Wednesday 6 July 2022

বৈভব

নিউ টাউন। নতুন শহর গড়ে উঠছে পুরনো শহরের পাশে। ঝকঝকে চওড়া রাস্তা; নতুন নতুন আকাশ ছোয়াঁ বাড়ী, অফিস এবং শপিং মল। রাস্তায় আধুনিক গাড়ী; হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন বিদেশ। মসৃন রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে একটি দুধ সাদা গাড়ী – ‘বিএমডব্লিউ’; খুব কেতার গাড়ী এবং ভীষন দামি, ছন্দা বলেছিল। চালকের আসনে ধপধপে উর্দী এবং টুপি পরা একটি মাঝবয়সী লোক; ছন্দার খাস ড্রাইভার। ছন্দার বরের অন্য ড্রাইভার আছে। তিন তলা বাড়ীর সামনে বেশ কটা গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল। ক’জন ড্রাইভার আছে কে জানে?

মৃদু গুঞ্জনে এসি চলছে; ভেসে আসছে একটু হাল্কা সেতারের শব্দ, খুব আস্তে। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ব্রততীর। ছন্দাকে বলেছিল ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবে। কোনও অসুবিধে হবে না। ছন্দা শুনতেই চাইল না। জোড় করে ড্রাইভার দিয়ে পাঠাল। গাড়ীটা নাকি সারাদিন প্রায় বসেই থাকে, ব্রততীকে পৌঁছে দেবার অজুহাতে একটু চলবে। এই গাড়ী নিয়ে পাড়ায় ঢুকতে একটু লজ্জাই করছে। পৌঁছনোর আগে হয়তো দীপ্তও বাড়ী পৌঁছে যাবে। ঠিক পেছনে লাগবে, “বড়লোক বান্ধবী” “গরীব স্বামী” -- , পারেও বটে দীপ্ত। সু্যোগ পেলেই পেছনে লাগে। একটু হাসিই পেল ব্রততীর। মনটা বোধহয় একটু হাল্কা হল।

ঘটনার সুত্রপাত মাস খানেক আগে। দুপুর একটা নাগাদ, পাশের বাড়ীর রুপার সঙ্গে সাউথ সিটি মলে এসেছিল ব্রততী। বাড়ীর কাছেই, হেঁটেই যাওয়া যায়। কেনা কাটার বিশেষ কিছু ছিলনা। রুপা জোড় করল, “চল না ব্রততীদি, কিছু কেনার তো দরকার নেই, জাস্ট ঘুরে বেড়াব, এই একটু টাইম পাস”। রুপাটা খুব পারে টৈ টৈ করতে। মলে ঢুকলে কিছু একটা কেনা হয়েই যায়, দরকার না থাকলেও; কিংবা কিছু জিনিষ হঠাৎ দরকারি মনে হয়। সেদিনও তাই হল। দিদির শাশুরী অসুস্থ, আগামি কাল দেখতে যাবার কথা, একটা গেট-ওয়েল কার্ড কেনা হল, অথচ কোনও দরকার ছিলনা। মিন্টির খুব সফট টয় পছন্দ, তাও একটা কেনা হল যদিও মিন্টির ঘরে সফট টয়ের ছরাছরি। রুপা বেশ কিছু দামি পারফিউম কিনল।

শপিং মলের ফুড কোর্টটা বেশ আকর্ষনীয়, সব সময় বেশ একটা গমগমে ভাব। নানা রকমের কেনাকাটার পর সবাই এখানে বসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায়। ব্রততী এবং রুপাও এসে বসল কফি খেতে। রুপা অবশ্য শুধু কফিতে সন্তুষ্ট নয়,

- ব্রততীদি, লুচি মাংস খাবে? দারুণ করে, ঐ যে দেখছ স্পিরিট অফ বেঙ্গল, ওখানে।

- ও বাবা না, প্রচণ্ড স্পাইসি, আর মাংসের থেকে হাড়ই বেশি থাকে, আমি খেয়েছি

এমন কিছু স্পাইসি নয়, আর এক আধদিন খেলে কিছু হবে না। আর লোকগুলোকে চিনি আমি, বলে দেব ভাল ভাল পীস দিতে।

না রে রুপা তুই খা। আমার আজ ভাল লাগছে না। আমি বরং একটা পাপরি চাট নিচ্ছি। আর শোন আজ কিন্তু আমার টার্ন, আগের বার তুই দিয়েছিলি।

ও হো, তোমার মনেও থাকে বাবা, বড্ড হিসেব করে চল তুমি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে চল টোকেন কিনে নিয়ে আসি।


লুচি মাংস বেশ ভালই বাসে ব্রততী, কিন্তু খেলো না কিছুটা বিবেকের দংশনে। আসলে দীপ্ত প্রচন্ড  লুচিপ্রিয়, লুচি পেলে আর কিছুই চায়না। ইদানীং একটু প্রেশার ধরা পড়েছে, তাই ব্রততী একটু সাবধান হয়ে গেছে, আজকাল মাসে বড়জোড় এক দিন লুচি হয় বাড়িতে। আগে তো সব রবিবার সকালে লুচি আর আলুর তরকারি হত। আজকাল শুকনো রুটি করে, প্রচন্ড রেগে যায় দীপ্ত। দীপ্তর ওপর এত কড়াকড়ির পর বাইরে এসে নিজের আর লুচি খেতে মন চাইল না।


রুপা লুচি মাংস খেল বেশ তারিয়ে তারিয়ে, ব্রততী পাপরি চাট শেষ করল। কফি প্রায় শেষ হয়ে আসছে এমন সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ছন্দার সঙ্গে। মধুছন্দা, সেই কলেজের বন্ধু। ছন্দাই ডাকল,


ব্রততী না?


ছন্দাকে প্রথম চিনতে পারেনি ব্রততী, বেশ মোটা হয়েছে, পরনে দামি শাড়ি, একগাদা গয়না, হাতে একটা বাদামি রঙের ঢাউস ব্যাগ। দুপাশে দুজন সালোয়ার কামিজ পরা মেয়ে, এই পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে, দুজনের দুহাতে অজস্র শপিং ব্যাগ।

 

একি ছন্দা, তুই?

এই একটু কেনা কাটা করতে এসেছিলাম। আসলে এই সাউথ সিটি মলে আমার আগে আসা হয়নি, বাড়ি থেকে অনেকটা দূর পড়ে। আজ ঠিক করলাম একটু ঘুরে যাই

কোথায় তোর বাড়ি?

বাগবাজারে আমার শশুর বাড়ি, তবে বছর তিনেক আগে আমরা রাজারহাটে শিফট করেছি। 

ও মা তাই, দাঁড়া আলাপ করিয়ে দিই, এ হচ্ছে রুপা, আমার প্রতিবেশি, আমরা একই বিল্ডিঙে থাকি, একই ফ্লোরে। আর এ হচ্ছে ছন্দা, মধুছন্দা, আমার কলেজের বন্ধু।


রুপা হাত তুলে নমস্কার করে। ছন্দা একটু মৃদু হাসে।


তুই কি এদিকেই থাকিস, জিজ্ঞেস করে ছন্দা

হ্যাঁ রে, কাছেই, হাঁটা পথ। যাবি? চল না একটু বসে যাবি। কতদিন দেখা হয়নি

ঠিক আছে চল। বেশিক্ষন বসব না কিন্তু, বাড়ি ফিরতে হবে।


ছন্দার গাড়িতেই সবাই এল ব্রততীর বাড়ি। ছন্দা মোবাইলে ফোন করার পাঁচ মিনিট পর গাড়ি এসে দাঁড়াল সাউথ সিটি মলের দোরগোড়ায়। বিরাট গাড়ি। মিৎশুবিশি পাজেরো, জানাল ছন্দা। ধবধবে সাদা পোষাকের ড্রাইভার। তিন সারি সীট। গাড়ির ভেতরটা কুলকুলে ঠান্ডা মাখানো, এসি চলছে। মাঝখানের সারিতে বেশ আরাম করেই বসল ছন্দা, ব্রততী ও রুপা। পেছনের সারিতে ছন্দার দুই সঙ্গিনী। মেয়ে দুটোর মুখে কোনও কথা নেই। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ছন্দার বডিগার্ড। রাস্তায় বেশ জ্যাম, ব্রততীদের বাড়ি পৌঁছতে পনেরো মিনিট লেগে গেল। হেঁটে পাঁচ সাত মিনিটেই পৌঁছনো যায়। 


রুপা চলে গেল নিজের ফ্ল্যাটে। বাড়ি পৌঁছে বাইরের ঘরে ছন্দাকে বাসাল ব্রততী। পাখাটা চালিয়ে দিল ফুল স্পীডে। এসি গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেন বেশি গরম লাগছে। ছন্দা ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে গালে কপালে ঘাম শুকিয়ে নিচ্ছে মাঝে মাঝে। সঙ্গের মেয়েদুটোকে ডাকতে হল না, নিজেরাই নেমে এল। পেছন পেছন এল কিন্তু ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল ঠিক দরজার বাইরে, যেন হুকুমের অপেক্ষায়। ছন্দাকে দেখে মনে হল এক বিলাস বহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দু গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে এল ব্রততী, ছন্দা অর্দ্ধেকটা খেয়ে বাকিটা নামিয়ে রেখে দিল। বসল না বেশিক্ষণ। বাড়িতে কাজ আছে বলে উঠে পড়ল। যাবার আগে ব্রততীর ফোন নাম্বার এন্ট্রি করে নিল নিজের মোবাইল ফোনে। ব্রততী এগিয়ে এল গাড়ী অব্দি। মাঝের সীটে এবার একা বসল ছন্দা। দুই সহচরী সেই পেছনের সীটেই। কয়েক মিনিট একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল ব্রততী। ছন্দাটা বেশ পালটে গেছে। ব্রততীর সঙ্গে বিশেষ অন্তরঙ্গতা না থাকলেও মোটামুটি বেশ ভালই ভাব ছিল। খুবই সাধাসিধে মেয়ে ছিল। এখন যেন চলনে বলনে একটা প্রাচুর্যের অহঙ্কার, কথা বার্তাও ঠিক স্বতস্ফূর্ত নয়, একটু আঢ়ষ্ট, মাপা মাপা। আর এত গয়নাগাঁটি পরে কেউ মলে আসে?


ছন্দা রওনা হতেই রুপা এসে হাজির। মনে হয় তক্কে তক্কে ছিল,


বসল না?

না, কাজ আছে বলল।

কাজ না হাতি, কিছু মনে করনা ব্রততীদি, একটু অদ্ভুত আছে কিন্তু তোমার বন্ধু। একটা কথা বলল না আমার সঙ্গে। আমি নমস্কার করলাম, ও কিন্তু করল না। 

নারে, আসলে একটু লাজুক জানিস তো,

লাজুক না হাতি। তুমি যাই বল না কেন, বেশ অহঙ্কারি আছে।

যাক গে ছেড়ে দে না, আর তো দেখা হবে বলে মনে হয়না। একটু শরবত খা।


ছন্দার সঙ্গে ঐ একদিনের দেখার স্মৃতি হয়তো হাল্কাই হয়ে যেত ধীরে ধীরে। কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে দুপুর বেলা হঠাৎ ফোন এল ছন্দার,


এই ব্রততী, সেদিন একটু তাড়া ছিল বেশি কথা বলতে পারিনি। তুই বরং পরের সোমবার চলে আয় আমার বাড়ি। বারোটা নাগাদ চলে আয়, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করব আর সারা দুপুর আড্ডা মারব।

নারে এমনিই যাব একদিন, খাওয়া দাওয়া কেন আবার?

তুই না করিস না, চলে আয় আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব।

না না শোন, গাড়ি পাঠতে হবে না। আমি এমনিই চলে যেতে পারব। কিছু অকেশন আছে কি? অনেকে আসছে?

না রে, শুধু তুই আর আমি। কোনও অকেশন নেই। সারে এগারোটায় আমার গাড়ি পৌঁছে যাবে

না ছন্দা, গাড়ি পাঠাস না। - এবার একটু জোড় দিয়েই বলে ব্রততী।

কেন? আচ্ছা ঠিক আছে।–একটু দমে যায় ছন্দা 

তোর বাড়ির ঠিকানাটা দে।


ঠিকানাটা একটা কাগজে টুকে রাখে ব্রততী। একটু কৌতুহলও হচ্ছিল ছন্দা সম্পর্কে। তাই রাজি হল। আশ্চর্য লাগছে। সাধারণতঃ বন্ধুরা বরদেরও নিয়ে আসতে বলে, নিজেদের বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। ছন্দা তো দীপ্তর নামও জিজ্ঞেস করল না। সেদিনও দীপ্ত সম্বন্ধে কিছু জানতে চায় নি। সত্যিই অদ্ভুত, রুপা ঠিকই খেয়াল করেছে। 


দীপ্ত বাড়ি এসে সব শুনে অবাকই হল।


এই ভর দুপুরে একা একা কোথায় যাবে তুমি? রাজারহাট বেশ নির্জন জায়গা। বড় বড় বাড়ি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু লোকজন বেশি থাকে না। ট্যাক্সি ঐ অসময়ে যেতে চাইবে কিনা কে জানে। আর ফেরার সময় ট্যাক্সি পাবার চান্স খুব কম।

বাস?

বাস রুটও বেশি নেই। কাগজে পড় না, পরিকাঠামোর অভাব ইত্যাদি।

তবে কি করব? না করে দেব। কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে

দেখি আমি কোনও ড্রাইভার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। আমাদের গাড়িতেই তোমাকে পৌঁছে দেবে। ফেরার সময় যদি ট্যাক্সি না পাও, ফোন করে দিও। আমিই তুলে নেব তোমাকে। আমি কিন্তু তোমার বন্ধুর বাড়ি ঢুকব না

ঠিক আছে

তোমার বন্ধু বেশ শাসালো পার্টি মনে হচ্ছে। গাড়ির অফার দিল যখন নিয়ে নিলেই পারতে। 


দীপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করে। উঁচু পোস্টে আছে। ইচ্ছে করলে অফিসের গাড়ি ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দেবে না। অফিস থেকে কোনও রকম ব্যক্তিগত সুবিধে নিতে চায় না দীপ্ত। অথচ ওর সহকর্মীরা অফিসের গাড়ি নিয়ে দীঘা বেড়াতে চলে যায়, মহিলারা শপিং করতে যায়। দীপ্ত অফিসের গাড়ি শুধু অফিসের কাজেই ব্যবহার করে। নিজের বা পরিবারের জন্য বরাদ্দ পাঁচ বছর আগে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কেনা একটি মারুতি অলটো। তবে এই সততার স্বীকৃতি আছে। কোথাও কোনও রকম দুর্নীতির আঁচ পেলে দীপ্তকেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংবাদ মাধ্যমও দীপ্তকে খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখে।


নির্দিষ্ট দিনে সময় মত পৌঁছে গেল ব্রততী। দীপ্তর অফিসের এক রিটায়ার্ড ড্রাইভার, এখন পার্ট টাইম গাড়ি চালান একটু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, পৌঁছে দিলেন ব্রততীকে, ঠিকানা দেখে একেবারে বাড়ির সদর অব্দি। এবং বসে রইলেন ব্রততী ভেতরে না ঢোকা অব্দি। পেল্লায় তিন তলা বাড়ি। বাড়ির সামনে বেশ কেতা দুরস্ত বাগান। সামনে বেশ কয়েকটি গাড়ি। গেটে খাকি পোষাকে সিকিউরিটি গার্ড। ব্রততীর নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। নাম শুনে সসভ্রমে গেট খুলে দিল, বোধহয় ছন্দা বলে রেখেছিল। দেয়ালে একটা সুইচ টিপে কথা বলল কারও সঙ্গে। এগিয়ে দিল সিড়ি অব্দি।


সিড়ির দিয়ে নেমে এল সেদিনের এক সালোয়ার কামিজ। আজও একই রকম পোষাক। একটু হাসল ব্রততীকে দেখে, কথা বলল না, ইশারা করল ওপরে উঠে আসতে। সাদা ধবধবে সিড়ি। ওপরে উঠে একটা লম্বা প্যাসেজ, বেশ চওড়া, দেয়ালে নানা রকমের পেইন্টিং, এক মাপের ফ্রেমে, সারি সারি। মাঝে মাঝে নানা কায়দার গাছ গাছালি। বেশ সুন্দর সাজানো, একটু বেশিই যেন সাজানো। মনে হয় এই সাজানোর মধ্যে আন্তরিকতার চেয়ে পেশাদারিত্বর ছাপ বেশি। প্যাসেজের ডান দিকে এক বিরাট মাপের ঘর, ভারি পর্দার ফাঁকে চোখে পড়ল বড় বড় সোফা সেট। বাঁ দিকে মনে হল বিরাট এক ডাইনিং হল। বসার ঘরের ঠিক পাশে একটা দরজা একটু ভেজানো, দরজায় মৃদু টোকা দেল মেয়েটি। ভেতর থেকে ছন্দার গলা শোনা গেল “আয়”।


ভেতরে ঢুকল ব্রততী। এ ঘরটাও বেশ বড়, সোফা সেট দিয়ে সাজানো, দেয়ালে বড় বড় ফ্রেমে কিছু ছবি। পেইন্টিং নয়, নানা রকম পারিবারিক ছবি মনে হল। প্রায় পুরো মেঝে জুড়ে কার্পেট। এসি চলছে। মাঝখানে এক বিরাট গদিওয়ালা চেয়ারে গা এলিয়ে, পা মুড়ে বসে আছে ছন্দা। আজকেও গায়ে বেশ ভারি ভারি গয়না। হাল্কা পারফিউমের গন্ধ। সামনে একটা বড় এলইডি টিভিতে কোনও একটা সিরিয়াল চলছে।


এসেছিস ব্রততী, বোস। বাড়ি খুঁজতে অসুবিধে হয়নি তো?

না রে খুব সহজেই পেয়ে গেছি। 

ব্রততী পাশের একটা চেয়ারে বসে। ছন্দা বসেই থাকে।

কি করে এলি, ট্যাক্সি?

না, গাড়িতেই, ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে গেছে।

গাড়িটা ছেড়ে দিলি?

হ্যাঁ, দীপ্তর মানে আমার বরের যদি দরকার হয়।

ও, কি খাবি বল, চা, কফি, কোল্ড ড্রিংক?

একটু পরে। এখন একটু জল খেতে পারি। কিন্তু ফ্রিজের না কিন্তু।

ঠিক আছে। 

এবার সালোয়ার কামিজের দিকে তাকালো ছন্দা,

রেবা, দু গ্লাস জল নিয়ে এসো।

আচ্ছা বৌদি।

আর শোনো। 

রেবা থেমে ঘুরে দাঁড়ালো।

টিভিটা বন্ধ করে দাও।

ছন্দার হাতের পাশেই একটা ছোট কাশ্মিরি টেবিলে টিভির রিমোট কন্ট্রোল। রেবা মৃদু পায়ে এসে রিমোট কন্ট্রোল তুলে টিভি অফ করে। বেরিয়ে যায়, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যায় সন্তর্পনে।


আজ তোর সঙ্গে আড্ডা মারব বলে আমার বরকে বলেছি অফিসে খেয়ে নিতে।

উনি রোজ বাড়িতেই খেতে আসেন বুঝি?

হ্যাঁ, এই নীচের তলায় তো অফিস। তবে প্রায়ই এদিক ওদিক যেতে হয়, সাইটে কাজ থাকে। আজ বলেছি খাবার নীচে পাঠিয়ে দেব। 

ওনার কি নিজের ব্যবসা?

ফ্যামিলি বিজ়নেস। আমার শশুর মশাই শুরু করেছিলেন। মারা গেছেন। এখন আমার বর আর ভাসুর দেখাশোনা করে।

তোর শাশুরি?

এখানেই থাকেন। ওপরে। খুব একটা নীচে নামেন না। দিনে একবার বাগবাজারের বাড়ি যান, বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মন্দির, প্রতি অমাবস্যায় কালীঘাট। এমনিতে খুব শক্ত পোক্ত। তবে সংসারের ভার আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। পুজো আর্চা নিয়ে থাকেন।

তোর জা আর ভাসুর?

ওরা বাগবাজারের পুরনো বাড়িতে আছে। বেশ বড় সাবেকি বাড়ি। আমার ভাসুর ঐ বাড়ি ছাড়তে চান না। শশুর মশাই সবাইকে নিয়ে এ বাড়ি আসতে চেয়েছিলেন, বড় ছেলে রাজি হয়নি। তা ছাড়া ছেলে মেয়েরা কাছাকাছি সব স্কুলে পড়ে।, আমার ভাসুর আর জা’ও একটু ধর্ম কর্ম নিয়ে থাকতে ভালবাসে।

তোর ছেলে মেয়ে?

এক ছেলে। দার্জিলিঙে আছে। বোর্ডিং স্কুল।


প্রায় একতরফাই কথা বকে যায় ছন্দা। বরের নাম দিব্যেন্দু। কয়েক পুরুষের ব্যবসায়ি পরিবার। দিব্যেন্দুর ঠাকুরদার আমলে তেলের কল, লোহা লক্করের আরত আর একটা প্রেস ছিল। এখনও আছে। সেগুলো ভাসুর দেখাশোনা করেন। এই কন্সট্রাকশনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন শশুর মশাই। সেটা রমরমিয়ে চলছে। দিব্যেন্দু নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এই ব্যবসাটা এখন একাই সামলাচ্ছে। ভাসুরের অফিস অন্য জায়গায়, মাঝে মাঝে কাগজপত্রে সই করতে আসেন। সব ব্যবসাতেই সমান ভাগ দুই ভাইয়ের।


ছন্দা ব্রততীর ক থা কিছুই জানতে চাইল না। ব্রততীও নিজে থেকে কিছু জানালো না। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগছিল এক তরফা কথায়। মনঃস্থির করে ফেলল এর পর কোনও যোগাযোগ রাখবে না। এই ছন্দা সেই কলেজের ছন্দা নয়। এই ছন্দা বিত্ত বৈভবে আপ্লুত এক বিলাসিনী।


রেবা এসে জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে এল ঠান্ডা বাদামের শরবত, সঙ্গে কিছু মিষ্টি। মিষ্টি খেল না ব্রততী। দুপুরে খাওয়ার কথা বলেছিল ছন্দা, এসব খেলে আর কিছু খাওয়া যাবে না পরে। ছন্দা একবার সেই সালোয়ার-কামিজ রেবাকে ডেকে খবর নিল শাশুরি খেয়েছেন কিনা। দেড়টা নাগাদ আবার রেবাকে ডাকল ছন্দা, বলল খাবার দিতে। মিনিট পনেরো পরে রেবা এসে খবর দিল খাবার দেওয়া হয়েছে। এই প্রথম উঠে দাঁড়ালো ছন্দা। চেয়ারের সামনেই এক জোড়া চটি রাখা ছিল, সে জোড়াই আবার নীচু হয়ে রেবা এগিয়ে দিল ছন্দার পায়ের কাছে। 


হাত ধুবি তো? 


ঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল ছন্দা। সামনেই একটা বাথরুম। রঙিন টাইল, দেওয়াল। একই রঙের তোয়ালের সেট, শাওয়ার কার্টেন। বেসিনের ওপরে রাখা লিকুইড সোপে হাত ধুল ব্রততী, তোয়ালেতে হাত মুছল।


ঢোকার সময় বাঁদিকে যে ঘরটা দেখেছিল, সেটাই খাবার ঘর। এখানেও এসি চলছে। মনে হয় পুরো বাড়িটাই এয়ার কন্ডিশনড। বিরাট লম্বা এক ডাইনিং টেবিল। মেহগিনি, জানালো ছন্দা। একদিকে টেবিলের মাথায় বসল ছন্দা। পাশে ব্রততী। বাড়িতে শাশুরীকে নিয়ে তিনজন লোক, এত বড় টেবিল তো ফাঁকাই পড়ে থাকে। 


এই ডাইনিং রুম রোজ ব্যবহার হয়না – ব্রততীর প্রশ্ন অনুমান করে জানালো ছন্দা। বেশি লোকজন থাকলেই এখানে খাওয়া দাওয়া হয়। কিচেনের পাশে একটা ছোট ডাইনিং রুম আছে, দৈনন্দিন খাওয়া দাওয়া সেখানেই হয়।


টেবিলে বেশ বড় একটা রুপোর থালা ঘিরে গোটা দশেক রুপোর বাটি। সাবেকি কায়দায়। থালায় সুগন্ধী চালের ভাত, এক কোনায় নুন, সদ্য কাটা গন্ধ লেবু। বাটিতে শুক্তো, ছোলার ডাল, পেল্লাই সাইজের ভাজা পার্শে মাছ, এঁচোর ঘন্ট, ধোকার ডালনা, চিতল মাছের পেটি, সর্ষে ইলিশ, পাঁঠার মাংস, চাটনি ও মিষ্টি দৈ।


একটু পেছনে রেবা দাঁড়িয়ে। রেবার পাশে সেই দ্বিতীয় সালোয়ার কামিজকেও দেখা গেল। ব্রততী আর ছন্দা টেবিলের কাছে দাঁড়াতেই দুজনে এগিয়ে এসে চেয়ার দুটো একটু টেনে পিছিয়ে দিল বসার জন্য।


ব্রততী আঁতকে উঠল পদের বাহার দেখে,


আমি পারব না রে ছন্দা,  তুই তুলে নিতে বল। 

তুলতে হবে না। যা পারিস খা। জোড় করব না। আমাদের রাধুনি কিন্তু খুব ভাল। আগে এক বড় রেস্তোরাঁয় কাজ করত। আমার বর ওকে বাড়িতে কাজ দিয়ে নিয়ে এসেছে।


ব্রততী শুধু শুক্তো, ধোকার ডালনা আর ইলিশ মাছটা খেল। ছন্দা অবশ্য জোড় করল না খুব একটা। ছন্দা নিজে কিছুই খেল না, একটু পার্শে মাছ ভেঙে খেল শুধু। খুব নাকি মোটা হয়ে যাচ্ছে। কথাটা অবশ্য খুব মিথ্যে নয়, ব্রততী ভাবে, কলেজে পড়াকালীন বেশ ছিপছিপে রোগা ছিল ছন্দা। বেশ মিষ্টি চেহারা ছিল, ফ্যাশন ট্যাশন একেবারেই করত না। আর এখন? বেশ মোটা সোটা চকচকে চেহারা হয়েছে। পরনে দামি শাড়ি, গয়না। বাড়ির কাজকর্ম তো কিছুই করে বলে মনে হয় না।


হঠাৎ বাইরে থেকে এক উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা গেল, পুরুষ কন্ঠ,-

বৌদি কোথায়? আলমারির চাবি দিতে বল, জলদি

বলতে বলতেই একটি লোক ঘরে ঢোকে। বেশ লম্বা পেটানো চেহারা, ভুরু কুঁচকে প্রথমে ব্রততীকে দেখে তারপর ছন্দার দিকে তাকায়,

আলমারির চাবিটা দাও তাড়াতাড়ি

একটু হাসে ছন্দা,

আলাপ করিয়ে দিই, দিব্যেন্দু, আমার কর্তা। ব্রততী আমার কলেজের বন্ধু, সেদিন তোমাকে বলছিলাম না ...

দিব্যেন্দুর ডান রাতে একটা ফাইল, বাঁ হাতটা একটু তুলে হাল্কা নমস্কার জানায়

তাড়াতাড়ি কর দেরি হয়ে যাচ্ছে

দিব্যেন্দু বেরিয়ে যায়। একটু বিব্রত দেখায় ছন্দাকে,

দাঁড়া আসছি, 

ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে যায় ছন্দা, রেবাও ছোটে পেছনে।


কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে ছন্দা, মুখে একটু অপ্রস্তুত হাসি,

 

কিছু দরকারি কাগজ পত্র নিতে এসেছিল। খুব ব্যস্ত আছে জানিস, অফিসে উকিল বাবুর সঙ্গে জরুরি মীটিং চলছে। ব্যবসা চলাতে গেলে নানা রকম ঝামেলা তো লেগেই থাকে। পরে একদিন ভাল করে আলাপ করিয়ে দেব। এমনিতে খুব মজার লোক। মিষ্টি খেলিনা?

না রে আর পারব না।


বাথরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নেয় ব্রততী। মনটা বিষিয়ে উঠেছে হঠাৎ। আর একদন্ড থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। অপমানিত লাগছে নিজেকে। একে এক তরফা গল্প, তার ওপর এই ব্যবহার। ঘড়ির দিকে তাকায় ব্রততী,


আমি এবার রওনা হব বুঝলি?

না রে, এখন যাবি কি? খেয়ে উঠেছিস একটু বিশ্রাম করে যা। চা, কফি কিছু খাবি?

ও বাবা, এর পর চা কফি খাবার জায়গা নেই। আসলে আমার বর অফিস থকে ফিরবে, আমার মেয়ের একটু দেরি হবে আজ, নাচের ক্লাস আছে।

দাঁড়া তোকে বাড়িটা একটু দেখাই, দিব্যেন্দু আর্কিটেক্টদের সঙ্গে বসে সব কিছু প্ল্যান করেছে।


এবারও ছন্দা ব্রততীর স্বামী সন্তান সম্বন্ধে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করল না। বাড়ি দেখালো ঘুরে ঘুরে। সারা বাড়িতে বিলাস এবং বৈভবের চিহ্ন। তিন তলায় নিয়ে গেল শাশুরির কাছে, মানুষটি ভাল, সাদা সিধে। মাঝারি মাপের একটা ঘরে বসে আছেন বিছানার ওপর। এ ঘরে এসি নেই, পাখা চলছে। বিছানার পাশে মোড়ায় বসে এক পঞ্চাশোর্দ্ধ মহিলা, বোধহয় শাশুরির পরিচারিকা গোছের কেউ।


শাশুরি যত্ন করে বসালেন। জিজ্ঞেস করলেন বাড়ির কথা, মেয়ের কথা, মা বাবা কোথায় আছেন ইত্যাদি। হঠাৎ মন ভাল হয়ে গেল ব্রততীর, বেশ অনেকক্ষণ গল্প করল বৃদ্ধা মহিলার সঙ্গে। ছন্দাকে মনে হল একটু অধৈর্য হয়ে উঠছে। শাড়ির আচলে কপালে ঘাম মুচ্ছে মাঝে মাঝে। খেয়াল করলেন শাশুরী,


খুব ভাল লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে মা, যাও নীচে যাও। এখানে গরম লাগছে তোমাদের। আমার আবার ঐ মেশিনের ঠান্ডা সহ্য হয় না।

ব্রততী মৃদু আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছন্দা উঠে দাঁড়ালো সঙ্গে সঙ্গে,

হ্যাঁ মা, ব্রততীকে আবার ফিরতে হবে ...


নীচে নেমে এল দুজনে। ছন্দা চায়ের প্রস্তাব দিল আবার। কিন্তু আর বসতে চাইল না ব্রততী। এবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে, ছন্দা রেবাকে বলল ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ির ব্যবস্থা করতে। ব্রততী বারণ করেছিল, শুনলনা ছন্দা। ব্রততী এল গাড়ি অব্দি, পেছনে সেই দুই বডিগার্ড। ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। পেছনের সীটে উঠে বসল ব্রততী।


অনেকটা রাস্তা, রাস্তায় বার তিনেক ট্র্যাফিক জ্যামে আরও দেরি হল। বাড়ি পৌঁছে ড্রাইভার দরজা খুলে দিল, নেমে এল ব্রততী। নেমেই দেখল দীপ্ত গাড়ি থেকে নামছে। তখনই পৌঁছেছে। দীপ্তর চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত। হাঁ করে তাকিয়ে আছে গাড়ির দিকে। এই ভয়টাই করছিল ব্রততী, এখন হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আর পেছনে তো লাগবেই।


এই গাড়ি?

ওপরে চল, বলছি।


দীপ্ত পেছনে তাকায়, ছন্দার গাড়ি অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফ্ল্যাটে পৌঁছে আর সময় দেয় না দীপ্ত। বসতে না বসতেই জেরা শুরু হয়,


তুমি এই গাড়িতে কেন?

কেন মানে? ছন্দা এই গাড়িতে পাঠাল আমাকে।

ছন্দা? ছন্দা কি করে এই গাড়িতে তোমাকে পাঠায়?

কি মুশকিল? এটা ওদের গাড়ি আর ওরা খুব বড়লোক, তুমিই তো সেদিন বললে শাঁসালো পার্টি!

এটা ছন্দার গাড়ি?

হ্যাঁ মশাই, আর এই গাড়িতেই আমি ফিরেছি, দেখলে তো?

কে এই ছন্দা?

আচ্ছা বিপদ তো? কি আরম্ভ করেছ তুমি? ছন্দা আমার কলেজের বন্ধু। বলেছি তো তোমায়।

এ গাড়ির মালিক কে জানো?

মানে?

এ গাড়ি রাধাকৃষ্ণ ইন্টারন্যাশনাল কন্সট্রাকশন কোম্পানির গাড়ি। এটা কোম্পানির ক্লায়েন্টদের রিক্রিয়েশনের জন্য ব্যবহার হয়। এ গাড়ি আমি চিনি।

সে কি?

হ্যাঁ ম্যাডাম।

এ রকম দেখতে কি আর কোনও গাড়ি থাকতে পারে না?

না পারে না। গাড়ির নম্বরটা খেয়াল করেছ?

গাড়ির নম্বর?

হ্যাঁ, ১২৩৪। এ ধরণের নম্বর এমনিতে পাওয়া যায় না। কাঠখর পোড়াতে হয়। এ নম্বর আমার মুখস্থ। আচ্ছা এখন বলো তো, ছন্দার হাজ়ব্যান্ডের নাম কি?

দিব্যেন্দু, পুরো নাম জানিনা। 

ও মাই গড!


মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে পড়ে দীপ্ত।


কি হল?

শোনো তোমায় পুরো ব্যাপারটা বলছি। ভেরি কনফিডেনশিয়াল, কিন্তু তোমার এখন জানা দরকার। কিন্তু প্রথমে বলো, ছন্দা কি জানে, তুমি কে? মানে ও কি জানে তুমি আমার স্ত্রী?

না, ও তো তোমার কথা কিছু জিজ্ঞেসই করেনি।

আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে। এতদিন পর হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা। বাড়িতে নেমন্তন্ন?

তুমি কিন্তু ভীষন আবোল তাবোল বকছ!

ওকে। বলছি। মন দিয়ে শোনো। রাধাকৃষ্ণ ইন্টারন্যাশনাল কন্সট্রাকশন কোম্পানির মালিক দুই ভাই। বড় শুভেন্দু শেখর  এবং ছোট দিব্যেন্দু শেখর। ছোট ভাই চেয়ারম্যান, কোম্পানি ঐ চালায়। বাবা নবেন্দু শেখর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন। মারা গেছেন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠা নবেন্দু শেখরের হাতেই। ভালই চলছিল যতদিন বুড়ো বাবা বেচে ছিলেন। দিব্যেন্দু কর্ণধার হতেই বাঁকা রাস্তা ধরল। সব ডীটেলস বলতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে, তাই সংক্ষেপে বলছি, কয়েকটা খুব বড় সরকারি কাজ ওদের দেওয়া হয়েছিল। বেশির ভাগই হাইওয়ে এবং ব্রীজ। বড় মুনাফার আশায় দিব্যেন্দু কারচুপি শুরু করল যেমন বাজে মাল দেওয়া, হিসেবে গড়মিল দেখানো। প্রথম দিকে ধরা পড়েনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের অফিসাররাও তো ইনভলভড। সেই সময়টা প্রচুর টাকা কামিয়েছে কোম্পানি। কিন্তু লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ইদানিং কয়েকটা মেজর ইশুতে ফেঁসে গেছে। ব্রীজ একটা কোলাপস করেছে আদিবাসী অঞ্চলে, বেশ কিছু লোক মারা গেছে। হাইওয়ের যে অংশটা ওরা করেছিল, সেটা তিন জায়গায় ধসে গেছে। পার্লামেন্টে প্রচুর হৈচৈ হয়েছে এ নিয়ে। কাগজে দেখে থাকবে। গত মাসে ইনভেস্টিগেশন কমিটি বসানো হয়েছে। এর মধ্যেই রিপোর্ট বেরোবে। আর যেটা তোমার জানা দরকার সেটা হল যে আমি এই কমিটির চেয়ারম্যান।

বল কি?

তাই তো বলছি। ওদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সমস্ত সাক্ষীসাবুদ ওদের বিরুদ্ধে। বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।

কি হবে?

প্রথমে তো ওদের ব্ল্যাক লিস্ট করা হবে। আর কোনও কাজকর্ম ওরা পাবেনা। তাতে ওদের এই ব্যবসা উঠে যাবে। দ্বিতীয়তঃ ক্ষতিপুরণের সিদ্ধান্ত যদি হয়, তবে বিষয় সম্পত্তি ক্রোক হতে পারে। আর ফাইনালি, ক্রিমিনাল নেগলিজেন্সের জন্য জেলও হতে পারে।

এ মা। বেচারা ছন্দা!

সত্যি কি বেচারা? ভেবে দেখ তো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে তুমি কে সেটা জেনেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তোমাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। তোমার থ্রুতে আমাকে অ্যাপ্রোচ করার ইচ্ছে হয় তো।

অত সোজা নয়। তুমি আমাকে পুরো ব্যাপারটা বলে ভাল করেছ। আমি আর ওদেরকে কাছে ঘেঁসতে দেব না।

ঐ গাড়িতে যদি তোমাকে কেউ দেখে থাকে, তবে কিন্তু আমি একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ব। শত্রুর অভাব কিন্তু নেই আমার। এ ধরনের বেশ কিছু কেস হ্যান্ডেল করেছি আমি আর প্রচুর বন্ধু খুইয়েছি।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা কাকতালিয়।

কেন কি করে?

দেখো, সেদিন ছন্দা এখানে বেশিক্ষন বসল না। মনে হচ্ছিল এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে। যদি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আসত, তবে বসত এবং তোমার সঙ্গে আলাপ করে যেত। সত্যি কথা বলতে কি ও একবারের জন্যও তোমার বা মিন্টির কথা জিজ্ঞেস করল না। ওদের বাড়িতেও না।

তবে তোমাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেল কেন?

ওর বৈভব দেখাতে। সারাক্ষণ তো নিজেদের ব্যবসা আর ধন সম্পত্তির গল্পই করল। বাড়ি দেখালো ঘুরে ঘুরে। রাজকীয় কায়দায় খাওয়ালো...

সেটা অসম্ভব নয়। তবে সন্দেহ একটা থেকেই যায়।

আর দিব্যেন্দু, ছন্দার বর তো আমাকে পাত্তাই দিল না। যদি আমার পরিচয় জানত, তবে একটু খাতির করত আশা করি।

দিব্যেন্দুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে না কি?

হ্যাঁ কি সব কাগজ পত্র নিতে এসেছিল। আমার সঙ্গে তো ভাল ভাবে কথাই বলল না। আমার খুব খারাপ লেগেছে। তাই বলছি, যদি ও জানত আমি কে, তবে অত অভদ্র ব্যবহার করত না।

গুড পয়েন্ট। কোথায় দেখা হল?

আমরা তখন খেতে বসেছি। হঠাৎ হন্তদন্তঃ হয়ে ঢুকল, ঢুকেই বেশ কড়া মেজাজে ছন্দাকে বলল আলমারির চাবি দিতে। ছন্দা আলাপ করিয়ে দিল আমার সঙ্গে, ভাল করে আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। আমার খুব খারাপ লেগেছে ছন্দার বরের ব্যবহার। তবে খুব টেন্স মনে হচ্ছিল। পরে ছন্দা বলল যে কি একটা কেসের ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে মীটিং চলছে। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তোমার এই কেসটা নিয়েই হয়তো। 

হতে পারে, জানিনা। কিন্তু সাবধান। এর পরে যদি যোগাযোগ করে বলে দিও ব্যস্ত আছ।

ঠিক আছে তুমি চিন্তা কর না। বসো, আমি চা নিয়ে আসছি। একটু সময় দিতে হবে কিন্তু, আমার ফিরতে এত দেরি হবে বুঝতে পারিনি।


ব্রততী বেরিয়ে যায়, রান্নাঘরে ঢোকে। ছন্দাটার জন্যে খারাপই লাগছে। বেচারার তাসের ঘর ভেঙে পড়তে আর দেরি নেই। আবার অনুকম্পাও হচ্ছে এই ভেবে যে এত বর আর বরের ব্যবসার কথা বললি সারা দুপুর ধরে, কিন্তু তোর বরের ভবিষ্যৎ তো এখন আমার বরের হাতে।


চায়ের জল বসায় ব্রততী। একটু আলু বের করে ধুয়ে, ছাড়িয়ে কেটে রাখে এক পাশে। দেরাজ খুলে ময়দা বের করে। আজ একটু লুচি তরকারি করে দেবে চায়ের সঙ্গে। অনেক দিন বিকেলের জলখাবারে লুচি হয়নি। আজ একদিন হলে কিচ্ছু হবে না। এত লুচি খেতে ভালবাসে দীপ্ত।


************

























No comments:

Post a Comment