এক কিশোরী পাঠিকার অনুযোগ, “লেক নিয়ে কত কথা লিখলেন কিন্তু কোনও প্রেমিক যুগলকে
নিয়ে লিখলেন না তো?”
“কিন্তু আমি তো প্রাতঃভ্রমন নিয়ে লিখেছি। ভোর বেলার কথা। তখন তো লেকে শুধু স্বাস্থ্যান্বেষীরা যান। প্রেমিকেরা তো সন্ধ্যের দিকে যায়, যখন লেক
ফাঁকা হয়ে আসে। সেই সময়ে আমি থাকি না”
শুনে
খুশি হল না মেয়েটি,-
“কেন? লেক থেকে ফেরার পথে দেখলে তো
পারতেন, দুই-বিনুনি করা মেয়েটি আর সদ্য গোঁফ গজানো ছেলেটি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে,
যাচ্ছে গানের দিদির কাছে গান শিখতে। বাস্, প্রেম শুরু। হতে পারে তো?”
উত্তর ছিল না আমার কাছে। অত সকালে দিদিমনিরা কি গান শেখান? তা ছাড়া আজকালকার প্রেমিক যুগলদের আমি চিনতে পারি না।
দুটি ছেলে মেয়ে দিব্যি তুই তোকারি করতে করতে চলেছে; হাঁটা চলায় সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস, চোখে মুখে কোনও উদ্বেগের ছাপ নেই। কি করে বুঝব যে প্রেমিক প্রেমিকা?
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল আমাদের
জমানায়। তখনও প্রেমিক প্রেমিকারা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত। কিন্তু চোখে মুখে একটু
উদ্বেগের ছাপ, দৃষ্টি সতর্ক, - “এই ফুলুমাসী
আসছে, তুমি পাশে হেঁটো না, একটু এগিয়ে যাও। উলটো ফুটপাথে চল, সামনে ভোম্বলকাকু দাঁড়িয়ে আছে”। প্রচন্ড বিধিনিষেধ। বিশেষ করে মেয়েদের।
কে কখন দেখে ফেলবে আর লাগিয়ে দেবে মায়ের কাছে, বাস্ কাল থেকে বেরনো বন্ধ, - ছোড়দা
পৌঁছে দেবে গানের ক্লাসে, অফিস থেকে ফিরে বাবা গিয়ে নিয়ে আসবে। তার থেকে অনেক নিরাপদ সেই সব জায়গায় দেখা করা যেখানে ঐ
সব মাসী, মামারা থাকেন না। যেমন দুপুর বেলা ময়দানের গাছতলা,- সঙ্গে চিনেবাদাম। সন্ধ্যেবেলা লেক, যখন আবছা অন্ধকারে দূর থেকে কেউ চিনতেও পারবে না।
যারা একটু দুঃসাহসী, তাদের জন্য ছিল স্যাঙ্গুভ্যালির পর্দা ঢাকা কেবিন বা কোন ফ্লপ
সিনেমার খালি হলের ম্যাটিনি শো। তখন কোথায় ক্যাফে কফি ডে
আর কোথায় শপিং মলের ফুড কোর্ট। আর পকেট তো গড়ের মাঠ।
ফুলুমাসী,
ভোম্বলকাকুরা এখন সব বিলুপ্ত প্রজাতি। তাঁদের জায়গা নিয়েছেন মিষ্টি-মাসী আর সেন-আঙ্কেলরা।
বেশ বুক ফুলিয়ে এঁদের সামনে দাঁড়ানো যায়, “হাই মিষ্টি-মাসী শপিং করতে বেড়িয়েছ? এ
হচ্ছে রনি,- রনি, আমার মাসী”। রনি একগাল হাসল, “হাই মাসী”। মাসীও হাসলেন, “ও তুমিই
রনি, খুব ভাল গীটার বাজাও শুনেছি? এক দিন যাব তোমাদের ব্যান্ডের গান শুনতে।” মাঝে
মাঝে মনে হয় এই মিষ্টি-মাসীরা কি গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন না নিজেদের যৌবনের
বাধা নিষেধ স্মরণ করে।
টেলিফোনে
প্রেমালাপের জন্য কাঠখর পোড়াতে হত বিস্তর। বাড়ির ফোন বেশির ভাগ সময় “ডেড”, - কেবল-ফল্ট।
তাও সব বাড়িতে ফোন ছিল না। হ্যাঁ, ফোনের অ্যাপ্লিকেশন করা ছিল; কিন্তু ফোন কবে
পাওয়া যাবে তা শুধু ঈশ্বরই জানতেন। রীতিমত উৎসব হত বাড়িতে ফোন এলে। সোজাসুজি ফোনও
করা যেত না, হয়তো ধরবেন প্রেমিকার বাবা নিজেই কিংবা গুঁফো জ্যাঠামশাই, “কাকে
চাই?”। আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। খোশামদ করতে হত ছোট বোনকে, “দে না বাবা, ফোনটা
লাগিয়ে, বলছি তো সিনেমার টিকিট কেটে দেব তোকে আর তোর দুই বন্ধুকে”।
আজকাল
কত সুবিধে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন। ঝটপট টেক্সট মেসেজ। মা বাবারা কত উদার। অর্থনৈতিক
উন্নতি হয়েছে দেশের; ছেলে মেয়েদের পকেটও বেশ ভারি।
আজকাল
ছেলেমেয়েরা কি ভাষায় কথা বলে তাও জানি না। ওদের নিয়ে লিখব কি? তবে হ্যাঁ একটু
আন্দাজ করেছিলাম নবীন সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর কল্যাণে। দেশ পত্রিকায়
ধারাবাহিক বেরোচ্ছিল “পালটা হাওয়া”। পেশাগত কারণে সময় পেতাম না বইটই পড়ার। গিন্নী
পড়তেন নিয়ম করে। খুব পছন্দ হলে সুপারিশ করতেন। গিন্নীর প্রস্তাবেই পড়তে শুরু করি
এবং পুরো মগ্ন হয়ে যাই লেখকের মুন্সীয়ানায়। এক সময় মনে হচ্ছিল এক নতুন প্রতিভার
“আত্মপ্রকাশ” পড়ছি। গল্পের নায়ক রীপ, নায়িকা মৌনিকা। অভিনব নাম। তাদের ভাষা,
জীবনযাত্রা, সম্পূর্ণ অপরিচিত। গল্পের শুরু থেকেই নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ। মাঝে মাঝে
ফ্ল্যাশব্যাকে বলা হচ্ছে তাদের সোনালী দিনগুলোর কথা। ধীরে ধীরে বেশ জড়িয়ে পড়লাম
গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে। এক সময় তো এমন অবস্থা হল যে গিন্নীকেই শাসালাম,
“উপন্যাসের শেষে যদি রীপ আর মৌনিকার মিলন না হয় তবে এই লেখকের আর কোনও বই আমি
স্পর্শও করব না”। যাক গে, শেষে দু-জনের মিলন ঘটিয়েছিলেন লেখক।
একটু
বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আমার পরিচয় ঐ পালটা
হাওয়ার মাধ্যমেই।
সব
শেষে সত্য ঘটনা অবলম্বনে একটা গল্প বলি।
গড়িয়াহাট
মোড়ের সন্ধ্যেবেলাগুলো ছিল খুব রোমান্টিক। ফুরফুরে হাওয়া, সারি সারি ঝলমলে দোকান
পাট, হকারের দৌরাত্ম ছিল না, ছিল না বিশাল কদর্য এক উড়াল পুল। চার দিকে ছিল আলাদা
আলাদা আড্ডা, বেশির ভাগই কলেজের ছাত্র আর কিছু সদ্য চাকরিতে ঢোকা কিছু এলেজিবল
ব্যাচেলরের দল। আমাদেরও একটা আড্ডা ছিল। আমরা তখন ফাইনাল ইয়ারে, বেশ একটা মস্তান
মস্তান ভাব। প্রায় প্রত্যেক দিনই দেখতাম তিনটি মেয়ে, দেখেই মনে হয় কলেজে পড়ে,
হেঁটে বাড়ি ফিরত। বন্ধুদের একজনের, ধরা যাক তার নাম সঞ্জয়, একটি মেয়েকে খুব পছন্দ
হয়ে গেল। কিন্তু আলাপ করে কি করে? সাহস নেই যেচে গিয়ে কথা বলার। রোজ মেয়ে তিনটি
হেঁটে চলে যায়, সঞ্জয়ের সাহস আর হয় না। আস্তে আস্তে শুরু হল টিটকিরি, “হিম্মত নেই,
এসেছো প্রেম করতে”? একদিন খেপে উঠল সঞ্জয়। মেয়ে তিনটি অন্যদিনের মতই হেঁটে চলে
গেল, হঠাৎ দেখি সঞ্জয়ও চলেছে পেছন পেছন। মনে হল যেন ডাকল মেয়েটিকে। আশ্চর্য,
মেয়েটিও দাঁড়াল। সঙ্গের মেয়ে দুটিও দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু চার কদম এগিয়ে। সঞ্জয় কথা
বলল মেয়েটির সঙ্গে মিনিট পাঁচেক। সেই গল্পের শুরু। সে গল্প শেষ হয় নি আজও। বছর চারেক
আগে ওদের নাত্নীর অন্নপ্রাশনে গিয়েছিলাম। খুব হৈ চৈ হল। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“সেদিন কি কথা বলেছিলিরে তোরা”?
দু-জনেই
হাসল, বলল “মনে নেই”।
২০
অগাস্ট ২০১৩
No comments:
Post a Comment