সকালে এক কাপ গরম চায়ের সঙ্গে খবর কাগজের প্রথম পাতায়
হেড লাইন পড়াটা জীবনের নির্মল আনন্দের অন্যতম। ছোটবেলায় এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিলাম।
থাকতাম আসামের এক শিল্প নগরীতে, গৌহাটি বা কোলকাতা থেকে বিমানযোগে কাগজ এসে পৌঁছোত বিকেল বেলা। বাবা অফিস
থেকে এসে কাগজ খুলে বসতেন। আমি বন্ধুদের সঙ্গে খেলা ধুলো সেরে সন্ধ্যেবেলা কাগজের মুখ দেখতাম। অবশ্যই প্রথমে
খেলার পাতা, বিশেষ করে ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে তো কথাই নেই। টিভির টাটকা খবর তো আর
পেতাম না তখনকার দিনে, আগের দিনের খেলার খবর পরের দিন সন্ধ্যেয় পেতাম।
বছরে অন্ততঃ একবার ছুটিতে কলকাতায় আসতাম। তখনই প্রথম উপলব্ধি করি সকাল বেলার
টাটকা খবরের মাহাত্ম্য। সাইকেলের পেছনে কাগজ চাপিয়ে কাগজয়ালা ভাইরা এক একটা বাড়ির
সামনে এসে মুহূর্তের মধ্যে একটি কাগজ সরু দড়ি দিয়ে বেঁধে অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুড়ে
দিতেন একতলা, দোতলা, তেতলা এমন কি চারতলা বাড়ির বারান্দায়। কোনও দিনই লক্ষ্যভ্রষ্ট
হতে দেখিনি। ভোরবেলা বারান্দায় খুট করে একটা শব্দ হত। আমি বিছানা ছেড়ে ছুটতাম কাগজ
আনতে। দড়ি খুলতে খুলতে প্রথম পাতার হেডলাইনে চোখ পড়ত। সেই থেকেই এই নেশা। কাগজটা
কিন্তু বেশিক্ষণ হাতে রাখা যেত না। পৌঁছে দিতে হত বাড়ির কর্তাদের কাছে। তারপর বড়
কর্তা, মেজ কর্তা, বড়দা, মেজদার হাত ঘুরে আমাদের হাতে কাগজ পৌঁছোত বেশ বেলার দিকে।
এখন আমিই কর্তা। অন্ততঃ আমার তো তাই ধারণা। কাগজ সকালে আমার হাতেই আসে। তবে
প্রথম পাতার হেডলাইন? না; সেটা এক স্মৃতি মাত্র। প্রথম পাতা এমন কি দ্বিতীয় পাতায়
থাকে মেগা বিজ্ঞাপন, - ‘শহরের উপকন্ঠে সুলভ আবাসন, সঙ্গে সুইমিং পুল, ক্লাব, সুপার
মার্কেট, প্রস্তাবিত মেট্রো থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে’ ... অথবা ‘খাঁটি হীরের গয়নায়
৩০% ছাড়’ ...... ইত্যাদি ইত্যাদি। হেডলাইনে পৌঁছোতে দুবার কখনও বা তিন বার পাতা ওল্টাতে
হয়। হয়তো অনেকের কাছেই এটা খুব সামান্য ব্যাপার কিন্তু আমার খুব বিরক্তিকর মনে হয়।
মেনে নিয়েছি। বাজার অর্থনীতির যুগ চলছে আর বিজ্ঞাপন তো সেই অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ!
আধুনিক অর্থনীতির পৃষ্ঠোপোষক এক বন্ধুকে আমার হতাশার কথা ব্যক্ত করতেই বন্ধুটি
প্রায় আমাকে ধমকেই ওঠেন, - ‘আরে ঐ বিজ্ঞাপনের জন্যই তো কাগজটা এত সস্তায় পাচ্ছিস।
নইলে দৈনিক কাগজ কিনতে কিনতে ফতুর হয়ে যেতিস’। বন্ধুটি ভবিষ্যতের কিছু অতিরিক্ত
সম্ভাবনার কথাও আমাকে জানান মহা উৎসাহে। শুনে আমি আঁতকে উঠি। একদিন নাকি আমরা
সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ফোন করতে পারব এমন কি এসটিডি এবং আইএসডি কলও ফ্রি হয়ে যাবে।
কি করে? না বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি আমাদের কল স্পনসর করবে। ‘মানে’? ‘খুব সোজা,
তুই তোর ছেলেকে ফোন করলি, ফোনে রিং না হয়ে একটা বিজ্ঞাপন বার্তা শোনানো হবে। তারপর
কথাবর্তার মাঝে মাঝে থাকবে বিজ্ঞাপন বিরতি’। শুনে তো আমার চক্ষু চরক গাছ। বলে কি?
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হয়তো কোনও গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি, হঠাৎ শুনব ঝিন
চ্যাক মিউজিকের সঙ্গে উচ্চ কন্ঠে, - ‘এ দিল মাঙ্গে মোর...’। কি ভয়ানক! ভয়ে ভয়ে
জিজ্ঞেস করলাম ‘আচ্ছা আমার কি বিজ্ঞাপন না শুনে ফোন করার স্বাধীনতা থাকবে? মানে
আমি পয়সা দিয়ে ফোন করব, বিজ্ঞাপন শুনব না’। বন্ধুটি বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে
বললেন, ‘ছাড়; তোকে বোঝানো আমার কম্ম নয়। নে চা খা’।
বিজ্ঞাপনের কত রকমফের। আমাদের ছোটবেলায় বৈদ্যুতিন মাধ্যম বলে কিছু ছিল না। এমন
কি এই বৈদ্যুতিন শব্দটারই কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সব বিজ্ঞাপন বেরোতো খবরের কাগজে,
সাময়িক পত্রে কিংবা পোস্টারে। আমার সমসাময়িক বন্ধুদের নিশ্চয়ই মনে আছে, - ‘সুখী
গৃহকোণ, শোভের গ্রামাফোন’ বা ‘আমার সৌন্দর্যের রহস্য লাক্স’, সঙ্গে কোনও সুন্দরী
চিত্রতারকার ছবি বা ‘দুলালের তাল মিছরি’ ইত্যাদি। আমাদের কিন্তু একটা স্বাধীনতা
ছিল, আমরা বিজ্ঞাপনের দিকে না তাকিয়ে কাগজের পাতা ওল্টাতে পারতাম। রাস্তায় হাঁটতে
হাঁটতে পোস্টারের দিকে না তাকানোর পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের ছিল। কিন্তু এখন? কোনও
উপায় নেই। টিভি দেখলে আমাকে বিজ্ঞাপন দেখতেই হবে, বিজ্ঞাপন না দেখে টিভির অনুষ্ঠান
দেখার উপায় নেই। আমার সমব্যথী এক বন্ধু জানালেন যে হিসেব করে দেখেছেন একটা আধ
ঘন্টার সিরিয়ালে অন্ততঃ পনের মিনিট বাণিজ্যিক বিরতি থাকে। আমি অবশ্য যাচাই করে
দেখিনি।
আজকাল আবার এক নতুন ধরণের বিজ্ঞাপন পদ্ধতি চালু হয়েছে। ফোন করে কোনও মধুভাষিণী
তরুণী বা সব্যসাচী-কন্ঠ যুবক জানাবেন, - স্যর আমাদের একটা নতুন প্রডাক্ট লঞ্চ
হয়েছে। ৫ বছরে ৯% রিটার্ন এবং সম্পূর্ণ করমুক্ত। কিংবা মোবাইলের নতুন স্কীম, সব
লোকাল কল ফ্রী, বাইরের কলে ৩% ডিসকাউন্ট। এই বিজ্ঞাপন পদ্ধতির একটা নতুন নামও
হয়েছে, - টেলিমার্কেটিং। সাধারণতঃ দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর মানুষ যখন বিশ্রাম করে
তখন এঁদের ফোন আসে। আমি প্রথম দিকে খুব রেগে যেতাম। পরে শুনলাম এঁরা না কি সব কল
সেন্টারের কর্মী, এঁদের কোটা থাকে যে এতগুলো ফোন করতেই হবে। নেহাৎ চাকরীর দায়ে ফোন
করতে হয়, মাঝে মাঝে লোকের কটুক্তিও শুনতে হয়। আমার আরেক বন্ধু দুপুরে ফোন সাইলেন্ট
করে ঘুমোন। ঘুম থেকে উঠে দেখে নেন ক’টা মিসড কল আছে। আমিও তাই শুরু করেছিলাম। এক
দিন আমার বৃদ্ধ কাকা ফোন করেছিলেন, কাকীমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, খবরটা আমাকে
জানাতে চাইছিলেন। জানাতে পারেন নি, কারণ আমার ফোন সাইলেন্ট ছিল। এই বয়সে কারও
সাহায্য না পেয়ে প্রচুর ঝক্কি পোয়াতে হয়েছিল কাকাকে। সেই শুনে এখন আর ফোন সাইলেন্ট
মোডে রাখি না।
কিছুদিন আগে আমার এক ফেসবুক বন্ধু আমাকে এক ঘটনার কথা জানান। ঘটনাটি কাল্পনিক
কি না জানিনা। তবে পড়ে বেশ মজা পেয়েছিলাম।
একটি মেয়ে প্রত্যেক দিন এক প্রবীণ ভদ্রলোককে ফোন করে উত্যক্ত করে। ইন্টারনেটের
নতুন প্রযুক্তি ফোর-জী’র একটা ডেমো দিতে
চায় মেয়েটি। ভদ্রলোক জানান ‘আমার ইন্টারনেট সংযোগ আছে এবং আমি তাতে খুবই সন্তুষ্ট’।
মেয়েটি নাছোড়বান্দা। রোজ ফোন করে, - ‘তাও একবার দেখুন না। আপনার বাড়ির ঠিকানাটা
একবার দিন, আপনাকে নিতে হবে না, শুধু একবার দেখুন না প্লীজ। প্লীজ প্লীজ প্লীজ’।
ভদ্রলোক খুবই সজ্জন ব্যক্তি, মেয়েটিকে মুখের ওপর কিছু বলতে পারেন না।
একদিন মেয়েটি ফোন করলে ভদ্রলোক খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘বেটি তুমি রোজ ফোন
কর, তোমাকে আমার বেশ ভাল লেগেছে। তোমার নাম কি বেটি’? মেয়েটি খুব খুশি, বরফ গলেছে,
- জানায় তার নাম হেমা। ‘তুমি কি বিবাহিতা’? – ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন। না, মেয়েটি
হাসে। ‘ও খুব ভাল, আসলে আমার একটি ছেলে আছে, খুব ভাল চাকরি করে, আমি ভাবছিলাম
তোমাকে আমার পুত্রবধু করব’। মেয়েটি আবার হেসে বলে ‘আঙ্কেল সরি আমি একজনের বাগদত্তা’।
‘তাতে কি হয়েছে মা, একবার দেখো আমার ছেলেকে, তোমাকে কোনও কথা দিতে হবে না। তোমার
ঠিকানাটা দাও, আমি বরং তোমার মা বাবার সঙ্গে একটু কথা বলি’। মেয়েটি এবার একটু
রেগেই যায়, ‘দেখুন আঙ্কেল, আই এম নট ইন্টারেস্টেড’। একটু থেমে ভদ্রলোক বলেন, ‘এই
কথাটাই তো তোমাকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বলছি বেটী, তুমি তো শুনতেই চাইছ না’?
এর পর মেয়েটি না কি আর ফোন করে নি।
সিদ্ধার্থ
দেব
কলকাতা
৭ই ফেব্রুয়ারী ২০১৪
No comments:
Post a Comment