Sunday 24 April 2016

তোমারে সেলাম

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বা বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি তখন উত্তাল। অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনে তোলপাড় পুরো ক্যাম্পাস। কি কারণে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটা এতদিন পর আর মনে করতে পারছি না। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল এক দিন। প্রশাসন থেকে ঘোষণা করা হল, University will be closed sine die. এক নতুন শব্দগোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হলাম। মানে ও উচ্চারণ নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ালো।
আমি আর আমার কয়েক জন বন্ধু তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়িমুখো হলাম। এমন উপরি ছুটি, - ছেড়ে দেওয়া যায় না। মা-বাবাকে সন্তুষ্ট রাখতে কিছু বই খাতাও নেওয়া হল সঙ্গে। কিন্তু বিধি বাম; সপ্তাহ দুয়েক পর চিঠি চলে এল, ক্যাম্পাস খুলছে, ছাত্র ছাত্রীরা যেন পত্রপাঠ ফিরে আসে। আজ এত বছর পর ভাবতে খুবই অবাক লাগে, কি পরিমান প্রশাসনিক সংগঠন থাকলে এভাবে প্রত্যেকটি ছাত্র ছাত্রীকে আলাদা ভাবে চিঠি দেওয়া যায়।
মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। মা-বাবারা অবশ্য খুশি হলেন খুব। হবেনই তো। ছেলে মেয়ের পড়াশোনায় ব্যাঘাত কোনও মা বাবার কাছেই কাম্য নয়।
নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছলাম ক্যাম্পাসে। ক্লাস শুরু হল। কিন্তু শান্তি এল না। আবার স্ট্রাইক, ক্লাস বয়কট, ভুখ হরতাল। আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে উপাচার্য ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাস জুড়ে শুরু হল উৎসব। বাজি পুড়ল, ফেস্টুন উড়ল। কিন্তু অনিশ্চয়তা থেকেই গেল।
বি এইচ ইউ একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সব প্রান্ত থেকে এমন কি বিদেশেরও প্রচুর ছাত্র ছাত্রী পড়তে আসে এখানে। এই অস্থিরতার সংবাদ পৌঁছে গেল দেশের কোনায় কোনায় এবং সংবাদ মাধ্যমে। অবশ্য সংবাদ মাধ্যম বলতে তো সেকালে শুধু খবরের কাগজ ও আকাশবাণী। প্রত্যেক হস্টেলের কমন রুমে একটি করে রেডিও থাকত। খুব ভীড় হতে শুরু করল সংবাদ পাঠের সময়। আমাদের হস্টেলের রেডিওটি ছিল আবার এক বিশেষ মেজাজের। চুপচাপ থাকতেই ভালবাসত বেশি। অন করে দু-গালে দুটি চড় মারলে তবে মুখ খুলত।
একদিন সন্ধ্যায় কমন রুম থেকে শোনা গেল এল বিপুল হর্ষধ্বনি। যারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আড্ডা মারছিলাম, ছুটে গেলাম সেদিকে। আনন্দের কারণটা বুঝলাম। এইমাত্র ঘোষণা করা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার নতুন উপাচার্য নিযুক্ত করেছেন। শীঘ্রই কার্যভার গ্রহণ করতে আসছেন ডঃ ত্রিগুণা সেন।
ক’দিন ধরেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে কেন্দ্রীয় সরকার নানা নাম বিবেচনা করছেন। ছাত্রদের মধ্যে সব চেয়ে গ্রহণযোগ্য নাম ছিল ডঃ ত্রিগুণা সেন। দক্ষ প্রশাসক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি তখনই দেশবিখ্যাত।
তবে কিছু প্রবীণ অধ্যাপক ও প্রশাসনের চাঁইদের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ চোখে পড়ল না। অনেকে তো গোপনে বলেই ফেললেন, - ইয়ে বনারস হ্যায় ভাই, যাদবপুর নহী।
নির্ধারিত দিনে ডঃ সেনের ট্রেন এসে পৌঁছল বারাণসী স্টেশনে। রেজিস্ট্রার ও প্রশাসনের অন্যান্য কর্তারা দুধ সাদা অ্যাম্বেসেডর নিয়ে পৌঁছলেন কিন্তু স্টেশনে ঢুকতে পারলেন না। স্টেশন চত্বরে তখন শুধু কালো কালো মাথা। কয়েক শ’ ছাত্র এসেছে উপাচার্যকে অভ্যর্থনা জানাতে। ছাত্র নেতাদের কয়েকজন হাত জোড় করে দাঁড়াল ডঃ সেনের সামনে। কি কথা হল জানিনা, আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম একটু দূরে। কোথা থেকে একটা খোলা জীপ জোগার করা হয়েছিল। সেখানেই বসানো হল নতুন উপাচার্যকে। পেছনে কয়েক শ সাইকেলের মিছিল। প্রশাসনের চাঁইরা কাছেই ঘেসতে পারলেন না।
ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে থামল মিছিল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য মদন মোহন মালব্যর মূর্তির সামনে উপাচার্য নামলেন। মুখে স্মিত হাসি। কোনও উৎকন্ঠা বা নার্ভাসনেসের নামগন্ধ নেই। একটা বেদীর ওপরে উঠে একটি ছোট্ট ভাষণ দিলেন, - সবার সহযোগিতা কামনা করলেন। ওনাকে সসম্মানে পৌঁছে দেওয়া হল ওনার আবাসনে।
তারপর যা হল সেটা এক স্বপ্নের মত। বা বলা যেতে পারে ম্যাজিক। বিশদ বিবরণে যাব না, আর সব কথা মনেও নেই। মাঝে মাঝেই শোনা যেত আজ ভিসিকে দেখা গেছে কোনও হস্টেলে ছাত্রদের সঙ্গে চা খাচ্ছেন। কখনও বা খেলার মাঠে। আমাদের কলেজে এসে ছাত্রদের সম্বোধিত করলেন একদিন, ছাত্র ও অধ্যাপকদের ভিড়ে উপচে পড়ল অ্যাসেম্বলি হল। আমাদের বার্ষিক মডেলস একজিবিশনেও এলেন এক দিন; নিজে ইঞ্জিনীয়ার, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন সব কিছু। মাস খানেকের মধ্যে ক্যাম্পাসে আশ্রমের শান্তি। নিয়মিত ক্লাস শুরু হল। আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেল। সবাই বেশ খুশি। অধ্যাপকদেরও গাম্ভীর্যের ফাক দিয়ে বেরিয়ে এক পরম পরিতৃপ্তির হাসি। কি করে সেটা সম্ভব হয়েছিল, তা আজও জানিনা।
বেশি দিন ছিলেন না ডঃ সেন। কয়েক মাস পর, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ডেকে পাঠালেন উপাচার্যকে। শিক্ষা দফতরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। ইউনিভার্সিটিতে শোকের ছায়া। ছাত্ররা ঘেরাও করল ডঃ সেনের বাড়ি, - আপকো জানে নহী দেঙ্গে। আবার মুখে সেই স্মিত হাসি, আবার সস্নেহে বোঝালেন ছাত্র নেতাদের। একটি দৃশ্য এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিতে। ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে মারকুটে ছাত্র নেতারা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে ডঃ সেনের সামনে, চোখে জল, বলছে, হমে ছোড়কে মত যাইয়ে আপ।
নির্দিষ্ট দিনে স্টেশনের দিকে রওনা হল গাড়ি আর সাইকেলের কনভয়। এবার মিছিলে সামিল হলেন প্রশাসক ও অধ্যাপকেরাও। কিছু ছাত্র রাস্তায় শুয়ে রইল, মিছিল এগোতে দেবেনা। সেটা অবশ্য একটা প্রতীকি প্রতিবাদ ছিল। কিছুক্ষণ পর কনভয় রওনা হল স্টেশনের দিকে। সেই খোলা জীপ, পেছনে কয়েকটি গাড়ি ও অজস্র সাইকেল।
সসম্মানে বিদায়ী ভাইস চ্যান্সেলরকে দিল্লিগামী ট্রেনে তুলে দেওয়া হল।
কোন ম্যাজিকে ডঃ সেন অশান্ত ক্যাম্পাসে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, - সেটা আজও এক রহস্য।
দেশের আর কোনও ভাইস চ্যান্সেলরের এই কৃতিত্ব আছে কিনা আমার জানা নেই।
নিউ জার্সি ২৩ শে এপ্রিল ২০১৬

No comments:

Post a Comment