Thursday 20 March 2014

রোমান্স


রোমান্স, - বেশ শ্রুতিমধুর একট শব্দ আচ্ছা রোমান্সের বাঙলা কি? আমার না ঠিক জানা নেই আজকাল তো হাতের কাছেই গুগল ট্রান্সলেশন খুব উন্নত প্রযুক্তি খুব সহজেই এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যায়। তারই শরণাপন্ন হলাম কিন্তু ফলাফল দেখে তো চক্ষু চরক গাছ। ল্যাপটপের পর্দায় ভেসে উঠল, - রমন্যাস, উপন্যাস, কল্পিত কাহিনী, অবাস্তব ঘটনা ইত্যাদি। কি জানি বাবা; গুগল তো সারা বিশ্ব থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, হয়তো ঠিকই বলছে।
বেশ কয়েক বছর আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের একটি সঙ্কলন বেরিয়েছিল। ক্যাসেটে। সিডি তখনও বেরোয়নি। তাতে শিল্পী নিজেই ভাষ্যকারের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেখানে ‘এই রাত তোমার আমার’ গানটি সম্বন্ধে বলার সময় এই গানের গভীর ‘রোমান্টিকতা’-র কথা বলেছিলেন। শব্দটি দো-আঁশলা হলেও আমার খুব মনে ধরেছিল। আমি তার পর থেকে এই শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করি।
রোমান্সের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বহু বছর আগে। তবে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে নয় কিন্তু। আমার বয়স তখন বছর চোদ্দ। প্রেম ভালবাসা সম্বন্ধে একটা ভাসা ভাসা ধারণা তৈরি হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে উল্টোরথ, সিনেমা জগৎ ইত্যাদির পাতায় চোখ বুলিয়ে দুনিয়ার রঙীণ দিকটা সম্বন্ধে একটু আধটু জ্ঞান সঞ্চয় করছি। এমন সময় পাড়ার এক দাদা ও দিদি প্রমে পড়লেন এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। দাদাটি অত্যন্ত সুপুরুষ এবং দিদিও বেশ সুন্দরী। দিদিটির আরেকটি বৈশিষ্ট ছিল যে কথা বললে মনে হত যে বাঙলার চেয়ে মিষ্টি ভাষা এই পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। আমরা শুধু দিদির কথা শোনার জন্যেই মুখিয়ে থাকতাম।
দাদা দিদি বিয়ের পর সংসার পেতেছিলেন একটি ছোট্ট বাড়িতে। সেখানে যেতে আসতে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হত। প্রায়ই দেখতাম দাদা-দিদি হেঁটে হেঁটে গল্প করতে আসছেন। দুজনেই খুব আস্তে কথা বলছেন, মুখে মৃদু কিন্তু মিষ্টি হাসি। নিজেদের মধ্যে মগ্ন; কোনও দিকে কোনও খেয়াল নেই। হঠাৎ খুব সামনে এলে চোখাচোখি হত, দু-জনেই প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠতেন, কেমন আছিস রে, একদিন আয় না আমাদের বাড়ি, বন্ধুদের নিয়ে। সেই ছবিটা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। আমার কাছে সেটাই ছিল চরম রোমান্স।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে একদিন কলেজে গেলাম; কলকাতায়। জীবনে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করলাম। ইচ্ছে মত যেখানে খুশি যেতে পারি, সিনেমা দেখতে পারি; কারও অনুমতির দরকার নেই। আঃ সে কি আনন্দ। সেই সময়েই মুক্তি পেয়েছিল সপ্তপদী। দেখতে গেলাম একদিন। মুগ্ধ হয়ে দেখছি; হঠাৎ এল সেই দৃশ্য; উত্তম কুমার স্কুটারে, পেছনে সুচিত্রা সেন আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে সেই অমর গান, - এ পথ যদি না শেষ হয়। এবার আমি সম্মোহিত। মনে হল এর থেকে গভীর রোমান্স আর হতেই পারে না। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম যে পড়াশোনা শেষ করে চাকরীতে ঢুকে একখানা স্কুটার কিনে ফেলব; তারপর প্রেমিকাকে পেছনে বসিয়ে ...। প্রেমিকা? তাই তো! পাব কোথায়? মনকে আশ্বাস দিলাম যে একদিন কেউ না কেউ নিশ্চয়ই চোখ তুলে তাকাবে আমার দিকে।
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। কেউ তখনও চোখ তুলে তাকায়নি। মুক্তি পেল আরেকটি ছবি, - শঙ্খবেলা। উত্তম কুমার ও মাধবী মুখোপাধ্যায়। সেখানেও রোমান্টিকতায় ভরপুর একটি গান, মান্না দে আর লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে, - কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম চেয়ে দেখেছি, কিছুতেই পাইনা ভেবে কে কখন ভাল বেসেছি, তুমি না আমি? উফ, - সারা রাত ঘুমোতে পারিনিঠিক করে ফেললাম এই গানটা মুখস্থ করতেই হবে। তারপর একদিন প্রেমিকার আবির্ভাব হলেই ---!
পড়াশোনা শেষ হল একদিন। চাকরীতে ঢুকলাম। ছোট্ট শহর। তবে কোম্পানি খুব উদার ছিল। থাকার জন্য বাড়ি পেলাম। কয়েক বছর পর সুলভে কার-লোনও মঞ্জুর হল। কিনে ফেললাম এক খানা ১৩ বছরের পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড। কিন্তু তখনও কেউ চোখ তুলে চাইল না। একদিন মা-বাবা জানালেন যে তাঁরা এক পুত্রবধু পছন্দ করে রেখেছেন, এখন আমি রাজি হলেই দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলা হবে। প্রেমিকার আশা ছেড়ে রাজি হয়ে গেলাম। শুভদৃষ্টি হল। সেটা আমার জীবনের একটি বিশেষ মূহুর্ত; কারণ আমার জীবনে সেই প্রথম কোনও মেয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। সেই প্রথম ও সেই শেষ!
নববধুকে নিয়ে এলাম কর্মস্থলে। এক পড়ন্ত বিকেলে গাড়িতে বসিয়ে রওনা দিলাম শহরের বাইরে। শহরের আশে পাশে চা-বাগান; সবুজ গালিচার মত। মাঝে মাঝে কৃষ্ণচুড়ার গাছে ফুল ফুটেছে। খুউব রোমান্টিক পরিবেশ। ইচ্ছে হল প্রথম যৌবনের ইচ্ছেটা পূর্ণ করে ফেলা যাক। স্কুটার নেই তো কি হয়েছে, গাড়ি তো আছে, হোক না পুরনো। আর নববধুকে প্রেমিকা ভেবে নিতে তো কোনও অসুবিধে নেই। সাহস করে বলে ফেললাম, - দেখো তুমি তো ভাল গান জানো, আমি কিন্তু পুরো বেসুরো। তবে আমার খুব পুরনো একটা আকাঙ্খা আছে। আমি ‘এ পথ যদি না শেষ হয়’ গানটা গাইব, আর তুমি জায়গা মত ‘না না তুমি বল, তুমি বল’ বলে যাবে, ঠিক আছে? নববধুকে একটু বিভ্রান্ত দেখালো, - জায়গা মত? মানে?
আরে সপ্তপদী দেখেছো তো? ঠিক সে ভাবে!
সপ্তপদী তো আমি দেখিনি।
কি!!! সপ্তপদী দেখোনি!!!!
না, আমি তখন খুব ছোট ছিলাম; মা দেখতে দেয়নি!!
অলমিতি।

কলকাতা ১৯শে মার্চ ২০১৪

No comments:

Post a Comment