আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফাইনাল ইয়ারে। বেনারস হিন্দু
ইউনিভার্সিটি। নতুন সেশন শুরু হয়েছে। আর একটা বছর পার করলেই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরবো। বেশ
একটা মস্তান মস্তান ভাব। হাজার হোক কলেজে আমরা সবচেয়ে সিনিয়র। নতুন সেশন, যথারীতি
ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের র্যাগিং চলছে। আমাদের সময় কিন্তু র্যাগিংটা ছিল একটা হালকা
মজা; আজকাল যে সব বীভৎস ঘটনা শুনি তা আমাদের সময় অকল্পনীয় ছিল। অঘটন যে একেবারেই
ঘটত না তা নয়, কিন্তু সে ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ খুব কড়া ব্যবস্থা নিতেন।
জুলাই মাসের ৯ তারিখে ক্লাস শুরু হত আমাদের। রবিবার পড়লে ১০
তারিখ। মোটামুটি মাস খানেক ধরে চলত র্যাগিং। ১৫ই অগাস্ট থেকে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের
স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেওয়া হত। অগাস্টের প্রথম দিকের এক রবিবার বিকেলে আমাদের
হস্টেলের কমন রুমে সব ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের জড়ো করা হয়েছে। ফাইনাল র্যাগিং,
প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করে দেখাবে, গান, শের শায়েরি, আবৃত্তি, অভিনয় যা খুশি।
যারা পারবে না তাদের হলের একটা কোনে দেয়ালের দিকে মুখ করে, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে
হবে।
এক এক করে সব ছেলের নাম ডাকা হচ্ছে। বেশ জমে উঠেছে। বেশ
কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটির জামা কাপড় বেশ মলিন, চেহারায় একটা নিষ্পাপ
সারল্য, দেখে মনে হয় কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছে। যথারীতি নিজের পরিচয় দিল;
হিন্দিতে। আমাদের সহপাঠী কয়েক জনের ইংরিজি প্রশ্নের উত্তরে সবিনয়ে জানাল, “ক্ষমা
কিজিয়েগা, মুঝে অংরেজি নহি আতী”। “তব কয়া আতা হ্যায়”। ছেলেটি
মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মনে হল এই পরিবেশের সঙ্গে ও একদম মানিয়ে নিতে পারছে
না। চারিদিকে সিনিয়রদের ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, তার মাঝে ফার্স্ট
ইয়ারেরই আরেকটি ছেলে, বোধহয় বন্ধুর করুণ অবস্থা আর সহ্য করতে না পেরে পাশ থেকে বলে
উঠল, “উসে গানা আতা হ্যায়”। ছেলেটিকে
জিজ্ঞেস করতে সে বলল, “কোই খাস নহি”। আমরা বললাম, তোমাকে গাইতেই হবে।
কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটি। দেখে মনে হল
হয়তো বা গাইবার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু গুনগুন করে সুরটা ঠিক করে নিল। তারপর হঠাৎ
গলা ছেড়ে ধরল, ‘পুছো না কৈসে মৈনে রৈন বিতায়ী’, সে একবারে অবাক করা এক মসৃন গলা আর
তেমনি সুরের জাদু। ধীরে ধীরে যখন গলা উঠল, ‘উতজল দীপক, ইত মন মেরা, ফির ভি না জায়ে
মেরা ঘরকা অন্ধেরা’ আবার নেবে এল, ‘তড়পত-তরসত উমর গওয়াই’ – মনে হল যেন ঘরের মধ্যে সুর ভাসছে। গান শেষ হল, চারিদিক
নিঃস্তব্ধ কয়েক সেকেন্ড। তারপর পুরো কমন রুম ফেটে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে আমরা হাততালি
দিলাম। কয়েক জন গিয়ে তো জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। তারপর যা হয়, ‘ঔর এক সুনাও’। ছেলেটি
ততক্ষণে বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। একে একে গাইল, ‘দিলকা হাল সুনে দিলওয়ালা, অ্যায় মেরে
প্যারে ওয়াতন, কৌন আয়া মেরা মনকে দ্বারে, ইয়ে রাত ভিগি ভিগি, তু প্যার কা সাগর
হ্যায়, আ জা সনম মধুর চান্দনিমে হম’ – আসর জমে গেল। মাঝখান থেকে পরের ছেলেগুলোকে
আর কিছুই করতে হল না। অনুরোধের পর অনুরোধ। এক সময়, রফি, কিশোর আর মুকেশের গানও
গাইতে বলা হল। আর তখনই ছেলেটি হঠাৎ বেঁকে বসল। মাথা নীচু করে মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায়
ঘোষণা করল, ‘ম্যায় ঔর কিসিকা গানা নহি গাতা’। আশ্চর্য, ছেলেটি মান্না দে ছাড়া কারও
গান গাইবে না। কিছুতেই না। শুধু বলল ‘সবকো সম্মান করতা হুঁ, লেকিন গানা সির্ফ
মান্নাজীকা-হি গাতা হুঁ’। সাংঘাতিক গোঁ, একেবারে গাঁওয়ার যাকে বলে। আমরা জিজ্ঞেস
করলাম তুমি কি শুধু মান্না দের ফ্যান। ছেলেটা উত্তরে বলল না আমি সবার ফ্যান, সবার
গান শুনি। কিন্তু মান্নাজীর আমি ফ্যান নই, ভক্ত পুজারী।
সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ হল। ছেলেটি খুবই মুখচোরা, খুব একটা
দেখা হত না। ওর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে খোঁজ খবর নিতাম। শুনলাম ছেলেটি পড়াশোনা
নিয়েই ব্যস্ত থাকে; শুধু কলেজ আর হস্টেল, হস্টেল আর কলেজে। কলেজের বাৎসরিক
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবার দেখলাম। স্টেজে উঠে দুটো গান গাইল, - পুছোনা কৈসে আর
লগা চুনরিমে দাগ। সে কি সুরের মুর্চ্ছনা; কলেজের রাশভারী প্রফেসরদের দেখলাম গম্ভীর
মুখ কিন্তু গানের সুরে সুরে দুলছেন।
দেখতে দেখতে বছর প্রায় শেষ হয়ে এল। পরীক্ষার আর মোটে দুমাস
বাকি। জোর কদমে চলছে পড়াশোনা, হাজার হোক ফাইনাল ডিগ্রির ব্যাপার, একদম ফাঁকি দেওয়া
চলবে না। এক রবিবার কলেজের লাইব্রেরিতে কিছু রেফারেন্স বই থেকে নোটস নিচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ
পর মনে হল কলেজ ক্যান্টিন থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসা যাক। ক্যান্টিনে ঢুকে দেখি সেই
ছেলেটি, এক কোনায় একা বসে এক খাতা থেকে অন্য খাতায় কিছু টুকছে। বোধহয় কোনও ক্লাসে
যেতে পারেনি, সহপাঠীর নোটস দেখে লিখে নিচ্ছে। আমি এক কাপ চা নিয়ে সোজা ছেলেটির
সামনে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ আমাকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল। বললাম অনেক দিন
থেকেই তোমার সঙ্গে একটু কথা বার্তা বলব ভাবছি। ছেলেটি দেখলাম আগের থেকে অনেকটা
সাবলীল এবং আত্মবিশ্বাসী, বেশ ইংরিজিও বলছে মাঝে মাঝে। আমি ওকে বললাম যে আমিও
মান্না দের একজন খুব বড় ফ্যান। শুনে ছেলেটি হাসল। আমি বললাম তুমি কি জানো যে
মান্না-জী বাংলাতেও প্রচুর গান গেয়েছেন এবং জবরদস্ত সব গান। শুনে ছেলেটি গম্ভীর
হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরুর গায়ে হোঙ্গে”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সুননা
চাহোগে?” ছেলেটি বলল নিশ্চয়ই, “সিখনা ভি চাহুঙ্গা”। আমি বললাম তোমাকে কি আমি দু একটা রেকর্ড কিনে দেব।
ছেলেটি তখন একটু ম্লান হেসে ওর পুরো পারিবারিক পরিস্থিতির কথা জানাল।
বলল যে রেকর্ড বাজিয়ে শোনার আর্থিক ক্ষমতা ওর নেই। গরীব
কিসানের ছেলে। বাবার মতের বিরুদ্ধে পড়তে এসেছে। স্কুলের মাস্টারজীরা জোর করে পড়তে
পাঠিয়েছেন। বাপু অনেকবার স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছিলেন। মাস্টারজীরা রুখে
দাঁড়িয়ে আটকেছেন। সেকেন্ডারি পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করায় স্টেট
স্ক্ললারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছে। বাপুর ভয়ে ছুটিতে নিজের গাঁও পর্যন্ত যায় না, পাশে
গ্রামে মামার বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রেকর্ড প্লেয়ার কেনা তো দুরের কথা গ্রামে
বিজলীও নেই।
কথা শেষ করে হঠাৎ খাতাটা খুলে আমাকে বলল, “দো চার লাইন হমে
বাতাইয়ে ম্যায় লিখ লেতা হুঁ, একদিন খুদ ম্যায় খরিদ লুঙ্গা”। আমি সে যুগের কয়েকটি গানের লাইন আমার বেসুরো
গলায় ওকে শোনাই,- ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভাব তরঙ্গে”, রাধা চলেছে মুখটি
ঘুরায়ে, ইত্যাদি। ছেলেটি সযত্নে লাইন গুলো লিখে নেয়। তারপর স্বপ্নাদিষ্ট চোখে
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে একদিন মান্না-জীসে মৈ জরুর মিলুঙ্গা।
এর পর আর কোনও দিন দেখা হয় নি ছেলেটির সঙ্গে। নামটাও ভুলে
গেছি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না। এখন কোথায় আছে কে জানে? যে সময়কার কথা বললাম তখন
ফার্স্ট ইয়ার আর ফাইনাল ইয়ারের মাঝে তফাৎটা খুব বেশি মনে হত। কিন্তু এখন এই বয়সে
তিন চার বছরের ব্যবধানটা খুবই গৌন। সেও তো এখন আমার মত একজন প্রবীণ নাগরিক। মান্না
দের বাংলা গানগুলো কি সংগ্রহ করেছিল? কে জানে?
মান্না-জীর সঙ্গে কি ওর দেখা হয়েছিল? তাও জানি না। যদি না
হয়ে থাকে তবে আর হবেও না কোনও দিন।
কোলকাতা – ২৪ শে অক্টোবর ২০১৩
No comments:
Post a Comment