Saturday 6 January 2018

ভ্রান্তিবিলাস – এ যুগে

আচ্ছা দু-জন মানুষের কি এক চেহারা হতে পারে? আমি যমজ ভাই বোনদের কথা বলছিনা। আমি বলছি দু’টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অনাত্মীয় মানুষের কথা। আমরা যে সব কাহিনী টিভিতে বা সিনেমায় দেখি, - এই যেমন, উত্তম কুমারের ঝিন্দের বন্দী বা দেব আনন্দের হম দোনো। অদ্ভূত ব্যাপার, তাই না? এ সব ঘটনা বাস্তব জীবনে কখনও ঘটে না বলেই সবার ধারণা। কিন্তু আমার জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে আমার মনে হয় আমার মত চেহারার এক বা একাধিক লোক এই শহরেই আছে।

প্রথম থেকেই বলি।

আজ থেকে বছর ষাটেক আগের কথা। আমি তখন স্কুলে। বয়স ১০ বা ১২। আসামে থাকতাম। বাবার চাকরি ছিল সেখানেই। আমার ও আমার ছোট বোনের পূজোর ছুটি শুরু হলে বাবাও ছুটি নিতেন। আমরা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসতাম। এসে উঠতাম রাজাবাজারে আমার কাকার বাড়ি। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে বালিগঞ্জের ফার্ন রোডে আমার বড়ো পিসীমার বাড়ি। তারপর ক’দিন পর চুঁচুড়ায়, - আমার জন্মস্থান ও মাতুলালয়। সেখানে খুব ধুমধাম করে পূজো হত। পূজো শেষ হলে আবার কলকাতায়। আবার বড়ো পিসীমার বাড়ি, কাকার বাড়ি হয়ে ফেরত।

পিসীমার সহকারী ছিলেন হরিকাকা। হরিকাকা বহুদিন ধরে পিসীমার পরিবারে। তিনি সবার হরিকাকা। পিসেমশায়, আমার পিস্তুতো দাদা ও দিদি, আমার মা ও বাবা ও আমাদেরও তিনি হরিকাকা। তাঁর বয়স কেউ জানত না, একটু ন্যুব্জ, কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণকায় চেহারা। তাঁর তত্ত্বাবধানে আমার  বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। একদিন সকালে আমি হরিকাকার সঙ্গে বাজারে গেছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি, হরিকাকার শক্ত হাতে আমার হাত। এমন সময়, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোক, ফর্সা, লম্বা দোহারা চেহারা, পরনে ধবধবে ধুতি ও পাঞ্জাবী, আমায় দেখে একগাল হেসে বললেন ,- একি? তোমরা কলকাতায়? কবে এসেছো? মা, বাবা, বোন সবাই এসেছেন নিশ্চয়ই। আমি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির। অচেনা  লোক দেখে বাক্যিহারা হয়ে যাই, মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভদ্রলোকের আবার প্রশ্ন, - কেমন লাগছে কলকাতা? আমি মিনমিন করে বললাম, - ভাল লাগছে। এর পরের প্রশ্নে আমি একেবারে দিশাহারা। উনি জিজ্ঞেস করলেন, - দিল্লী থেকেও ভাল? দিল্লীতে আমার এক মাসী থাকতেন, সেখানে একবার যাওয়ার কথাবার্তা চলছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমি কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক আবার বললেন, - কি? দিল্লী ভাল না কলকাতা ভাল? আমি মিনমিন করে বললাম, - কলকাতা। ভদ্রলোক খুশি হয়ে থুতনি ধরে আদর করে চলে গেলেন। এর পর অবশ্য ওনার সঙ্গে দেখা হয়নি। উনি নিশ্চয়ই অন্য কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়েছিলেন।

পরবর্তী ঘটনা ঘটে অনেক দিন পরে। আশির দশকের প্রথম দিকে। বাবা কাজ থেকে অবসর নিয়ে তখন কলকাতায়। আমি সদ্য চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছি এক বছর আগে। প্রথম ছুটিতে দেশে ফিরেছি। খুব ফুরফুরে মেজাজে। কলকাতা পৌঁছেই বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে যোগাযোগ করছি। প্রথম ফোন করলাম দেবু মানে দেবরাজের বাড়ি। ফোন ধরল রত্না, দেবুর স্ত্রী। দেবুর মা হাসপাতালে। দেবু ছুটি নিয়েছে। ডাক্তার, বদ্যি, ওষুধ-পত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত। রত্না জানাল দেবুর বাড়ি আসার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে ভিজিটিং আওয়ারে হাসপাতালে গেলে দেখা হবে। রত্না জানিয়ে রাখবে আমার কথা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাসীমা খুব স্নেহশীলা। ছাত্রজীবনে অনেকবার দেবুর বাড়ির ছাদে আড্ডা মেরেছি। মাসীমা দফায় দফায় চা, জলখাবার পাঠাতেন।

ভাবলাম হাসপাতালে একা না গিয়ে আরও কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই। অনিন্দ্যকে ফোন করলাম। অনিন্দ্য ব্যস্ত মানুষ। এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কম বয়সে খুব উন্নতি করেছে। শহরের কয়েকটি তথাকথিত অভিজাত ক্লাবের সদস্য, গলফ-টলফ খেলে। পরের দিন রবিবার। অনিন্দ্য জানালো বিকেলের দিকে আমরা হাসপাতালে যাবো একসঙ্গে। ওকে ওর ক্লাব থেকে তুলে নিতে হবে, ওর ব্রিজ ম্যাচ আছে। ওর গাড়ি থাকবে না। গাড়ি নিয়ে শ্বেতা, মানে ওর স্ত্রী, বন্ধুদের নিয়ে শপিং-এ যাবে।

পরের দিন বিকেলের দিকে একটি গাড়ি ভাড়া করে আমি অনিন্দ্যর ক্লাবে পৌঁছলাম। অনিন্দ্যের নির্দেশ মত ক্লাবের রিসেপশনে গিয়ে ওর নাম বললাম। সেকালে তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা। রিসেপশনের ভদ্রলোক আমায় বসতে বললেন। সামনে কয়েকটি সোফা সাজানো ছিল, - গিয়ে বসলাম। হঠাৎ দেখি বছর পঁচিশের একটি ছেলে, গলায় টাই, বোধহয় ঐ ক্লাবেরই কর্মচারী, আমায় দেখে বলল, - গুড আফটারনুন। স্যর আপনি? আমি একটু ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে আবার প্রশ্ন, - অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম স্যর। আপনি কি এখন এখানে থাকেন না? আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার স্মৃতি হাতরে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কুল কিনারা পাচ্ছি না। মিনমিন করে জানালাম, - না এখন বাইরে থাকি। ছেলেটি একগাল হেসে বলল, - তাই আপনাকে আজকাল ক্লাবে দেখিনা। আমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করার আগেই অনিন্দ্য পৌঁছে গেল। ছেলেটি অনিন্দ্যকেও গুড আফটারনুন জানালো। অনিন্দ্য একটু মৃদু হেসে আমাকে বলল, - চল রওনা হই।

গাড়িতে উঠে অনিন্দ্যকে বললাম। কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বলল, - অন্য কারও সঙ্গে গোলমাল করেছে বোধহয়। যা নন-ডেসক্রিপটিভ চেহারা তোর!

যাক, সংক্ষেপে বলি মাসীমা মানে দেবুর মা সে যাত্রা সেরে উঠেছিলেন।

এবার তৃতীয় ঘটনা।

বছর পাঁচেক আগে কাজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরেছি। গিন্নীকে যথা সম্ভব সাহায্য করছি নতুন সংসার সাজিয়ে নিতে। সাংসারিক ব্যাপারে আমার কোনও রকম সুনাম নেই। যাই হোক, একদিন গিন্নীর দেওয়া লিস্ট পকেটে নিয়ে বাজারে বেরোলাম। আবাসনের পাশে আধুনিক শপিং মল। সেখানে বিশাল এক সুপার মার্কেট। কেনা কাটা করে বিল মেটাতে ডেবিট কার্ড বের করলাম। বিল হয়েছে ৮৩৮ টাকা। পেমেন্ট কাউন্টারের ছেলেটি কার্ড ঢুকিয়ে কি টেপাটেপি করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, - এরর মেসেজ আসছে স্যর। আমি দ্বিতীয় বার চেষ্টা করতে বললাম। এবার কোনও গোলমাল হলনা। বিল পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাগ হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পকেটে মোবাইল ফোন দু-বার কুঁক কুঁক করে উঠল, - বের করে দেখি ব্যাংক থেকে এসএমএস এসেছে, - ৮৩৮ টাকা দু-বার ডেবিট হয়ে গেছে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে দেখালাম। ছেলেটির তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা, - স্যর আপনার সামনেই তো এরর মেসেজ এসেছিল, আপনাকে তো দেখালাম। শেষ অব্দি ছেলেটিই বলল, - ম্যানেজারের কাছে যাই চলুন।

একটি মাঝারি আকারের সুসজ্জিত অফিস ঘরে ম্যানেজার আসীন। মহিলা বেশ আকর্ষণীয়া; বছর পঞ্চাশের মত বয়স। এককালে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন, - স্যর আপনি? বুঝলাম আবার সেই ভ্রান্তিবিলাস। ভদ্রমহিলা এক নাগারে বলে যাচ্ছেন – আমাকে চিনতে পারছেন না স্যর, আমি সেই যে মিউজিকাল ওয়ার্লডে ছিলাম। পার্ক স্ট্রীটে। আপনি ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল রেকর্ড কিনতে আসতেন। নতুন কিছু এলে আমি আপনাকে ফোন করে খবর দিতাম...। পার্ক স্ট্রীটের মিউজিকাল ওয়ার্লডে আমি এক আধবার গেছি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী গানের সিডি কিনতে। পাশ্চাত্য ধ্রূপদী সঙ্গীত আমি কস্মিন কালেও শুনিনি।  আমি একটু দেঁতো হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম এনার সাহায্য যখন দরকার তবে আমার আসল পরিচয় না দেওয়াই ভাল।

ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে এত খুশি হয়েছিলেন যে সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। আমাকে সযত্নে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে উনি বেশ কয়েকটা ফোন করলেন এদিন ওদিক। তিন দিন পর ৮৩৮ টাকা আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেল।

এখনও সেই সুপার মার্কেটে গেলে আমার সঙ্গে দেখা হয় মহিলার। আমি খুব ব্যস্ততার ভান করে পাশ কাটিয়ে সরে যাই।

এর পরের ঘটনা গত পূজোর সময়কার।

অষ্টমীর দিন সকালে কয়েক জন প্রবীণ নাগরিক কলকাতা শহরে বনেদি বাড়ির পূজো দেখতে বেরিয়েছিলাম। সবাই আমাদের আবাসনের। কয়েকটি অচেনা মুখও দেখলাম। আলাপ পরিচয় করে জানতে পারলাম এঁরা কলকাতায় থাকেননা। এঁদের ফ্ল্যাট বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে এখানে এসে ছুটি কাটিয়ে যান। সারা দিন ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে যখন ফিরে আসছি, আবাসনের কাছাকাছি এসে, আমাদের পাশের সীটে বসা দম্পতীর সঙ্গে আলাপ হল। বছর ষাটেক বয়স। প্রেসিডেন্সীতে সহপাঠি ছিলেন। এক সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। এখন দু-জনেই আমেরিকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বিষয় অর্থনীতি। দুই ছেলে সেদেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত।

ওনাদের পরিচয় নিয়ে আমি বললাম, - আচ্ছা এবার আমার পরিচয় দিচ্ছি। তাতে ওঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে ও শুনে আমার ভির্মি খাওয়ার মত অবস্থা। দুজনেই হাতজোড় করে সসম্ভ্রমে বলে উঠলেন, - লজ্জা দেবেন না স্যর, আপনাকে কে না চেনে, - কত অনুষ্ঠানে গান শুনেছি আপনার। আমার তখন হেঁচকি টেচকি উঠে ভয়ঙ্কর অবস্থা। ভাবলাম এ রকম ভাবে চলতে পারেনা। আসল পরিচয় দিয়ে দেওয়া উচিৎ , এবং এখনই। কিন্তু সেই সময়েই আমাদের গাইড বলে উঠলেন আপনাদের বাড়ি পৌঁছে গেছি, এবার আস্তে আস্তে নেমে যান। আমি সামলে উঠে কিছু বলার আগেই ওঁরা বাস থেকে নেমে গেলেন। আমার সঠিক পরিচয় আর দেওয়া হলনা।

পরে খোঁজ খবর করেছিলাম। শুনলাম ওঁরা আমেরিকায় ফিরে গেছেন। সামনের বছর এলেই ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসল পরিচয়টা দিতে হবে নইলে বিবেকের দংশনেই জ্বলে পুড়ে মরব।

আপনারা যারা আমাকে চেনেন তাঁদের অনুরোধ যদি আমার মত দেখতে কারও সঙ্গে আলাপ হয় যিনি শহরের কোনও অভিজাত ক্লাবের সদস্য, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীতের ভক্ত, সুগায়ক এবং ছোটবেলায় দিল্লীতে ছিলেন, তবে দয়া করে আমাকে জানাবেন।

শুভেচ্ছা রইল।

কলকাতা ৬ই জানুয়ারি ২০১৮ 


No comments:

Post a Comment