Tuesday 12 April 2016

দশানন


ক’দিন ধরে একটু রাবণ চর্চ্চায় জড়িয়ে পড়েছি। সূত্রপাত কয়েক মাস আগে। বৈবাহিক সম্পর্কে এক নিকট আত্মীয়র ছেলের বিয়ে হল। বউটি বেশ, সদ্য ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা শেষ করেছে, খুব মিশুকে। আজকালকার মেয়ে, সেকালের বউদের মত দামী শাড়ি, একগাদা গয়না পরে, ঘোমটা দিয়ে ঘুরে বেরায় না। ঘরোয়া পোষাকে বেশ দাপিয়ে বেড়ায় বাড়ির ভেতরে।

আমার থেকে বয়সের তফাৎ প্রায় অর্দ্ধ শতাব্দীর। কিন্তু খুব ভাব হয়ে গেল আমার সঙ্গে। ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু করে দিল। একদিন সকালে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, - পিসেমশাই, তোমার দাঁত মাজতে কতক্ষণ লাগে। আমি বললাম, ঠিক জানিনা রে, তবে মিনিট পাঁচেক লাগে নিশ্চয়ই।

হুম্ম্ম্ , তার মনে রাবণের কতক্ষণ লাগত?

আমি কিছু না ভেবেই বললাম, - দশটা মাথা যখন, অন্ততঃ পঞ্চাশ মিনিট লাগত তো নিশ্চয়ই।

হল না। ফেল্‌। কুড়িটা হাত না? ডান হাতগুলোতে ব্রাশ নিয়ে একসঙ্গে মাজত। ঐ পাঁচ মিনিটই লাগত।

বুঝলাম দাদাগিরির গুগলি জাতীয় প্রশ্ন ছিল, আমি ধরতে পারিনি। সেই ছোটবেলার ডিম সেন্ধর গল্পের মত। ১টা ডিম সেদ্ধ হতে যদি ৫ মিনিট লাগে, ১০টা ডিম সেদ্ধ হতে কত সময় লাগবে?

ঠকে গেলাম এক পুঁচকে মেয়ের কাছে।

এর ক’দিন পর একটা হোয়াটসঅ্যাপ এল। এক বন্ধু একটি প্রশ্ন পাঠিয়েছে। ওষুধের পাতায় ১০ টা ক’রে ওষুধ থাকে কেন? কেন ৭টা বা ১২টা নয়। উত্তরটা নীচে দেওয়া ছিল; স্ক্রল করে দেখতে হবে। তাই করলাম। গিয়ে দেখি, রাবণের একবার মাথা ধরেছিল, সেই থেকে এই প্রথা চলে আসছে। দুচ্ছাই, - মেজাজটা খিঁচড়ে গেল।

ক’দিন পর আবার এক হোয়াটসঅ্যাপ! এক উত্তর প্রদেশী বন্ধুর কাছ থেকে। রাবণ মহাবীর ছিলেন কিন্তু শ্রীরামচন্দ্রজীর কাছে পরাস্ত হন। কেন? আবার সেই স্ক্রল করে উত্তর, - রাবণের ভাই রাবণকে ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু রামের ভাই সর্বক্ষণ পাশে ছিল। ভ্রাতৃপ্রেমের মহিমা।

এই রাবণ-চর্চায় জর্জরিত অবস্থায় হঠাৎ একটা গল্প মনে এল। সেই গল্পটাই বলতে চাইছি।

লঙ্কাকান্ড ঘটে গেছে সেই কোন যুগে! সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। রাম সেই কবে ফিরে গেছেন বৈকুন্ঠে। রাবণও সব পাপস্খলনের পর এখন স্বর্গবাসী। রামের সঙ্গে এখন খুব সদ্ভাব, প্রায়ই এক সঙ্গে আড্ডা মারেন দু-জনে। রাম, সাক্ষাৎ বিষ্ণু, - খুব স্নেহের চোখে দেখেন রাবণকে। মাঝে মাঝে এক সঙ্গে পুষ্পকে চড়ে বেড়াতে যান এদিন সেদিক।

একদিন, শ্রীরাম জিজ্ঞেস করলেন, কি ভায়া, কলকাতা দেখেছো, কখনও? চল ঘুরে আসি এবার। পূজোর সময় যাব। খুব হৈ চৈ হয় সেই সময়ে।
- পূজোর সময়?
- হ্যাঁ। আর জান তো, এই পূজো আমিই শুরু করেছিলাম। মা দূর্গাকে অকালে, অবেলায় ঘুম থেকে তুলে... হতচ্ছারা বাঙালিগুলো বলে এটা নাকি ওদের পূজো…
- হ্যাঁ জানি জানি, কেন পূজো করেছিলেন তাও আমি জানি, - অভিমানী মুখ করলেন রাবণ
- আহা, সে তো অনেক পুরনো কথা, সেসব কথা মনে রেখ না ভায়া, সব চুকে বুকে গেছে। চল ঘুরে আসবে। ভাল লাগবে খুব খাওয়া দাওয়া হয়, খুব সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো হয় পুরো শহর…
- না আমি যাব না। আমি জানি ঐ শেষ দিনে আমার একটা অদ্ভূতুরে পুতুল বানিয়ে সেটাকে জ্বালানো হয়…
- আহা, বড় ছেলেমানুষী করছ। তোমাকে তো আর সরাসরি জ্বালায়  না। ঠিক আছে আমরা নয় তার আগেই ফিরে আসব। নবমীর দিন যাই চল, সেদিন অনেক জায়গায় মাংস খাওয়া হয়
- তাই? এবার রাক্ষস রাজের চোখ চকচক করে উঠল

তাই ঠিক হল। অবশেষে মহানবমীর দিন ভোর রাতে রাম আর রাবণ এসে পৌঁছলেন কলকাতা শহরে। ভোর রাত তখনও আলো জ্বলছে সব প্যান্ডেলে। চোখ জুড়িয়ে গেল রাবণের।

সারাদিন ঘোরা হল প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। দিনের শেষে দুজনেই খুব ক্লান্ত। ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। কোথাও গিয়ে কিছু খেলে হত। শ্রীরামচন্দ্রের মাথায় একটা আইডিয়া এল। পূজোর সময় বড় বড় রেস্তোরাঁয় খুব ভাল বাঙালি ভোজন থাকে। সেখানেই যাওয়া যাক।

বেশ তাই হোক। - রাজি হলেন রাবণ

মধ্য কলকাতার এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁ সামনে এসে পৌঁছলন দু-জনে। অবশ্যই মন্ত্রবলে। রাম গটগট করে ভেতরে ঢুকলেন। পেছনে রাবণ। ভেতরে কাউন্টারের সামনে এক বেশ সুন্দরমত দিদিমণি। রাম কিছু জিজ্ঞেস করলেন। হেসে মিষ্টি করে উত্তর দিলেন দিদিনণি। রাম হেসে মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। রাবণের মুখ চূণ। বিরস মুখে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

পরের দিন বিষ্ণুলোকে বিশ্রামরত রাম। মুখে তৃপ্তির হাসি। নারদকে বলছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। বিশেষ করে বাঙালি ভোজনের তো উচ্চ প্রশংসা। সে কি রাজকীয় আয়োজন। নারকোল কুচি দিয়ে ছোলার ডাল, আলু পোস্ত, মোচা ঘন্ট, ধোকার ডালনা, পার্শে মাছ ভাজা, চিতল মুইঠ্যা, সর্ষে ইলিশ, কসা মাংস, লুচি, পোলাও, চাটনি, মিষ্টি দই, কড়াপাকের সন্দেশ আর মিষ্টি পান। আঃ অপূর্ব। রাবণটা যে কেন চলে গেল কে জানে?

- খুব দাম নিশ্চয়ই, - নারদ জিজ্ঞাসা করলেন।
- এমন খুব একটা বেশি নয়, ৭০০ টাকা মোটে। অত খাবার একটু দাম তো হবেই। আর কত বিখ্যাত রেস্তোরাঁ, - সেটা দেখবি তো!
- তা ঠিক, - স্বীকার করলেন নারদ।

বিষ্ণুলোক থেকে বেরিয়ে নারদ গেলেন রাবণের প্রাসাদে। রাবণের মন মেজাজ ভাল নেই। গম্ভীর মুখে বসে আছেন। নারদকে দেখে মুখ ব্যাজার করলেন।

- কি ভাই, কাল আপনি না খেয়ে চলে এলেন? প্রভু তো খুব তৃপ্তি করে খেয়েছেন।
- হ্যাঁ, প্রভু তো তৃপ্তি করে খাবেনই। ওনার আবার কি?
- কেন? কি ব্যাপার? আপনি খেলেন না কেন?
- ভীষন এক্সপেনসিভ, - মানে খুব দাম … মুখ ভেটকে বললেন রাবণ
- সে কি প্রভু যে বললেন খুব সস্তা
- সে তোমার প্রভুর জন্য সস্তা হতে পারে। আমার জন্য নয়… এবার বেশ রেগেই গেলেন রাবণ
- সে কি? আপনি তো প্রচুর সোনাদানার মালিক!
- আরে ছাড় তো তোমার সোনাদানা...
- একটু বুঝিয়ে বলবেন?
- বুঝিয়ে বলার কি আছে? তোমার প্রভু রেস্তোরাঁর এক দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করলেন কত দাম পড়বে।
- তো?
- দিদিমণি বলল ৭০০ টাকা পার হেড। আমি শুনেই পালিয়ে এসেছি।

*******
জার্সি সিটি – ১১ই এপ্রিল ২০১৬


No comments:

Post a Comment