কুয়েতনামা ১
১৯৮১ সালের
জানুয়ারীতে এসে পৌঁছোই কুয়েতে। এয়ার ইন্ডিয়ার
ফ্লাইট ৪ ঘন্টা দেরীতে ছেড়েছিল বম্বে থেকে। রাত ৯টায় যেখানে পৌঁছোবার কথা, সেখানে রাত ১টায় পৌঁছোয়। বাইরে
লাল ট্যাক্সি পাওয়া যায় জানতাম, মাস তিনেক আগে যখন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম, তখন
দেখে গেছি। কিন্তু এত রাতে, অচেনা জায়গা,- একটু ভয় ছিল মনে। ইমিগ্রেশনে আমার
সামনেই এক সুদর্শন সর্দারজী দাঁড়িয়েছিলেন, বছর ৪০/৪৫-এর হবেন। যখন লাগেজের জন্য
অপেক্ষা করছি, ভদ্রলোককে গিয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম যে আমাকে আহমদী যেতে হবে, এত
রাতে সেটা কি নিরাপদ? একটু হাসলেন ভদ্রলোক, জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে আসছ? জানালাম,
- কলকাতা থেকে। আবার হেসে বললেন, - আমি থাকি বম্বে। এইটুকু বলতে পারি এই জায়গা
কলকাতা, বম্বে বা দিল্লী থেকে অনেক নিরাপদ। নির্ভয়ে চলে যাও। আমি যাচ্ছি উলটো দিকে
নইলে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যেতাম। ভদ্রলোক, একটি লাল ট্যাক্সিতে আমাকে তুলে দিয়ে,
আরবি ভাষায় ড্রাইভারকে বলে দিলেন আমাকে কোথায় নামাতে হবে।
বলা
বাহুল্য নিরাপদেই পৌঁছেছিলাম।
তিন
মাসের প্রোবেশন ছিল কেওসি-তে। তবে সাধারণতঃ মাস দেড়েকের মধ্যেই
কনফার্ম করে দেওয়া হত। তারপর রেসিডেন্স এবং ওয়ার্ক পারমিট (আকামা), ফ্যামিলি ভিসা
ইত্যাদির ব্যবস্থা করে গৃহিনী সুমিতা আর চার বছরের কন্যা শ্রেয়া এসে পৌঁছোতে
এপ্রিল হয়ে গেল। মুশকিল হল একটাই; তখনও ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়নি। একটা লারনার
লাইসেন্স (ইস্তেমারা) পাওয়া গেছে কিন্তু টেস্টের তারিখ দেয়নি তখনও। শুনলাম কয়েক
বছর আগে অব্দি ভারতীয় লাইসেন্স দেখালেই কুয়েতি লাইসেন্স দেওয়া হত; কোনও পরীক্ষা
দিতে হত না। কিন্তু সেই সুবিধে আর পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এরা জেনে গেছে যে ভারত,
পাকিস্তান ও বাঙলাদেশের লাইসেন্স পয়সা দিলেই পাওয়া যায়। ব্রিটিশ বা আমেরিকানদের
ড্রাইভিং টেস্ট দিতে হয় না।
ড্রাইভিং
লাইসেন্স না হওয়া অব্দি আল-গানিমের কল-ট্যাক্সিতেই যাওয়া আসা করতাম। ঝকঝকে
ইম্পালা, ফোন করলেই চলে আসত। ফিনতাসে থাকতাম। ফাহাহিল অব্দি ভাড়া ছিল দেড় দিনার (১
দিনার = ৩০ টাকা)। যেতে আসতে তিন দিনার। ফাহাহিলে আল-গানিমের অফিস ছিল, সেখানে সারি সারি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকত।
যেদিন থাকত না, সেদিন বাসে ফিরতাম; ভাড়া মাথাপিছু ১০০ ফিলস।
একদিন
বাসে ফিরছি। জানলার পাশের সীটে আমি বসেছি। কোলে শ্রেয়া। পাশে সুমিতা। শ্রেয়া প্রায় ঘুমন্ত। বাসের
দুলুনিতে হঠাৎ চোখ খুলে, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, - বাবা দেখো
সমুদ্র।
বাসটা হঠাৎ একটু যেন ঝটকা দিয়ে
উঠল। সামনে তাকিয়ে দেখি ড্রাইভার সহাস্য মুখে আমাদেরই দিকে তাকিয়ে। আমরা কিছু
বোঝার আগেই এক গাল হেসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, বাঙ্গালী?
আমরাও বিস্মিত। জানালাম হ্যাঁ।
পরের প্রশ্ন, - কোন জিলা? বললাম, -আমরা কলকাতার।
আচ্ছা ইন্ডিয়ান বাঙ্গালি?
মহা উৎসাহে গল্প জুড়ে দিলেন। কোথায় কাজ করি, বেতন টেতন কেমন, ফ্যামিলি নিয়ে এসেছি কিন্তু গাড়ি কিনিনি কেন,
- ইত্যাদি। নিজের সম্বন্ধেও অনেক কথা জানালেন। ভদ্রলোকের উচ্চারণ শুনে বুঝলাম যে আমার
পূর্বপুরুষেরা যে অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন, উনি সেই অঞ্চলেরই। বাবা, কাকার মুখে
শোনা কিছু দেশি সংলাপ ছেড়ে দিলাম এবং জানালাম আমিও আদতে ঐ অঞ্চলেরই লোক। শুনে তো
তিনি খুব খুশি; গ্রামের নাম টাম জিজ্ঞেস করলেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেখলাম বাড়ির
কাছে পৌঁছে গেছি। ওনাকে জানালাম যে সামনের স্টপে নামব।
মনে হল
উনি একটু হতাশ হলেন; আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল। জিজ্ঞেস করলেন, - কোন দিকে বাসা
আপনার? আমি রাস্তার উলটো দিকে আমাদের বিল্ডিঙের রাস্তা দেখিয়ে দিলাম। শুনে উনি
বললেন, - ও রে বাবা, রাস্তা পার হইবেন কি ভাবে? বললাম চলে যাব আস্তে আস্তে। আমার
উত্তর শুনে খুশি হলেন না মনে হল। শ্রেয়াকে দেখিয়ে বললেন, - না না, মামনির কষ্ট
হইব।
আমরা
কিছু বোঝার আগেই ভদ্রলোক দুম করে একটা ইউ-টার্ন নিয়ে, বাস-রুট থেকে বেরিয়ে সোজা
রাস্তার উল্টো দিকে আমাদের বাড়ির দিকে বাস ঘুরিয়ে দিলেন। বাসের অন্য যাত্রীদের
তীব্র প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সেই বিরাট বাস থামালেন আমাদের বিল্ডিঙের সামনে। বাস
থেকে নেমে শ্রেয়াকে নামতে সাহায্য করলেন। আমরা নামতেই বাসে উঠে, ঘুরিয়ে চলে গেলেন
নিজের রুট অনুযায়ী। যাবার সময় হাত নেড়ে বলে গেলেন,
সালাম ভাই, দোয়া করবেন। আমরা বিহবলের মত দাঁড়িয়ে।
এই
সহৃদয় বাঙালী বন্ধুটির সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি।
কুয়েতনামা ২
অফিসে বসে কাজ করছি একদিন। হঠাৎ ফোন এল। অচেনা গলা, - মে আই স্পীক টু মিস্টার সিদ্ধার্থ
দেব। জানালাম, - বলছি। পরিচয় পেলাম সেই ব্যক্তির, -
হিমাংশু ভৌমিক, কেএনপিসি-তে কর্মরত। কুয়েতের বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটির
সাধারণ সম্পাদক। হিমাংশুর সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। জানতে চাইছিল আমরা মেম্বার হব কি
না। আমি তো এক কথায় রাজি। বাড়ির ঠিকানা দিলাম। সে দিন সন্ধ্যায় হিমাংশু এল
সপরিবারে। হাতে চকোলেটের বাক্স। মেম্বারশিপ ফর্ম নিয়েই এসেছিল। তখনকার দিনে স্বামী
ও স্ত্রী আলাদা মেম্বার হতে পারতেন। বাৎসরিক ১০ দিনার মাথা পিছু। আমরা দু-জনে
আলাদা মেম্বার হলাম। আমাদের আগে মোট মেম্বারেরে সংখ্যা ছিল ৩৮। আমাদের নিয়ে ৪০ হল।
দু-সপ্তাহ পরে সালমিয়া গার্ডেনে
পিকনিক। আমার তো গাড়ি নেই। আমাকে জানানো হল নবাশিস কবিরাজ নামে একজন আমাকে নিতে
আসবে। কবিরাজ এল বিশাল একটা মান্ধাতা আমলের গাড়ি নিয়ে। মে মাসের শেষ তখন, বেশ গরম
পড়ে গেছে। গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কবিরাজ গাড়ির কাচ নামিয়ে দিতে বলল, এসি না কি
কাজ করছে না। সেই গরমে সালমিয়া গার্ডেনে পৌঁছোলাম। এক কোনায় বড় বড় গাছের ছায়ায় বেশ
ভীড়, একটু হাল্কা হাওয়া, সেখানে অবশ্য খুব একটা গরম লাগছিল না। আমাদের দেখে সবাই
হৈ হৈ করে উঠল। আমাদেরই জন্য বিসিএসের সদস্য সংখ্যা চল্লিশ ছুঁয়েছে, সে কি
উত্তেজনা।
রায় দা অর্থৎ বিভূতোষ রায় তখন
বিসিএসের প্রেসিডেন্ট। নিজেই এসে আলাপ করলেন। রায় বৌদির সঙ্গেও আলাপ হল। এত দিন
আগেকার কথা স্মৃতি অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সেদিনই আলাপ হয়েছিল
অসিত মানে অসিত কুন্ডুর সঙ্গে। বিসিএসের ট্রেজারার, হাতে জাবদা খাতা। যাদের চাঁদা
বাকি, তাদের কাছে থেকে আদায় চলছে। প্রাক-কম্প্যুটারের যুগে হাতে লিখে প্রত্যেকটি
জমা খরচের হিসেব থাকত সেই খাতায়; নির্ভুল। অসিত বিসিএসের এক জন ফাউন্ডার মেম্বার
এবং খুব সম্ভবতঃ অসিত ছাড়া আর কোনও ফাউন্ডার মেম্বার এখন আর কুয়েতে নেই।
সেই সময়, পিকনিকে মেম্বাররাই
নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নানা রকম রান্না করে নিয়ে আসতেন। কয়েকজন হয়তো মাছ
বানালেন, কয়েক জন মাংস, কেউ বা নিরামিষ কোন পদ কেউ বা চাটনি। সেদিন রায় বৌদি এক
গামলা রসগোল্লা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। জীনস এবং টি-শার্ট পরা একটি ছেলে, বৌদি
চোখের আড়াল হলেই, ঢাকনা খুলে গপাগপ গালে পুরছিল; আর বৌদি ‘দাশগুপ্তোওও’ বলে ছুটে
যাচ্ছিলেন। সে এক মজার দৃশ্য। জানলাম ছেলেটির নাম স্বপন দাশগুপ্ত, স্ত্রী নন্দিতা সংক্ষেপে
নন্দা। ওদের সঙ্গে সেদিনই আলাপ হল। আর সবাই এসে নিজেরা পরিচয় দিলেন এবং খুব সহজেই
আপন করে নিলেন। এত দিন আগের কথা, কাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মনে নেই। তবে বোধহয় অসিত
– আলপনা কুন্ডু, কল্যাণ-কৃষ্ণা মজুমদার, মজুমদার দা – দীপা বৌদি, সলিল-ধরিত্রী (বুবুল) ব্যানার্জি; এঁদের সবার সঙ্গে সেদিনই
আলাপ হয়েছিল। রায় দা, মজুমদার-দা, স্বপন এঁরা
আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, বিসিএসের প্রথম দিন গুলোতে এঁদের অবদান অবিস্মরণীয়।
সারাদিন হৈ চৈ করে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরলাম। এবার হিমাংশু
পৌঁছে দিল বাড়িতে। ফিরে এসে বুঝলাম এই অচেনা মরুর দেশে নিজেদের লোক পেয়ে গেছি।
এখানে বেশ জমিয়ে থাকা যাবে। এবং ছিলামও, - পুরো ৩২ বছর।
কুয়েতনামা ৩
ফিনতাসে যে ফ্ল্যাটে উঠেছিলাম,
সেগুলো কম্পেনি থেকেই ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ফ্ল্যাটে ফোন ছিল না।
নীচে হারিসের ঘর থেকে বাইরে ফোন করতে হত। বা ঐ নাম্বারে আমাদেরকে কেউ ফোন করলে
হারিস ডেকে দিত। একদিন রায় দা অফিসে ফোন করে বললেন , - আপনার ফ্ল্যাটে নাকি ফোন
নেই? জানালাম, - না নেই।
কেন? আপনি অ্যাপ্লাই করেন নি?
না, মানে কম্পেনির ফ্ল্যাট তো?
ও আচ্ছা। তবে তো আপনার সঙ্গে
ছুটির দিনে যোগাযোগ করা যাবে না, - একটু চিন্তিতই মনে হল।
উইক-এন্ড এল। তখন বৃহস্পতি ও
শুক্র ছিল আমাদের উইক-এ ন্ড। মিনিস্ট্রিতে বৃহস্পতি বারে হাফ ছুটি ছিল। বৃহস্পতি বার সকালে দরজায় বেল।
খুলে দেখি কাভার-অল পরিহিত এক ভারতীয়, হাতে একটি টেলিফোন যন্ত্র। দক্ষিন ভারতীয়
উচ্চারণে জানতে চাইল কঁহা ফিট করনা হ্যায়। পেছনে হারিস এবং আরও কয়েক জন প্রতিবেশীর
কৌতূহলী মুখ।
হারিস জানালো লোকটি আমার
ফ্ল্যাটেই ফোন বসাতে এসেছে। আমিও অবাক, লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম কে তোমায় পাঠিয়েছে।
লোকটি বলল, টেলিফোন অফিস-সে রয় সাহাবনে ভেজা। শুনে তো আমি হতভম্ব। তাড়াতাড়ি নীচে
গেলাম, হারিসের ঘর থেকে রায়দাকে ফোন করব বলে। আমার পেছন পেছন হারিস আর অন্যান্য
প্রতিবেশী। একটু ফিসফাসও শুনলাম, - হাও কুড হি গেট আ ফোন বিফোর মি? আই ওয়াজ দ্য
ফার্স্ট টু মুভ ইন হিয়ার... ইত্যাদি।
ফোনে পেয়ে গেলাম রায়দা কে। জানালাম এ ভাবে ফোন লাগানোটা
বোধহয় ঠিক হবে না। হাজার হোক ফ্ল্যাট তো আমার নামে নয়। একটু যেন একটু নিরাশ হলেন
রায় দা, - ঠিক আছে, আপনার যা ইচ্ছে। কাভার-অল পরিহিত ব্যাক্তিটিকে ফোন শুদ্ধ ফেরত
পাঠানো হল। সরকারি অফিসে সেকালে ভারতীয়দের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। স্থানীয় লোকদের
মাতব্বরি ছিল না খুব একটা। বিদেশীরা,
বিশেষ করে ভারতীয় বা ফিলিস্তিনিরাই ছিল সর্বেসর্বা।
অবশেষে ফোন লাগল ফ্ল্যাটে। অফিস থেকেই ব্যবস্থা হল। তারপর একদিন ড্রাইভিং টেস্টও পাশ করে গেলাম। সাতদিন পরে
লাইসেন্স হাতে পাওয়া যাবে। শুরু হল শো-রুম ঘুরে গাড়ি পছন্দ করা। এখনকার তুলনায়
গাড়ি অনেক সস্তা ছিল সেই আমলে। টয়োটা ২০০০ সিসি গাড়ি ২০০০ থেকে ২২০০ দিনারের মধ্যে
পাওয়া যেত। বড় আমেরিকান গাড়ি পাওয়া যেত ৩০০০ দিনারে। সিক্স সিলিন্ডার আমেরিকান কমপ্যাক্ট গাড়ি গুলো তখন সদ্য বাজারে বেরোতে শুরু করেছে। একটা ওল্ডসমোবিল কমপ্যাক্ট মডেল
পছন্দ হয়ে গেল। ক্যাশ ডাউন প্রাইস ২৪৫০ দিনার। ঠিক করলাম ১০০০ দিনার ক্যাশ-ডাউন
করে বাকিটা ইন্সটলমেন্টে দেব।
লাইসেন্স হাতে এল এক দিন, - পুরোটা আরবীতে লেখা। একজন
কুয়েতি সহকর্মীকে দিয়ে পড়ালাম। বলল লেখা আছে লাইসেন্স দশ বছরের জন্য ভ্যালিড। আর
আমার নাম লেখা আছে, - দীব সাঈদ হার্থা। ঐ নামেই কুয়েতে গাড়ি চালিয়েছি শেষ দিন
অব্দি।
এক দিন এক বন্ধুর গাড়িতে সুমিতা আর শ্রেয়া কে নিয়ে হাজির
হলাম আল-গানিমের শো রুমে। পছন্দ করা ওল্ডসমোবিলের পাশেই একটা বড় দুধ-সাদা পন্টিয়াক
রাখা ছিল। আট সিলিন্ডারের গাড়ি, ৪৬০০ সিসি। একই দাম। সুমিতার দেখি সেটাই পছন্দ।
চার বছরের শ্রেয়ার মতও নেওয়া হল। সেও দেখি মায়ের দলে, পন্টিয়াকের দিকে আঙুল তুলে
বলে দিল, - ওটা। তাই নেওয়া হল। ১০০০ হাজার ক্যাশ ডাউন করার পর দু-বছর ধরে প্রত্যেক
মাসে ৯১ দিনার দিতে হবে। পরের দিন গাড়ির ডেলিভারি। সুমিতা আর শ্রেয়াকে গাড়িতে
বসিয়ে রওনা হলাম বাড়ির দিকে। বন্ধুটিকে বললাম পেছন পেছন আসতে। ডান দিকের লেন ধরে
বাড়ি পৌঁছোই। ভাগ্য ভাল এর ক’দিন পরই রামাদানের মাস পড়ে গিয়েছিল। ইফতারের সময়
রাস্তা সুনসান, সেই সময় গাড়ি নিয়ে বেরোতাম।
একদিন রায়-দা রাত্রে ডিনারে ডাকলেন। আটটা নাগাদ পৌঁছোতে
বললেন। আমার সেদিন অগ্নিপরীক্ষা। সালমিয়া যেতে হবে গাড়ি নিয়ে। রাস্তা জানা নেই।
ফাহাহিল এক্সপ্রেসওয়ে (৩০) তখন তৈরি হচ্ছে। আর কোনও ফ্লাইওভার ছিল না, ছিল বিশাল
বিশাল রাউন্ড অ্যাবাউট। নেভিগেটর হিসেবে গৌর ভট্টাচার্যিকে সঙ্গে নিলাম, কুয়েতের
পুরনো বাসিন্দা, রাস্তা ঘাট সব চেনা। আমি আর গৌর সামনে। সুমিতা, অরুন্ধতী, শ্রেয়া
আর গুল্লি (চেতনা) পেছনে।
বিনা সমস্যায় পৌঁছোলাম। মাঝে কয়েকটি গাড়ি অধৈর্য হয়ে পেছন
থেকে হর্ন দেওয়া ছাড়া আর কোনও সমস্যা হয়নি।
অসিতের সঙ্গে আবার দেখা হল রায়দার বাড়িতে। সেদিনই জানলাম অসিত রায়-বৌদির
ছোট ভাই। গল্প গুজবের মাঝখানে বৌদি জিজ্ঞেস করলেন চা, কফি বা কোনও সফট ড্রিংক নেব কি
না।
আর তখনই রায়দা একটা বোমা ফাটালেন, - জিজ্ঞেস করলেন, - একটু
ওয়াইন চলবে?
আমি তো শুনে স্তম্ভিত! কি? ওয়া--- এখানে মানে কুয়েতে??
রায়দার মুখে মৃদু হাসি, - খাবেন কিনা বলুন না?
হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কিন্তু পেলেন কোথায়? দাদা গম্ভীর হয়ে
বললেন, - বানিয়েছি। আমরা এখানে বানাই। আমি আবার স্তম্ভিত।
ওয়াইন এল সুদৃশ্য গ্লাসে। অতি সুঃস্বাদু। একটু ইতস্ততঃ করে
জানতে চাইলাম প্রস্তুত প্রণালী। রায় দা বললেন, - একটা ঢাকনা-ওয়ালা বড় প্লাস্টিকের
বালতি, ১২ বোতল গ্রেপ জুস (সাদা বা লাল), দু-কেজি চিনি আর মেশানোর জন্য একটা বড়
কাঠের হাতা কিনে আমায় খবর দেবেন। আমি এসে দেখিয়ে দেব।
তাই হল। নির্দিষ্ট দিনে রায়দা এসে ডেমো দিলেন, - আর লিখে
দিলেন এর পর কি কি করতে হবে। তিন সপ্তাহ পর পেয়ে গেলাম ১২ বোতল উৎকৃষ্ট শ্বেত
সুরা। এর পর কুয়েতে বরাবরের জন্যে তৃষ্ণার অবসান।
এর পর যতবারই
বানিয়েছি, মনে পড়েছে রায়-দাকে। রায়-দা অকালে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।
কুয়েতনামা ৪
মেম্বারদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে
সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমাকে দিয়ে কোনও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ আশা করবেন না।
আমি নেহাৎই অসাংস্কৃতিক। তবে হ্যাঁ সুমিতা দেশে থাকতে কিছু অনুষ্ঠান করেছে এবং
করিয়েছে; দরকার হলে ওকেই বলবেন।
একদিন হিমাংশু আর রায়দা বাড়ি এলেন।
সামেনেই ২৫ শে বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষ্যে একটা অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা
চলছে। কমিটির ইচ্ছে এবার নতুন কিছু হোক। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য আগে হয়নি কখনও। ওদের
ইচ্ছে এবার সুমিতা একটি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য পরিচালনা করুক। সুমিতা রাজি হল, আর
সেই প্রোগ্রামের দৌলতে আমাদের আরও লোকজনের সঙ্গে আলাপ হয়। মনে আছে প্রথম মীটিং
হয়েছিল সাঁতরাদার (শ্রী পান্নালাল সাঁতরা) বাড়িতে। অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শাপমোচন’ মঞ্চস্থ করা হবে। সাঁতরাদার দুই মেয়েও অংশ গ্রহণ
করেছিল। সাঁতরা-বৌদি রন্ধন শিল্পে বিশেষ পারদর্শী। সেই সন্ধ্যেয় যত না অনুষ্ঠান
নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল খানাপিনায়। প্রসঙ্গতঃ বলে
রাখি সাঁতরা-দা নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত রন্ধনশিল্পী। দৈনন্দিন রান্না উনি করতেন না।
তবে পিননিকে শ-খানেক লোকের রান্না নামিয়ে দিতে পারতেন। এক একই গুণ ছিল পরিমল
(পরিমল দে) আর সলিলের (সলিল ব্যানার্জি)। বিসিএসের সদস্য সংখ্যা যখন বেড়ে শ-দেড়
শয়ে দাঁড়াল, তখন সাঁতরা-দা, পরিমল বা কখনও সলিলের (ব্যানার্জি) ওপর সমস্ত রান্নার
দায়িত্ব অর্পিত করা হত। পিকনিক স্পটেই উনুন জ্বেলে রান্না
হত। পরিবেশনের দায়িত্ব নিতেন দত্ত-দা (মনোহর দত্ত), দাশ-দা, কল্যাণ এবং আরও কয়েক
জন। সবাইকে খুব যত্ন করে খাওয়াতেন এঁরা। শেষে নিজেদের জন্য আর কিছুই থাকত না। অনেক
সময় এঁদের শুধু ভাত আর মাংসের ঝোল দিয়ে খাওয়া সারতে দেখেছি।
দাশ-দার কোনও খবর জানিনা। কল্যাণ
(মজুমদার) কুয়েত এয়ারয়েজ থেকে ইউ এন-এ চলে যায়। সম্প্রতি অবসর নিয়ে দিল্লিতে আছে। দত্ত-দার
খবর নিয়মিত পেতাম বুরনের (প্রবীর দত্ত) কাছে। (এটা লেখার ক’দিন পরেই জানতে পারি যে দত্তদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর
আত্মার চিরশান্তি কামনা করি)।
শাপমোচনের মহড়া বা রিহার্সাল
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন লোকের বাড়িতে হত। বহুবার রাস্তা হারিয়েছি। একবার তো সালমিয়া
থেকে ফিনতাসে ফেরার পথে হঠাৎ দেখলাম কুয়েত টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ উল্টো
রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম! কিন্তু এ ভাবেই কুয়েতের রাস্তা ঘাট চিনেছি। আর সেই সূত্রে
আলাপও হয়েছিল অনের সঙ্গে।
খুব সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ হয়েছিল
শাপমোচন। কমলিকার ভূমিকায় অরুন্ধতী ভট্টাচার্য আর রাজার ভূমিকায় সুমিতা। অন্যান্য
ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেছিল স্কুলের মেয়েরা। লাইভ মিউজিক করা যায় নি। রেকর্ড বাজানো
হয়েছিল। অনুষ্ঠানের পর সুমিতার বেশ পরিচিতি হয়ে গেল কুয়েতের বাঙালী মহলে।
আমারও হল, এক নতুন পরিচয় - সুমিতা দেবের হাজবেন্ড!!
কুয়েতনামা ৫
সত্তরের দশকে ফাহাহিল, আবু হালিফা বা আহমেদিতে বাঙালীদের সংখ্যা ছিল হাতে
গোনা। ১৯৮০ থেকে ধীরে ধীরে কেওসি ও কেএনপিসি-তে এক এক করে বাঙালীদের আগমন শুরু হয়।
আমরা যখন আসি তখন ফাহাহিলে আমার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, নাম তপন
সেনগুপ্ত। তপন ও নূপুর বাড়ি এল একদিন। আড্ডা হল চুটিয়ে, নেমন্তন্ন করে গেল পরের
বৃহস্পতি বার। সেখানেই প্রথম আলাপ হয় ওই অঞ্চলের কিছু বাঙালীর সঙ্গে; শুক্লা-পরিমল
দে, মহুয়া-অপূর্ব সেনগুপ্ত এবং নূপুর-শ্যামল রায়চৌধুরী। কথায় কথার বেরিয়ে গেল যে
আমি ও শ্যামল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এক ক্লাসে পড়েছি; তবে আলাদা সেকশনে, তাই আলাপ
ছিল ছিল না। তবে অনেক চেনা বন্ধু-বান্ধব বেরিয়ে গেল। তার পরের সপ্তাহে নূপুর ও
শ্যামলের বাড়িতে আড্ডা এবং খাওয়া দাওয়া। তার পরে এক এক দিন পালা করে শুক্লা-পরিমল
এবং মহুয়া-অপূর্বর বাড়ি।
অত্যন্ত সুললিত কন্ঠস্বর ছিল মহুয়ার। আবৃত্তি করত খুব সুন্দর। বিসিএসের প্রচুর
অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করেছে, আবৃত্তিতে, গানে, নাটকে। দুটি ছেলে; বাবি (শান্তনু) ও
পাপু (শমীক)। অদৃষ্টের পরিহাস; এক এক করে পরিবারটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
প্রথমে অপূর্ব; ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, তারপর বাবি। মহুয়া তখন চরম শোকে মূহ্যমান।
তারপর হঠাৎ খবর পেলাম বম্বে থেকে, - যে মহুয়াও চলে গেছে। পাপু এখন আছে আমেরিকায়,
সপরিবারে। কিছুটা যোগাযোগ আছে আমাদের সঙ্গে এখনও।
স্যাটেলাইট টিভি বলে কোনও পদার্থ ছিল না সেকালে। কুয়েত টিভির ইংরিজি চ্যানেল
দেখতাম শুধু। সব প্রোগ্রাম ভাল লাগত না। প্রতি শুক্রবার কুয়েতের আরবি চ্যানেলে
হিন্দী ছবি দেখানো হত। সে কি উত্তেজনা। তাড়াতাড়ি খাওয়া
দাওয়া শেষ করে টিভির সামনে। সন্ধ্যেবেলা একটু ফাঁকা ফাকাঁ লাগত। ছেলেমেয়েরাও ছোট,
পড়াশোনার চাপ কম। এখানে ওখানে আড্ডা দেওটাই ছিল স্বাভাবিক। একদিন ফাহাহিলে বাজার
করতে গিয়ে দেখলাম, হাতে বেশ সময় আছে। পরিমলের ফ্ল্যাট ছিল কাছেই, ভাবলাম ঘুরে আসি।
দরজায় বেল দেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিমল দরজা খুলে দিল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম
বেশ ভীড়। প্রচুর লোকজন, চুটিয়ে আড্ডা হচ্ছে। বুঝলাম পার্টি চলছে এবং আমরা অজান্তে
গেট ক্র্যাশ করেছি। পরিমল সাদরে আমন্ত্রন জানাল, ভেতরে গেলাম। এর মধ্যে সুমিতা আর
শুক্লার মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কথোপকথন, - এখানে খেয়ে যাও। - না না, বাড়িতে রান্না
আছে। - তাতে কি হয়েছে, ফ্রিজে রেখে দেবে ... ইত্যাদি। পরিমল বলল, খেয়েই যান না,
কোনও ফর্মালিটির ব্যাপার তো নেই। আমি পরিমলকে জানাই যে দুই মহিলা যেটা করছেন সেটা
একটা সামাজিক রিচুয়াল, - আমি কিন্তু দরজা খুলতেই বুঝে গেছি যে আমাদের রাতের অন্ন
আজ এখানেই। যত দূর মনে আছে সেদিন পরিমল বিদেশি নিষিদ্ধ পানীয় খাইয়েছিল; অবদান
অবশ্যই লাহিড়ীদার। লাহিড়ীদা ইউনাইটেড নেশনের হয়ে কুয়েতে ছিলেন এবং ওনার পারমিট
ছিল। প্রচুর রান্না করেছিল শুক্লা।
পরিমল ও শুক্লা এখন কলকাতায় আমার প্রতিবেশি। শুক্লা কুয়েতে নানা অনুষ্ঠানে
অংশগ্রহন করেছে এবং এখানেও শুক্লার ভূমিকা খুব সক্রিয়।
বিসিএসের বেশির ভাগ সদস্যই থাকতেন সালমিয়া অঞ্চলে। এবং থাকতেন খুব হৈ চৈ করে।
দীপা বৌদি আর সুশান্ত মজুমদার-দার বাড়িতে খুব ঘটা করে সরস্বতী ও লক্ষ্মী পূজো হত।
প্রচুর লোকের নিমন্ত্রন থাকত। বিনা নিমন্ত্রিতদের জন্যেও দরজা খোলা থাকত সব সময়।
অফিস থেকে ফিরে, একটু বিশ্রাম করে রওনা দিতাম সালমিয়া। পুজো শেষে প্রথমে লুচি,
বেগুন ভাজা ইত্যাদি। তারপর খিচুড়ি, লাবরা, চাটনি, পায়েস। খাওয়া দাওয়ার পর
মজুমদার-দা কার্পেটে চাদর বিছিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। শুরু হত গানের আসর।
প্রথমে নিজে গাইতেন, তারপর এক এক করে সবাইকে ডাকতেন। শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে যেত।
গান ছাড়াও মজুমদার-দার নাটকে খুব উৎসাহ ছিল। অভিনয় করেছেন প্রচুর। বিসিএসের
প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজদ্দৌলা’র পরিচালক ছিলেন। মজুমদার-দা ও দীপা বৌদির দুই
ছেলে মেয়ে; শিখা ও বাবুল। শিখা খুব ভাল নাচত। বিসিএসের কোনও
নাচের অনুষ্ঠান শিখাকে ছাড়া ভাবাই যেত না। দিল্লীতে শিখার নাচের স্কুল আছে এখন।
নিয়মিত অনুষ্ঠানের আমন্ত্রন আসে নানা জায়গা থেকে। প্রচুর ছাত্র ছাত্রী। ৯১-৯২ সাল
নাগাদ মজুমদার-দা কুয়েতের পাট চুকিয়ে কলকাতা ফিরে যান। সুন্দর দোতলা বাড়ি করেছিলেন
সল্ট লেকে। সুমিতা আর আমি গেছি কয়েক বার। তখন তাঁরা সল্টলেকের ওই অঞ্চলে
সুপ্রতিষ্ঠিত। সব রকম অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করতেন। এক ডাকে চিনত সবাই। ৯৫-৯৬ সালে
আসে দুঃসংবাদ;- মজুমদার-দা ইহলোকে নেই। তারপর একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বাবুলও চলে
গেল। দীপা বৌদি এখন শিখার কাছে থাকেন গুরগাওঁ-এ। মাস দুয়েক আগে ফোনে কথা হয়েছিল।
যোগাযোগ শিখার মাধ্যমেই। অনেক কথা হল। বয়স ও অসুস্থতার জন্য খুব আস্তে কথা বলেন।
কিন্তু স্নেহ ও আন্তরিকতা সেই আগের মতই। দিল্লী গেলে দেখা করব; প্রতিশ্রুতি
দিয়েছি।
কুয়েতনামা ৬
প্রকাশ্যে বা গোপনে কোথাও কোনও
পূজো আর্চা করার রেওয়াজ ছিল না সেকালে। তবে সরস্বতী পূজো উপলক্ষ্যে বাচ্চাদের নিয়ে
কিছু অনষ্ঠান করা হত। যেমন আবৃত্তি, ছবি আঁকা ইত্যাদি। প্রায় সব অনুষ্ঠানই হত নিউ
ইংলিশ স্কুলের মাউস ট্র্যাপ থিয়েটারে। আসন সংখ্যা ১৩০; সোসাইটির মেম্বার ও তাদের
পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমরা তখনও নতুন। প্রতি অনুষ্ঠানেই কারও না কারও সঙ্গে
নতুন আলাপ হচ্ছে। সেবার একটি কুইজ কম্পিটিশনের আয়োজন করা হয়েছিল, বাচ্চাদের জন্য।
ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন গ্রুপে স্টেজের ওপর বসেছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুইজ মাস্টার। বাকি
সবাই হলে বসে আছে। প্রতিযোগীরা কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে না পারলে সেই প্রশ্ন ছুঁড়ে
দেওয়া হচ্ছে দর্শকদের দিকে, - সঠিক উত্তরের পুরস্কার একটি চকোলেট।
একটা বেশ কঠিন প্রশ্ন ছিল। স্টেজে
বসা ছেলে মেয়েরা উত্তর দিতে পারল না। যথারীতি দর্শকদের জিজ্ঞেস করা হল। কেউ পারল না। কেবল হলের ডান দিকের পেছনের সারি থেকে এক গোঁফ-ওয়ালা রোগা মত এক জন,
বয়স ত্রিশেক বয়স, উঠে সঠিক উত্তরটা বলে দেয়। চারিদিকে বিরাট হর্ষধ্বনি। বুঝলাম,
লোকটি বেশ জনপ্রিয়।
হঠাৎ সামনে বসা এক তরুণী মহিলা উঠে
দাঁড়িয়ে দু-হাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে একেবারে নেচে উঠলেন, অ্যাই আমার বর, আমার বর, -
কেউ পারেনি, কেউ পারেনি, শুধু আমার বর পেরেছে। হলশুদ্ধ লোক মহিলার কান্ড দেখে হেসে
কুটিপাটি। আমি তো হতভম্ব; পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, - এরা কারা? উনি বললেন, -
এরা ডাঃ প্রসূন ঘোষ ও তার স্ত্রী চন্দ্রাবলী ঘোষ।
আরও কয়েক বছর এগিয়ে যাই। প্রসূন ও
চন্দ্রাবলী তখন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম। আনন্দমেলা
অনুষ্ঠান। প্রসূন স্টল দিল, - ল্যাম্ব কারি অ্যান্ড রাইস। প্রসূন নিজে বেশ ভাল
রান্না জানে। আনন্দমেলার এই স্টল ওর একার প্রচেষ্টা। স্টল সাজিয়ে একাই বসল।
আমার ছেলে সত্তমের তখন বছর পাঁচেক
বয়স। এসে জানালো ল্যাম্ব কারি খাবে। শুনলাম বাচ্চারা খাবে বলে প্রসূন বেশ হাল্কা
করে, ঝাল ছাড়া রান্না করেছে। কুপন কিনে সত্তমকে পাঠিয়ে দিলাম। আর খেয়াল রাখিনি,
বাচ্চারা নিজেদের বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত। আমরাও আড্ডায় মত্ত, মাঝে মাঝে এটা ওটা
চেখে দেখা হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ খেয়াল হল,
প্রসূন ওর স্টল থেকে চেঁচিয়ে আমায় ডাকছে। কাছে গিয়ে দেখি সত্তম খালি প্লেট হাতে
প্রসূনের সামনে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে ঐ বয়সী আরও ছেলে মেয়ে। আমি সামনে যেতেই প্রসূন
জিজ্ঞেস করল, এই তুমি সত্তমকে বলনি যে একটা কুপনে একবারই নেওয়া যায়?
না তা তো বলিনি, আমি জানাই।
আরে সেই প্রথমে একটা কুপন দিয়ে বার
বার এসে আরও নিয়ে যাচ্ছে। বেশ ক’বার হল। এখন আবার বন্ধুদের নিয়ে এসেছে, কারও কাছে
কুপন নেই। সবাই দাঁড়িয়ে আছে প্লেট নিয়ে।
কি আর করবে প্রসূন। কুপন ছাড়াই
খাওয়াল বাচ্চাদের। করুণ অবস্থা। দিনের শেষে দেখা গেল প্রসূনের “বিক্রী” বিশেষ
হয়নি। কিন্তু ল্যাম্ব-কারি নিঃশেষ।
কুয়েতনামা ৭
পরের বছর আবার রবীন্দ্রজয়ন্তী। একটা সুন্দর আলেখ্য লিখে ফেলল
অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। কবির কাব্য ও সঙ্গীত জীবনের একটি ইতিহাস। নাম রবীন্দ্র
বন্দনা। আখ্যানের মাঝে মাঝে কবিতা ও গান। এমন ভাবে গান বেছেছিল অরূন্ধতী যে
প্রত্যেকটির সঙ্গে নাচের উপস্থাপনা করা যেতে পারে। বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হল। একদিকে
গানের রিহার্সাল আর এক দিকে নাচের। সঙ্গে সঙ্গে ভাষ্য পাঠ। পরিচালনার দায়িত্ব
নিয়েছিলেন সুনীল সরকার।
রিহার্সাল শুরু করার ক’দিনের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল যে আমাদের
সোসাইটিতে মহিলা কন্ঠশিল্পীর অভাব নেই; কেকা মুখার্জি, ধরিত্রী (বুবুল)
ব্যানার্জি, কৃষ্ণা মজুমদার, সুমিতা প্রত্যেকেই সুগায়িকা। কিন্তু পুরুষ কন্ঠের
বিরাট অভাব। পরিচালক সুনীলদা এক কালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন,
কাজ চালানোর পক্ষে যথেষ্ট, সলিলকেও নামানো হল, কিন্তু প্রধান বা মুখ্য গায়কের অভাব
পালন করার মত পুরুষ কন্ঠ কেউ ছিল না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে, এক্সিকিউটিভ কমিটির
অনুমতি নিয়ে এক বাংলাদেশি গায়ককে আমন্ত্রন জানানো হয়। নাম মাহমুদ হুসেন দুলু। আমরা
দুলু বলেই ডাকতাম। । রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী। মুখ্য গান গুলোর দায়িত্ব
দুলুকেই দেওয়া হল। এই নিয়ে ছোট্ট একটা বিতর্কও হয়েছিল। দুলু গত ২৮ বছর নিউ ইয়র্কের
বাসিন্দা। পেশায় আর্কিটেক্ট। তবে গান বাজনা নিয়েই থাকে। ম্যানহাটনে অঙ্গনা নামে
একটি রেস্তোঁরা খুলেছিল। সেখানে একদিন ডিনারে ডেকেছিল আমাদের।
তবলা আর বাঁশির জন্য দুই পাকিস্তানি পেশাদারকে বহাল করা হল।
ভাষ্যকারদের মধ্যে ছিল মহুয়া সেনগুপ্ত ও অরুন্ধতী ভট্টাচার্য (মহিলা কন্ঠ) ও স্বপন
দাশগুপ্ত এবং নবাশিস কবিরাজ (পুরুষ কন্ঠ)। পরিচালক সুনীল-দা একদিন গম্ভীর গলায়
জানালেন, - আরেকটি পুরুষ কন্ঠ হলে ভাল হয়। সুমিতা শ্রেয়াকে খাওয়াচ্ছিল; দু-হাত
জোড়া। থুতনি দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল। বাস, পরিচালক আদেশ দিলেন, - বসে পড়। তাই হল।
আমিও কুশী-লবদের মধ্যে ভীড়ে গেলাম, অনিচ্ছায়। কুয়েতে আমার সেই প্রথম রঙ্গমঞ্চে
আত্মপ্রকাশ!
কয়েক মাস ধরে চলল রিহার্সাল, সে যেন এক দীর্ঘ পিকনিক। খাওয়া
দাওয়া। পালা করে কয়েক জন মহিলা রান্না করে নিয়ে আসতেন। বাচ্চাদের জন্য চিকেন
টিক্কা বা কেনটাকি ফ্রাইড চিকেন বা কাবাব নিয়ে আসা হত। সব নিজেদের খরচে, সোসাইটির
ক্ষমতা ছিল না রিহার্সালে খাওয়ানোর।
তিন দিন ধরে মঞ্চস্থ হয়েছিল রবীন্দ্র বন্দনা। মাউস ট্র্যাপ
থিয়েটারে। একদিন মেম্বারদের জন্য। বাকি দু-দিন পাস বিলিয়ে (অর্থাৎ টিকিট বিক্রী
করে) অন্যান্য দর্শকদের দেখানো হয়েছিল। আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুরা দল বেঁধে এসে
দেখে গেলেন।
এই প্রোগ্রামের সব চাইতে কঠিন কাজ ছিল প্রায় গোটা কুড়ি
বাচ্চাকে সামলানো। খুব ছোট্ট জায়গার রিহার্সাল হত, এদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে রাখা যেত
না। পরবর্তী কালে যখন সোসাইটির তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি বাচ্চা নিয়ে অনুষ্ঠান করতে
দেখেছি ইন্ডিয়ান কম্যুনিটি হলে, উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়েছি দূর থেকে।
সোসাইটির বর্তমান প্রজন্ম মনে হয় অনেক বেশী সংগঠিত; এবং অনেক বেশী প্রতিভাশালী।
এখন বাইরের কোন শিল্পীর সাহায্য নেবার দরকার হবে না।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিন একটি মজার ঘটনা ঘটে। অনেক লম্বা
অনুষ্ঠান। বাচ্চাদের ক্ষিদে পাবে; তাই ওদের জন্য স্যান্ডুইচের ব্যবস্থা করা
হয়েছিল। সেকালে যারা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করত শুধু তাদেরই খাওয়ার
ব্যবস্থা থাকত। বাচ্চাদের যখন
মেক-আপ চলছে, তখন বলা হল, তোমাদের নাচ শেষ হলে তবেই স্যান্ডুইচ খাবে, নিজেদের
মা-কে জিজ্ঞেস করে নেবে। যথা সময়ে প্রোগ্রাম শুরু হল, কয়েক জন বাচ্চার নাচও শেষ
হল। কিন্তু দু-জন মা তো মঞ্চে, কেকা ও সুমিতা, গান গাইতে ব্যস্ত। তাদের দুই মেয়ে
কাঁকন ও শ্রেয়া; মা-কে জিজ্ঞেস না করে খাবে না। মঞ্চে নাচ চলছে, হঠাৎ দেখা গেল দুই
মেয়ে একেবারে স্টেজের সামনে এসে নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে দুই-মায়ের অনুমতি চাইছে।
হাতে স্যান্ডুইচ। অনেক্ষণ নাচানাচির পর মায়েরা ইশারায় অনুমতি দিলেন। কাঁকন আর
শ্রেয়া সেখান থেকেই স্যান্ডুইচে কামড় দিতে দিতে ভেতরে চলে গেল। প্রথম দিনের
অনুষ্ঠান ছিল শুধু মেম্বারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সবাই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করেছিলেন।
খুব প্রশংসিত হয়েছিল অনুষ্ঠান। ভিডিও ক্যামেরা বাজারে আসেনি
তখনও। তবে অডিও রেকর্ডিং হয়েছিল, - তিনটি ক্যাসেটে। দুটি এখনও আছে আমার কাছে।
তৃতীয়টি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বহু খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।
কুয়েতনামা ৮
অসিত আর আলপনার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব সেই প্রথম থেকে। আমরা থাকতাম ফিনতাসে; ওরা বরাবরই
সালমিয়ায়। আসা যাওয়া ছিল নিয়মিত;
বিনা নোটিসেই। এই বিনা নোটিসে আসা যাওয়ার ব্যাপারটা আজকাল বেশ কমে গেছে। অসিতের
খুব ক্যামেরার সখ ছিল। লেন্স, অ্যাপারচার ইত্যাদি খুটি নাটি বেশ জানত। অসিত বিসিএসের ফাউন্ডার মেম্বার, আগেই বলেছি। অসিত আর আলপনার একটা বৈশিষ্ট্য আছে;
যেটা খুব বিরল।
ওরা সোসাইটির কোনও অনুষ্ঠান মিস করে না; এবং কখনও দেরি করে
আসে না। এই গুণটি কিন্তু খুব কম লোকেরই আছে। বিসিএসের কোনও ব্যাপারে সাহায্য চাইলে
নিরাশ করে না কখনও। আমার সঙ্গে একটি নাটকেও একবার অভিনয় করেছিল অসিত। আলপনা
সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছে। অসিত প্রেসিডেন্ট ছিল। আমার মনে
হয় ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে অসিতের বহু আগেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নেওয়া উচিৎ
ছিল।
বেশ কয়েক বছর এগিয়ে গিয়ে অসিত
পেসিডেন্টা থাকাকালীন একটা ঘটনা বলি। ফ্ল্যাশ-ব্যাক নয়, ফ্ল্যাশ-ফরোয়ার্ড। স্টেজে
আসীন আমরা কয়েকজন; - অভ্যুদয়, সুভদ্রা, কমল, শর্বরী ও আমি। আর কেউ ছিল কিনা এখন এই
মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। প্রোগ্রামের নাম ‘বাঙলা কবিতা, যুগে যুগে’; বাঙলা
কাব্যের বিবর্তন। অডিটোরিয়াম ভর্তি। প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু পেছনে বোধহয়
চা-সিঙারার ব্যবস্থা চালু ছিল। প্রচন্ড চ্যাচামিচি। আমরা স্টেজে কিছুই প্রায় শুনতে
পারছি না। হঠাৎ প্রথম সারি দেখে উঠে দাঁড়ালেন খোদ প্রেসিডেন্ট মানে অসিত। দু হাতে
একটা টাইম আউট সঙ্কেত দিয়ে আমাদের বলা হল প্রোগ্রাম বন্ধ করতে; আমরা চুপ করলাম।
অসিত দ্রুত পায়ে পেছনে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে অবস্থা নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এল। তারপর
সামনে এসে আবার সঙ্কেত দিল শুরু করতে। আমরা শুরু করলাম। এবার নির্বিঘ্নে শেষ হল
অনুষ্ঠান।
আবার ফিরি ৮০’র দশকে। অসিত ও আলপনা
ডাকল একদিন। কি একটা অনুষ্ঠান ছিল ওদের ফ্ল্যাটে। প্রচুর
লোক জন। এর মধ্যে আমাদের মোটামুটি অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে। গিয়ে দেখলাম সবই
প্রায় চেনা মুখ। তবে জনা চারেক ভদ্রলোককে মনে হল যেন নতুন দেখছি। এক সঙ্গে
বসেছিলেন ঐ চার জন; কথাবার্তা বলছিলেন নিজেদের মধ্যে। তার মধ্যে একজনের দিকে চোখ আটকে গেল, মনে হল
ইনি এখানে কি করছেন, এনার তো বলিউডে থাকার কথা বা নিদেন পক্ষে টলিউডে। লম্বা, সুদর্শণ, সপ্রতিভ, চোখে মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ, - টল, ফেয়ার অ্যান্ড
হ্যান্ডসাম। এক কথায় হীরো মার্কা চেহারা। আমি শ্রেয়াকে নিয়ে ওনাদের কাছেই বসলাম। সুমিতা
ভেতরে চলে গেল। টুকরো টূকরো কথাবার্তা শুরু হল। খেয়াল
করলাম যে খুব মার্জিত ও সুক্ষ্ম রসবোধ আছে সেই সুদর্শন ভদ্রলোকটির। কিছুক্ষণ পরে
আমাকে ছেড়ে শ্রেয়ার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। কথায় কথায় বুঝলাম, নিজের মেয়েদের খুব
মিস করছেন। দুই মেয়ে, মায়ের সঙ্গে কলকাতায় আছে। সময় মত
আসবে কুয়েতে।
শ্রেয়াকে
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, - তুমি ইংরিজি বলতে পারো? শ্রেয়া তখন বেশ ক’দিন ধরে স্কুলে
যাচ্ছে, মাথা নেড়ে জানালো, হ্যাঁ। পরের প্রশ্ন, - তুমি গড়গড় করে ইংরিজি বলতে পারো?
গড়গড় শব্দটা শ্রেয়ার পরিচিত ছিল না, তাই আর উত্তর দিতে পারে নি। বেশ কয়েকটা জোকও
শোনালেন সেই তরুণ ব্যক্তিটি। প্রথম আলাপেই বেশ প্রভাবিত হয়েছিলাম মনে আছে।
সেদিনের
সেই তরুণ পরবর্তী কালে বিসিএসের এক প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ান। ধীরে
ধীরে আত্মপ্রকাশ করে্ন একজন দক্ষ সংগঠক, বিদগ্ধ নাট্য পরিচালক এবং এক অন্যতম সফল
প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
ঐ যা!
কথায় কথায় পরিচয়টাই দিতে ভুলে গেছি। অসিতই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সেদিন। কলকাতার
সেন্ট লরেন্স স্কুল এবং আই আই টি খড়্গপুরের প্রাক্তন ছাত্র। দেশে আইবিএমে কাজ করতেন। ছেড়ে দিয়ে কুয়েতের একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।
নাম
ইন্দ্রজিৎ ভৌমিক।
কুয়েতনামা ৯
কুয়েতের
বাঙালী মহলে তিনটি পরিবারের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল, - অঞ্জু-সুভাষদা
(ভট্টাচার্য), তপন-নুপুর সেনগুপ্ত এবং কেকা-অমিতাভ মুখোপাধ্যায়।
এদের
মধ্যে তপন আর নুপুরের কথা আগে কিছুটা বলেছি। তপন আমার বাল্যবন্ধু, এক পাড়ার।
একসঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি। খুব ভাল ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিল। সময়ের আগেই কাজ
থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে যায়; গলফ গ্রীনে এক বেসরকারি আবাসন এখন তপনের স্থায়ী
বাসস্থান। আমার সমবয়সী, কিন্তু এখনও সপ্তাহে ৬ দিন সকালে র্যাকেট হাতে টেনিস খেলতে যায়। “একদম ফিট বস”।
সুভাষদা
অবসর নিয়েছিলেন ২০০১ সালে। এখন মধ্যপ্রদেশের ভোপালের বাসিন্দা। সুভাষদা কেওসির
ভারতীয়দের মধ্যে এক অগ্রদূত। এর পরেই কেওসি ধীরে ধীরে ভারতীয়দের জন্য দ্বার
উন্মুক্ত করে দেয়। খুব ভাল আবৃত্তিকার আর অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তি। বিশাল লম্বা
কবিতা সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। মাঝে মাঝে কবিতার
আসন বসাতেন বাড়িতে। কাব্য চর্চা ছাড়াও সেই সব আসরের এক মুখ্য আকর্ষণ ছিল অঞ্জুর
হাতের রান্না। প্রচুর আয়োজন থাকত। অঞ্জুকে চিনি ছোটবেলা থেকে, আমার ছোট বোনের
সমসাময়িক। অঞ্জু আর সুভাষদার একটি “একদা কি করিয়া মিলন হল দোঁহে/কি ছিল বিধাতার
মনে” – টাইপ গল্প আছে। ভবিষ্যতে যদি সুযোগ
পাই, তবে শোনাবো। ১৯৯৫ সালে সুভাষদা সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
এবার
একটু কেকা আর অমিতাভর প্রসঙ্গে আসি। কেকাকে কুয়েতে সবাই এক সঙ্গীতজ্ঞা হিসেবে এক
ডাকে চেনেন। কেকার কিন্তু অন্য প্রতিভাও আছে। সম্প্রতি সোসাইটির সদস্যরা অশালীন
নাটকে কেকার অভিনয় ক্ষমতার কিছুটা পরিচয় পেয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয় কেকার অভিনয়
প্রতিভার সম্পূর্ন বিকাশ ঘটেছিল ১৯৮৬-৮৭ তে অভিনীত “কাঞ্চনরঙ্গ” নাটকের “তরলা”র
ভূমিকায়। তরলা, যে চরিত্রকে অমর করে গেছেন
স্বয়ং তৃপ্তি মিত্র। কাঞ্চনরঙ্গ নাটকে আমারও একটি ছোট ভূমিকা ছিল। সেই প্রসঙ্গে না
হয় পরে আসা যাবে। নাটকের নানা দৃশ্যের প্রায় ফ্রেম-বাই-ফ্রেম ছবি তুলেছিল অনিমেষ;
অনিমেষ মন্ডল। সেই সব ছবি আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। তাই দেখে
একদিন হঠাৎ এক মহিলা আমায় ফোন করেন। সম্প্রতি আলাপ ওনার সঙ্গে, এবং ফেসবুকে
বন্ধুত্ব। মহিলাটি সুলেখিকা এবং গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন এক
সময়। আমায় ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, - দাদা, মনে হচ্ছে আপনারা
কাঞ্চনরঙ্গ নাটকটি করেছিলেন। আমি জানাই হ্যাঁ করেছিলাম, বহু বছর আগে। আচ্ছা, তরলার
ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন? জানালাম, - কেকা মুখোপাধ্যায়; কিন্তু কেন? মহিলাটি
বললেন, আমি ছবিগুলোতে ওনার অভিব্যক্তি (এক্সপ্রেশন) অবাক হয়ে দেখছি। কি অপূর্ব।
আমার তো তৃপ্তি মিত্রর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বারে বারে।
মন্তব্য
নিস্প্রয়োজন।
এবার
একটু আসি অমিতাভ প্রসঙ্গে। খুবই লো প্রোফাইল কিন্তু একটি চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া।
প্রাক-ইন্টারনেট যুগে আমার কোনও তথ্য জানার দরকার হলে আমি অমিতাভকে ফোন করতাম।
অমুক বইয়ের লেখক কে, সেই গানটার সুরকার কে, কোন নাট্যকার অমুক পুরস্কার পেয়েছিলেন,
ফোন করলেই উত্তর পাওয়া যেত। এই বছর দুয়েক আগেও এক্সিকিউটিভ কমিটির কোনও মেম্বার
আমাকে একটি অনুষ্ঠানের আগে আমাকে একটি ইংরিজি শব্দের বাঙলা জিজ্ঞেস করে, আমি
কালক্ষেপ না করে অমিতাভকে ফোন করি। এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে যাই। খুবই সংস্কৃতিমনস্ক,
খুব ভাল প্রেসিডেন্ট হতে পারত। কিন্তু হল না কখনও। ঐ শেন ওয়ার্ন সম্বন্ধে কোনও এক
অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক আক্ষেপ করে বলেছিলেন না, - দ্য বেস্ট ক্যাপ্টেন অস্ট্রেলিয়া
নেভার হ্যাড।
অনেকটা
সে রকমই।
কুয়েতনামা ১০
এক অলস সন্ধ্যা। বসে বসে সেদিনের
আরব টাইমসের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোন। আচার্যি-দা ফোন করেছেন। শ্রী নৃপেন
আচার্য বিসিএসের একজন প্রবীন সদস্য। জানালেন যে এ-বছরের নাটক পরিচালনার দায়িত্ব ওনাকে
দিয়েছে এক্সিক্যুটিভ কমিটি। নাটক নির্বাচন হয়ে গেছে, - বাদল সরকারের বড় পিসীমা।
উনি আমার জন্য একটি চরিত্র ভেবে রেখেছেন। শুনে আমি তো হতবাক। আমি? তা কিসের
চরিত্র? আচার্যি-দা বললেন, - একটা ছোট হিরোর রোল। হিরো? আমি এবার বেশ আঁতকে উঠি।
কম্পিত কন্ঠে জানালাম, - নতুন জায়গা, এখানে এসেই হিরোর রোল? আমি পারব না। উনি
সহাস্যে অভয় দিয়ে বললেন, ঠিক হিরো নয়, তবে নাটকের কাহিনির মধ্যে আরও একটি নাটক
আছে;- মানে কোনও এক ফ্ল্যাট বাড়ির ছেলেরা একটি নাটক করছে, সেই নাটকে যে হিরোর
ভূমিকায় অভিনয় করছে, তার চরিত্র আমাকে করতে হবে। শুনে একই সঙ্গে নিরাশ এবং
নিশ্চিন্ত হলাম। অনেক চিন্তা ভাবনা করে রাজিই হয়ে গেলাম।
তিন দিন পর রিহার্সালের শুরু;
আচার্যি-দার বাড়ি। সালমিয়া সেন্টারের কাছে একটা উঁচু গোল বিল্ডিং ছিল। সেখানেই ছিল
আচার্যি-দার ফ্ল্যাট। বিল্ডিংটা এখন আর নেই। ভেঙে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে।
যথা সময়ে গিয়ে পৌঁছলাম। দরজার সামনে অজস্র জুতো আর চটি। তার মানে প্রচুর লোকজন এসে
গেছে। গিয়ে দেখি, মোটামুটি সবাই চেনা।
সবাইকে বসিয়ে আচার্যি-দা নাটকের
একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন। সবার ভূমিকা বুঝিয়ে দেওয়া হল। এও জানালেন যে এক মহিলা
সদ্য কুয়েতে এসেছেন এবং তাঁর খুব উৎসাহ নাটকে অংশ গ্রহণ করার। উনি এসে পৌঁছোবেন একটু পরে। কিন্তু সব চরিত্রই তো দেওয়া হওয়া
গেছে। যেহেতু এখনও কোনও প্রম্পটার ঠিক হয়নি, আচার্যি-দার ইচ্ছে উনি এলে ওনাকে
প্রম্পট করতে বলা হবে। এবং ভদ্রমহিলা এসে পৌঁছলে নাটকটা একবার পড়া হবে।
একটু পরেই এলেন ভদ্রমহিলা।
আধুনিকা, সপ্রতিভ, বয়-কাট চুল, হাল ফ্যাশনের চশমা, বেশ একটা ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব। একটু
ফিসফাস শুরু হয়ে গেল; প্রম্পট করতে বলা হবে ওনাকে, বাংলা পড়তে পারেন তো? চেহারা
দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয়। একটু
ইতস্ততঃ করে একজন জিজ্ঞেসই করে ফেলল, - আপনি বাংলা পড়তে পারেন তো? ভদ্রমহিলা একটু
হেসে বললেন, - আমি বাংলায় এম এ। প্রশ্নকর্তার তখন ‘ধরণী দ্বিধা হও’ অবস্থা।
নাটকটি পড়া হল; যে যার নিজের
পার্ট পড়লাম। মহিলাটির সঙ্গে আলাপ হল; - নাম সুভদ্রা ভৌমিক। কিছুদিন আগে যে
সুদর্শণ ভদ্রলোকটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অসিতের বাড়ি, তাঁরই সুযোগ্যা সহধর্মিণী।
পরবর্তী কালে নাটক,
সঙ্গীতানুষ্ঠান, আবৃত্তি সব রকম অনুষ্ঠানেই অংশ গ্রহণ করেছে সুভদ্রা।
বড় পিসীমা নাটকের নাম ভূমিকায়
দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সাঁতরা বৌদি। আর পিসেমশাই-এর ভূমিকায় দীপক ভট্টাচার্য
এক কথায় অনবদ্য। যাঁরা সেই নাটক দেখেছেন সবার মনে আছে সেই অভিনয়। কুয়েতে দীপকের
সেই প্রথম এবং সেই শেষ অভিনয়। তারপর বহু চেষ্টা করেও আর কখনও স্টেজে নামানো যায়নি।
নায়ক নায়িকার ভূমিকায় ছিল কবিরাজ
আর শুক্লা। সলিল (ব্যানার্জি) আর কল্যাণ (মজুমদার) ছিল দু-টি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকায়। শেষের দু-জন ঘাঘু অভিনেতা। অনেক সময় অনেক বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে
বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। কিন্তু একটি খুব বদভ্যাস ছিল দু-জনেরই। প্রায়ই দুয়েকটা
সংলাপ নিজেরা বানিয়ে বলে দিত; তাতে নতুন অনভিজ্ঞ অভিনেতাদের বেশ অসুবিধে হত।
বড় পিসীমা নাটকে আমার সঙ্গে কল্যাণের
একটা দৃশ্য ছিল। কল্যাণ হচ্ছে নিতাই-দা; একটি নাটকের পরিচালক। নাটক চলছে আড়ালে,
মঞ্চে দেখা যাচ্ছে নিতাই-দা গ্রীন রুমে বসে, ঘন ঘন সিগারেট টানছে, খুব নার্ভাস।
একটু পরে আমি স্টেজে ঢুকে বলব, - নাটক তো দারুণ জমে উঠেছে নিতাই-দা। নিতাই-দা
বলবে, - তাই নাকি রে? আমি তখন বলব, হ্যাঁ
দাও একটা সিগারেট দাও। ওই পুরো সীনে আমার আর কোনও সংলাপ নেই। আমি যথারীতি ঢুকলাম
স্টেজে। আমি কিছু বলার আগে, নিতাই-দা মানে কল্যাণ বলে উঠল, এই যে নাটক তো খুব জমে
উঠেছে, নে একটা সিগারেট খা। বাস,
পুরো সীনে সিগারেট খাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।
ঘটনাটা কল্যাণের মনে আছে কি না
জানিনা, আমার আছে এবং এ নিয়ে এখনও খুব হাসাহাসি হয় বন্ধুদের মধ্যে।
এই ঘটনার কয়েক বছর পর আমাকে একটি
নাটক পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাতে কল্যাণ একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় অভিনয়
করেছিল। আমার বিশেষ অনুরোধে কল্যাণ সম্পূর্ণ স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সংলাপ বলেছিল। এক
চুলও এদিক ওদিক করেনি।
কুয়েতনামা ১১
হল ভাড়া করে জেনারেল বডি মীটিং করার মত সচ্ছলতা ছিল না
সোসাইটির। মীটিং হত যে কোনও একজন মেম্বারের বাড়িতে। সাধারণতঃ শুক্রবার সকালেই হত
মীটিং। সবাইকে ১০টার সময় আসতে বলা হত। কোরাম হতে হতে ১১টা, ১১-১/২ টা হয়ে যেত।
খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব ছিল গৃহস্বামীর; - অফুরন্ত চা, সঙ্গে সিঙাড়া আর জিলিপি। কোনও কোনও সহৃদয়া বউদি মাঝে মাঝে
লুচি ও আলুর দমও করে ফেলতেন। আগাম খবর দেওয়া থাকলে পৌনে দশটার মধ্যেই কোরাম সম্পূর্ণ
হয়ে যেত!
একদিন হিমাংশুর বাড়ি বসে সোসাইটির প্রথম সংবিধানের খসরা বা
ড্রাফট নিয়ে আলোচনা হয়। বেশ তর্কাতর্কিও হয়েছিল মনে আছে। ঘন্টা তিনেক আলোচনা করে
শেষ অব্দি সোসাইটির প্রথম কন্সটিটিউশান বা সংবিধান গৃহীত হয়। এর বহু বছর পর
সাঁতরা-দার (শ্রী পান্নালাল সাঁতরা) নেতৃত্বে সংবিধানের সংশোধন করা হয়েছিল। সেবার
কিন্তু অত তর্ক বিতর্ক হয়নি।
যাই হোক, সংবিধান অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনে আমার প্রথম
এক্সিকিউটিভ কমিটিতে প্রবেশ। কমিটির সদস্য সংখ্যা মোটে ৭ জন। প্রেসিডেন্ট, ভাইস
প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি, ট্রেজারার, এক জন লেডি মেম্বার, আর দু-জন সাধারন
মেম্বার। সেকালে না ছিল মোবাইল ফোন না ইন্টারনেট। মেম্বারদের সময় মত খবর দেওয়া ছিল
খুব কঠিন সমস্যা। আন্সারিং মেশিন তখন সদ্য বাজারে আসতে শুরু করেছে। সবার বাড়িতে
ছিল না। কিছু ব্যাচেলর মেম্বারদের তো বাড়িতে পাওয়াই যেত না। প্রত্যেক জিবিএমে এই
নিয়ে বেশ রাগা রাগিও হত। মাঝে মাঝে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হত।
কিছু মেম্বার আবার খুব খুঁটিনাটি প্রশ্ন করতেন। যেমন ধরা
যাক একজনকে ফোনে পেলাম,
দাদা, আগামী শুক্রবার জিবিএম আছে আমার বাড়িতে সকাল সাড়ে
দশটায়; আসবেন।
কোথায়?
আমার বাড়ি।
কবে?
আগামী শুক্রবার
ডেট?
১৪ তারিখ দাদা
মান্থ?
এই মাসেই!!!
ইউ মীন মে...
অফ কোর্স
কটার সময়?
সাড়ে ১০টা
এ-এম অর পি-এম?
অবভিয়াসলি এ-এম, পি-এমে কি করে মীটিং হবে দাদা?
হুম।
অ্যাজেন্ডা?
আগামী অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি...
ইউ শুড সারকুলেট দি অ্যাজেন্ডা অ্যাট লীস্ট আ উইক বিফোর! উই
শুড অল বি প্রিপেয়ার্ড ফর আ গুড ডিসকাশন।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেওয়া...!?!?!?
তা দিতে হবে, কমিটিতে আছ যখন
ঠিক, এবার থেকে চেষ্টা করব
ইউ মাস্ট। এনি ওয়ে, তোমার বাড়িতে হচ্ছে; লাঞ্চ খাওয়াচ্ছ না
কি?
কিছু একটা হবে, সুমিতা ব্যবস্থা করছে।
আই সি। ইটস গুড আই হোপ
আসবেন কিন্তু দাদা
কোথায়?
জিবিএমে?
ওহ নো, ... আই ক্যান-নট কাম,
সরি...
কেন দাদা?
আমি আজ সন্ধ্যে বেলা ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি এক মাসের জন্য। এনি
ওয়ে, থ্যাঙ্কস ফর কলিং।
এতদিন আগের কথা, কালানুক্রমে ঘটনাগুলো মনে পড়ছে না। সব কি রকম তালগোল পাকিয়ে
গেছে। তবে এই আশির দশকেই কুয়েত সিনে ক্লাবের আমন্ত্রণে সস্ত্রীক মৃণাল সেন ও
অপর্ণা সেন কুয়েতে এসেছিলেন। কুয়েত
সিনে ক্লাব ছিল মুখ্য স্পনসর, আমরা ছিলাম কো-স্পনসর। মৃনালের খন্ডহর আর জেনেসিস
দেখানো হয়েছিল আর অপর্ণার ৩৬ চৌরঙ্গী লেন ও পরমা। বেশ ভীড় হয়েছিল। একদিন এঁদের
সঙ্গে এক ঘরোয়া আড্ডা খুব উপভোগ করেছিলাম। মৃণাল সেনের একটা বিশেষ গুণ, উনি
সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের সঙ্গেও জমিয়ে আড্ডা মারতে পারেন। সেই আড্ডার আসরে ছবি
বানানোর খুঁটিনাটি, বড় পর্দা ও ছোট পর্দার ক্যামেরা ব্যবহার নিয়ে বেশ দীর্ঘ
কথাবার্তা বলেন মৃণাল আর অপর্ণা। মৃ্ণাল সেনের হিন্দী জ্ঞান নিয়েও খুব হাসাহাসি
হয়েছিল। উনি অবিরাম সিগারেট খেতেন; একবার বম্বেতে শুটিং চলাকালীন ওনার সিগারেট
ফুরিয়ে যায়। উনি শুটিং থামিয়ে প্রোডাকশন অ্যাসিস্টেন্টকে বলেছিলেন, - অ্যাই হামারা
সিগারেট ফুর গিয়া, জলদি কিনকে লে আও।
এই সব ঘটনা এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিতে।
কুয়েতনামা ১২
১৯৮৭ সাল আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অরবিন্দ ঘোষের
বাড়িতে এজিএম। নতুন কমিটি হল। কল্যাণ
সভাপতি, কেকা সহ সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক, মলয়
(প্রসূনের অনুজ) কোষাধ্যক্ষ, লেডি মেম্বার সুভদ্রা, আর সাধারণ মেম্বার বরুণ ভট্টাচার্য
আর বিষ্ণু কর্মকার। এখানে
বলে রাখছি আমি আর কল্যাণ প্রায় সমবয়সী। আমরা দুজনেই তখন ৪১/৪২-এর ঘরে। বর্তমান
মেম্বারদের আমি বলতে চাইছি যে প্রেসিডেন্ট হবার জন্য পক্ককেশ হবার দরকার নেই।
সে বছর বেশ কয়েটা স্মরনীয় ঘটনা ঘটেছিল। সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।
ভারতীয় দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল ইন্ডিয়া ডে। কুয়েত টাওয়ারের কাছে একটা
ক্লাবের ভেতর বিরাট জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেকটি সোসাইটিকে আলাদা আলাদা
স্টল করতে বলা হল। আমাদের স্টল খুব সুন্দর সাজিয়েছিলেন মহিলারা। বালুচরী ও
অন্যান্য শাড়ি টাঙিয়ে স্টলের ভেতরটা ঢেকে দেওয়া হয়, মাঝে মাঝে আবার কৃষ্ণনগরের
ঘোড়া, নানা রকম পটের ছবি ইত্যাদি দিয়ে বাঙলার পরম্পরা তুলে ধরা হয়েছিল। স্টলের
সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল নানা রকমের বাঙালী মিষ্টি; সব মেম্বারদের বাড়িতে করা।
মনে আছে কুয়েত টিভি অনেক্ষণ ধরে ছবি তুলেছিল আমাদের স্টলের।
দুপুর বেলা নাগাদ খুব ভিড়, বেশ একটা মেলার পরিবেশ
তৈরি হয়ে গেছে। এমন
সময় এক কুয়েতি যুবকের আবির্ভাব। আমাদের স্টলের সামনে এসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, - ওয়েন
আমিতাবাচান? আমরা জানালাম অমিতাভ বচ্চন তো নেই এখানে। ছেলেটি বিরক্ত হয়ে চলে গেল।
ফিরল আধঘন্টা পরে, এক গাদা অমিতাভ বচ্চনের ছবি নিয়ে। প্রত্যেক স্টলের সামনে একটা
করে ছবি রেখে দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, - নাও ওকে। নো আমিতাবাচান, নো ইন্ডিয়া ডে!
বিকেলে শুরু হল নাচ গানের অনুষ্ঠান। চারদিক খোলা এক
বিরাট মঞ্চে সব সোসাইটির সদস্যরা একে একে নৃত্য গীত পরিবেশন করছে। আমাদের মহিলারা
কয়েকটি গান পরিবেশন করলেন, ছোট মেয়েরা নাচল। হঠাৎ অনুষ্ঠান থামিয়ে উদ্যোক্তারা
ঘোষনা করলেন, - যে একটি বাচ্চা ছেলে স্টেজের কাছে চলে এসেছে। মা বাবা কোথায় বলতে
পারছে না, মা বাবার নামও বলতে পারছে না। একজন কর্মকর্তা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে মাথার ওপরে তুলে ধরলেন।
আমরা দূর থেকে আমাদের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি। টিংকুও ছিল আমাদের সঙ্গে, হেসে
বলল, - আশ্চর্য দ্যাখ, বাচ্চাটা যেই শার্টটা পরেছে, আমিও টাপুনকে (টিংকু-দেবাশিসের
ছেলে) ঠিক ঐ রকম একটা শার্ট পরিয়েছি, --- টা আ আ আ আ পুউউউউ ন। হঠাৎ দেখা গেল
টিঙ্কু রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে স্টেজের দিকে।
বাচ্চাটা টাপুনই ছিল।
কুয়েতের বহু বাঙালী সোসাইটির মেম্বার ছিলেন না। অনেক
অনুরোধ সত্ত্বেও মেম্বার হতে রাজি হতেন না। আমরা কিন্তু খুব উদার ছিলাম। প্রত্যেক
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন জানাতাম, নাম মাত্র প্রবেশ মূল্যের (১ দীনার) বিনিময়ে। দুর্গা
পূজো হত না কিন্তু বিজয়া সম্মিলনী হত খুব ঘটা করে। যারা মেম্বার নয় তাদের ও সাদরে
নিমন্ত্রন জানানো হত; পুরো খরচটা মেম্বাররাই বহন করতেন।
সেবার ঠিক হল সবাইকে মাটিতে বসিয়ে পাত পেতে খাওয়ানো
হবে। মাউস ট্র্যাপ থিয়েটারে ছোটখাট একটা অনুষ্ঠানের পর পাশের হলে আসন পেতে বসার
ব্যবস্থা হল। একবারে সবার জায়গা হবে না। বাঙালী পরম্পরা অনুযায়ী ফার্স্ট ব্যাচ
বসল। কমিটির মেম্বার আর কিছু সেচ্ছাসেবী লেগে গেল পরিবেশনে। দারুণ জমে উঠল। ফার্স্ট
ব্যাচের খাওয়া শেষ হল। সেকেন্ড ব্যাচ বসবে, এমন সময় একজন কমিটি মেম্বার ছুটে এসে
আমার আর কল্যাণের কানে কানে দুঃসংবাদটি দিল, - ভাত শেষ হয়ে গেছে। ডাল, তরকারি,
মাছ, মাংস, চাটনি, মিষ্টি সব প্রচুর আছে কিন্তু ভাত শেষ। কি আতঙ্ক। সেকেন্ড ব্যাচ
তখনই বসবে। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল; যার পকেটে যা আছে বের করে গোটা
কয়েক গাড়ি বেরিয়ে গেল বিভিন্ন দিকে। যেখানে যত ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে, সব জায়গা
থেকে ভাত সংগ্রহ করল কয়েক জন। আমি আর কল্যাণ হলের বাইরে দাঁড়িয়ে, গাড়ির আলো দেখলেই
ছুটছি আমাদের কারও গাড়ি এল কি না দেখতে। ভেতরে ভীষণ সোরগোল, - এত দেরি হচ্ছে কেন?
উঃ সে কি বিভীষিকা। যাই হোক, একটু দেরি হলেও বেশ অনেকটা ভাত এসে পৌঁছোল এবং
পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল কোনও রকমে। সবাই বেশ তৃপ্তি করে খাওয়া দাওয়া সেরে একে
একে রওনা দিল বাড়ির দিকে। এবার আমাদের খাওয়ার পালা। দেখা গেল সব পদ শেষ। বেচেছে
শুধু দু-ডেকচি ভাত।
বাকি বাসনগুলোতে কিছু কিছু তলানি পড়ে ছিল। সেই ভাত
আর তলানি দিয়ে শুভ বিজয়ার ভোজ সারলাম আমরা ক’জন।
কুয়েতনামা ১৩
এর পরের ঘটনা সোসাইটির ইতিহাসে একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল অধ্যায়।
প্রথমে ইন্ডিয়ান আর্টস সার্কলের (আই এ সি) কথা একটু
বলা দরকার। এটি ছিল একটি সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ফুনাইতিস অঞ্চলে অনেকখানি
জায়গা নিয়ে ছিল একটি বিরাট প্রেক্ষাগৃহ, ইনডোর ও আউটডোর ব্যাডমিন্টন কোর্ট, অনেকটা
ফাঁকা জায়গা আর বেশ বড় একটা কিচেন। বাইরে বিশাল জায়গা জুড়ে গাড়ি পার্কিঙের
ব্যবস্থা। আমরা অনেকেই এই প্রতিষ্ঠানেরও মেম্বার ছিলাম। সোসাইটির মেম্বারের সংখ্যা
যখন আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করল, তখন মাউসট্র্যাপ থিয়েটারে আর জায়গা হত না। তখন
আমাদের অনেক নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠান আই
এ সি-তেই হত। কুয়েতের আর কোনও দেশের নাগরিকদের এই সুবিধে ছিল না। দুর্ভাগ্যবশতঃ, কয়েক বছর আগে
কুয়েতের ডেভেলপমেন্ট স্কীমের আওতায় এসে, পুরো জায়গাটা বুল ডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া
হয়।
এই ইন্ডিয়ান আর্টস সার্কল থেকে একাঙ্ক নাটকের এক
প্রতিযোগিতা ঘোষণা করা হয়। চারিদিকে খুব সাড়া পড়ে গেল। আমরা খবরটা পেয়েই ঠিক করে ফেললাম
এই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতেই হবে। প্রথমেই একজন পরিচালক নির্বাচিত করা দরকার
যে নাটক নির্বাচন থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব পালন করবে। আর আমরা কমিটি থেকে সব রকম
সহযোগিতা করব। স্বপন দাশগুপ্তকে দেওয়া হল পরিচালনার দায়িত্ব। ঠিক হল আমরা
প্রেমচন্দের সদগতি মঞ্চস্থ করব; মূল গল্পটি হিন্দীতে হলেও, নাটকটি বাঙলাতেই হবে।
বিচারকদের মধ্যে অনেকেই হয় তো সদগতির গল্প শোনেন নি; তাই স্বপন ঠিক করল প্রত্যেক দৃশ্যের আগে হিন্দীতে একটা
করে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হবে। সেই দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। পরিচালকের কড়া নির্দেশ, কাগজ দেখে পড়লে চলবে না। স্পট লাইটের আলোয় গলায় যথেষ্ট দরদ এনে প্রায় অভিনয় করার মত করে বলতে হবে। উপায় নেই, কমিটি থেকে সহযোগিতা করা হবে কথা দিয়েছি, রাজি হতেই হল।
শুরু হল রিহার্সাল। নাটক বেশ ভালই দাঁড়াল। প্রতিযোগিতা শুরু হবার সপ্তাহ দুয়েক
আগে মীটিং ডাকল ইন্ডিয়ান আর্টস সার্কেল। জানানো হল সব নিয়ম কানুন। প্রত্যেক প্রতিযোগী দলকে স্টেজ সাজানোর জন্য শুধু ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হবে; আর নাটকের জন্য ৩০ মিনিট। শুনে তো আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত। সদগতি নাটকে একটা ছোট বাড়ি এবং তার বারান্দা আর উঠোন দরকার। ১৫ মিনিটে কি করে তা সম্ভব? পরিচালক স্বপন, কিছুক্ষণ
চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, - কোই বাত
নহি। হো যায়গা।
তারপর স্বপন যা করল, তার বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কাটবোর্ড কেটে একটা বারান্দা বানিয়ে ফেলল, পেছনে দেওয়াল,
দেখলে মনে হয় দেওয়ালের অন্য দিকে একটি ঘর আছে। এমন ভাবে মেটে রঙ করল তার ওপর, যেন মাটির বাড়ি, বেশ ভাঙাচোরা
অবস্থা। কিভাবে জানি
খড়ের মত একগাদা কি এনে ঘরের ছাদ বানাল। পুরো কাঠামোর নীচে চাকা লাগিয়ে খাড়া করিয়ে দিল উইংসের পেছনে। আমরা স্টেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল আমাদের
কুঁড়ে ঘর। আরও কিছু
টুকিটাকি জিনিস দিয়ে স্টেজ তৈরি হল ঠিক ৫ মিনিটে। দর্শকের
আসন থেকে মনে হচ্ছিল অজ গাঁয়ে একটা সত্যিকারের কুঁড়ে ঘর।
নির্দিষ্ট দিনে অভিনয় তো হল ভালয় ভালয়। আমরা হিন্দী, মালয়ালি, টামিল, তেলুগু, কন্নড়, মারাঠী, গুজরাতি, - বাকি সব নাটকও দেখলাম। কয়েকটি নাটক তো দেখলাম বেশ উচ্চমানের। এক সপ্তাহ ধরে চলল প্রতিযোগিতা।
অবশেষে এল ফলাফল ও পুরস্কার বিতরণীর দিন। খুব আশা
মঞ্চ সজ্জার প্রাইজটা তো পাবই। তা ছাড়া মুখ্য অভিনেতা ও অভিনেত্রীরও একটা পেয়ে
যেতে পারি। অরবিন্দ ঘোষ ও চন্দ্রাবলী অপূর্ব অভিনয় করেছিল; অন্ততঃ আমাদের ধারণায়।
অনুষ্ঠান শুরু হল। ইন্ডিয়ান আর্টস সার্কেলের সভাপতি
ছোট একটা ভাষণ দিয়ে, ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম সচিব আব্দুল খালেককে অনুরোধ জানালেন
মঞ্চে এসে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করতে। তারপরের ঘটনা এক স্বপ্নের মত। আজ এত বছর পরেও
সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। নাম ঘোষণা শুরু হল।
বেস্ট
স্টেজ-ক্রাফটঃ বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটি
বেস্ট
কস্টিউমঃ বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটি
বেস্ট
ড্রামাঃ বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটি
বেস্ট
ডিরেক্টরঃ স্বপন দাশগুপ্ত; বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটি
বেস্ট
অ্যাকট্রেসঃ চন্দ্রাবলী ঘোষ, বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটি
৬টা পুরস্কারের ৫টা আমাদের। একমাত্র বেস্ট
অ্যাক্টারের প্রাইজটা আমরা পাইনি। কেন জানি না। অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন অরবিন্দ
ঘোষ।
ইন্ডিয়ান আর্টস সার্কেলের পুরো হল তখন হর্ষধ্বনিতে
ফেটে পড়ছে, - স্ট্যান্ডিং ওভেশন। আমরা একেবারে স্তম্ভিত; এতটা আশা করিনি। সবাই এসে
আমাদের অভিনন্দন জানালেন; ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধিরা, ইন্ডিয়ান আর্টস সার্কেলের
কর্মকর্তারা আর অন্যান্য সোসাইটির সদস্যরাও। অবশ্য কয়েক জন আড়ালে একটু উষ্মাও প্রকাশ
করেন এই এক তরফা ফলাফলের জন্য; তবে সেটা খুবই স্বাভাবিক।
তারপর কেটে গেছে প্রায় ২৭ বছর। কিন্তু সেদিনের
সুখ-স্মৃতি আজও অম্লান। তবে এও জানি যে এই
সাফল্যের পেছনে পরিচালক স্বপনের ভূমিকাই ছিল প্রধান। প্রচন্ড খেটেছিল এই
নাটকের পেছনে। ২০০১ সালে স্বপন আমাদের
ছেড়ে চলে যায় চিরদিনের মত; সেই ক্ষতি পূরণ হবে না কোনও দিন।
কুয়েতনামা ১৪
বিসিএসের ইতিহাসে নাটকের একটা বিরাট ঐতিহ্য আছে। সত্তরের দশকে একটি নাটকের
মাধ্যমেই নাকি বিসিএসের গোড়াপত্তন হয়েছিল। সেই নাটকের নাম আমি শুনেছিলাম কিন্তু
এখন আর মনে করতে পারছি না।
১৯৮১ সালের প্রথম দিকে আমি কুয়েতে একা; আহমদীতে ব্যাচেলার ফ্ল্যাটে থাকি, তখন সুভাষদার (সুভাষ ভট্টাচার্য) কাছে প্রথম বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটির কথা জানতে পারি। একদিন সুভাষদা ফোন করে জানালেন যে সোসাইটি
মেম্বাররা প্রত্যেক বছর একটি নাটক করেন, এ বারের
নাটকে আমি চাইলে যেতে পারি। এক কথায় রাজি হলাম। এও জানালাম
যে আমার সঙ্গে অসীম রায় বলে আরও এক জন বাঙালী ভদ্রলোক আছেন, উনিও যাবেন । সুভাষদার গাড়িতে আরেকটি পরিবারও যাবে, তাই আমাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা হল; ডাঃ বোস
বলে এক ডাক্তার আমাদের সন্ধ্যে ৬টার সময় নিতে আসবেন। আমরা তো সেজে গুজে তৈরি, কিন্তু ডাক্তার বাবুর দেখা নেই। ভদ্রলোককে চিনিও না, আর ফোন নাম্বারও
নেই। সাড়ে সাতটা
অব্দি অপেক্ষা করে হাল ছেড়ে দিলাম। পরে শুনেছিলাম ওনার নাকি এমার্জেন্সী ডিউটি পড়ে
গিয়েছিল।
নাটকটি ছিল ‘ছুটির ফাঁদে’। অভিনয়ে স্বপন দাশগুপ্ত,
নন্দা ও হিমাংশু (ভৌমিক), আর পরিচালনায় নবাশিস কবিরাজ। খুব জমেছিল শুনেছি।
১৯৮২ সালে আমরা মোটামুটি গুছিয়ে বসেছি কুয়েতে।
সেবারের নাটক খুব ভাল ভাবেই উপভোগ করেছিলাম। সেবার স্বপনের পরিচালনায় ‘কেনারাম
বেচারাম’ অভিনীত হয়েছিল। নাম ভূমিকায় ছিলেন সাঁতরা-দা (পান্নালাল সাঁতরা) ও মজুমদার-দা
(সুশান্তময় মজুমদার)। সলিল (ব্যানার্জি), নগেন পাঁজার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়
করেছিল। এর বহু বছর পর এই একই নাটক আরও একবার মঞ্চস্থ হয়েছিল সলিলের পরিচালনায়।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। সেকালে কিন্তু তিন দিন ধরে
স্টেজ রিহার্সাল হত; তৃতীয় দিন তো পুরো ড্রেস রিহার্সাল হত। আমরা কয়েক জন অত্যুৎসাহী
মেম্বার প্রত্যেক দিন গিয়ে হাজির হতাম। খালি হাতে নয় কিন্তু; সবাই কিছু না কিছু
বানিয়ে নিয়ে যেত, স্যান্ডউইচ, সিঙারা বা চা-কফি। আর রিহার্সালও হত খুব হালকা মেজাজে; এ ওর পেছনে লাগত; সব মিলিয়ে
বেশ একটা হৈ চৈ-এর পরিবেশ।
স্মৃতি সত্যিই খুব দুর্বল হয়ে গেছে। ১৯৮৩ সালে অভিনীত
নাটকের নাম ছিল ঘুঘু। কিন্তু কুশীলবদের নাম কিছুতেই মনে
করতে পারছি না। শুধু এইটুকু মনে আছে যে হিমাংশু আর অরুন্ধতী (ভট্টাচার্য) ছিল
মূখ্য চরিত্রে। পরিচালনায় ছিলেন দিলীপ চ্যাটার্জি।
১৯৮৪ সাল নাটকের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। সেবার ‘সিরাজদ্দৌল্লা’
অভিনীত হল; বিসিএসের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক। বেশ একটু যাত্রা স্টাইলে অভিনয় করা হয়েছিল। এবার পরিচালনায় ছিলেন মজুমদার-দা এবং মূখ্য চরিত্রে হিমাংশু ও মঞ্জু সিনহা। আমার যতদূর মনে পড়ে ঠিক সেই সময়ে ঢাকা
থেকে একটি পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী কুয়েতে এসেছিলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের আমন্ত্রণে এবং সেই গোষ্ঠীও ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ নাটকটি অভিনয় করেন। আমরা নিজেদের নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকার
জন্য যেতে পারিনি কিন্তু সেই নাট্যদলের কয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রী আমাদের নাটক দেখতে
এসেছিলেন এবং খুব প্রশংসা করে গিয়েছিলেন।
সিরাজদ্দৌল্লা নাটকের ঐতিহাসিক কস্টিউম, জুতো থেকে পাগড়ি অব্দি কোলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। বেশ একটা গম্ভীর রাজকীয় পরিবেশ তৈরি
হয়েছিল।
১৯৮৫ সালের নাটক বড়ো পিসীমা। এই নাটকেই আমার কুয়েতের মঞ্চে প্রথম
আত্মপ্রকাশ। এই নাটকের কথা আগেই বলেছি। শ্রেষ্ঠাংশে শুল্কা (দে) ও কবিরাজ। পরিচালনায় আচার্যি-দা (নৃপেন আচার্য)। এই নাটকটি নিয়ে কয়েকদিন আগে কিছু
স্মৃতিচারণ হয় এবং শুক্লা একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করে। প্রত্যেক দিন রিহার্সালের আগে একটা
ওয়ার্ম-আপের নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিচালক। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মুখে নানা রকম
শব্দ করতে হত, যেমন
কা-কা-কা—কা, বা-বা-বা-বা, না-না-না-না ইত্যাদি, অনেকক্ষণ ধরে। এতে নাকি মুখের জড়তা কেটে যায়। শুধু তাই নয় এর পর আবার মুখের মাংসপেশী
শিথিল করার জন্য নানা রকম মুখভঙ্গি করতে হত। সে এক আজব দৃশ্য। ডজন খানেক প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্কা মুখ ভেঙিয়ে গলা দিয়ে
নানা রকম আওয়াজ বের করছে, এই দৃশ্য কল্পনা করা খুবই কঠিন। এই অনুশীলন থেকে প্রম্পটারেরও নিস্কৃতি
ছিল না। তবে কল্যাণ (মজুমদার) সেদিন জানাল যে সে এবং সলিল (ব্যানার্জি) না কি এতে অংশ গ্রহণ করেনি কখনও। কি করে বেঁচে গেল, সেটা এক রহস্য।
১৯৮৬। দু-বছর আগের সিরাজদ্দৌল্লার স্মৃতি তখনও উজ্জ্বল। সবারই ইচ্ছে আরও একটা ঐতিহাসিক নাটক
হয়। কস্টিউমগুলোও পড়ে আছে। কিন্তু বিপদ হল, সিরাজদ্দৌল্লার পোষাকে তো
আর ‘চন্দ্রগুপ্ত’ করা যায় না। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক হল এবার হবে ‘পলাশীর পরে’। সিরাজদ্দৌল্লার পরে বাঙলার ইতিহাস
নিয়ে নাটক। আবার শুরু হল রিহার্সাল, পুরোদমে। নাটকটি বিরাট বড়। কোনও অজ্ঞাত কারণে স্টেজ রিহার্সালের
আগে নাটকটির প্রথম থেকে শেষ অব্দি একটানা রিহার্সাল হয়নি। স্টেজ রিহার্সালের দিন দেখা গেল নাটক
প্রায় চার ঘন্টার কাছাকাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর কি করা? নাটকের ঠিক দু দিন আগে নির্দয় ভাবে সবার পার্ট ছাঁটা হয়। সে নিয়ে মহা অসন্তোষ! কারও হয় তো চার পাতা সংলাপ
ছিল, গিয়ে দাড়াল চার লাইনে। এত দিনের পন্ডশ্রম বৃথা। যাই হোক, সোসাইটির স্বার্থে সবাই মেনে নিল
এবং মানে মানে মঞ্চস্থ হল নাটক।
এর ঠিক পরেই এক বিশেষ ঘটনায় আমরা একটু নেড়ে চেড়ে বসি। আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুরা মনোজ মিত্রের ‘চাক ভাঙা মধু’ নাটকটি করে এবং আমাদের সাদরে
আমন্ত্রণ জানায়। নাটকটি আমাদের খুব প্রভাবিত
করে। বেশ একটা পেশাদারি মেজাজের ছাপ ছিল
নাটকটির উত্থাপনায়; আমদের
মত হাল্কা মেজাজের নয়। সত্যি কথা বলতে কি নাটকটি
দেখার পর আমরাও একটু নতুন করে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করি।
১৯৮৭ সালের ‘কাঞ্চনরঙ্গ’ সেই চিন্তা ভাবনারই ফলশ্রুতি।
হিমাংশু পরিচালনার দায়িত্ব নিল। মুখ্য ভূমিকায় নির্বাচিত হল কেকা
মুখার্জি ও সৌমিত্র ব্যানার্জি। আমারও একটি ভূমিকা ছিল। অন্যান্য নানা ভূমিকায় ছিল স্বপন
দাশগুপ্ত, সুভদ্রা, বীরেন-দা (শ্রী বীরেন মল্লিক) কল্যাণ, ধ্রুব মুখার্জি, সোমেশ গুপ্ত, পম্পা মন্ডল, মিনাক্ষী চন্দ, নুপুর রায় চৌধুরি, চন্দ্রাবলী। প্রথম দিনের রিহার্সালেই একটি বিশেষ
নিয়ম আরোপিত হল, - “নো
প্রম্পটিং”। শুনে তো সবার চক্ষু চরক গাছ। সে কি? প্রম্পটার না থাকলে চলবে কি করে? হিমাংশু জানাল প্রম্পটার
থাকবে কিন্তু প্রম্পটিং হবে না। সবাই নিজের সংলাপ কন্ঠস্থ করবে। যদি কেউ আটকে যায় কখনও, তবে প্রম্পটার উইংসের পাশ
থেকে তাকে শুধু সেই অংশটা ধরিয়ে দেবে। বাস। মন্ত্রের মত কাজ হল; কয়েক দিন পর দেখা গেল সবার নিজেদের
সংলাপ একেবারে ঝরঝরে মুখস্থ করে ফেলেছে।
খুব সুন্দর সেট বানিয়েছিল অনিমেষ (মন্ডল); একটি মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের
বৈঠকখানা। একটা বাইরে যাবার দরজা, একটা ভেতরে যাবার; দুটো জানলা, জানলায় স্প্রিং লাগিয়ে হাফ
পর্দা, দেয়াল একটু দাগ ধরা নোংরা, কিছু ছবি আর আসবাব পত্র। খুব খেটেছিলাম সবাই। দারুণ নাটক হয়েছিল। মনে হয় তিন দিন ধরে চলেছিল নাটক। এই নাটকে একটা খুব ছোট্ট রোল ছিল; - পিয়ন বা পোস্টম্যানের, যে শুধু শেষ দৃশ্যে “টেলিগ্রামমম ……” বলে মঞ্চে ঢুকে টেলিগ্রাম
হাতে দিয়ে বেরিয়ে যাবে। এখন সমস্যা হল এই ছোট ভূমিকায়
কে অভিনয় করতে রাজি হবে? হিমাংশুর অনুরোধে এক কথায় রাজি হয়েছিলেন রায়-দা (বিভুতোষ রায়), সোসাইটির প্রবীনতম মেম্বারদের
অন্যতম।
‘কাঞ্চনরঙ্গ’ নাটক সোসাইটির নাটকের ইতিহাসে
আরেকটি মাইলস্টোন।
এবার ১৯৮৮ সালের নাটক। এর আগে বলি যে সেকালে আরব টাইমস থেকে
এক সাংবাদিক, এক
হায়দরাবাদী মহিলা খুব উৎসাহ নিয়ে আমাদের নাটক দেখতে আসতেন এবং খুব ভাল রিভিউ লিখতেন। ভদ্রমহিলার নামটা ভুলে গেছি। ওনার লেখনীর কল্যাণে আমাদের তখন ভারতীয়
মহলে খুব সুনাম। কিন্তু যেহেতু আমরা বাঙলায়
নাটক করি, অন্যান্য
রাজ্যের দর্শকদের কাছে আমরা সরাসরি পৌঁছতে পারি না। তাই এবার ঠিক হল আমরা হিন্দী নাটক
করব, - মহাশ্বেতা দেবীর ‘বিছন’।
এবারও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হল হিমাংশুকে। রিহার্সাল চলাকালীন বুঝতে পারলাম
বাঙালীদের হিন্দী জ্ঞান কত কম। এমনিতেই বাঙালীর হিন্দী উচ্চারণে অ-কার, আ-কারের সমস্যা আছে। তার ওপর এই নাটকের পটভূমি ছিল বিহারের
পূর্বাঞ্চলের এক দরিদ্র গ্রাম, যেখানে বর্তমান সভ্য জগতের কোনও সুযোগ সুবিধে গিয়ে পৌঁছয়নি, এবং সেখানকার লোকেরা এক নিজস্ব
লবজে (ডায়লেক্ট) কথা বলে। উচ্চারণ শুধরে দেবার জন্য এক বিহারী
ভদ্রলোককে আমাদের টি্মে ঢোকানো হল। উনি উচ্চারণের খুটিনাটি গুলো ধরিয়ে দিতেন। কয়েক সপ্তাহ পরে বেশ একটু উন্নতি
দেখা গেল। তবে স্টেজ রিহার্সালের দিন একটু পদস্খলন
হয়। একজনের সংলাপ ছিল; - তু যা তুরন্ত, তেরে লিয়ে ইন্তজার কর রহা
হৈ। নাটক তখন ক্লাইমেক্সে প্রায়, সেই অভিনেতা ‘ইন্তজার’ কথাটি বেমালুম ভুলে গেলেন, বুদ্ধি খাটিয়ে বলে দিলেন
তেরে লিয়ে ‘ওয়েট’ কর রহা হৈ। তবে আসল অভিনয়ের দিনগুলোতে আর কোনও
সমস্যা হয়নি
মুখ্য চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিল কেকা মুখার্জী ও
দীপঙ্কর চক্রবর্তী; অন্যান্য
ভূমিকায় স্বপন দাশগুপ্ত, সত্য চক্রবর্তী, বীরেন-দা (বীরেন মল্লিক), কল্যাণ মজুমদার, অরবিন্দ ঘোষ, সাঁতরা-দা (শ্রী পান্নালাল সাঁতরা), পম্পা মন্ডল, পরিমল দে ও চন্দ্রাবলী ঘোষ। আমিও একটি মাঝারি ভূমিকায় ছিলাম। আরও অনেকে ছিলেন কিন্তু সবার নাম
মনে করতে পারছি না।
এই নাটকে চন্দ্রাবলীর কোনও সংলাপ ছিল না। সে ছিল এক দেহাতী বাড়ির বৌ, মাঝে মাঝে মঞ্চে আসবে, টুক টাক কাজ করে আবার ভেতরে
চলে যাবে। শুধু একটা দৃশ্যে, স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে “মাইয়া” বলে এক আর্ত চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে, হাত থেকে বাসনটা পড়ে গড়িয়ে
যাবে এক দিকে। সেই দৃশ্যে যে কি মর্মস্পর্শী
অভিনয় করেছিল চন্দ্রাবলী আমি তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। সত্যি, সংলাপ ছাড়াও যে কি অপূর্ব অভিনয় করা
যায় তা সেই নাটকেই দেখেছিলাম।
চারদিন ধরে চলেছিল ‘বিছন’। যাকে বলে সুপার হিট। প্রচুর ভীড় হয়েছিল প্রত্যেক দিন।
কয়েকটি নাটকের ভিডিও এখনও আছে। দেখেছি কয়েকবার। একটা মিশ্র অনুভূতি হয়। ভাল লাগে বেশ কিন্তু কখনও আবার মনটা
বেশ বিষন্নও হয়ে যায়। কেন জানি না!
(আগামী পর্বে শেষ)
কুয়েতনামা ১৪
কুয়েতের ঘটনাবলীকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়; - বিফোর ইনভেশন এবং আফটার লিবারেশন। ইনভেশনের আগে ও লিবারেশনের পরে। বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটির বেশির
ভাগ মেম্বারই লিবারেশনের পরে কুয়েতে এসেছেন বা সোসাইটির মেম্বার হয়েছেন। তাঁদের জন্যই পুরনো কিছু ছোট ছোট
ঘটনা মোটামুটি সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। সেই প্রাচীন যুগে, যখন স্মার্ট ফোন তো দূরের কথা, মোবাইল ফোনও ছিল না, না ছিল ই-মেল বা ইন্টারনেট বা স্যাটেলাইট
টিভি। ১৯৮২ সালের কপিল দেবের বিশ্ব কাপ
জয়ের খবর জানতে পারি অন্ততঃ ১২ ঘন্টা পরে, আকাশবাণীর খবরের মাধ্যমে, সারা দিন টেনশনে থাকার পর। দেশে ফোন করতে হলে ইন্টারন্যাশনল
কল বুক করে বসে ত্থাকতে হত; অনেক সময় সারা রাত অপেক্ষা করেও কানেকশন পাওয়া যেত না। ইন্দিরা গান্ধীর শোকযাত্রা দেখেছিলাম
দুবাই টেলিভিশন চ্যানেলে, তাও লাইভ নয়। তা সত্ত্বেও বেশ একটা বর্ণময় জীবন কিন্তু সেকালেও ছিল।
কুয়েতের প্রথম দিনগুলোতে মনে আছে অনেক প্রবীণ বাঙালী ছিলেন যাঁরা সোসাইটির মেম্বার
ছিলেন না এবং মেম্বার হতেও চাইতেন না। কেন জানি না। আমরা মেম্বার হওয়ার পরে আমাদের বলা হয়েছিল, - খুব ভুল করলে, ওদের ভেতরে খুব গন্ডগোল, ঝগড়া ঝাটি লেগেই থাকে। ভাগ্যিস সে সব কথায় কান দিই নি। ৩২ বছরেও কারও সঙ্গে ঝগড়া হয় নি। মতভেদ হয়েছে কিন্তু সেটা কখনও ঝগড়া
অব্দি গড়ায় নি। বরং এই সোসাইটির মাধ্যমে
পেয়েছি প্রচুর বন্ধু-বান্ধব, দাদা-বৌদি এবং পরবর্তী কালে অনেক ছোট ভাই-বোন আর সম্প্রতি কিছু ভাইপো-ভাইঝি।
যাক আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। একটা ছোট্ট ঘটনা বলে যবনিকা টানছি। মে মাসের প্রথম দিনে কলকাতায় একটি
রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি আমরা দু-জন। বেশ জমজমাট অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শেষে ছিলেন এক প্রবীন
ও কিংবদন্তী আবৃত্তিকার। যখন বাড়ি ফিরছি; সুমিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, - কেমন লাগল? সুমিতা একটু ভেবে বলল, - ভালই; তবে ……… আমাদের প্রোগ্রাম আরও ভাল
হয়।
আমাদের মানে?
মানে আর কি? আমাদের
মানে বেঙ্গলী কালচারাল সোসাইটি।
এক বছরের ওপর হয়ে গেল কুয়েত ও বিসিএস ছেড়ে চলে এসেছি; কিন্তু, এখনও “আমাদের”। আশ্চর্য!
আপাততঃ এখানেই সমাপ্তি। সবাইকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
সমাপ্ত
নিউ জার্সি – ১৪ জুন ২০১৪
No comments:
Post a Comment