Saturday 11 February 2017

মডেলস একজিবিশন

প্রেমনাথ ভার্গব। আমরা ডাকতাম প্রেম। আমাদের সহপাঠী। মাঝারি হাইট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। একটু দোহারা। পড়াশোনায় খারাপ নয় তবে আহামরিও কিছু নয়। ক্লাসের ফাঁকে ও ছুটির দিনগুলোতে লাইব্রেরিতে বসে থাকত আর নানা রকম বই ও ম্যাগাজিন পড়ত। টেক্সট বুকে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।  পপুলার মেকানিক্স নামে একটি ম্যাগাজিন প্রেমের খুব প্রিয় ছিল। গোগ্রাসে গিলত সেটাকে। শুধু তাই নয়, - কিছু যদি পছন্দ হয়ে গেলে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত।

প্রত্যেক বছর জানুয়ারী মাসে আমাদের কলেজে মডেলস একজিবিশন হত। সে এক এলাহী ব্যাপার। বড় বড় দুটো হল জুড়ে নানা রকম মডেল, - উৎসাহী ছাত্রদের ভীড়। উদ্বোধন করতেন স্বয়ং প্রিন্সিপাল, সঙ্গে সব রাশভারী প্রফেসরেরা। তাঁদের ইম্প্রেস করতে ছাত্রদের মধ্যে বেশ একটা রেষারেষি। তৃতীয় দিনে আসতেন ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যান্য ভিআইপিরা। ঐ একই দিনে এক ঝাঁক পায়রার মত হাজির হত উইমেন্স কলেজের ছাত্রীরা; বেশ সেজেগুজেই আসত। যাক গে, সে এক অন্য কাহিনী।

আমাদের সময় ১১ বছরের হায়ার সেকেন্ডারির পর পাঁচ বছরের ইন্টিগ্রেটেড কোর্স ছিল। প্রথম দু-বছর র্যা গিং ট্যাগিং সামলে থার্ড ইয়ারে একটু ধাতস্থ হয়ে বসেছি। এমন সময় প্রেমের মাথায় ভূত চাপল। সে ক্ষেপে উঠল এবার আমাদেরও মডেল বানাতে হবে। কি বানাবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। এবার আমাদের শুধু সহযোগিতা করতে হবে। রাজি হতেই হল। এত উৎসাহ ওর; নিরাশ করতে মন চাইল না।

কোনও একটা টেকনিকাল ম্যাগাজিন থেকে আইডিয়াটা পেয়েছে প্রেমনাথ। মডেলের নাম – অটোমেটিক কয়েন সর্টিং মেশিন। একটা ছোট সাইজের ড্রাম বা সিলিন্ডার ঘিরে একটা একটা হেলিক্যাল-শেপড স্লাইড; তার ওপর বিভিন্ন সাইজের খাঁজ কাটা। সিলিন্ডারের ওপরে একটা ফানেল; সেই ফানেলে নানা সাইজের কয়েন ঢোকানো হবে। ভেতরে একটা মোটর বসানো। সুইচ টিপে মোটর চালু করলে সিলিন্ডারে একটা কম্পন বা ভাইব্রেশন হবে। ফানেলের ভেতর রকমারি কয়েন ছেড়ে দিলে, ভাইব্রেশনে স্লাইড বেয়ে কয়েন গুলো নীচে নামবে ও খাঁজের মাপ অনুযায়ী নীচে নানা মাপের কৌটোতে জমা হবে। আহা মরি কিছু নয় কিন্তু আশ্চর্য, জিনিসটা বেশ কাজ করল। প্রেমকে বাহবা দিতেই হল। একবার কাজ শুরু করতেই সবারই উৎসাহ ছিল দেখার মত। সেই সময় একটা মান্ধাতা আমলের ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবিও তোলা হয়েছিল। কিন্ত অর্দ্ধ শতাব্দী পর সেই ছবি আর খুঁজে পাইনি। ছবিটা দিলে মোটামুটি বোঝানো যেত জিনিসটা কি।

একজিবিশনের প্রথম দিনই দেখা গেল, আমাদের স্টলের সামনে বেশ ভীড়। লোকে বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের মডেল দেখছে। বেশ একটু আশা হল; হয়তো একটা প্রাইজ পেয়েও যেতে পারি। ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড প্রাইজ ছাড়াও অনেক কনসোলেশন প্রাইজও ছিল।

কিন্তু সব চেয়ে বেশি ভীড় দেখলাম আমাদের এক বছরের সিনিয়র একটি গ্রুপের স্টলে। সেই গ্রুপের নেতা সুবোধ নিগম বলে একটি ছেলে। ওরা বানিয়েছে পোস্টকার্ড ডিস্পেনসিং মেশিন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় সেটি একটি অভূতপূর্ব উদ্ভাবন। মানতেই হল। এরা প্রাইজ পাবেই। অপূর্ব কাজ করছে সুবোধের মেশিন। সবাই মেশিনে পয়সা ঢুকিয়ে পোস্টকার্ড কিনছে। কিন্তু সুবোধের মুখ চোখ থমথমে। কেন বোঝা গেল না।

যথা সময় পুরস্কার ঘোষণা করলেন কর্তৃপক্ষ। আমাদের মডেল থার্ড প্রাইজ পেয়েছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাল্টিলেভেল ফ্লাইওভার পেয়েছে সেকেন্ড প্রাইজ। প্রচুর সান্ত্বনা পুরস্কার। আর যা ভেবেছিলাম আমরা সবাই, - সুবোধের মডেল ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। সুবোধের মুখ তখনো গম্ভীর, যেন কেঁদেই ফেলবে।

ব্যাপারটা বোঝা গেল পরের দিন।

সেই সময় পোস্টকার্ডের দাম ছিল পাঁচ পয়সা। সুবোধের মেশিনে পাঁচ পয়সার মাপের একটি খাঁজ বা স্লট কাটা ছিল। সেটাতে একটি মুদ্রা ঢোকালে, দু সেকেন্ডের মধ্যে একটা পোস্টকার্ড বেরিয়ে আসত। দিব্যি চলছিল। কাল হল একজিবিশন শুরু হওয়ার তিন দিন আগের একটি ঘোষণা। ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগ পোস্টকার্ডের দাম পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ছ-পয়সা করে দিলেন। বাধ্য হয়ে সুবোধদের গ্রুপকে একজিবিশনের আগের দিন পোস্ট অফিস থেকে ছ-পয়সা দামের পোস্টকার্ড কিনে আনতে হল। নিয়ম অনুযায়ী মেশিন চালু রাখতেই হয়েছিল। জনসাধারণ পাঁচ পয়সা দিয়ে ছ-পয়সার পোস্ট কার্ড নিয়ে চলে গেছে।

কলকাতা
১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭

No comments:

Post a Comment