আধুলি উঠে
যাচ্ছে, খবরে পড়লাম। তাতে ভারতীয় অর্থনীতির ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না, হলফ করে বলতে
পারি। তবে প্রবীণ প্রজন্মের মনে একটু কষ্ট তো হবেই। আসলে আমাদের
ছোটবেলার স্মৃতি জড়িত অনেক কিছুই তো ধীরে
ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। টেলিগ্রাম আর নেই। মানি অর্ডার কি বস্তু আজকালকার কলেজ
পড়ুয়ারা জানে কি না সন্দেহ। স্লাইড-রুলের জায়গা বোধহয় জাদুঘরে।
এর আগে এক পয়সা, দু-পয়সা,
সিকি লুপ্ত হয়ে গেছে। সিকি-শব্দটা যদিও এখনও বেঁচে আছে; যেমন সিকি ভাগ সম্পত্তির
মালিক, - ইত্যাদি। আধুলি শব্দটার তো আর কোনও ব্যবহার নেই। আধুলি ভাগ সম্পত্তি বলে কিছু
হয় না। তার মানে ধীরে ধীরে আধুলি শব্দটাই বিদায় নেবে আমাদের ভাষা থেকে।
আমি ছোটবেলায় ফুটো পয়সা
দেখেছি। একটা ছোট্ট তামাটে চাক্তির মাঝে ছোট্ট একটি ফুটো। মার ব্যাগে ছিল। কোনও
দিন সেটা দিয়ে মা’কে কিছু কিনতে দেখিনি। আর এও মনে আছে, দেউলে বোঝাতে গেলে বলা হত,
- পকেটে ফুটো পয়সা। মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটাই সবচেয়ে কম দামী মুদ্রা কি না। মা
বলেছিলেন আধ পয়সারও মুদ্রা না কি ছিল, আধলা। আমি দেখিনি।
ছোটবেলায় মুদ্রা পরিচিতি
হয়েছিল পয়সা, এক-আনা দু-আনার মাধ্যমে। এক পয়সা, এক-আনা, দু-আনা, সিকি (৪ আনা) ও
আধুলি (আট আনা)। ৪ পয়সায় ১ আনা, আর ১৬ আনায় ১ টাকা; অর্থাৎ ৬৪ পয়সায় ১ টাকা। ১৯৫৭
সালে আমি যখন স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে, তখন ভারত সরকার মুদ্রা সংস্কার করলেন। রাতারাতি চালু
হয়ে গেল ‘নয়া পয়সা’, দশমিক পদ্ধতিতে। পুরনো মুদ্রাও বজায় রইল। নতুন
মুদ্রা ব্যবস্থায় আনা’র কোনও ঠাঁই হল না। রইল শুধু টাকা আর নয়া পয়সা; ১০০ নয়া পয়সায়
১ টাকা, - দশমিক পদ্ধতি। এও জানলাম যে যথাসময় আনা এবং পয়সাকে বিদায় দেওয়া হবে এবং
নয়া পয়সাই পয়সা নামে পরিচিতি পাবে। তাই হয়েছে।
১৯৫৭ সালে কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। দুটি
মুদ্রা-ব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক কিছু ফরমুলা
চালু করলেন। ১ আনা অর্থাৎ ৪ পয়সার মূল্য ধার্য হল ৬ নয়া পয়সা; ২ আনা (৮ পয়সা) হল
১২ নয়া পয়সা। কিন্তু ৩ আনা (১২ পয়সা) হয়ে গেল ১৯ নয়া পয়সা, ১৮ নয়া পয়সা নয়। তার মানে
৪ আনা দাঁড়াল ২৫ নয়া পয়সা। সে এক বিরাট বিভ্রান্তি। আমরা বেশ মজা পেয়ে গেলাম।
মাস্টার মশাইদের নানা প্রশ্ন করে উত্যক্ত করতে শুরু করলাম। যেমন ধরুন, চার আনার
ঘুগনি যদি একবারে কিনি, খরচ হবে ২৫ নয়া পয়সা। কিন্তু যদি এক আনা, এক আনা করে কিনি,
তবে খরচ হবে ২৪ নয়া পয়সা। তার মানে ১ নয়া পয়সা সাশ্রয় হবে। অর্থাৎ যে বেশি কিনছে
তার কাছ থেকে বেশি পয়সা নেওয়া হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর
মাস্টার মশাইদের কাছে ছিল না, তাঁরা খুব বিব্রত হতেন।
প্রসঙ্গ ক্রমে জানিয়ে রাখি যে এক আনার ঘুগনি কিন্তু
খেয়েছি আমরা। ওই একরত্তি মুদ্রার যথেষ্ট ক্রয় ক্ষমতা ছিল বাজারে।
১৯৬৪ সালে পুরনো মুদ্রা অর্থাৎ পয়সা, আনা ইত্যাদি
বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। কিছু পয়সা, আনা, দু-আনা, চার আনা,
আট আনা আমি সরিয়ে রেখেছিলাম। ভবিষ্যতে লোককে দেখাব বলে। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে এত
ঠিকানা পরিবর্তন হয়েছে যে আমার সেই সংগ্রহ কখন এবং কোথায় হারিয়ে গেছে টেরও পাইনি।
এক নয়া পয়সা ছিল চকচকে
তামার ছোট একটি মুদ্রা। বেশ ভাল দেখতে। অঢেল পাওয়া যেত বাজারে। আজকাল যে খুচরো
সনস্যা আমরা প্রত্যক্ষ্য করছি তা সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। হঠাৎ একদিন বাজারে রটে গেল
যে একটি এক নয়া পয়সার মুদ্রা তৈরি করতে নাকি দু-নয়া পয়সা খরচা হয়। বাস, রাতারাতি
এক নয়া পয়সা বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল। ধান্দাবাজ লোকের তো অভাব নেই আমাদের দেশে।
যাই হোক, বিদায় আধুলি। জীবন
চলবে তার নিজের গতিতে। আধুলি না থাকলেও কিছুই আটকাবে না। তবে ভবিষ্যতে যদি কেউ
জিজ্ঞেস করে, - দাদু, ব্যাঙের আধুলি মানে কি? তবে কি করে বোঝাব?
কোলকাতা, ১৮ মার্চ ২০১৪
No comments:
Post a Comment