নাত্নীর বয়স পৌনে তিন। দেখা হল ঠিক এক বছর পর। এর আগে দেখা হয়েছিল গত বছর, - যখন কোলকাতায় এসেছিল। ছিল মোটে আড়াই সপ্তাহ। আমেরিকায় ছুটিছাঁটা বড্ড কম। এবার তাই আমরাই চলে এসেছি। থাকব কিছু দিন।
নাত্নী স্কুলে যেতে শুরু করেছে মাস কয়েক আগে। স্কুল বললে ভুল হবে, বরং বলা যেতে পারে প্লে-স্কুল বা ডে কেয়ার সেন্টার। এরা বলে প্রি-স্কুল। মা বাবা দুজনেই চাকরি করে তাই অফিস যাওয়ার মুখে নামিয়ে দিয়ে যায়। টীচাররা সেই সময়টা দেখাশোনা করে। খাইয়ে দেয়। নানা রকম খেলার ব্যবস্থাও আছে। বিছানা আছে ছোট ছোট। সময় মত ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াও হয়।অন্যান্য বাচ্চারাও থাকে, তাদের সঙ্গে বেশ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তবে ইদানীং কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই বাঙলা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আজকাল না কি শুধু ইংরিজি বলে। নাত্নীর মা, অর্থাৎ আমার কন্যা খুব খেটে খুটে বেশ কয়েকটা বাঙলা ছড়া ও গান শিখিয়েছিল, সব নাকি ভুলে গেছে। আমার কন্যা ছোটবেলায় প্রত্যেক দিন গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখত। স্কুল থেকে ফিরলেই ভিডিও চালিয়ে দিতে হত। আমিও কিনে রেখেছিলাম ঐ ছবির ক্যাসেট। মেয়ের উৎসাহে নাত্নী শিখেছিল নানা গান, - দেখো রে নয়ন মেলে, ওরে মন্ত্রী মশাই ষড়যন্ত্রী মশাই ইত্যাদি। এখন স্কুলে সব ইংরিজি গান আর ছড়া শেখানো হচ্ছে। অবশ্য সেগুলো আমাদের দেশের শিশুদের কাছেও খুব পরিচিত। যেমন টুইঙ্কিল টুইঙ্কিল লিটল স্টার, বা বা ব্ল্যাক শীপ, মেরী হ্যাড আ লিটল ল্যাম্প ইত্যাদি।
বাচ্চাদের স্কুল। বছরে দু-বার অভিভাবকদের আমন্ত্রন জানানো হয়। বাচ্চারা মঞ্চে উঠে স্কুলে শেখা গান গায় বা ছড়া আবৃত্তি করে। আমার মেয়ে জামাইও গেছে। গিয়ে দেখে আমাদের নাত্নী মুখ চুন করে এক কোনায় বসে আছে। দেখে মনে হয় বেশ নার্ভাস। এক সময় ডাক পড়ল নাত্নীর। ভয়ে ভয়ে স্টেজে উঠে হঠাৎ মা-বাবাকে দেখে এক গাল হাসি। হাত টাত নেড়ে একেবারে হৈ হৈ কান্ড। ব্যাপার স্যাপার দেখে দর্শকরা হেসেই কুটিপাটি।এদিকে সামনে দাঁড়িয়ে এক টিচার ইশারায় বললেন গান শুরু করতে।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে উদাত্ত কন্ঠে মাইকের সামনে শুরু হল, - ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে। মা-বাবাকে খুশি করার কি অসীম আগ্রহ। টীচার তো হতভম্ব। এ কি গাইছে। হাত পা নেড়ে নাত্নী গেয়েই চলেছে মা-বাবার দিকে তাকিয়ে, পেটে খেলে পিঠে সয়, এ তো কভু মিছে নয়। দর্শকের আসনে অন্যান্য অভিভাবকরাও বিভ্রান্ত। ভরা হলের এক কোনে আরও একটি বাঙালী পরিবার ছিল, তারা তো আনন্দে প্রায় হাততালি দিয়ে উঠল। টীচার এসে সলজ্জ কন্ঠে জানালেন, - কি গাইছে জানিনা, আমরা তো এসব শেখাইনি। যাই হোক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল তখনকার মত।
এই ঘটনা শুনে আমি কিন্তু খুব পুলকিত। এ আমারই নাত্নী। আমার তো দৃঢ় বিশ্বাস, যেখানেই থাকো, যেখানেই জন্মাও, আসল শেকড় থাকবে দেশের মাটিতেই।
শাবাশ দিদিভাই।
নিউ জার্সি ৩০/১/২০১৬
No comments:
Post a Comment