চিকিৎসকের উপদেশ এবং পরিবারের সদস্যদের উপরোধ এড়াতে পারিনি। অনেকটা বাধ্য হয়েই মর্নিং ওয়াক অভ্যাস করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। অসহ্য লাগত প্রথম দিকে। ভোরের দিকের ঘুম বড় মধুর, বিশেষ করে শীত কালে লেপের উষ্ণতার তো তুলনা হয় না। সেই আরাম ছেড়ে কাকভোরে হাঁটতে যাওয়ার কোনও মানে হয়? কিন্তু স্বাস্থ্যের খাতিরে যেতেই হত। অসহ্য লাগত প্রথম দিকে। তবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছিলাম।
আমার নিবাস দক্ষিন কলকাতা, “লেক” অর্থাৎ রবীন্দ্র সরোবর
থেকে পাঁচ সাত মিনিটের হাঁটা পথ। তবে সে পথ বড় দুর্গম, বিশেষ করে ভোর বেলা। ফুটপাথে
সারি সারি নিদ্রিত পথবাসী; ছোট ছোট মশারি, এক প্রান্ত বাঁধা বন্ধ দোকানের তালায়, অন্য প্রান্ত ল্যাম্প পোস্টে বা টানা রিকশার হাতলে। এখানে সেখানে বকলস বাঁধা অভিজাত সারমেয়কুলের প্রাতঃকৃত্যের
নমুনা। রোল ব্যাপারীদের রাস্তায় ফেলে যাওয়া অজস্র ডিমের খোসা। এই সব বাঁধা পেরিয়ে পথ
চলা এক বিরক্তিকর ব্যাপার।
তবে একবার লেকে পৌঁছোতে পারলে শরীর ও মন বেশ চনমনে হয়ে ওঠে। শ’য়ে শ’য়ে লোক হাঁটছে। নারী, পুরুষ, কিশোর, কিশোরী, যুবা বৃদ্ধ সবাই। আর জায়গাটা মোটামুটি দূষণ মুক্ত, বেশ ভালই লাগে। সত্যি
কথা বলতে কি, চুপ করে এক কোনায় বসে হাঁটুরেদের কান্ডকারখানা দেখেও
বেশ সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কেউ একা হাঁটেন – গম্ভীর মুখে, কেউ বা আবার এক একটি
দলে। যারা দল বেঁধে হাঁটেন তারা আবার আড্ডা মারেন হাঁটতে হাঁটতে। নানা টপিক নানা
বিষয় বস্তু। ধরুন একটা বাঙালী দল, পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল আর কানে এল কয়েকটি
খুচরো সংলাপ, “ হ্যাঁ ধোনি খুব ভাল করছে, কিন্তু টিমটা কিন্তু সৌরভই তৈরি করেছিল
...”। আরেকটি দল, এঁরা আদতে দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের বাসিন্দা; শুনতে পাবেন,
“সিমেন্টকা ভাও অচানক বহুত বাড় গয়া, ... ”। নবীন প্রজন্মের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে
অনেকে দৌড়োন বা যাকে বলে জগিং করেন; পরনে ট্র্যাক স্যুট, পায়ে নাইকি বা আডিডাস,
কানে ইয়ার ফোন।
তবে সবাই যে হাঁটেন বা দৌড়োন তা কিন্তু নয়। অনেকে ধ্যান
করেন পদ্মাসনে বসে, কেউ আবার চারিদিকের কোলাহল সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে, উদাত্ত কন্ঠে
আবৃত্তি করেন সংস্কৃত স্তোত্র; বেশ লাগে শুনতে। অনেকে বাবা রামদেবের মত চোখ বন্ধ
করে সজোরে শ্বাস নেন অথবা এক নাসারন্ধ্রে নিশ্বাস নিয়ে অন্য নাসারন্ধ্র দিয়ে
ছাড়েন। আবার বেশ কয়েকজন প্রবীন প্রবীনা আছেন, যাঁরা দল বেঁধে আসেন, ধীরে সুস্থে
গল্প করতে করতে। লেকের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি সিমেন্টের বাঁধানো আসন
আছে, তার একটিতে এসে বসেন এবং ঘন্টা খানেক চুটিয়ে আড্ডা মারেন তারপর আবার গল্প
করতে করতে ফিরে যান। দেখে মনে হয় এঁরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হয় তো বা প্রতিবেশীও।
প্রথম দিন যখন লেকে ঢুকি, সমবেত কন্ঠের এক বিরাট অট্টহাসির
আওয়াজে বুক কেঁপে উঠেছিল। লেকের একটি কোনায় একটা ঘেরা জায়গায় লাফিং ক্লাবের
মেম্বাররা তাঁদের দৈনন্দিন কর্মসূচী পালন করছিলেন। তাঁদের দলে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক
সদস্য, নানা বয়সের। পুরুষের সংখ্যাই বেশি, মহিলা খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রায়
ঘন্টা খানেক ধরে এঁরা পুরো শরীর কাঁপিয়ে অট্টহাসি হাসেন। পাশ দিয়ে একটা মেঠো পথ,
সেখান দিয়ে সকাল বেলা কিছু গৃহ কর্মচারিনী যাওয়া আসা করেন। এঁরা ভোর বেলা রাজ্যের
দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আসেন ট্রেনে চেপে। স্টেশনে নেমে হাঁটেন কর্মস্থলের দিকে। পরনে
আধ ময়লা শাড়ী, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, হাঁটেন খুব দ্রুত। দেরী হলে আবার গিন্নীমারা বকাবকি
করবেন। লাফিং ক্লাবের পাশ দিয়ে যাবার সময় এঁরা বাবুদের কান্ডকারখানা দেখে হেসে
কুটিপাটি হন। সমবেত কন্ঠের সেই খিলখিলে হাসি মাঝে মাঝে বাবুদের অট্টহাসিকে ছাপিয়ে
ওঠে। এক দিন লাফিং ক্লাবের এক বাবু একটু বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই হাসছিস কেন
রে?”
সামনে দিয়ে যাচ্ছিল একটি অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মেয়ে, বেশ
হাজির জবাব, গলা তুলে উত্তর দিল, “আমরা তো তোমাদের কান্ড কারখানা দেখে হাসতেছি
বাবুরা, কিন্তু তোমরা যে বিনি কারণে হাসতিছো ...।
এক ভদ্রলোক, বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি, একা আসেন, ধীর
গতিতে। পরনে অত্যাধুনিক ‘শর্টস’ – অনেক গুলো পকেট ওয়ালা, পায়ে বেশ দামী স্পোর্টস
শু বা স্নিকার, রঙিন টি-শার্ট, মাথায় কায়দার টুপি, কিন্তু অত্যন্ত ব্যাজার মুখ,
দেখে মনে হয়, জোর করে বাড়ির লোকেরা হাঁটতে পাঠিয়েছে। ভদ্রলোক কারও সঙ্গে কথা বলেন
না, এবং কেউ আলাপ করার চেষ্টা করলে মুখ ঘুরিয়ে নেন। লেকের এক কোনায় বসে চুপচাপ
খবরের কাগজ পড়েন; মিনিট চল্লিশেক পর আবার
ধীর গতিতে বেরিয়ে যান। এক দিন ওনার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল এক চায়ের দোকানে। গোল
পার্কের এক কোনায় একটি পুলিস ব্যারাক আছে, পাশে স্টেট ব্যাংকের একটি শাখা। সামনের
ফুটপাথে সারি সারি চায়ের স্টল। আমি হেঁটে ফেরার পথে সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুরিতে
চা খাই। এলাচ সহ গরম গরম সেই চা বড়ই সুঃস্বাদু। এক দিন দেখি পাশের স্টলেই সেই ব্যাজার মুখো ভদ্রলোক; আমাকে দেখেই খবরের কাগজে
মুখ ঢেকে ফেললেন। আমিও পেছন ফিরে ওনার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চায়ে মন
দিলাম। কিছুক্ষণ পর শুনলাম ভদ্রলোক খুব নীচু গলায় বলছেন, “ডিম গুলো টাটকা তো?” –
“হ্যাঁ স্যার, কাল রাতেই কিনেছি, পোল্ট্রি থেকে” – “দেখি একটা ওমলেট বানাও তো ভাল
করে। ভাল তেল আছে তো?” – “হ্যাঁ স্যার” চা ওয়ালা একটা নামী কোম্পানির বোতল দেখায় –
“ঠিক আছে, বেশি তেল দিও না কিন্তু; আমার আবার একটু প্রেশার আছে। ও কি, একটা ডিম
দিচ্ছ না কি? একটা ডিমে কি ওমলেট হয়? দুটো দাও, নুন বেশি দিও না, বল্লুম না
প্রেশার আছে” – “ঠিক আছে স্যার, ...... আর কিছু?” – “টোস্ট দাও দুটো, মাখন আছে?” –
“হ্যাঁ স্যার আমুল” চা ওয়ালা একটা ছোট প্যাকেট তুলে দেখায়। “ঠিক আছে, সামান্য এ-এ-একটু
মাখিয়ে দাও আর ওপরে তোমার সেই মোটা দানা চিনি ছিটিয়ে দিও, সামান্য, আমার আবার
শুগারও আছে বুঝলে”।
ভদ্রলোককে প্রায়ই দেখি, হয় লেকের এক কোনায় বসে কাগজ পড়ছেন
কিংবা ঐ চায়ের স্টলে ব্রেকফাস্ট করছেন। কোনও দিন হাঁটতে দেখিনি।
নিউ জার্সি
৪ অগাস্ট ২০১৩
No comments:
Post a Comment