২০১৩ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি শেষবারের মত অফিসে গিয়েছিলাম। কাজকর্ম কিছুই ছিল না, গিয়েছিলাম কিছুটা আবেগের বশে। সেই অফিস, সেই আসবাব, সেই ফাইলপত্র, টেলিফোন, কমপিউটার; - এতদিন এখানে বসে কাজ করেছি। সবাই জানত এটা আমার অফিস। কিন্ত কাল থেকে, অর্থাৎ পয়লা মার্চ থেকে, এ অফিস আর আমার থাকবে না। এসেছি খবর পেয়ে অনেকেই চলে এল দেখা করতে, খোদ বড় কর্তাও। সবাই অবাক, বিদায় সম্বর্ধনা হয়ে গেছে, লোকটা পাগল না কি? অস্বস্থিতে পড়লাম; - বললাম না কিছু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ড্রয়ারে ছিল, নিতে এসেছি। সবাই মিলে পার্কিং লট পর্যন্ত এগিয়ে দিল আমায়।
৯ই মার্চ কুয়েত ছাড়ি। এমিরেটস এয়ারলাইনের প্লেন যখন মাটি ছাড়ল, পাশে উপবিষ্ট গৃহিণীকে বললাম; - আমরা আর ফিরছি না, অবাক লাগছে না? গৃহিণী কিছু বললেন না, চোখে মুখে বিষাদের ছায়া, বত্রিশ বছরের মায়া কাটিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়।
১০ই মার্চ কোলকাতা পৌঁছোলাম। প্রথম কয়েক দিন মনে হচ্ছিল যেন ছুটিতে এসেছি, যেমন আসি প্রত্যেক বছর। টনক নড়ল দশ দিন পর যখন এয়ারপোর্টের কার্গো টার্মিনাল থেকে জানালো, স্যর আপনার শিপমেন্ট এসে গেছে। অর্থাৎ ২৬টা বাক্স এসে পৌঁছেছে। মাথায় বজ্রপাত হল যেন, এতগুলো বাক্স রাখব কোথায়?
পরের দিন কার্গো টার্মিনালে গিয়ে কাস্টমস থেকে মাল ছাড়াতে প্রায় সারা দিন লেগে গেল। বিশদ বিবরণে যাব না। এইটুকু বলতে পারি সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আমার সেই দিনের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখের হয় নি। আর আমি কোনও গোপন আদান প্রদানেও রাজি হইনি। যাই হোক, ২৮টা বড় কাঠের বাক্স ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছল; হাঁটা চলার আর জায়গা রইল না। সে রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে, পরের দিন সকালে এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভাবতে বসলাম কি করা যায়। এমন সময় গৃহিণী ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। রিসেপশন ডেস্কে ফোন করে দু-জন লোক আনালেন। তাদের নির্দেশ দেওয়া হল সব বাক্স খালি করতে হবে এক দিনের মধ্যে। এও বলা হল কাঠের বাক্স খালি করে যেন বিল্ডিঙের বাইরে বিদায় দেওয়া হয়। এই কাঠের বাক্স বাইরে রদ্দিওয়ালার দোকানে বেশ ভাল দামে বিক্রি হয়। বেশ মন্ত্রের মত কাজ হল। ঝটাপট বাক্স খালি হল, কিন্তু ভেতরের জিনিস? ডাঁই করে রাখা হল বিছানার ওপর, চেয়ার টেবিলও রেহাই পেল না। রান্না ঘর আর ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা হল অগুন্তি বাসন। বিকেল নাগাদ লোক দুটি তাদের পারিশ্রমিক, কিছু বখশিশ আর কাঠের বাক্সগুলো নিয়ে অদৃশ্য হল। বাক্স তো বিদায় হল। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর শোব কোথায়। খাওয়া দাওয়ার অবশ্য ঝামেলা ছিল না। প্রত্যেক দুপুরে ‘দেবযানী’স কিচেন’ থেকে ডাব্বা চলে আসত। বাড়িতে শুধু চা আর টুকিটাকি জলখাবারের ব্যবস্থা ছিল। অনেক দিন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এই দেবযানী। ভদ্রমহিলাকে দেখিনি কখনও, যদিও ফোনে কথা হয়েছে বহুবার। ডাব্বা পৌঁছে দিতেন দেবযানীর স্বামী; রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। বেশ অমায়িক ভদ্রলোক।
হ্যাঁ যা বলছিলাম। শোব কোথায়? গৃহিণী জানালেন, শুতে হলে বিছানার জিনিস পত্র আলমারিতে ঢোকাও। এবার স্ট্র্যাটজিটা পরিস্কার হল; ঠ্যালার নাম বাবাজি! ব্যাজার মুখে একটা একটা করে জিনিস আলমারিতে তুললাম। অবশ্য একা নয়, যৌথ ভাবেই সব কিছু করা হল। রাত্রে বেশ নিশ্চিন্তে নিদ্রাও হল।
এর মধ্যে কিছু প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপও হয়ে গিয়েছিল। তাঁরাই কাজের লোকজনের ব্যাবস্থা করে দিলেন। দিন চারেকের মধ্যে আমাদের ফ্ল্যাট বেশ বাসযোগ্য হয়ে দাঁড়াল।
এখন সংসার সাজানোর পালা, সেই প্রথম জীবনের মত। বাড়ির কাছেই এক বিরাট শপিং মল; হাঁটা পথ। গুটি গুটি হাজির হলাম এক বিকেলে। প্রথম গন্তব্য সুপার মার্কেট। চাল, ডাল, চিনি, মাছ, তরি-তরকারি ইত্যাদি কেনা হল। দাম চুকিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে দেখি বিরাট ভারী। এ বোঝা নিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পারব না। ক্যাশ কাউন্টারের ছেলেটি আমাদের করুণ মুখ থেকে বোধহয় ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিল। জিজ্ঞেস করল, - হেল্প লাগবে স্যার? সেই জানালো যে কাছাকাছি বাড়ি হলে, সার্ভিস কাউন্টারে গিয়ে জানালে, একটু পরে ওরাই বাড়ি পৌঁছে দেবে। সেই ব্যবস্থাই হল।
বাড়ি ফেরার মুখে খেয়াল হল শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করলেই তো হবে না, একটু আধটু বিনোদনের আয়োজনও তো রাখতে হবে। ঢুকলাম এক টিভির দোকানে। দাম টাম যাচাই করে একটি টিভি পছন্দ করা হল। দামও মেটানো হল। ঠিকানা দিলাম। ওরাই জানালো ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ডেলিভারি হয়ে যাবে। শুনে খুশী হলাম আর সত্যি কথা বলতে গেলে বেশ আশ্চর্যই হলাম। এ ধরণের চট জলদি সার্ভিস আশা করিনি।
এর পরের ঘটনায় তো আমি অভিভূত। দেশের সরকার নিয়ন্ত্রিত পরিষেবার শ্লথ গতিতেই অভ্যস্থ আমরা। কিন্তু এবার বেসরকারিকরণের কিছু উপকারিতা টের পেলাম। টিভি চলে এল প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী; দু-ঘন্টার মধ্যেই। ফোন করলাম এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে। জানালাম আমার টিভির কেবল সংযোগ, ইন্টারনেট-ওয়াই ফাই, ল্যাণ্ড লাইন ফোন এবং একটি মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিকানা দিলাম। যে মহিলা ফোন ধরেছেলেন, তিনিই জানালেন, কাল সকাল আট-টায় লোক পৌঁছে যাবে। সত্যিই তাই। ফোন করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে সব কিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, তারপর কয়েক দিন পর ফোনের পর ফোন, - সব কিছু ঠিক আছে তো স্যার, আর ইউ স্যাটিসফাইড স্যার, দিস ইস কাস্টমার ফীডব্যাক সেকশন স্যার। অতিষ্ঠ হয়ে এবার আমিই ফোন করলাম; - প্লীজ আমাদের ফোন করা বন্ধ করুন। আমাদের সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। কিছু সমস্যা হলে আমরাই ফোন করব। এরপর আর ফোন আসেনি।
গাড়িও কেনা হল একখানা। শো-রুম থেকে নিয়ে এলাম বাড়িতে। নতুন গাড়ি চালানোর মজাই আলাদা। ঠিক করলাম নিজেই চালাবো, এতদিন গাড়ি চালাচ্ছি; আপাততঃ ড্রাইভার রাখব না। দিন সাতেকের মধ্যে সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। কলকাতা শহরে যান বাহন অনেকটা ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে, আইন কানুন সর্বনেশে’ – নিয়মে চলে। অনেক বছর আগে একবার ইজিপ্ট বা মিসর বেড়াতে গিয়েছিলাম। কায়রো এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সিতে উঠে চমকে উঠেছিলাম। বেশ সুন্দর চওড়া রাস্তা। ৬-লেনের হাই ওয়ে, এক এক দিকে তিন লেন করে। কিন্তু গুণে দেখলাম পাঁচ লাইন গাড়ি চলছে। শুধু গাড়ি নয়, বাস এবং ট্রাকও। এক একটা যানের ব্যবধান বড় জোড় ৬ ইঞ্চি। আমার উদ্বেগ লক্ষ্য করে ড্রাইভার জানালেন, দোন্ত ওয়ারি, দিস ইজ কায়রো। এভরিবদি দ্রাইভ লাইক দিস। হোটেল অব্দি চোখ প্রায় বন্ধ করে ছিলাম। কুয়েত ফিরে এসে এক মিসরি সহকর্মী বন্ধুকে বলেছিলাম আমার অভিজ্ঞতার কথা। সে বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেছিল যে হ্যাঁ এটাই কায়রোর বিশেষত্ব; যে কায়রোতে গাড়ি চলায় সে সারা বিশ্বে চালাতে পারবে। এবার ভাবছি ওকে একটা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতায় ডেকে পাঠাই, কেমন গাড়ি চালাস তুই আমার শহরে, দেখি একবার। আসলে কলকাতার রাস্তায় কোনও লেন টেন মানে না কেউ, যার যত কলজের জোড় সে তত ভাল গাড়ি চালায়। যাই হোক, আপাততঃ এক পেশাদার চালকের হাতে স্টীয়ারিং ছেড়ে দিয়েছি, আমি পেছনের সীটে বসি। নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হয়।
এবার মোটামুটি নতুন জীবন যাত্রা শুরু হল। অফিস যাবার তাড়া নেই, এটা একটা বিরাট মানসিক শান্তি। যেই আবাসনে আমাদের বসবাস এখন, সেটা বিরাট এক কমপ্লেক্স; ১৬০০ ফ্ল্যাট। তার তিন ভাগের এক ভাগ প্রবাসী। কিন্তু প্রায় হাজার খানেক পরিবার তো আছেনই। বেশ গমগমে ভাব। সকালে প্রচুর নারী, পুরুষ, যুবা, বৃদ্ধ, হাঁটতে বেরোন। আবাসনের সীমানা ঘিরে পাচিল আর পাঁচিলের পাশ দিয়ে জগিং ট্র্যাক। কিছু অত্যুৎসাহী জগিং করেন ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগই আমার মত হাঁটা পার্টি। অনেকে দল বেঁধে হাটেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নানা রকম হতাশা ব্যক্ত করতে করতে। কখনও ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়েও বেশ তর্ক বিতর্ক চলে। কেউ হাঁটেন একা। কারও দিকে তাকান না। তবে বেশির ভাগই বেশ অমায়িক।
প্রথম দিন যখন হাঁটতে নামলাম, অনেকেই ভুরু কুঁচকে তাকালেন, অচেনা মুখ তো! দ্বিতীয় দিন খেয়াল করলাম একটু মৃদু হাসি; তৃতীয় দিন থেকে নমস্কার, গুড মর্নিং ইত্যাদি বিনিময় শুরু হয়ে গেল।
আমাদের আবাসনে দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে আগত এক ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থাকেন; বেশ দলে ভারী। তাঁরা প্রথম দিকে আমার এই বিশাল বপু দেখে আমাকে তাঁদেরই একজন বলে মনে করেছিলেন। খুব সহাস্যে আমাকে সম্ভাষণ জানাতেন, - জয় রামজি কী, ভাইয়া। নিজেদের ভাষায় দু-একটা কথাও বলতেন। আমিও অস্পষ্ট প্রত্যুত্তর দিতাম। কিছুদিন পর আমার আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ওনারা একটু অস্বস্তিতে পড়েছিলেন কিন্তু সেই প্রাথমিক হৃদ্যতা এখনও বজায় আছে।
একদিন সকালে এক অপরিচিত ভদ্রলোক আমার উল্টোদিক থেকে আসছিলেন। কাছাকাছি আসতেই হাতজোড় ও মাথা নত করলেন। আমিও হাতজোড় করলাম। কয়েক সেকেন্ড পর আমি হাত নামিয়ে দেখি উনি তখনও জোড়হস্ত। আমি অবিলম্বে আবার হাতজোড় করলাম। একটু পর ভদ্রলোক আমায় ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু তখনও হাত জোড়া। আমি অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। পেছনে দুটী বিল্ডিঙের মাঝ দিয়ে উদিত সূর্য দেখা যাচ্ছে। উনি এতক্ষণ আমাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন না; সূর্যপ্রণাম করছিলেন।
আবাসনের প্রাতর্ভ্রমনকারীরা মাসে একবার মিলিত হন; ব্রেকফাস্ট পার্টিতে। প্রথম দিন গিয়ে দেখি বিরাট কান্ড। প্রচুর ভীড়। এক বিরাট লম্বা টেবিলে সারি সারি রাখা আছে লুচি, আলুর দম, বিভিন্ন পাকোড়া-ভাজা ভুজি, সিঙারা, চাটনি ও জিলিপি। আরেক পাশে চা, কফি, সফট ড্রিং আর জল। আমার তো চক্ষু চরক গাছ। এই ব্রেকফাস্টের পর তো লাঞ্চের কোনও অবকাশই নেই। সবাই অভয় দিলেন, যেদিন ব্রেকফাস্ট থাকে সেদিন বাড়িতে আর কেউ লাঞ্চ করেন না। এঁদের মধ্যে আবার কয়েকজন আছেন তাঁদের হাঁটতে বেশি দেখা যায় না, কিন্তু এই পার্টিতে উপস্থিতি অবধারিত। এখানে সেই প্রথম দিনই প্রচুর প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ হল এবং ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব। এঁদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাঁরা প্রায়ই এক সঙ্গে বেড়াতে যান। আমরাও এই গ্রুপের সঙ্গে চীন ঘুরে এলাম; মন্দারমনিতে কাটিয়ে এলাম দু-দিন।
আবাসনের মধ্যেই একটা বেশ বড় পার্ক ও একটা কৃত্রিম লেকও আছে। পার্কের চার ধারে বেঞ্চ পাতা। সন্ধ্যে বেলা সেখানে বিরাট আড্ডা বসে। অনেকেই আমার মত অবসরপ্রাপ্ত, ঝাড়া হাত-পা। জমিয়ে আড্ডা হয়।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, - কেমন লাগছে অবসর জীবন? সত্যি কথাই বলি, - দারুণ লাগছে। অফিসের চাপ নেই, নেই মিটিঙের কচকচি, প্রজেক্ট ডেডলাইন, কস্ট ওভার রান, ফলো আপ, টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন ইত্যাদি। এখন তো মনে হয় ঐ সব অন্য কোনও সুদূর গ্রহের জীবন যাত্রা ছিল বুঝি।
কুয়েতকে মিস করেন না? হ্যাঁ আলবাত মিস করি। প্রতি নিয়ত। ৩২ বছরের জীবন তো এ জন্মে ভুলব না। বন্ধু-বান্ধব, বাজার হাট, বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খাওয়া। প্রতি শুক্রবার বাংলাদেশী দোকানে মাছ-সব্জী কেনা আর কুয়েতের বিখ্যাত স্ট্রীট ফুড, - শোয়ারমা, ফাতায়ার, এ তো আর ভোলার নয়! তবে কুয়েতের ঘনিষ্ট বন্ধুরা কলকাতায় এলে যোগাযোগ করেন, আড্ডা হয় জমিয়ে, আমরাও ফিরে যাই সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে।
সময় কাটান কি ভাবে? হ্যাঁ এটা খুব শক্ত প্রশ্ন! এর সদুত্তর আমার জানা নেই। ভেবে দেখলাম, - আমি সময় কাটাই না। সময় নিজেই কাটে। আমি সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। বেশ বয়ে চলি। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বরাবরই। মাসে দু-মাসে প্রায় নিয়ম করেই আড্ডা হয় কারও বাড়িতে। বন্ধুদের বয়স হয়েছে। বয়সের খেসারতও দিয়েছে অনেকে। কারও বসেছে পেস মেকার, কারও স্ট্রোক হয়ে গেছে কারও বা আবার বাই-পাস। নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন। কিন্তু আড্ডায় এলেই যেন বয়স কমে যায় সবার, অজান্তেই সবাই ফিরে যায় সেই হস্টেলের ফেলে আসা দিনগুলোতে, ভাষা হয়ে ওঠে অসংযত। প্রথম দিকে আমাদের গৃহিণীরা আমাদের বল্গাহীন ভাষা শুনে কানে আঙ্গুল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন। ইদানীং দেখছি বেশ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন আর একটু আধটু উপভোগও করছেন।
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তার দৌলতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথা হল বহুদিন পর; বহুদিন মানে প্রায় তিপ্পান্ন বছর পর। তার মধ্যে একজন স্কুল জীবনেই ছিল খুব মজার কিন্তু বেশ খাম খেয়ালী টাইপের। আমাদের ছিল বাঙলা মিডিয়াম স্কুল। এর আবার খুব ইংরিজি বলার বদভ্যাস ছিল। তাকে ফোন করলাম কিন্ত পরিচয় না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - গেস হু? কয়েক মূহুর্ত নিঃস্তব্ধতার পরে ভেসে এল এক গুরু গম্ভীর কন্ঠস্বর, - ইজ দিস সাম কাইন্ড অফ আ জোক? এবার
স্কুল জীবনের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অশালীন শব্দ ব্যবহার করতেই মন্ত্রের মত কাজ হল, - ব্যাটা তুই? এখনও বেঁচে আছিস? এত দিন পরে কোত্থেকে? অনেকক্ষণ গল্প হল। বন্ধুটি বিশেষ কোথাও যায় না বলল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একটু গেঁতিয়ে গেছে। স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ, আর নাতি-নাত্নী নিয়ে ভরা সংসার। দেখা হয়নি এখনও। মাস কয়েকের জন্য গুরগাঁও গেছে মেয়ের কাছে। ফিরে যোগাযোগ করবে বলেছে।
এই ভাবেই কাটছে সময়।
অনেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রিটায়ার করছেন; আগে থেকে কিছু প্ল্যান করেছিলেন কি? না ভাই করিনি। জীবন চলবে নিজের মত। আমিও চলব সাথে। এভাবেই কেটেছে সারা জীবন। এভাবেই চলবে।
আমার কোন বাড়তি চাহিদা নেই জীবন থেকে।
*************
No comments:
Post a Comment