজ খেত, তাও সব সময় নয়, যখন একটু...ইত্যাদি; কি ভয়ানক পরিনাম হয়েছিল সেই ছেলের। এখন  নিশ্চিন্ত, - পেঁয়াজ খাবার ভয় আর নেই। পাবে কোথায়?

আর স্বাস্থ্যের দিকটাও ভাবতে হবে। বড় বড় ডাক্তাররা সবাই একযোগে বলছেন যে তেল এবং তেলে ভাজা (ইংরিজিতে যাকে ডীপ ফ্রাই বলা হয়) বিষবৎ বর্জনীয়। পেঁয়াজ তো ভ্যানিশ হল, এখন যদি সরকার এবং বেওসায়িরা বেগুনও ভ্যানিশ করে দিতে পারেন তবে তা যথার্থ দেশ সেবা হবে।

কিন্ত বাঙালী কি এত সহজে শোধরাবে? প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক আমার মতই অবসর জীবন যাপন করছেন। একটি মাত্র মেয়ে, স্বামী-কন্যা নিয়ে দুবাই-এ থাকে। আজ সকালে ফোন করে জানিয়েছে, বর ছুটি পেয়েছে। আসছে আগামী সপ্তাহে। পুজো কাটিয়ে ফিরে যাবে। জানতে চাইছে দুবাই থেকে কিছু আনতে হবে কি না। দুবাই ভোগ্য পণ্যের স্বর্গ রাজ্য; গিন্নী ফোন হাতে স্বামীকে শুধোলেন, - ওগো, রিন্টু জানতে চাইছে কিছু লাগবে কি না। ওরা একটু পরে বাজারে বেরোবে।

ভদ্রলোক কাগজ পড়ছিলেন। চোখ না সরিয়েই বললেন, - দু বস্তা পেঁয়াজ নিয়ে আসতে বল।

নিউ জার্সি
১৭ অগাস্ট ২০১৩

Thursday 8 August 2013

প্রাতর্ভ্রমন


চিকিৎসকের উপদেশ এবং পরিবারের সদস্যদের উপরোধ এড়াতে পারিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই মর্নিং ওয়াক অভ্যাস করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। অসহ্য লাগত প্রথম দিকে। ভোরের দিকের ঘুম বড় মধুর, বিশেষ করে শীত কালে লেপের উষ্ণতার তো তুলনা হয় না। সেই আরাম ছেড়ে কাকভোরে হাঁটতে যাওয়ার কোনও মানে হয়? কিন্তু স্বাস্থ্যের খাতিরে যেতেই হতঅসহ্য লাগত প্রথম দিকে। তবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছিলাম।

আমার নিবাস দক্ষিন কলকাতা, “লেক” অর্থাৎ রবীন্দ্র সরোবর থেকে পাঁচ সাত মিনিটের হাঁটা পথ। তবে সে পথ বড় দুর্গম, বিশেষ করে ভোর বেলা। ফুটপাথে সারি সারি নিদ্রিত পথবাসী; ছোট ছোট মশারি, এক প্রান্ত বাঁধা বন্ধ দোকানের তালায়, অন্য প্রান্ত ল্যাম্প পোস্টে বা টানা রিকশার হাতলেএখানে সেখানে বকলস বাঁধা অভিজাত সারমেয়কুলের প্রাতঃকৃত্যের নমুনা। রোল ব্যাপারীদের রাস্তায় ফেলে যাওয়া অজস্র ডিমের খোসা। এই সব বাঁধা পেরিয়ে পথ চলা এক  বিরক্তিকর ব্যাপার

তবে একবার লেকে পৌঁছোতে পারলে শরীর ও মন বেশ চনমনে হয়ে ওঠে য়ে শ’য়ে লোক হাঁটছে নারী, পুরুষ, কিশোর, কিশোরী, যুবা বৃদ্ধ সবাই আর জায়গাটা মোটামুটি দূষণ মুক্ত, বেশ ভালই লাগে। সত্যি কথা বলতে কি, চুপ করে এক কোনায় বসে হাঁটুরেদের কান্ডকারখানা দেখেও বেশ সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কেউ একা হাঁটেন – গম্ভীর মুখে, কেউ বা আবার এক একটি দলে। যারা দল বেঁধে হাঁটেন তারা আবার আড্ডা মারেন হাঁটতে হাঁটতে। নানা টপিক নানা বিষয় বস্তু। ধরুন একটা বাঙালী দল, পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল আর কানে এল কয়েকটি খুচরো সংলাপ, “ হ্যাঁ ধোনি খুব ভাল করছে, কিন্তু টিমটা কিন্তু সৌরভই তৈরি করেছিল ...”। আরেকটি দল, এঁরা আদতে দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের বাসিন্দা; শুনতে পাবেন, “সিমেন্টকা ভাও অচানক বহুত বাড় গয়া, ... ”। নবীন প্রজন্মের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে অনেকে দৌড়োন বা যাকে বলে জগিং করেন; পরনে ট্র্যাক স্যুট, পায়ে নাইকি বা আডিডাস, কানে ইয়ার ফোন।

তবে সবাই যে হাঁটেন বা দৌড়োন তা কিন্তু নয়। অনেকে ধ্যান করেন পদ্মাসনে বসে, কেউ আবার চারিদিকের কোলাহল সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে, উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তি করেন সংস্কৃত স্তোত্র; বেশ লাগে শুনতে। অনেকে বাবা রামদেবের মত চোখ বন্ধ করে সজোরে শ্বাস নেন অথবা এক নাসারন্ধ্রে নিশ্বাস নিয়ে অন্য নাসারন্ধ্র দিয়ে ছাড়েন। আবার বেশ কয়েকজন প্রবীন প্রবীনা আছেন, যাঁরা দল বেঁধে আসেন, ধীরে সুস্থে গল্প করতে করতে। লেকের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি সিমেন্টের বাঁধানো আসন আছে, তার একটিতে এসে বসেন এবং ঘন্টা খানেক চুটিয়ে আড্ডা মারেন তারপর আবার গল্প করতে করতে ফিরে যান। দেখে মনে হয় এঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হয় তো বা প্রতিবেশীও।

প্রথম দিন যখন লেকে ঢুকি, সমবেত কন্ঠের এক বিরাট অট্টহাসির আওয়াজে বুক কেঁপে উঠেছিল। লেকের একটি কোনায় একটা ঘেরা জায়গায় লাফিং ক্লাবের মেম্বাররা তাঁদের দৈনন্দিন কর্মসূচী পালন করছিলেন। তাঁদের দলে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক সদস্য, নানা বয়সের। পুরুষের সংখ্যাই বেশি, মহিলা খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে এঁরা পুরো শরীর কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসেন। পাশ দিয়ে একটা মেঠো পথ, সেখান দিয়ে সকাল বেলা কিছু গৃহ কর্মচারিনী যাওয়া আসা করেন। এঁরা ভোর বেলা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আসেন ট্রেনে চেপে। স্টেশনে নেমে হাঁটেন কর্মস্থলের দিকে। পরনে আধ ময়লা শাড়ী, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, হাঁটেন খুব দ্রুত। দেরী হলে আবার গিন্নীমারা বকাবকি করবেন। লাফিং ক্লাবের পাশ দিয়ে যাবার সময় এঁরা বাবুদের কান্ডকারখানা দেখে হেসে কুটিপাটি হন। সমবেত কন্ঠের সেই খিলখিলে হাসি মাঝে মাঝে বাবুদের অট্টহাসিকে ছাপিয়ে ওঠে। এক দিন লাফিং ক্লাবের এক বাবু একটু বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই হাসছিস কেন রে?”
 
সামনে দিয়ে যাচ্ছিল একটি অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মেয়ে, বেশ হাজির জবাব, গলা তুলে উত্তর দিল, “আমরা তো তোমাদের কান্ড কারখানা দেখে হাসতেছি বাবুরা, কিন্তু তোমরা যে বিনি কারণে হাসতিছো ...।

এক ভদ্রলোক, বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি, একা আসেন, ধীর গতিতে। পরনে অত্যাধুনিক ‘শর্টস’ – অনেক গুলো পকেট ওয়ালা, পায়ে বেশ দামী স্পোর্টস শু বা স্নিকার, রঙিন টি-শার্ট, মাথায় কায়দার টুপি, কিন্তু অত্যন্ত ব্যাজার মুখ, দেখে মনে হয়, জোর করে বাড়ির লোকেরা হাঁটতে পাঠিয়েছে। ভদ্রলোক কারও সঙ্গে কথা বলেন না, এবং কেউ আলাপ করার চেষ্টা করলে মুখ ঘুরিয়ে নেন। লেকের এক কোনায় বসে চুপচাপ খবরের কাগজ পড়েন;  মিনিট চল্লিশেক পর আবার ধীর গতিতে বেরিয়ে যান। এক দিন ওনার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল এক চায়ের দোকানে। গোল পার্কের এক কোনায় একটি পুলিস ব্যারাক আছে, পাশে স্টেট ব্যাংকের একটি শাখা। সামনের ফুটপাথে সারি সারি চায়ের স্টল। আমি হেঁটে ফেরার পথে সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুরিতে চা খাই। এলাচ সহ গরম গরম সেই চা বড়ই সুঃস্বাদুএক দিন দেখি পাশের স্টলেই সেই ব্যাজার মুখো ভদ্রলোক; আমাকে দেখেই খবরের কাগজে মুখ ঢেকে ফেললেন। আমিও পেছন ফিরে ওনার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চায়ে মন দিলাম। কিছুক্ষণ পর শুনলাম ভদ্রলোক খুব নীচু গলায় বলছেন, “ডিম গুলো টাটকা তো?” – “হ্যাঁ স্যার, কাল রাতেই কিনেছি, পোল্ট্রি থেকে” – “দেখি একটা ওমলেট বানাও তো ভাল করে। ভাল তেল আছে তো?” – “হ্যাঁ স্যার” চা ওয়ালা একটা নামী কোম্পানির বোতল দেখায় – “ঠিক আছে, বেশি তেল দিও না কিন্তু; আমার আবার একটু প্রেশার আছে। ও কি, একটা ডিম দিচ্ছ না কি? একটা ডিমে কি ওমলেট হয়? দুটো দাও, নুন বেশি দিও না, বল্লুম না প্রেশার আছে” – “ঠিক আছে স্যার, ...... আর কিছু?” – “টোস্ট দাও দুটো, মাখন আছে?” – “হ্যাঁ স্যার আমুল” চা ওয়ালা একটা ছোট প্যাকেট তুলে দেখায়। “ঠিক আছে, সামান্য এ-এ-একটু মাখিয়ে দাও আর ওপরে তোমার সেই মোটা দানা চিনি ছিটিয়ে দিও, সামান্য, আমার আবার শুগারও আছে বুঝলে”।

ভদ্রলোককে প্রায়ই দেখি, হয় লেকের এক কোনায় বসে কাগজ পড়ছেন কিংবা ঐ চায়ের স্টলে ব্রেকফাস্ট করছেন। কোনও দিন হাঁটতে দেখিনি।

নিউ জার্সি
৪ অগাস্ট ২০১৩

Sunday 4 August 2013

আশঙ্কা


-        কি করছিস?
-        আরে আয়, অফিস থেকে সোজা না কি? টাই-টাও খুলিস নি এখনও
-        ও হ্যাঁ তাই তো, খেয়ালই করি নি, দাঁড়া খুলি আগে; - জয় টাই-এর নটে হাত দেয়
-        থাক না, বেশ ভালই তো লাগছে – এ কি খুলে ফেললি?
-        তুই কি করছিস, একা একা বাড়িতে? গীতা মাসী কোথায়?
-        মা’র কলেজের এক বন্ধুর মেয়ের আশীর্বাদ আজকে, সেখানে গেছে, ফিরতে একটু দেরি হবে
-        আর মেসোমশাই?
-        বাবা গত কাল চেন্নাই গেছে, কাজে। পরশু ফিরবে। অফিস থেকে সোজা আসছিস, চা খাবি তো?
-        কে বানাবে? তুই?

-        হ্যাঁ, এক কাপ চা বানাতে কি? এক্ষুনি করে দিচ্ছি; - নীলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়
-        না বোস তো, এখন চা বানাতে হবে না। আমি এলাম একটু আড্ডা মারতে আর উনি চললেন চা বানাতে
-        অফিস থেকে সোজা এসেছিস আড্ডা মারতে, আমার সঙ্গে। বাবা, তোর সব ইয়ার দোস্তরা কোথায় গেল?
-        ওরা সব সন্ধ্যে বেলা বাড়ি আসবে বলেছে, তাই ভাবলাম তোর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। কাল সকালে দিল্লী ফিরছি।
-        সে কি রে? এখানকার কাজ হয়ে গেল?
-        হ্যাঁ রে
-        ছুটী নে ক’দিন
-        না রে। বসের সঙ্গে এসেছি তো, সঙ্গেই ফিরতে হবে
-        ক’টায় ট্রেন তোর?
-        কাল ভোরের ফ্লাইট
-        ও তাই তো! – হেসে ফেলে নীলা – তুই তো এখন হাই ফ্লাইং এক্সিকিউটিভ!
-        দুর দুর – মোটে তো এক বছর হল সবে, বসের সঙ্গে এসেছি বলেই; যাক গে, বাজে কথা রাখ। তুই কবে ফিরছিস?
-        আজ সোমবার, আমি পরের মঙ্গলবার রওনা হচ্ছি, বুধবার পৌঁছব
-        এত তাড়াতাড়ি কলেজ খুলে গেল
-        না কলেজ খুলতে দেরি আছে; আসলে ফাইনাল ইয়ার তো, কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে হবে। নইলে পরে প্রেশার পড়বে খুব।
-        এর পর কি করবি?
-        ভাবছিলাম তো মাস্টার্স করব, দেখি ...
-        গীতা মাসীর তো অন্য প্ল্যান, মা বলেছে – এক গাল হাসে জয়
-        তাই? সত্যিই ভীষণ বাড়াবাড়ি শুরু করেছে মা। বাবা কিন্তু আমার দলে
-        সব ঘ্যামা ঘ্যামা সম্বন্ধ আসছে শুনলাম। উচ্চ শিক্ষিত, পিএইচডি, রোজগেরে, সুদর্শন...
-        ঠিকই শুনেছিস, কিন্তু সবাই বিদেশে থাকে জানিস তো? আমেরিকা আর ক্যানাডা; এক জন আবার স্কটল্যান্ডে ডাক্তার
-        ও বাবা এ তো সবই বিরাট সুপাত্র রে, রাজি হয়ে যা
-        চুপ কর তো, আমি মরছি ফাইনালের টেনশনে আর উনি এলেন ঘটকালি করতে
-        আমাকে কিন্তু একটু আগে থাকতে জানাস, আমি যে করেই হোক, ছুটি নিয়ে আসবই
-        আমি মোটেই বিদেশে যাব না; আমার অনেক প্ল্যান আছে।
-        কি রকম?
-        মাস্টার্স করব, পিএইচডি করব, পড়াব; ডঃ নীলা সেনের ক্লাস আজ, ছাত্ররা সব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে।।
-        সে টা তো বিয়ের পরেও করতে পারিস…
-        এই দেখ জয়, আমার কিন্তু এই টপিকটা ভাল লাগছে না
-        ঠিক আছে, আমি একটা পরামর্শ নিতে তোর কাছে এসেছি।
-        আমার কাছে? পরামর্শ? প্রেমে টেমে পড়েছিস না কি?
-        অনেকটা সে রকমই – একটু থেমে থেমে বলে জয়…
-        সে  কি  রে? - সোফার ওপরে প্রায় লাফিয়ে ওঠে নীলা – একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে, জয় বাবু প্রেম করছে! সুর্য কি পশ্চিম দিকে উঠল?
-        এ রকম বলিস না, - জয় একটু দমে গেল – একটা প্রবলেমে পড়ে তোর কাছে এসেছি
-        প্রবলেম? এতে আবার প্রবলেম কি আছে?
-        আসলে … মানে কি করে যে তোকে বোঝাই, জানিস তো আমাকে, এ সব ব্যাপারে আমি বেশ হাঁদা, মেয়েদের সঙ্গে ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।
-        তা তো দেখতেই পাচ্ছি…
-        আরে তোর কথা আলাদা; তুই তো সেই ছোট্ট বয়স থেকে আমার খেলার সাথী, বন্ধু। তোর জন্মের সময় আমার বয়স ছিল এগারো মাস।
-        আচ্ছা ঠিক আছে। সিরিয়াস। বল কি হয়েছে?
-        কাউকে বলবি না তো?
-        আরে বাবা না। প্রমিস
-        আমার না এক জন কে ভাল লাগতে শুরু করেছে
-        বেশ তো। এর মধ্যে প্রবলেম কোথায়?
-        আসলে …।
-        মীরা মাসীকে বলতে হবে। নো প্রবলেম। আমি কালই বিকেলে গিয়ে ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করব। তুই আমাকে সব ডিটেলস গুলো দে…
-        আরে নারে বাবা। এত সহজ নয়
-        কেন?
-        আমি তো মেয়েটা কি চায় তাই বুঝতে পারছি না
-        তো জিজ্ঞেস কর… গিয়ে সোজা বল, এর মধ্যে সঙ্কোচের কি আছে?
-        অনেক বার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সামনে দাঁড়ালেই সব কি রকম গন্ডগোল হয়ে যায়…
-        হুমমমম , তুই শুধু হাঁদাই নোস, রাম হাঁদা…মেয়েটা কি দিল্লীরই মেয়ে? বাঙালী?
-        অ্যাই, নো প্রশ্ন।
-        আমায়ও বলবি না… একটু রাগ দেখায় নীলা
-        বলব। ব্যাপারটা যদি দাঁড়িয়ে যায়, তবে তোকে সব চেয়ে আগে বলব। কথা দিলাম।
-        ঠিক আছে। একটা আইডিয়া আসছে মাথায়
-        কি?
-        মেয়েটার ঠিকানা জানিস?
-        হ্যাঁ জানি
-        চিঠি লেখ
-        চিঠি? কি লিখব?
-        সোজাসুজি লেখ যে, “তুমি এই চিঠি পড়ে খুব অবাক হবে। কিন্তু আমি অনেক দিন থেকে তোমাকে একটা কথা জানাবার চেষ্টা করছি।  কিন্তু সঙ্কোচ করে জানাতে পারছি না। তোমাকে না আমার খুব ভাল লাগে। আমি শুধু এই টুকুই জানতে চাইছিলাম যে তুমি আমার সম্বন্ধে কি ভাবো।” --…ব্যস। এর বেশি কিছু লেখার দরকার নেই। আর বেশি ইনিয়ে বিনিয়ে লিখতে যাস না। তুই পারবিও না।
-        লিখব?
-        হ্যাঁ লেখ। দেরি করিস না। দেরি করলে পরে পস্তাবি।
-        যদি রেগে যায়?
-        না রে রাগবেনা। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি। তুই তো একটা ভদ্র ছেলে। মেয়েটা রাজি হবে কি না আমি জানি না। তবে ফ্ল্যাটার্ড হবে আমি হলফ করে বলতে পারি।
-        লিখব বলছিস?
-        হ্যাঁ, তবে বাংলায় লিখবি না ইংরিজিতে সেটা তোকে  ঠিক করতে হবে। আমাকে তো আসল খবর কিছুই দিলি না। ঠিক আছে। কথা দিয়েছিস, সব চেয়ে আগে আমায় জানাবি।
-        একদম পাক্কা। আজ চলি তবে।
-        আয়। ই-মেল দিস। আর বেস্ট অফ লাক – এক গাল হাসে নীলা
-        থ্যাংক ইউ --- একটু হেসে বেড়িয়ে যায় জয়

নীলা জানলার পর্দা সরিয়ে অনেকক্ষণ দেখে জয়কে। গট গট করে এগিয়ে চলেছে। এক বারও পেছন ফিরে তাকালো না। হঠাৎ বুকটা ভারি হয়ে আসে নীলার। গলার ভেতরে কি যেন একটা জমাট বেঁধে উঠছে। অকৃতজ্ঞ, সেলফিশ একটা। মনটা খারাপই লাগছে। আর কি দেখা হবে জয়ের সঙ্গে?

তাড়াতাড়ি পা চালায় জয়। নীলার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি দশ মিনিটের হাঁটা পথ। রাস্তায় একটা স্টেশনারি দোকান থেকে এক বাহারি রাইটিং প্যাড আর খাম কিনল। নীলাকে মিথ্যে কথা বলেছে, ইয়ার দোস্ত কেউ আসবে না বাড়িতে। এখন বাড়ি পৌঁছে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে চিঠি লিখতে বসবে জয়। জীবনের প্রথম প্রেমপত্র। লিখে খামে ভরে রাখবে রাত্রে শুতে যাবার আগে। কাল সকালেই এয়ারপোর্টের পোস্ট অফিসে পোস্ট করবে। কাল মঙ্গলবার। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র; তিন দিনেই পৌঁছে যাবে চিঠি। এই ভাল। ই-মেলের থেকে হাতে লেখা চিঠি অনেক বেশি আন্তরিক।

নীলা হস্টেলে পৌঁছবে আগামী বুধবার। গিয়েই পেয়ে যাবে জয়ের চিঠি। ভয় নেই। রেগে যাবে না। কথা দিয়েছে নীলা।
 
নিউ জার্সি- ৪ অগাস্ট ২০১৩