Sunday 25 December 2016

ফ্লুরি’স

এবার ক্রিসমাস বা বড়দিন পড়েছে রবিবারে। বিভিন্ন রবিবাসরীয়তে বড়দিনের মাহাত্ম্য ও পরম্পরা নিয়ে নানা রকম লেখা খুব উৎসাহ নিয়ে পড়লাম। অনেক অজানা তথ্য সামনে এল। আর জানতে পারলাম রঙীন পার্ক স্ট্রীটের বর্ণময় ইতিহাস। পার্ক স্ট্রীটের বড়দিন উৎসব কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

আমার ছোটবেলা কেটেছে বাঙলার বাইরে। পার্ক স্ট্রীট নিয়ে কোনও বাল্যস্মৃতি আমার নেই। যা আছে তা কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণের। স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম কলেজে ভর্তি হতে। খুব সখ ছিল কলকাতায় কলেজে পড়ব। ভর্তি হলাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। কলেজের হস্টেলে জায়গা হলনা। নাম লেখালাম অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে। বিধান সরণি ও বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। এখনও আছে, - তবে নাম পালটে হয়েছে ওয়াই এম সি এ।

মোড়ের মাথয় ২বি বাসে উঠে নেমে যেতাম পার্ক স্ট্রীট – চৌরঙ্গী রোডের মোড়ে। ভাড়া ছিল ২০ পয়সা। দান্ডিযাত্রারত গান্ধিজি তখন সেখানেই অবস্থান করতেন। পরে পাতাল রেল প্রকল্পের জন্য সেখান থকে অপসারিত হন।

পার্ক স্ট্রীট দিয়ে কোনও বাস চলত না। মোড় থেকে হেঁটে কলেজে পৌঁছতে মিনিট দশেক লেগে যেত। প্রথম দিকে যখন হেঁটে যেতাম, হাঁ করে দেখতাম চারদিক। সে এক স্বপ্ন রাজ্য। ঝকঝকে দোকান পাট, হোটেল আর রেস্তোঁরা। যত দূর মনে আছে, আমাদের ক্লাস শুরু হত সকাল দশটা নাগাদ। সেই সময় দোকান পাট সবে খুলছে, ক্রেতার সংখ্যা খুব কম। তবে একটি রেস্তোঁরা গমগম করত। নাম ফ্লুরি’স। অবাক হয়ে ভাবতাম সকাল বেলায় এত ভীড় কেন? কলকাতাবাসী কিছু সহপাঠীর কল্যাণে জানলাম এখানকার ব্রেকফাস্ট নাকি বিখ্যাত। সারা ভারতের এমন কি বিদেশের লোকরাও নাকি সেখানে প্রাতঃরাশ করতে আসেন। কে আসেন নি সেখানে? বড় বড় চিত্রতারকা, সঙ্গীত শিল্পী, ক্রিকেটার- রাজ কপূর, দিলীপ কুমার, কিশোর কুমার, পাতৌদির নবাব, শর্মিলা ঠাকুর, জয়সীমা। হাঁ করে শুনতাম আর জুলজুল করে দেখতাম কাচের বাইরে থেকে ভেতরের দৃশ্য। একটা চাপা স্বপ্ন বোধহয় জেগেও উঠেছিল, - যে একদিন এখানে আমিও ব্রেকফাস্ট করব।

সেন্ট জেভিয়ার্সের পড়াশোনা শেষ হল। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। পার্ক স্ট্রীট ও ফ্লুরিসের স্মৃতি ম্লান হয়ে গেল ধীরে ধীরে। চাকরীও পেলাম একদিন; আবার বাঙলার বাইরে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় বোধহয় তখন। কলকাতায় এসেছি ছুটি কাটাতে। মা বাবা তখন কলকাতাবাসী। মুক্তি পেল সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য। শংকরের উপন্যাস পড়া ছিল আগেই। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলাম ছবিটি। একটি দৃশ্যে রবি ঘোষ, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এসেছেন ফ্লুরিসে। অর্ডার দিয়েছেন চিকেন অমলেট। পুরনো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মনে হল তাই তো এখানে তো আমার ব্রেকফাস্ট করার স্বপ্ন ছিল। না সেবারও সম্ভব হয়নি।

সুযোগ এল বহু বছর পর। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। ছেলে কলকাতায় এসেছে সবার সঙ্গে দেখা করতে। বিদেশে জন্ম ও মানুষ। একদিন জিজ্ঞেস করে বসল, বাবা এখানে নাকি ফ্লুরিস নামে একটা খুব ভাল রেস্তোঁরা আছে, - খুব ভাল ব্রাঞ্চ পাওয়া যায়? আমার কলকাতার বন্ধুরা বলেছে।

গেলাম অবশেষে। সপরিবারে। ঢুকলাম। চারিদিক দেখলাম ভাল করে। ভেতর থেকে এই প্রথম দর্শন। খেলাম সেই ব্রেকফাস্ট। বেশ ভালই। কিন্তু সেই থ্রীল বা সেই শিহরণ অনুভব করলাম না তো। এত দিনের স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি? আসলে কৈশোরের সেই মনটা হারিয়ে গেছে কবে টেরই পাইনি।

কলকাতা – বড়দিন ২০১৬

No comments:

Post a Comment