রমজানের মাস শুরু হল। এই পবিত্র মাসে বিশ্বের দেড়’শ কোটিরও বেশি নরনারী রোজা পালন করবেন। পশ্চিম এশিয়ার কুয়েতে ছিলাম বত্রিশ বছর। সেখানে সন্ধ্যের পর বেশ
একটা উৎসবের মেজাজ অনুভব করতাম। কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি আরবরা উচ্চারণ করেন রামাদান। এক বন্ধুকে কারণ জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, রমজান শব্দটি ফার্সী, রামাদান হল আরবী। এ ব্যাপারে অবশ্য আমার নিজস্ব কোনও জ্ঞান নেই। আরবী উচ্চারণ ও শব্দ প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন ওঁরা নামাজকে বলেন সালাত। আজানকে বলেন আদান। আর রোজা শব্দটিও ওঁদের ব্যবহার করতে শুনিনি
কখনও, ওঁরা বলেন সিয়াম।
কুয়েতে এবং প্রতিবেশী অন্যান্য দেশেও সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রকাশ্যে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও আইনতঃ দন্ডনীয়। সেই সময়টা সব রেস্তোরাঁ, কাফে এবং হোটেলের ডাইনিং হল বন্ধ থাকে। হোটেলের অতিথিদের জন্য রুম সার্ভিস চালু থাকে যদিও। কিন্তু সূর্যাস্তের পর, মাগরেব (সান্ধ্য নামাজ,
দিনের চতুর্থ) আজানের সঙ্গে সঙ্গে
রাস্তা ঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে যায় বেশ কিছুক্ষণের জন্য। যান বাহন, লোকজন যেন
হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। ইফতার (উপবাস ভঙ্গ) ও মাগরেব নামাজের কিছু পরেই পুরো দেশ একটা বিরাট উৎসবের চেহারা নেয়। সব দোকান পাট, রেস্তোরাঁ, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স খুলে যায় আর চালু থাকে গভীর রাত অব্দি। পার্কগুলোতে থাকে বাচ্চাদের বিনোদনের অঢেল ব্যবস্থা। কুয়েতীরা তাদের নিজস্ব পরম্পরা অনু্যায়ী প্রায় সারা রাত বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করে্ন, খাওয়া দাওয়া চলে আর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা।
কয়েক বার ইফতারের নিমন্ত্রন পেয়েছি। বেশীর ভাগ আমন্ত্রিতই সারা দিন রোজার পর উপবাস ভাঙতেন। আর আমি ও আমার মত মুষ্টিমেয় কয়েক জনের খাওয়া দাওয়া করে এসে ওঁদের সঙ্গে ইফতার করতে কেমন যেন অস্বস্তি হত। সবাই উপবাস ভাঙতেন দুটো খেজুর আর একটু জল খেয়ে। সারাদিন উপবাসের পর শরীরের শর্করার পরিমান কমে যায় আর ডিহাইড্রেশনেরও সম্ভাবনা থাকে, তাই খেজুর আর জল দিয়ে শুরু। খুবই বিজ্ঞান সম্মত। তারপর দেখতাম স্যুপ জাতীয় কিছু একটা খেয়ে নামাজ পড়তে যেতেন সবাই মিলে। তারপর একটা হলঘরে (ওঁরা বলেন দিওয়ানিয়া) বসা হত সারি সারি। সামনে নানা রকম ভোজ্য বস্তু; কাবাব, শওয়ারমা (আরবী স্যান্ডউইচ), ফাতায়ার (বাইরে আটার প্রলেপ, ভেতরে মাংস বা চীজ বা ফেলাফিল), সাম্বুসা (আরবী সিঙাড়া; আকারে ছোট, ভেতরে চীজ, বা মাংস), জালেবিয়া (জিলিপি) ও নানা রকম ফল। একটু একটু করে খেতেন সবাই। সারাদিন উপবাসের পর আমি গোগ্রাসে খেতে দেখিনি কাউকে।
একবার আমার এক বন্ধু ও সহকর্মী আমাকে নিমন্ত্রন জানালেন রাত্রে খাওয়ার জন্য, বললেন রাত সাড়ে দশটা- এগারোটার মধ্যে চলে এসো। এত রাতে? আমি বেশ অবাক হই। হ্যাঁ, বন্ধুটি জানালেন– “এটা একটা মিড-নাইট ফীস্ট;
আমাদের একটা খুব পুরনো সংস্কৃতি। আমরা এটাকে বলি ‘গবকা’। এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে, সারা রাত আড্ডা মেরে একসঙ্গে সুহুর (সেহরিঃ- উপবাস শুরুর
আগে কিছু খাদ্য-পানীয় গ্রহণ। এটি
অবশ্য কর্তব্য) এবং ফজরের নামাজ সেরে যে যার বাড়ি চলে যাই।”
সময় মত পৌঁছে দেখি বিরাট আয়োজন। বাড়িটি বেশ বড়, সবাই মিলে থাকে। বাড়ির সামনে একটা বড় তাঁবু , তার ভেতরে সারি সারি বসার ব্যবস্থা; মাটিতে। মাঝখানে বসে আছেন বন্ধুর পিতা, পরিবারের কর্তা। সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে তাঁকে শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানিয়ে, একে একে বাকি সবাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আসন গ্রহণ করলাম। প্রথমে এল দুধ ছাড়া চা, ছোট্ট কাপে, এদের ভাষায় ‘ইস্তিকানা’। তারপর খুব উৎকৃষ্ট খেজুর, তারপর নানা রকম মিষ্টি, বাকলাভা, খুনাফা ইত্যাদি। গুগল করলেই এই সব লোভনীয় মিষ্টির পুরো বিবরণ পাওয়া যাবে। মধ্যরাতে নৈশ ভোজনের আহ্বান জানালেন বন্ধুর পিতা। তাবুর একধারে সারি সারি টেবিল, তার ওপর বিশাল বিশাল থালা। সেই থালা ঘিরে সবাই দাড়িঁয়ে একসঙ্গে খাওয়া হয়। বেশ একটা আন্তরিকতা অনুভব করা যায়। রাত দুটো নাগাদ বন্ধুর কাছে বিদায় নিলাম।
পরের দিনের অফিস কাছারি? কুয়েতী সমাজেই তার ব্যবস্থা করা আছে। আমাদের অফিসে কাজের সময় ছিল সকাল সাতটা থেকে বিকেল তিনটে। দৈনিক আট ঘন্টা, সপ্তাহে পাঁচ দিন, রবি থেকে বৃহস্পতি। শুক্র, শণি ছুটি। কিন্তু রামাদানের মাসে সরকারী নির্দেশেই কাজের সময় কমিয়ে সকাল ন’টা থেকে বিকেল তিনটে করে দেওয়া হয়। সবাই ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে কাজে আসেন।
কুয়েতে প্রথম বছর, মানে প্রথম রামাদানে আমাদের এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বাড়িতে বসে আছি এক সন্ধ্যায়। রামাদানের মাস অর্ধেক অতিবাহিত হয়ে গেছে। দরজায় হঠাৎ বেল; আর খুব কচিকাচাদের কোলাহলের আওয়াজ। দরজা খুলতেই এক পাল খুদে বাচ্চা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে আমাদের বসার ঘরে বিরাট হৈ চৈ জুড়ে দিল। এক দঙ্গল সোফাতে উঠে লাফাচ্ছে, কেউ পর্দা ধরে ঝুলছে, একজন আবার টিভি চালিয়ে দিয়েছে। আমাদের মেয়ের বয়স তখন চার, এ সব কান্ড কারখানা দেখে ভীষণ উত্তেজিত; কিছুক্ষণ পরে দেখি ওদের সঙ্গে সেও লাফাচ্ছে। ভাষা বোঝে না তো কি হয়েছে। আমি আর আমার স্ত্রী তো তখন সম্পূর্ণ দিশাহারা। কি করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কি খেয়াল হল। একটা চকোলেটের বাক্স ছিল বাড়িতে। সেটা খুলে ওদের সামনে ধরতেই সবাই ঝাপিয়ে পড়ে চকোলেট নিয়ে “শুকরান শুকরান” অর্থাৎ ধন্যবাদ দিতে দিতে মুহুর্তের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন অফিসে এক কুয়েতী সহকর্মীকে ব্যাপারটা জানাতেই সে তো হেসে কুটিপাটি, বলল, - “তোমার বাড়ি গিয়েছিল বুঝি? রামাদানের
মাঝখানে, পূর্ণিমার সন্ধ্যেবেলা বাচ্চারা বাড়ি বাড়ি যায়, আর আমরা ওদের চকোলেট,
বাদাম ইত্যাদি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাই। তাই
ওরা চকোলেট দেবার পরই চলে গেছে। এই সময় তুমি দেশের সব সুপার মার্কেটে দেখবে সব
ডাঁই করে চকোলেট আর বাদাম রাখা আছে, এই বাচ্চাদের জন্য। এটা আমাদের এক পুরনো সংস্কৃতি, একে আমরা বলি ‘গিরগিয়ান’।
প্রতি বছর এই দিনে বাচ্চাদের জন্য নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।”
এর পরের বছর থেকে আমরা তৈরি থাকতাম। তবে বছর পাঁচেক পর পাড়ার বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেল আর প্রতিবেশীরাও জেনে গেল আমরা হিন্দী অর্থাৎ ভারতীয়, আর ওরা আসত না।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে কুয়েতের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এসেছি। কিন্তু এই স্মৃতিগুলো “আমায়
যে পিছু ডাকে”। তাই এই একটু স্মৃতিচারণ।
যাঁরা এই পবিত্র মাসে রোজা পালন করছেন তাঁদের সবাইকে
জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
সিদ্ধার্থ দেব
নিউ জার্সি – ২৮ জুন ২০১৪
No comments:
Post a Comment