যাত্রা হল শুরু
মুম্বাই থেকে বাহরেইন হয়ে গালফ এয়ারলাইন্সের প্লেন
যখন ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে এসে নামল, তখন সকাল প্রায়
দশটা। চড়া রোদ উঁকি মারছে প্লেনের জানলা দিয়ে। ক্লান্ত লাগছে খুব। আগের দিন বিকেলে বেরিয়েছি কলকাতা
থেকে, ইন্ডিগোর ফ্লাইটে মুম্বাই পৌঁছেছি রাত আটটায়,- তারপর ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক
বিমান বন্দরের কেঠো চেয়ারে সারা রাত অপেক্ষা। ইস্তানবুলের প্লেন ছাড়ল ভোর সারে
ছটায়। প্লেন থেকে নামার সময় মনে হচ্ছিল শরীর আর চলছে না।
ইস্তানবুল আতাতুর্ক বিমান বন্দর তুরস্কের সবচেয়ে
বড় ও ব্যস্ত বিমান বন্দর। বেশ বড়, কিন্তু দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মত অত ঝকঝকে বা বিলাস
বহুল নয়। ভিসা আগেই করা ছিল। ইমিগ্রেশনে বেশি সময় লাগল না। অনেকগুলো কাউন্টার। এক
অতি সুদর্শণ যুবক কাগজ পত্র দেখে খুব গম্ভীর মুখে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন।
আমি ভদ্রতার খাতিরে গুড মর্নিং, থ্যাঙ্ক ইউ ইত্যাদি বললাম কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম
না। মনে হল কি জানি বাবা, এখানকার লোক বোধহয় এরকমই গোমড়ামুখো। পরে অবশ্য ধারণা
পালটে গিয়েছিল। তুরস্কের লোকজন খুবই অমায়িক ও বন্ধুসুলভ। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
দশ জনের দল আমাদের। সবাই আমাদের আবাসনেরই বাসিন্দা
এবং প্রবীন নাগরিক। প্রত্যেকের একটি করে মাঝারি সাইজের ব্যাগ। মালপত্র নিয়ে
কাস্টমস ছাড়িয়ে বেরিয়ে দেখলাম দুটি কমবয়সী ছেলে হাতে বিরাট প্ল্যাকার্ড নিয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাতে বেশ স্পষ্ট হরফে বড় বড় করে লেখা টমাস কুক ওয়েলকামস দ্য গ্রুপ
ফ্রম কোলকাট্টা (ইংরিজিতে লেখা বানান Kolkatta), - কবে
যে লোকে আমাদের শহরের নামটা শুদ্ধ ভাবে লিখতে বা বলতে পারবে।
ছেলে দুটি সাদর অভ্যর্থনা জানাল আমাদের। একটি ভারতীয়, - নাম বলল সুর্জিৎ (সুরজিৎ), এখানেই
থাকে। স্ত্রী কন্যা থাকে দিল্লীতে। দ্বিতীয় ছেলেটি স্থানীয়, - নাম ওসগুর, যে রকম ভাবে নামটা উচ্চারণ করল, -
মনে হল “স” পেটের ভেতর থেকে
আর “গ” গলার গভীরতম জায়গা থেকে বেরোচ্ছে। আমরা সবাই বার কয়েক চেষ্টা করে
রণে ভঙ্গ দিলাম। ওকে জানিয়ে দিলাম, - তোমায় ভাই আমরা অস্কার বলে ডাকবো। ছেলেটি সহাস্যে রাজি হল।
সুরজিৎ জানালো আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে কারণ
দিল্লী থেকে আরেকটা ফ্লাইটে আরও ছ’জন আসছেন। ওঁরাও আমাদের দলে, দিল্লী থেকে বুক করেছেন। অগত্যা এয়ার পোর্টে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ঘন্টা খানেক পর দিল্লীবাসীদের
সঙ্গে আমরা রওনা হলাম শহরের দিকে। সুন্দর আরামদায়ক বাস, সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
ইস্তানবুল – অতীত ও বর্তমান
সুরজিৎ ও অস্কার আমাদের গাইড। প্রথমে সুরজিৎ, তারপর অস্কার মাইক হাতে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল এই ঐতিহাসিক শহরের সঙ্গে। এশিয়া ও ইউরোপ, দুটি মহাদেশে
বিস্তৃত এই শহরের মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় দেড় কোটি। ঝকঝকে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন
রাস্তায় ছুটে চলেছি শহরের দিকে। ডুয়েল ক্যারেজওয়েরর মাঝখানের ডিভাইডারে সুন্দর
ফুলের বাগান। সেই ফুল কেউ ছেঁড়ে না। শহরের সৌন্দর্যের ব্যাপারে নগরিকেরা খুব
সচেতন।
রাস্তার
ডিভাইডারে ফুলের বাগান
ইস্তানবুলের বর্তমান আধুনিক চেহারা দেখলে কে বলবে
যে এই শহরেই রোম সম্রাট কনস্টানটাইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর রাজধানী, -
কনস্টানটিনোপোল, ৩৩০ খৃষ্টাব্দে। অস্কার জানালো, এই শহরের ইতিহাস আরও পুরনো।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে যে তিন
হাজার বছর আগেও এখানে এক প্রাচীন উপজাতির বসবাস ছিল। সেই সময়ের এর নাম ছিল লাইগস।
পরবর্তী কালে গ্রীক সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এই শহর, নাম দেওয়া হয় বাইজান্টিয়াম।
অত্যন্তঃ জটিল এই ইতিহাসের খুঁটিনাটি। আমরা খেই হারিয়ে ফেললাম। শুধু এইটুকু জানলাম
যে পরবর্তী কালে এই শহর অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে ও ঘোষিত হয় সাম্রাজ্যের
রাজধানী। নাম হয় ইস্তানবুল। তবে ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর
রাজধানী স্থানান্তরিত হয় আঙ্কারা শহরে। ইস্তানবুল হারায় তার রাজনৈতিক গড়িমা। তবে
এখনও এই শহরের বানিজ্যিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এখনও অক্ষুন্ন।
এই দেশের লোকেরা নিজেদের দেশকে বলে তুর্কিয়া।
ইংরিজিতে বলে টার্কি। আমরা কেন তুরস্ক বলি সেই রহস্য ভেদ হলনা। আমাদের গাইড দু’জনও
এ ব্যাপারের কোনও আলোকপাত করতে পারল না। দিল্লীবাসী আমাদের সহযাত্রীরাও জানালেন তুরস্ক
শব্দ ওঁদের অপরিচিত। যাই হোক, এ নিয়ে আলোচনা আরেক দিন করা যাবে।
তুরস্কবাসীদের আচার ব্যবহার, চেহারা, পোষাক আষাক
সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যমুখী। নারী ও পুরুষ গতানুতিক পশ্চিমী জামা কাপড়েই সচ্ছন্দ্য। কিন্তু
এঁরা ধর্মপ্রাণ মুসলিম। এক’শ বছর আগেও এঁরা ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম খিলাফতের
নাগরিক।
রাস্তার দু-ধারে একটু পর পরই চোখে পড়ে নানা আকারের
মসজিদ। মসজিদের স্থাপত্য আমাদের পরিচিত স্থাপত্য থেকে একটু আলাদা। মসজিদের সামনে
সুন্দর বাগান ও গাড়ি পার্ক করার সুব্যবস্থা। এখানে বলে রাখা ভাল যে তুর্কি
স্থাপত্যের জগৎ জোড়া খ্যাতি ছিল এক কালে। ভারত ও উপমহাদেশের বহু শহরেও তার নিদর্শন
রয়েছে।
মসজিদের
স্থাপত্য একটু স্বতন্ত্র
রাস্তায় বেশ ভীড়। বুধবার, - কাজের দিন। শহরের
কাছে এসে বাসের গতি কমে এলো। বেশ ট্র্যাফিক। অবশেষে পৌঁছোলাম হোটেলে। এখন কিছুক্ষণ
বিশ্রাম ও স্নানাহার। হোটেলটি ইস্তানবুল শহরের কেন্দ্রেই। আশেপাশে অনেক দোকানপাট
আর রেস্তোরাঁ।
বিকেলের দিকে মনে হল নতুন দেশে এসেছি যখন, হোটেলে
বসে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে। দিল্লীবাসীরাও সাগ্রহে
রাজি হলেন। আমাদের গাইডদ্বয়ও দেখলাম খুব উৎসাহী। যে বাসে করে এয়ারপোর্ট থেকে এসেছিলাম,
সেই বাসটি হোটেলের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এটিই এখন আমাদের বাহন। বাসে উঠে বসলাম
সবাই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম শহরটা, যতটা সম্ভব।
ইস্তানবুলের এক তৃতীয়াংশ লোক বাস করেন এশিয়
অঞ্চলে। বাণিজ্যিক কর্মকান্ড
কিন্তু ইউরোপিয়ন অঞ্চলেই বেশি। এশিয় অঞ্চল থেকে প্রচুর লোক প্রত্যেক দিন ইউরোপিও অঞ্চলে আসেন পেশাগত
কারণে। এশিয়া আর ইউরোপিও অঞ্চলের মাঝখানে বয়ে চলেছে বসফরাস প্রণালী (Bosphorus
Strait)। স্বচ্ছ, পরিস্কার, টলটলে জলরাশি দেখলেই বোঝা যায়, এই প্রণালী খুব সযত্নে
লালিত। জলে ভাসছে প্রচুর ছোট ও মাঝারি আকারের স্টীমার। তাতে রয়েছে লাঞ্চ,
স্ন্যাক্স ও ডিনারের ব্যবস্থা। পর্যটকদের কাছে জায়গাটি খুব প্রিয়।
বসফরাস
প্রণালী
আমাদের প্রশ্নের জবাবে অস্কার জানালো যে বসফরাস
প্রণালীর একপ্রান্তে কৃষ্ণ সাগর (Black Sea) আর
অন্য প্রান্তে মার্মারা সাগর (Sea of Marmara)। এই সাগরেই অবস্থিত মার্মারা দ্বীপ, সেই নামেই সাগরের নাম। এই দ্বীপের “মার্বেল”
জগদ্বিখ্যাত এবং মার্বেলের জন্যেই দ্বীপের নাম মার্মারা; - ওদের ভাষায় মার্বেলকে বলে মার্মারা! কি আশ্চর্য তাই না? মর্মরের
সঙ্গে মার্মারার কি অদ্ভুত মিল। তবে
কি কোনও এক প্রাচীন যুগে সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক লেনদেন ছিল আমাদের দুই
দেশের মধ্যে? তখনই কি আমাদের দেশবাসীরা এই দেশের নাম রেখেছিলেন তুরস্ক?
ইউরোপিয় অংশের বাণিজ্যিক অঞ্চল গমগম করছে পড়ন্ত
বিকেলে। রাস্তার দু-পাশে অসংখ্য দোকানপাট, পর্যটকদের ভীড়ই বেশি। নানা রকম পণ্য। তুরস্ক বেশ শিল্পোন্নত দেশ। এদের চর্ম ও বস্ত্র শিল্প
পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের দলের মহিলারা সাগ্রহে ঢুকে গেলেন বিভিন্ন দোকানে। শুরু হল
দরদাম। দোকানদারেরাও দেখলাম সাদরে নিমন্ত্রণ জানালেন সম্ভাব্য ক্রেতাদের।
রাস্তার
দু-ধারে দোকান ও রেস্তোরাঁ
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা এইটুকুই। সন্ধ্যের পর সবাই
দেখলাম খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন। একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে
হোটেলে ফিরে এলাম সবাই। বিছানায় পড়া মাত্রই গভীর নিদ্রা।
প্রাচীন স্থাপত্য
দ্বিতীয় দিন সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার
উঠলাম বাসে। সুরজিৎ আর অস্কারও দেখলাম তৈরী। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থল হল
সুলতান আহমেদ মসজিদ। সারা বিশ্বে এই মসজিদ “ব্লু মস্ক” বা নীল মসজিদ নামে পরিচিত। সপ্তদশ
শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত এই মসজিদ এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পর্যটন
কেন্দ্র। এর ভেতরে ও বাইরের সাজ সজ্জা ও অলঙ্করণ থেকে এক নীলাভ দীপ্তি ভেসে আসে।
সেই থেকেই এর নাম। ভেতর ও বাইরের সব সুক্ষ্ম কারুকার্য কিন্তু পুরোটা হাতে করা। এই
মসজিদের আরও একটি বৈশিষ্ট হল এর ছ’টি মিনার, পাঁচটি বিশাল গম্বুজ ও আরও আটটি
অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ। দুর্ভাগ্য যে ক্যামেরায় ছ’টি মিনারের ছবি ফ্রেমে আনতে
পারলাম না। তাই বাধ্য হয়ে পিকচার পোস্টকার্ড থেকে একটি ছবি দিলাম। অনন্য এর
স্থাপত্য। ভেতরে চারদিকের দেওয়ালে অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি। এই বিশেষ স্থানটি একটি
ধর্মীয় সৌহার্দেরও প্রতিক। ২০০৬ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এখানে এসেছিলেন অতিথি
হিসেবে। সঙ্গে ছিলেন এই মসজিদের ইমাম। দু-জনে এক সঙ্গে প্রার্থনা করেন এই ঐতিহাসিক
মসজিদে।
নীল
মসজিদ ছ’টি মিনার
মসজিদের
ভেতরে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম ছাদ বা সিলিং-এ অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি
নীল মসজিদ থেকে হাঁটা পথে পৌঁছলাম আয়া সোফিয়া (তুর্কী
উচ্চারণ) বা হ্যাগিয়া সোফায়া (Hagia Sophia)। এই ঐতিহাসিক নীল মসজিদ থেকে অন্ততঃ এক হাজার বছর
আগে নির্মিত। যাঁরা আধুনিক ইংরিজি সাহিত্য নিয়ে একটু আধটু চর্চা করেন তাঁরা
নিশ্চয়ই “দা ভিঞ্চি কোড” খ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউনের “ইনফার্নো” পড়েছেন। সেই বইটিতে
এই ভবনটির খুব বিশদ বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। এর একটি বৈশিষ্ট হল যে এটি বিভিন্ন সময়ে
বিভিন্ন মতবাদের ধর্ম চর্চার জায়গা ছিল। আমাদের গাইড অস্কারের কাছে শুনলাম যে
প্রাগৈতিহাসিক যুগে এখানে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। পরে গ্রীক আমলে এখানে নতুন করে
এক বিরাট গির্জা নির্মিত হয়, গ্রীক অরথোডক্স মতালম্বীদের তত্ত্বাবধানে। পরে কোনও
এক সময়ে এটি রোমান ক্যাথলিকদের নিয়ন্ত্রনে আসে। পরবর্তী কালে যখন এই অঞ্চল অটোমান
সাম্রাজ্যের অধীনে আসে, তখন এটি একটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়। আয়া সোফিয়ার স্থাপত্য
শিল্প কিন্তু নীল মসজিদের কাছাকাছিও আসে না। দেখে কেমন যেন মনে হয় যে এটি বেশ
জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছে। আমাদের মত অনভিজ্ঞ চোখেও ধরা পড়ে যে এর চারটি মিনার
আলাদা ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মসজিদের ঐতিহ্য অনুযায়ী। এখন অবশ্য এটি আর মসজিদ
হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। এটি এখন একটি মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা। নানা রকম অমূল্য
ঐতিহাসিক সম্পদ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরের দেওয়ালে এখনও রয়ে গেছে খ্রীস্টান ও
ইসলামি সভ্যতার নানা কালজয়ী নিদর্শন।
আয়া
সোফিয়া – মিনার গুলো পরে বসানো হয়েছে।
তুরস্কের ইতিহাসে অটোমান সাম্রাজ্য বা খিলাফতের
প্রসঙ্গ আসবেই। এই “অটোমান” শব্দটির সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানাই এবার। এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওসমান গাজী বা
প্রথম ওসমান। তাঁর নামেই এই বংশ বা সাম্রাজ্যের নাম। ব্যাকরণ-গত কারণে আরবরা ওসমান
শব্দটির উচ্চারণ করেন ওথমান বা উথমান। এ রকম উদাহরণ প্রচুর আছে। যেমন আরবরা রমজানকে
বলেন রামাদান বা আজানকে বলেন আদান। এই ওথমান বা উথমান থেকেই ইংরিজি ভাষায় অটোমান
শব্দের উৎপত্তি। যেহেতু আমরা এই অঞ্চলের ইতিহাস শিখেছি ইংরেজদের কাছে, আমরাও এই
অটোমান শব্দটি ব্যবহার করি। নিয়ম মত আমাদের কিন্তু ওসমান সাম্রাজ্যই বলা উচিৎ।
কালক্রমে এই সাম্রাজ্যের বিরাট বিস্তৃতি ঘটে এবং এই বংশের সুলতানরা খলিফা বা
আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান মুসলিম জগতে। ১৯২৪ সালে মুস্তাফা কামাল
আতাতুর্কের নেতৃত্বে ওসমান বা অটোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
বাজার হাট - সংক্ষেপে শপিং
ইতিহাস সমৃদ্ধ যে কোনও দেশ বা শহরে অজস্র
সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম দেখা যায়। গাইডরাও খুব উৎসাহের সঙ্গে সেখানে পর্যটকদের
নিয়ে যান। কিন্তু যাঁদের ইতিহাসে সচেতনতা কম তাঁরা কিছুক্ষণ পরে অধৈর্য হয়ে পড়েন।
তাই কয়েকজনের আগ্রহ সত্ত্বেও আমাদের দলের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্যের ইচ্ছেয় আমাদের
গাইড বন্ধুরা আমাদের নিয়ে গেলেন এক বিশেষ আকর্ষনীয় জায়গায়। ইস্তানবুলের বিখ্যাত
গ্র্যান্ড বাজারে। এই বাজারের খ্যাতি জগৎ
জোড়া। অস্কারের কাছে জানলাম যে প্রতি বছর নয় থেকে দশ কোটি লোক এখানে বাজার করেন।
এই বাজারের আদলটা অনেকটা কলকাতার নিউ মার্কেটের মত, কিন্তু বিশাল। এ বাজার বহু
পুরনো, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চলছে রমরমিয়ে। হেন জিনিষ নেই যা এখানে
পাওয়া যায় না। তুর্কীরা গর্ব করে বলে, - এটা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শপিং মল।
কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়।
সাহস করে একটা কথা বলেই ফেলি। এখানে ঢোকার পর দেখলাম
মহিলাদের মুখ চোখ কেমন চকচক করে উঠল। কিন্তু তাঁদের কর্তারা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে
গেলেন। আমাদের এক বন্ধু তো
আমার কানে ফিসফিস করে বলেই ফেললেন, - এবার হল, এখান থেকে কখন বেরোতে পারব তা
ঈশ্বরই জানেন। দিল্লীবাসী এক সহযাত্রী বেশ সশব্দেই তাঁর ধরমপত্নীকে বললেন, - সুনো
জি, ফজুলকী চীজ মত খরিদ না। কিন্তু সেই আবেদন মহিলাটির কানে পৌঁছল বলে মনে হল না।
মহিলারা নানা দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দোকানে ঢুকে
গেলেন। সবার কাছেই কিছু তুর্কী মুদ্রা বা লিরা রয়েছে। এক তুর্কী লিরা আমাদের মুদ্রায়
২০ টাকার কাছাকাছ। ইউরোও চলে। শুরু হল শপিং। এখানে দেখলাম সবাই মোটামুটি ইংরিজি
জানে। যথা সময় মহিলারা জানালেন এখানে সব কিছু নাকি খুব সস্তা। সেই শুনে কর্তারা
প্রমাদ গুনলেন। অস্কার ও সুরজিৎ দু-জনেই সাবধান করে দিয়েছিল যে এখানে প্রচন্ড
দরাদরি করতে হয়। কিন্তু কতটা দরাদরি করতে হয় তা আমি টের পেলাম একটু পরে। আগেই
বলেছি এখানকার চর্মশিল্প খুব বিখ্যাত। এক দোকানদার একটি চামড়ার টুপি হাতে নিয়ে আমার
পেছনে পড়ল। টেক স্যর ভেরি গুড স্যর করতে করতে আমার পিছু নিল। আমি টুপি পরি না;
কাউকে পরানোর ইচ্ছেও আমার নেই। কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। ওর হাত থেকে বাঁচবার
জন্য দাম জিজ্ঞেস করলাম, - বলল ওনলি হান্ড্রেড লিরা মানে আমাদের হিসেবে প্রায়
দু-হাজার টাকা। আমি বললাম, - টু মাচ। লোকটি নিরাশ হল না, জিজ্ঞেস করল, - হাও মাচ
ইউ পে? আমি ওকে কাটানোর জন্য বললাম, - পঁচিশ লিরা। লোকটা বিষন্ন মুখে বলল, - আই
মেক বিগ লস। বাট ইউ মাই গেস্ট। আই গিভ ফর টুয়েন্টি ফাইভ। লোকটি আমার হাতে টুপিটা
গুঁজে দিল। আমি বোকার মত পঁচিশ লিরা বের করে দিলাম। আমাকে টুপি পরানো যে এত সোজা
আগে বুঝিনি কখনও।
যাই হোক, অবশেষে গাইড দু’জনের তাড়ায় মহিলারা
বাজারে ক্ষান্ত দিলেন। আমরাও কিচ্ছু জামা কাপড় কিনলাম, নাতি নাত্নীদের জন্য।
আমাদের জন্য আর কিই বা নেব? আর দু-বাক্স টার্কিশ ডিলাইট কিনলাম। হালুয়া জাতীয় এই
তুর্কী মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়; স্বর্গীয়।
ইস্তানবুলের গ্র্যান্ড বাজার নানা
রকমের পসরা সজানো
এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে হোটেলে ফিরতে
বেশ রাতই হল।
রাজকীয় আঙ্কারা
তৃতীয় দিন। সকাল বেলা উঠেই ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে
ফেলতে হল। আজ ইস্তানবুলের হোটেল ছেড়ে আমরা বাসে রওনা হব আঙ্কারার উদ্দেশে। দূরত্ব
সাড়ে চার’শ কিলোমিটার। যদিও খুব সুন্দর হাইওয়ে, কিন্তু ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার বেগে ছুটলেও
পাঁচ ঘন্টা তো লাগবেই। তা ছাড়া মাঝে মাঝে বিরতিও দরকার, - খাওয়া দাওয়া, বাথরুম
ইত্যাদির জন্য।
ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে উঠতে উঠতে প্রায় ন’টা বেজে
গেল। আমরা অনেকেই গাইডদের পরামর্শ অনুযায়ী আটটায় তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সব দলেই কিছু লোক থাকে যারা কখনই সময়
মেনে চলে না। শুধু তাই নয়, দেরির জন্য দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা, ভাল সীট খালি নেই
বলে মেজাজ দেখাতেও ছাড়ে না। কিছু করার নেই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলাই হল জীবনযাত্রার
মন্ত্র।
অপূর্ব ছয়-লেনের হাইওয়ে। আমাদের বাস ছুটে চলেছে
এক’শ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার গতিতে। তুরস্ক যে কতটা শিল্পোন্নত তার উদাহরণ ছড়িয়ে
রয়েছে রাস্তার দু-ধারে। অসংখ্য কারখানা। একটার পর একটা। আর সব ক’টি ঝকঝকে তকতকে।
তুরস্কের ইস্পাত, মোটর গাড়ি বা অটোমোবাইল, জাহাজ নির্মান সবই খুব উন্নত মানের।
অস্কার জানালো তুরস্কে নির্মিত গাড়ির শতকরা ৮০ ভাগ রপ্তানী হয়।
আমাদের আঙ্কারা পৌঁছতে বিকেল ৪টে হয়ে গেল।
মাঝখানে একটি ছোট্ট শহরে লাঞ্চ সারা হল অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কাবাব ও রুটি সহযোগে।
তুর্কী কাবাব এক কথায় লা-জওয়াব।
হোটেল পৌঁছে সেই সন্ধ্যাটা দল বেধে খাওয়া দাওয়া
আড্ডা মেরেই কেটে গেল। কোথাও আর বেরনো হল না, বাসের ড্রাইভারও খুব ক্লান্ত।
বিশ্রাম দরকার। সুরজিৎ এসে জানিয়ে গেল আমরা যেন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে
নি। পরের দিন আঙ্কারা শহরের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। আর দেখা হবে
আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে।
আতাতুর্ক
চতুর্থ দিন। গত রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে
শুয়ে পড়ায় সকালে সবাইকে খুব তরতাজা দেখাচ্ছিল। যথারীতি কয়েক জন বিশিষ্ট লেট-লতিফের
কৃপায় বেরোতে বেরোতে সোয়া ন’টা হয়ে গেল।
প্রথম গন্তব্য স্থান মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের সমাধিসৌধ। মুস্তাফা কামাল আধুনিক প্রজাতন্ত্রী
তুরস্কের জনক। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তিনি দেশে
ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট
নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত, আমৃত্যু তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর শাসন
কালে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনেন। প্রাথমিক শিক্ষা
অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়, - যার ফলে দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে
থাকে। নারী পুরুষের বিভেদ দূর করে, নারীদের পূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার দেওয়া
হয়, - ফলস্বরূপ তুরস্কের মেয়েদের সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরুষদের কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে কাজ করতে, এমন কি সামরিক বাহিনীতেও। তাঁর এই অভূতপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে
“আতাতুর্ক” বা তুরস্কের জনক হিসেবে সম্মানিত করা হয়।
সমধিসৌধের পরিবেশ খুব শান্ত ও গম্ভীর। নিরাপত্তা
বাহিনীর সদস্যরা কৃষ্ণ বর্ণ অথবা শ্বেত শুভ্র পোষাকে পাহাড়ায় রত। পাথরের মূর্তির
মত দাঁড়িয়ে আছে সবাই। চোখের পলক পর্যন্ত পড়েনা। ছবি তুললাম কিছু। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ
দেখি একটা বাস এসে দাঁড়ালো। নেমে এলে দলে দলে ছাত্র ছাত্রী। প্রত্যেকের পরনে গ্র্যাজুয়েশন গাউন। সার বেঁধে
দাঁড়ালো সবাই তারপর ধীর পদক্ষেপে ও নীরবে এগিয়ে গেল সৌধের দিকে। অস্কার জানালো এটি
এখানকার একটি ঐতিহ্য। সদ্য স্নাতক বা গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের পর
সোজা এখানে চলে আসেন আতাতুর্ককে সম্মান জানাতে।
সেদিন যারা গিয়েছিলেন তাঁরা সব সদ্য পাশ করা ডাক্তার অর্থাৎ মেডিকেল
গ্র্যাজুয়েট।
আতাতুর্ক এই সৌধেই সমাধিস্থ। নীরবে দর্শন করে
বেরিয়ে এলাম আমরা।
সমাধি সৌধের
সামনে ছাত্ররা সমাধির পাদদেশে
পুষ্পস্তবক অতন্দ্র প্রহরী
সমাধিসৌধের চত্ত্বরেই রয়েছে এক বিরাট সংগ্রহশালা।
সেখানে তুরস্কের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের প্রচুর সাক্ষী অতি যত্নে রক্ষিত। সীমিত
সময়ের মধ্যে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব ছিলনা। তবে তুরস্কের ইতিহাস নিয়ে যদি কেউ
গবেষণা করতে চান তবে এই সংগ্রহশালা একটি স্বর্ণখনি।
রাতের আহার সারলাম এক বিশেষ রেস্তোরাঁয়। স্থানীয়
খাদ্যএর সঙ্গে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। সন্ধ্যেটা ভালই কাটল।
পাতাল নগরী
পঞ্চম দিন সকালে আবার তল্পি তল্পা গুটিয়ে রওনা
হলাম। আবার খুব লম্বা সফর। প্রায় তিন’শ কিলো মিটার; অন্ততঃ ঘন্টা চারেক তো লাগবেই।
গন্তব্য স্থান ক্যাপাডসিয়া, তুর্কী উচ্চারণে কাপাদকিয়া। আমাদের গাইড অস্কার ও
সুরজিৎ দু-জনেই উচ্চারণ করল ক্যাপাডসিয়া। তাই আমিও তাই বলছি।
বিস্তৃত অঞ্চল। পর্যটকদের প্রিয় জায়গা। নামটা
শুনেই মনে হয় এই অঞ্চলে এক কালে গ্রীক সভ্যতার প্রভাব ছিল। অস্কারকে জিজ্ঞেস করাতে
জানালো শুধু এই অঞ্চলই নয়, তুরস্কের বহু জায়গায় গ্রীক ও তার পূর্ববর্তী রোমান
সাম্রাজ্যের প্রভাবও রয়েছে।
ক্যাপাডসিয়া অঞ্চলের এক বিশেষ আকর্ষণ বিশাল
পাহাড়ি অঞ্চলের নীচে এক বিশাল ভূগর্ভস্থ শহর। মাটির নীচে অসংখ্য ঘর বাড়ি ও রাস্তা
ঘাট। এই শহরের গোড়াপত্তন হয় রোমান অঞ্চলে। তখন খৃষ্ট ধর্মের শৈশব। রোমান সম্রাটদের রোষে বহু খৃষ্ট ধর্মালম্বী
পালিয়ে গিয়ে এই ভূগর্ভস্থ গহ্বরে লুকিয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে এখানে এক গোপন শহর গড়ে
ওঠে। পরে রোমান সাম্রাজ্যের শক্তিক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের বাসিন্দারা ওপরে উঠে
আসেন এবং ভূতলেও এই শহরের বিস্তার ঘটে। এক আশ্চর্য জায়গা এই ভূগর্ভস্থ শহর। এটা যে
কেন সপ্তম আশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত নয় কে জানে। এখনও সেই শহর অটুট, যদিও পরিত্যক্ত।
এত রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও এখনও নিখুঁত রয়েছে এই আশ্চর্য শহর।
এমন আকর্ষনীয় জায়গা; ঘুরে দেখতে কেটে গেল সারা
দিন। গাইডের তাড়া খেয়েও কেঊ নড়ল না ওখান থেকে।
পাথর কেটে শহর
এই শহর মাটির তলায় বিস্তৃত
উষ্ণ প্রস্রবন
ষষ্ঠ দিনের সকালে মনে হল সবাই যেন খুব ক্লান্ত।
আগের দিন প্রচুর হাঁটা হয়েছে। আমাদের দলের সবাই প্রবীন নাগরিক। হাঁটু, কোমর বহু
ব্যবহারে জীর্ণ। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে একমত হল যে এ দেশে আসা উচিৎ ছিল কুড়ি বছর
আগে, যখন শরীরে কিছু জোর ছিল।
আমাদের সম্মিলিত মতামত গাইডদের জানানো হল নেহাৎই
ঠাট্টার ছলে। গাইডদ্বয় গম্ভীর মুখে আমাদের বক্তব্য শুনে নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে
কিছু একটা আলোচনা করে নিল। কিছুক্ষণ পরে জানালো আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে এমন এক
আকর্ষণীয় জায়গায় যেখানে সারাটা দিন খুব উপভোগ করব স্রেফ বিশ্রামের মাধ্যমে।
জায়গাটির নাম পামুক্কলে। অস্কার জানালো তুর্কী শব্দ পামুক্কলের অর্থ কটন কাসল।
কেন এই নাম সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই। জায়গাটি
হট স্প্রিং বা উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। ভূগর্ভ থেকে
উৎক্ষিপ্ত উষ্ণ জল বয়ে চলেছে অবিরাম। সেই জলস্রোতের সঙ্গে মিশ্রিত নানা রকম খনিজ
পদার্থ মাটির ওপর কয়েক হাজার বছর ধরে স্তরে স্তরে জমে উঠেছে। এখন মাটির ওপর সাদা
রঙে ঢেউ খেলানো সেই স্তর বা প্রলেপন দূর থেকে বিশাল তুলোর পাঁজার মত মনে হয়। তাই এই
অঞ্চলের নাম পামুক্কলে বা কটন কাসল। সে এক অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মানতেই হবে যে প্রকৃতিই
জগতের সবচেয়ে বড় শিল্পী।
হট স্প্রিং বা প্রস্রবণের জলের ধারাকে সিমেন্টের
বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়েছে, অনেকটা বহমান সুইমিং পুলের মত। সেখানে গা ডুবিয়ে বসে
ছিলেন অসংখ্য নারী পুরুষ। আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না কারণ আমরা তৈরি ছিলাম
না। আগে জানা থাকলে সাঁতারের পোষাক নিয়ে আসতাম। যাই হোক, সেই অবস্থাতেই প্যান্ট
গুটিয়ে বসে রইলাম হাঁটু অব্দি পা ডুবিয়ে। আঃ সে কি স্বর্গীয় অনুভূতি।
কটন কাসল উষ্ণ জলে গা ডুবিয়ে
এই অঞ্চলের আশেপাশে রয়েছে রোমান সভ্যতার প্রচুর
নিদর্শন। সবই প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত। ইদানীং তুরস্ক সরকারের প্রত্নতাত্মিক
বিশেষজ্ঞরা এই ঐতিহাসিক স্থানটির হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। ষাটের
দশকে পর্যটকদের ভীড় দেখে এখানে বেশ কয়েকটি বড় হোটেল তৈরি হয়। হোটেলের মালিকরা এই
উষ্ণ জলপ্রবাহের গতি পরিবর্তন করে হোটেলের সুইমিং পুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু
ধীরে ধীরে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন যে তাতে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
সরকারী আদেশে সব হোটেল ভেঙে দেওয়া হয়।
কুসাদাসি
সপ্তম দিন। আমাদের তুরস্ক ভ্রমণ শেষ পর্যায়ে।
আমরা এসে পৌঁছলাম কুসাদাসি, সমুদ্রের উপকুলে ছবির মত এক সুন্দর শহর। এর বীচ বা
সমুদ্র সৈকত খুব জনপ্রিয়। আমরা গাইডের মুখে শুনে অবাক হলাম যে এই শহরর জনসংখ্যা
মোটে ৬৫ হাজার। কিন্তু গ্রীষ্মকালে টুরিস্টদের ভীড়ে এই সংখ্যা ৫ লক্ষতে গিয়ে
দাঁড়ায়। অসংখ্য হোটেল, যা নাকি সারা বছর খালি পড়ে থাকে, কিন্তু টুরিস্ট মরশুমে তিল
ধারণের জায়গা থাকে না।
বিশাল এক বন্দর এই শহরের অর্থনীতির প্রধান
ভিত্তি। এখান থেকে ছাড়ে নানা রকম বাণিজ্যিক ও যাত্রী জাহাজ। এখন থেকেই শুরু হল
আমাদের বেরানোর দ্বিতীয় পর্ব। সমুদ্র ভ্রমণ। ক্রুজ শিপে বিভিন্ন গ্রীক দ্বীপ ছুঁয়ে
শেষে এথেন্স।
কুসাদাসি
বন্দর
আমার এই কাহিনী তুরস্কেই সীমাবব্ধ থাক। গ্রীসের
গল্প না হয় আরের দিন হবে। সংক্ষিপ্ত এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এইটুকুই বলতে পারি যে এক
সপ্তাহের মধ্যে তুরস্কের মত ঐতিহাসিক দেশে ঘোরা বা দেশটিকে জানা সম্ভব নয়। যেমন
সম্ভব নয় স্বল্প সময়ে আমাদের দেশের হৃদয়কে স্পর্শ করা। তবে যা পেয়েছি তাতে আমি নিজে
খুব তৃপ্ত ও নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান বলে মনে করি।
***************
No comments:
Post a Comment