গৃহস্থালীর কাজ আমার একেবারেই
আসেনা। এটা আমার একটি
বিরাট অক্ষমতা। আমার বেশ কিছু
বন্ধু বান্ধব আছেন যাঁরা রান্নাবান্না জানেন, ঘরদোর পরিস্কার রাখেন, এক
কালে ছেলেমেয়েদের সামলেছেন, আর এখন নাতি-নাত্নীদের সামলান। তাঁরা নমস্য ব্যক্তি।
তবে চেষ্টা আমি করেছি। বুকে
হাত দিয়ে বলতে পারি। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে যখন চাকরি নিয়ে বিদেশে যাই, তখন “কাজের
লোক”-এর অভাবটা খুব বুঝতে পেরেছিলাম। গিন্নীর ওপর তখন প্রচন্ড চাপ। বাচ্চারা
খুব ছোট। আমি অফিসে চলে যেতাম, গিন্নীকে একহাতে সব সামলাতে হত। বড়টি তখন স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ওকে তৈরি করা, খাওয়ানো ইত্যাদি বাড়তি কাজ
তো আছেই। সেই সময় আমি খুব আন্তরিক ভাবে বাড়ির কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু নেহাৎই দুর্ভাগ্য, দিন তিনেক পর আদেশ জারি হল যে আমি আর যাই করি না
কেন, হেঁসেলে যেন না ঢুকি। কারণ আমি নাকি সেখানে কাজের থেকে অকাজটাই বেশি করি। কি
আর আর করা, সেই আদেশ, শাপে বর ভেবে শিরধার্য করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা।
ঘরদোর পরিষ্কার ইত্যাদির ব্যাপারে অবশ্য বিশেষ কোনও অভিযোগ ছিল না।
তবে ছুটির দিনে মাঝে মাঝে
ছেলেমেয়েদের বিনোদনের জন্যেই ঘোষণা করতাম, আজ বাবা ব্রেকফাস্ট বানাবে; ইংলিশ ব্রেকফাস্ট!
ছেলেমেয়েরা প্রচন্ড হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানাত। কারণ বাবা বেশ
“হেল্প” করার সুযোগ দেয়। মা দেয় না। মহা সমারোহে শুরু হত ব্রেকফাস্ট প্রকল্প। সবার
ভাগে দুটো করে ডিম, - কারও ফ্রাই, কারও অমলেট, কারও হাফ বয়েল, ইত্যাদি। ছেলে তখন
খুবই ছোট, ব্যপারটা ঠিক বুঝত না, কিন্তু বেশ মজার একটা ঘটনা ঘটছে সেটা বুঝতে পারত।
দিদির সঙ্গে সঙ্গে লাফাত খুব। তারপর টেবিল ম্যাট, প্লেট, কাটা, চামচ, ছুরি সাজিয়ে,
গ্লাসের ভেতর ভাঁজ করে ন্যাপকিন, সামনে পাউঁরুটি টোস্ট, বিভিন্ন জ্যাম, জেলি,
মাখন। সঙ্গে বেকড বীন্স, সসেজ, কাচের জাগে অরেঞ্জ জুস ইত্যাদি। এলাহী কান্ড। এরপর মেয়ের সুউচ্চ ঘোষণা, ব্রেকফাস্ট রেডিইইইইইই।।
সবাই হৈহৈ করে বসা হত। শুধু একজনই একটু অসন্তুষ্ট! কারণ এরপরেই নাকি হেঁসেল পরিষ্কারের পালা। আমি
হলফ করে বলতে পারি যে খুব সযত্নে রান্নাঘর সাফ করা সত্ত্বেও গিন্নীমাকে খুশি করা
যেতনা। যাই হোক, দেখতে দেখতে আমার এই অপারগতা ছড়িয়ে গেল স্থানীয় বাঙালি সমাজে। এক সঙ্গে আড্ডাতে বসলেই শুরু
হত,
জানো তো আমার বরের কান্ড…… কি নোংরা করে
রাখে কল্পনা করতে পারবে না। প্রথম
ক’দিন
একটু আত্মগ্লানিতে ভুগতাম, - তারপর খেয়াল করলাম এই সংগ্রামে আমি একা নই, প্রচুর সমব্যথী
আছেন। কারণ আমার কেলেঙ্কারীর
গল্প শেষ হতে হতেই অন্য কোনও মহিলার গল্প শুরু হত, আরে আমার কর্তা কি করেছে জানো
তো ………
দেখলাম এ যাকে বলে, “ঘর ঘর কি কহানী”। এসব
গায়ে না মাখাই উচিৎ।
তখন সুদূর বিদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট
টিভি গিয়ে পৌঁছয়নি। ছেলেমেয়েরা
খুবই ছোট; পড়াশোনার চাপ বিশেষ নেই। সন্ধ্যায়
বা ছুটির দিনে সকালে, এর ওর বাড়ি গিয়ে আড্ডা মারার একটা রেওয়াজ ছিল। “প্রবাসে বাঙালি মাত্রেই সজ্জন”। প্রায়ই যে বাড়িতে আড্ডা বসত সেখানে
খাওয়া দাওয়া করেই আসা হত। বাড়িতে যা আছে
তাই দিয়ে বেশ পরিতৃপ্তি করে খেয়ে চলত দীর্ঘ্য আড্ডা। কখনও বা বসিয়ে দেওয়া হত স্রেফ সেদ্ধ ভাত। বেশ কাটছিল দিনগুলো।
একদিন সপ্তাহান্তের ছুটির দিন। বেশ একটা অলস সকাল। গিন্নী জানালেন, - বাজার হাটের
দরকার নেই। বাড়িতে তরি, তরকারি, মাছ ইত্যাদি
যথেষ্ট মজুদ আছে। কারও বাড়ি গিয়ে
আড্ডা মারা যেতে পারে। সমবয়সী এক দম্পতির
সঙ্গে সম্প্রতি বেশ ভাল ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ফোন করতেই তাঁরা সাদরে আমন্ত্রন জানালেন। কিন্তু আমি আবার কি খেয়ালে সকালেই “বাবা ব্রেকফাস্ট
বানাবে” ঘোষণা করে বসে আছি।
সব মিটিয়ে নতুন বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতে
বেশ দেরিই হয়ে গেল। সাদরে বৈঠকখানায়
বসিয়ে বন্ধুপত্নী একটু মৃদু অনুযোগ করলেন দেরি করে পৌঁছনোর জন্য। ব্যাস, গল্প শুরু, - আর বল কেন? সকালে উঠে বাপ
আর ছেলেমেয়েরা মিলে লঙ্কাকান্ড; সব গুছিয়ে, পরিষ্কার করে আসতে আসতে দেরিই হয়ে গেল। বলে পুরো ঘটনা, সবিস্তারে বর্ণনা
করা হল। কিন্তু তারপর
যা ঘটল তা সম্পূর্ণ অভাবিত।
বন্ধুপত্নী
সব শুনে অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। চোখেমুখে
ভর্ৎসনার ছাপ স্পষ্ট, বেশ কঠিন স্বরে জানালেন - এটা কিন্তু খুব অন্যায়; বিদেশ-বিভূইঁয়ে
সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হয়। এখানে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে
না। তারপর আমার গিন্নীর দিকে তাকিয়ে সমবেদনার সুরে বললেন, - আমার বর কিন্তু ও’রম
না, ও যা হেল্প করে আমাকে,- বলে সপ্রেম দৃষ্টিতে পাশে উপবিষ্ট স্বামীর দিকে
তাকালেন। স্বামীটিও নববধুর মত সুমিষ্ট হেসে প্রেমমদির চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে
আমার প্রতি এক অনুকম্পার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।
আমার
ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। নাঃ, এর একটা হেস্তনেস্ত আজ করতেই হবে। গিন্নীর দিকে একটু
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। সারা মুখ থমথমে, কালবৈশাখীর পূর্বাভাস।
হঠাৎ
যেন তাল কেটে গেল। আড্ডাও আর যেন এগোচ্ছে না। গিন্নী চুপ মেরে গেছেন। বন্ধু ও
বন্ধুপত্নী নানা রকম কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু জমছে না। কোথায় যেন একটু
ছন্দপতন হয়ে গেছে।
মিনিট
পনেরো পর, গিন্নী হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, একটু ফ্যাকাশে হেসে বললেন - আজ চলি ভাই, একটু
বাজারে যেতে হবে।
সে
কি? বেশ অবাক হলেন নতুন বান্ধবী, এই তো
এলে? খাওয়া দাওয়া করে যাও......
না
ভাই, আরেক দিন হবেখ’ন, - বলে আমার দিকে স্পষ্ট ইশারা, - এবার উঠে পড়।
কি
আর করা? কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। ছেলেমেয়েদের ডাকলাম। ওরাও দেখলাম ঘোর বিস্মিত,- সবে খেলা জমে উঠেছে, এই অবস্থায়
বেরিয়ে আসাটা ওদের একেবারেই মনঃপূত হয়নি। ওদের তীব্র প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে এবং তথাকথিত
বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর বিভ্রান্ত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে এলাম।
গাড়িতে
উঠে স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথেই বিস্ফোরণ, - কি বলল শুনলে? ন্যাকামোর একটা সীমা আছে
...... (একটু ভেঙিয়ে) ... আমার বর ও’রম না! যাঃ যাঃ, তোর বর কেমন জানা আছে।
মেনিমুখো কোথাকার... আরে পুরুষ মানুষ হবে পুরুষ মানুষের মত ... তা না... শুধু শুধু
বউয়ের আঁচল ধরে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করা... এই ধরণের পুরুষ আমার দু চক্ষের বিষ।
শাড়ি পরে থাকলেই পারে...
বাক্যস্রোত
আর শেষ হয়না। বেগতিক দেখে নিয়ে গেলাম বেশ একটা নামী রেস্তোঁরায়। সেখানে গিয়ে লাঞ্চ
টাঞ্চ খেয়ে মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হল। ছেলেমেয়েরাও মহা খুশি।
আমি আর সাহস করে রাগের
কারণটা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। কারণ মহিলাটি যা বলেছিলেন তাই তো আকছার শুনতে হত
আমায়। ব্যাপারটা রহস্যই ছিল বেশ কিছুদিন। অবশ্য পরে
এক আত্মীয়া খুব প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন; বলেছিলেন, - ওসব তোরা বুঝবি না, যা
মোটা মাথা তোদের! ব্যাপারটা খুব সিম্পল, আমার বরকে আমি যা খুশি তাই
বলতে পারি, এটা আমার রাইট। কিন্তু অন্য কেউ বলে দেখুক তো, জিভ উপড়ে নেব।
স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম!
“কিছুটা কাল্পনিক”
নিউ জার্সি ২৮শে এপ্রিল ২০১৬
No comments:
Post a Comment