মেয়েটি কে
রে?
ও আমাদের বাড়ির
ঝি
এই ঝি বলিস
না!
কেন?
আরে ওদের অপমান
করা হয়। বলবি কাজের মেয়ে।
দুই স্কুল-বান্ধবীর কথাবার্তা শুনছিলাম। আমার মনে যেন কেমন একটু খটকা লাগল। সত্যিই কি তাই? ঝি মানে তো মেয়ে; যেমন ভাইঝি, বোনঝি বা ভাসুরঝি! আমার তো মনে হয় কাজের
মেয়ে বা পরিচারিকাদের সম্মান দেবার জন্যই সেকালে এদের বাড়ির ঝি বলা হত। অর্থাৎ
বাড়ির মেয়ে। কালক্রমে বোধহয় ঝি শব্দটি তার সম্মান হারায়। কি জানি আমি তো আর
ভাষাবিদ নই আর বাঙলা ভাষায় বিভিন্ন শব্দের অর্থগত বিবর্তন সম্বন্ধে আমার কোনও
জ্ঞানই নেই।
আমিও বরং কাজের মেয়েই বলি।
এই কাজের মেয়েরা সমাজে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করেন।
এঁদের ছাড়া বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজ অচল। যে কোনও বাড়িতে সকল আটটা পর গিয়ে যদি দেখা
যায় গৃহিণীর মুখ হাড়ি, তবে নিশ্চিত যে কাজের মেয়ে কামাই করেছে।
প্রত্যেক সকালে কলকাতার প্রতি পাড়ায়, আবাসনে বা রেল
স্টেশনে এঁদের দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে; রুদ্ধশ্বাসে সবাই চলেছেন নিজেদের কর্মস্থলে
অর্থাৎ বিভিন্ন গৃহস্থালীর দিকে। অফিস বাবুদের মত গয়ংগচ্ছ ভাব নয় এঁদের। পরনে
আধময়লা শাড়ি ও হাওয়াই চপ্পল। ঠিক সময়ে কাজে পৌঁছনোর তাড়া এঁদের গতিতে প্রকট। এই
তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর তাগিদটা কিন্তু গিন্নীমায়েদের গঞ্জনার ভয়ে ঠিক নয়, সময়ের তাড়ায়।
এঁরা অনেকেই একাধিক বাড়িতে কাজ করেন। এক জায়গায় দেরি হলে দিনের শেষে বাড়ি ফিরতে
দেরি হয়ে যায়।
আমার সংসারেও আছেন একজন। নাম দূর্গা। সার্থকনামা। সত্যিকারের দশভূজা। সকাল ৮টায় ঢোকেন আর ৯টায় বেরিয়ে যান। এই সময়ের মধ্যে ঘর ঝার দেওয়া, মোছা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা
ও মেলে দেওয়া সব কমপ্লিট। এর পরেই অন্য বাড়ি। গিন্নী হাসিমুখে
বিদায় দেন, - পরে দরজা বন্ধ করে গজগজ করেন, কাপড় গুলো কি বিচ্ছিরি করে কেচেছে দেখো, আর ঐ দেখো কোনায় ধুলো পড়ে আছে। ইদানীং দূর্গা কে কাপড় কাচা থেকে নিস্কৃতি দেওয়া হয়েছে। সে যাক, সে অন্য গল্প।
দূর্গা খুব চুপ চাপ। বেশি কথা বলে না। ওর উপস্থিতি আমি টের পাই গ্রীষ্মের
সকালে হঠাৎ ফ্যান বন্ধ হয়ে গেলে। প্রথম দিকে আমি ভাবতাম বোধহয় লোড শেডিং হল। আসলে তা নয়। সম্মার্জনী হাতে নিয়ে দূর্গার ডিউটি শুরু হল। আমাকে খুব কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে, আমি যেন দূর্গার ঝাঁটার পাশে বা সামনে না থাকি, আমাকে পাশ কাটিয়ে ঝাঁটা এগিয়ে গেলে আশে পাশের ধুলো বালি পরিস্কার হবে না। ঝাঁটা থেকে বাঁচতে আমি এক ঘর থেকে আর
এক ঘরে আশ্রয় নিতাম। সকালবেলায়
এই সময়টা আমি আর যে কোন অবসর প্রাপ্ত প্রবীন নাগরিকের মত খবরের কাগজ পড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বার বার স্থান পরিবর্তনে মনঃসংযোগ বিঘ্নিত
হয়। তাই একদিন
ঠিক করলাম বিছানায় আধশোয়া হয়ে কাগজ পড়ব; তাতে অন্ততঃ
আমাকে স্থানচ্যুত হতে হবে না। কিন্ত আর এক বিপদ। কাগজ পড়া
শেষ করে নেমে আর চটিজোড়া খুঁজে পাই না। সম্মার্জনীর আঘাতে দু পাটি চটি খাটের তলায় দুই দুর্গম স্থানে প্রবিষ্ট হয়েছে। ঠিক এই সময় এক বন্ধুর ফোন এল, - কি করছিস? বললাম। বন্ধুটি অত্যন্ত বিচক্ষণ; বললেন, - খবরদার, খাটের নীচে ঢুকিস না। তার থেকে বরং নতুন চটি কিনে নিয়ে আয়। এই বয়সে খাটের তলায় ঢুকলে স্লিপ-ডিস্ক অবধারিত। তারপর যা চিকিৎসার খরচ, তার থেকে অনেক কম দামে নতুন চটি হয়ে যাবে। তাই করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার অভিপ্রায় জেনে, গিন্নী দূর্গাকে ডেকে, পর্দার রড খুলিয়ে, সেই লম্বা
রড দিয়ে চটির দু-পাটি উদ্ধার করালেন। কি কেলেঙ্কারী!
যে প্রতিবেশী মহিলা দূর্গাকে
পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে, তিনি সতর্ক
করে দিয়েছিলেন গিন্নীকে, মেয়েটা কাজের, কিন্তু বড় পয়সার খাঁই, এক গাদা কাজ নিয়েছে। রোজ সকাল আট-টা থেকে রাত ন-টা,
সাড়ে ন-টা অব্দি
কাজ করে। তা অবশ্য
করে, আমরাও লক্ষ্য করেছি।
কিন্তু দূর্গার একটা বিশেষ গুণ
আছে। কখনও কামাই
করে না। আসলে থাকে
খুবই কাছাকাছি। দক্ষিণ কলকাতার
এক অভিজাত অঞ্চলের ঠিক পাশেই একটি অনভিজাত জন বসতি আছে, টিনের চাল, ছোট ছোট ঘর, প্রচুর লোকের বাস। কিন্তু ‘ইলেকটিক’ আছে। দূর্গার
বাড়িতে ছোট্ট একটা টিভি আছে, আছে রান্নার
গ্যাস। আর মোবাইল
ফোন তো আজকাল ঘরে ঘরে। দুটো ঘর
নিয়ে থাকে দূর্গার পরিবার, স্বামী, দুই সন্তান (একটি মেয়ে
ও একটি ছেলে) আর মা। মাও ছিলেন কাজের মেয়ে। এখন বয়স ও রোগে জর্জরিত। স্বামী টুকটাক মিস্ত্রীর কাজ করে। বেশ কষ্টেই সংসার চলে। কিন্তু দূর্গা সুখী, একদিন গল্প করছিল যে ছোটবেলায় কুপির আলোয় বড় হয়েছে, ঘূঁটের উনুনে রান্না হত আর টিভি বা ফোন তো দেখেইনি কখনও। সেই আন্দাজে তো ভালই আছে। একেই কি বলে অর্থনৈতিক উন্নতি?
আর সামাজিক উন্নতি? কাজের মেয়ে বা মজুরের ছেলে মেয়েরা কি বংশানুক্রমে একই কাজ করবে? উত্তর পেলাম ক’দিন পর।
এক দিন সন্ধ্যবেলা দূর্গার আগমন। আমার চোখ তখন টিভির পর্দায়। বুদ্ধিজীবিদের তর্ক বিতর্ক শুনছি। দূর্গা গিন্নীকে চাপা গলায় কি বলছে
মনে হল। মিনিট দশেক
পর গিন্নী বললেন, শোনো দূর্গা তোমায় কিছু বলবে। কি ব্যাপার? আমি জিজ্ঞেস করি। দূর্গা দু-টো কাগজ এগিয়ে দিল, বলল ইশকুলের ফরোম মেসোমশাই, একটু যদি যদি ভরে দাও। হাতে নিলাম কাগজ দুটো। দুটো অ্যাডমিশন ফর্ম, মোটামুটি
নামী স্কুলের। অবাক হয়ে
তাকাই, -
এই স্কুলে দিবি ছেলে মেয়েদের? এখানে তো প্রচুর ফীস রে, মানে খরচা।
দূর্গার চোখ মাটিতে, কিন্তু বেশ দৃঢ় গলায় বলল জানি মেসোমাশাই। এ জন্যেই তো এত গুলো কাজ নিয়েছি। এদের আমি ল্যাকাপড়া শেখাবই।
কিন্তু ক-দিন পারবি রে? তোর ছেলে
মেয়েরা তো বেশ ছোট এখনও।
পারতে হবেই গো। চেষ্টা করে যাব যতক্ষণ না মুখে রক্ত
ওঠে; এদেরকে আমি কিছুতেই ঝি-চাকরের কাজ করতে দেব না; - এবার আমার চোখের দিকে তাকায় দূর্গা।
হঠাৎ যেন নতুন এক দূর্গাকে আবিস্কার
করলাম। যেন সেই
চিরন্তন মাতৃ মূর্তি। মাথা নত
হয়ে এল। খুব যত্ন
করে ভরে দিলাম ফর্ম দুটো। অস্ফূট স্বরে বললাম, সাবাশ।
সিদ্ধার্থ
দেব
১৩ই
জুন ২০১৪
No comments:
Post a Comment