Saturday, 12 September 2020

প্রলাপ: নানা রঙের দিনগুলি

প্রলাপ: নানা রঙের দিনগুলি: নানা রঙের দিনগুলি বাবা আসামে চাকরি করতেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন থাকতেন কলকাতা ও তার আশেপাশে। তাই বছরে একবার কলকাতা...

একটি সুপাত্র

 একটি সুদর্শন যুবক। পেটানো, মেদহীন চেহারা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। কলেজ জীবনে খেলাধূলো করেছে প্রচুর। নানা বিষয়ে পড়াশোনা ও জ্ঞান। বাংলা, হিন্দী, ইংরিজি সব ভাষাতেই সচ্ছন্দ। বয়সটা ঠিক জানিনা। পঁচিশ থেকে এই একত্রিশ বত্রিশের মধ্যে। এই ছেলের কি কোনও পাত্রী জুটবেনা? বা একটি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী বান্ধবী?

আপনারা বলবেন নিশ্চয়ই জুটবে। কিন্তু জোটেনি। ছেলেটি কিন্তু বাংলার গর্ব। পেশায় একজন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝে পিস্টল বা রিভলভার ব্যবহার করে, কিন্তু আসল অস্ত্র হল মগজাস্ত্র।

প্রদোষ মিত্র। বা আমাদের সবার প্রিয় ফেলুদা। সব ভাল কিন্তু কেমন যেন প্রেমহীন জীবন। এত লোকের সঙ্গে আলাপ, কত মক্কেল, প্রচুর অনুরাগী, কিন্তু কোথাও কোনও নায়িকার দেখা পাওয়া গেলনা। কিন্তু ফেলুদার পূর্বসুরীদের দেখুন। কিরিটী রায়ের একটি সুন্দরী স্ত্রী ছিল, - কৃষ্ণা। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ তো আত্মপ্রকাশের কিছু পরেই অর্থমনর্থম রহস্য সমাধান করে সত্যবতীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ব্যোমকেশ বাবু অবশ্য বিশেষ ভাগ্যবান। এক চিরকুমার বন্ধু আজীবন বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সংসারের দেখশোনা করে জীবন কাটিয়ে দিলেন।

কত লোকের সঙ্গে আলাপ ফেলুদার। কত বড় বড় শিল্পপতি, আইনজীবি, বিশাল জমিদার। কারও বাড়িতেই একটি সুলক্ষণা পাত্রী পাওয়া গেলনা। শুধু নায়িকা কেন? ফেলুদার জীবনে কোনও মাসীমারও আবির্ভাব হয়নি। বেশির ভাগ মক্কেল হয় অবিবাহিত কিংবা বিপত্নীক। যাঁরা বিপত্নীক, তাদের সবারই পুত্র সন্তান। অবিবাহিতদের ভাইপো বা ভাগ্নে। আশ্চর্য! কি কপাল! এত মক্কেল, পুলিস অফিসারদের সঙ্গে আলাপ, কিন্তু কারও বাড়িতেই তোপসের একজন বৌদি পাওয়া গেলনা। এই যে সিধু জ্যাঠা? তাঁর পরিচিত একটি সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েও কি ছিলনা? লালমোহন বাবুও বা কেমন? সাহিত্যিক মানুষ, - এই ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর তো নিতেই পারতেন।

অনেকে হয়তো বলবেন, - বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে? শার্লক হোমসেরও তো বিয়ে হয়নি। সে না হোক, ওদের সঙ্গে আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি মেলেনা। অবশ্য শুধু ফেলুদা কেন? অনেক বাঙালি হিরোই অবিবাহিত থেকে গেছেন। যেমন জয়ন্ত-মাণিক, বিমল-কুমার, দীপক চ্যাটার্জি-রতন লাল ইত্যাদি। তার আগে শ্রী পাঁচকড়ি দে দেবেন্দ্র বিজয় ও অরিন্দম বাবুর কথা বলেছিলেন। কিন্তু এঁদের সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনা। সবাইকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়েই বলছি, এঁদের মধ্যে শ্রী প্রদোষ মিত্রই সবচেয়ে সুপাত্র হিসেবে গন্য হবেন। ফেলুদার সত্যিই একটা বিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল।

ফেলুদার অভিভাবক বেঁচে থাকলে সবাই মিলে দাবী জানাতাম, - ফেলুদার বিয়ে দিন। এখন তো আর তা সম্ভব নয়।

এই একটা বাসনা অপূর্ণই থেকে গেল।

কলকাতা ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

Tuesday, 23 July 2019

নানা রঙের দিনগুলি

নানা রঙের দিনগুলি

বাবা আসামে চাকরি করতেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন থাকতেন কলকাতা ও তার আশেপাশে। তাই বছরে একবার কলকাতায় আসা হতই। আমাদের স্কুল ছুটি হলে বাবাও ছুটি নিতেন, - হয় গরমে বা পূজোর সময়।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। আমার বছর দশেক বয়স। হাঁ করে কলকাতার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট দেখতাম।

সবসময়ের সাথী ছিল আমার মাস্তুতো ভাই। আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। কিন্তু ছোট হলে কি হবে, কলকাতার ছেলে যে। অনেক কিছু জানে। আমাকে অনেক কিছু শেখাতো, - “ঐ যে দেখছিস বাস, সব পাঞ্জাবী (শিখ) ড্রাইভার আর কনডাক্টার, ঐ বাসগুলো এমনি বাস। আর যেগুলো খুব নতুন আর ঝকমকে, সেগুলো স্টেট বাস। ড্রাইভার, কনডাক্টার সব বাঙালি।

কথাগুলো খুব খাঁটি। ডাঃ বিধান রায় তখন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। চালু করেছেন স্টেট ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন। আধুনিক বাস এল বাইরে থেকে। কর্মচারিরা বেশির ভাগ পূর্ব বাংলা থেকে আগত। দোতলা বাসে চড়ার খুব শখ ছিল। রাস্তায় বেরোলেই বাবাকে বলতাম, - দোতলা বাসে যাব। স্টেট বাসের গায়ে দরজার কাছে ইংরিজিতে লেখা থাকত, - Wait till the bus stops.  ঠিক নীচেই লেখা থাকত, - বাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এই নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হয়। অনেক বিদগ্ধ নাগরিক জানালেন যে বাংলা অনুবাদটি ভুল। আসলে লেখা উচিৎ, - বাস না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। অনেক তর্কাতর্কি লেখালেখির পর একজন জানালেন যে “বাস থামলে ওঠানামা করুন” লিখলে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকেনা। যাই হোক কর্তৃপক্ষ এসব তর্ক বিতর্কে কর্ণপাত করেন নি।

ট্রামে চড়ার আকর্ষণ ছিল খুব। বেশ ট্রেনের মত অথচ ট্রেন নয়। সামনের কামরা ছিল প্রথম শ্রেণী, গদি মোড়া আসন। পেছনেরটি দ্বিতীয় শ্রেণী, কাঠের আসন। ভাড়া কত ছিল জানিনা। আমি তো আর ভাড়া দিতাম না, বাবা দিতেন।

ট্যাক্সি ডাকলেই দাঁড়াতো। কখনও কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যাবনা বলতে দেখিনি। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বেশির ভাগ ছিলেন শিখ। শহরের পরিবহন অনেকটাই এঁরা নিয়ন্ত্রন করতেন।

১৯৬১ সালে স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় পড়তে আসি, সে কি আনন্দ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হই প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে। তখন ধীরে ধীরে স্কুলগুলোতে এগারো ক্লাস শুরু হচ্ছে। দশ ক্লাসের স্কুল ফাইনাল থেকে এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি। হায়ার সেকেন্ডারির পর বি-এ, বি-কম, বিএসসি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলের পড়াশোনা। যে সব স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি চালু হয়নি, তাদেরকে স্কুল ফাইনালের পর এক বছর প্রি-ইউনিভার্সিটি করতে হত।

সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হলেও হস্টেলে ঠাঁই হলনা। খোঁজ খবর করে এক জায়গার সন্ধান পাওয়া গেল। বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের মোড়ে অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে সীট খালি আছে। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হল। সেই বাড়ীটি এখনও আছে। তবে নাম পালটে গেছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রীটও আরও কয়েক বছর নাম পালটে বিধান সরণী হয়ে গিয়েছিল।

কলেজে যাবার জন্য মোড়ের মাথা থেকে ২বি বাস ধরতাম। চৌরঙ্গী রোড (তখনও জহরলাল নেহরু রোড হয়নি) আর পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে নেমে যেতাম। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর মুর্তি ছিল। মেট্রো রেলের কাজের সময় সেটি স্থানান্তরিত হয়। ভাড়া ছিল ২০ পয়সা। ক’দিন পর এক সহপাঠী জানালো যে আমি মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করছি। আমি যদি ২বি তে না এসে  ৮বি বাস ধরি, তবে পার্কস্ট্রীট আর সার্কুলার রোডের মোড়ে, মানে পার্কস্ট্রীটের অন্য প্রান্তে নামব। ভাড়া ১৫ পয়সা। আমার ৫ পয়সা বেঁচে যাবে। তার মানে সপ্তাহে, মানে ছ-দিনে ৩০ পয়সা। এক মাসে ১টাকা ২০ পয়সা। একটা সিনেমার টিকিট, তাও বেশ ভাল সীটে। দারুণ ব্যাপার।

কোনও নেশা ছিল না। তবে একটি বিলাসিতা রপ্ত করেছিলাম। শণিবার একটু আগে ছুটি হত। হস্টেলে ঢোকার মুখে একটা পান, বিড়ি সিগারেটের দোকান ছিল। তার কোনটারই আকর্ষণ আমার ছিলনা। তবে সেখানে বরফ ঠান্ডা কোকাকোলা পাওয়া যেত। একটি বোতলের দাম ২৫ পয়সা। হস্টেলে ঢোকার আগে এক বোতল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে, তারিয়ে তারিয়ে সেই ঠান্ডা পানীয় উপভোগ করতাম। সেই আনন্দ আর কোনও দিনও পাইনি।

রাত্রে দশটার সময় হস্টেলের লাইট নিবিয়ে দেওয়া হত। সকালে খুব ভাঙত কিছু বর্ষীয়ান কীর্তনিয়ার কল্যাণে। খোল করতাল নিয়ে সূর্যোদয়ের আগেই এঁরা বেরিয়ে পড়তেন রাস্তায়। উদাত্ত কন্ঠে গাইতেন, - রাধে রে গোবিন্দ রাধে, রাধে রে গোবিন্দ। সেই সুরের ঝংকার এখনও কানে লেগে আছে।

মাসে একটা সিনেমা দেখতাম। প্রত্যেকটি সিনেমা মুক্তি পেত কয়েকটি বিশেষ হলে। যেমন “রূপবাণী, অরুণা, ভারতী” বা “শ্রী, ইন্দিরা, প্রাচী” বা “মিনার, বিজলী, ছবিঘর”। বেশ ভীড় হত। ভাল সিনেমার রজত জয়ন্তী, সুবর্ণ জয়ন্তী সপ্তাহ ফলাও করে ছাপা হত খবরের কাগজে।
আইন শৃঙ্খলার সমস্যা বরাবরই ছিল। কিন্তু সেটা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না কখনও। একদিন হস্টেলের ঘরে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছি। হঠাৎ শুনলাম বাইরে প্রচুর সোরগোল, চিৎকার। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি দু-দলের মধ্যে প্রচন্ড মারামারি চলছে। সেকালে বোমাবাজি দেখিনি। সোডার বোতলই চলত বেশি। গন্ডগোল দেখলেই পান, সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়র দোকানদারেরা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেন। যাই হোক। মিনিট পনেরোর মধ্যে পুলিসের গাড়ি এসে পৌঁছল। লাফিয়ে নামল আধ ডজন কন্সস্টেবল, হাতে লাঠি, মাথায় লাল পাগড়ি। সঙ্গে এক সাদা উর্দি পরা অফিসার। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক শুনশান। যারা মারামারি করছিল তারা কর্পূরের মত উবে গেল। একজন কন্সস্টেবলকে দাঁড় করিয়ে ফিরে গেল পুলিসের গাড়ি। একটু পরে দেখি সেই একলা পুলিস সামনের এক ছোট্ট চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসেছেন। আমরা গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আলাপ জমালাম। জিজ্ঞেস করলাম, - আবার গোলমাল হলে আপনি একা কি করবেন? ভদ্রলোক হেসে বললেন, - আমি তো কিছু করব না। করবে তো এ; - বলে নিজের পাগড়ি দেখিয়ে দিলেন। এই পাগড়ি দেখলে কেউ কাছে আসার সাহস পাবে না। এমনি ছিল সেকালে পুলিসের দাপট। কিছুক্ষণ পরে পুলিস ভদ্রলোক পকেট থেকে ব্যাগ বের করে চায়ের দাম মেটালেন। দোকানদারও হাত পেতে পয়সা গুণে নিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই।

বেহালার পর্ণশ্রীতে থাকতেন আমার স্নেহশীলা বড়মাসী। বাড়ির জন্য মন কেমন করলে বাসে উঠে রওনা দিতাম। রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনে। তারাতলায় দেখতাম অজস্র কারখানা, সারি সারি। কখনও হাওড়া স্টেশনে উঠে চুুঁচুড়া, আমার মাতুলালয় ও জন্মস্থান। বর্দ্ধমানে কাকা থাকতেন, সেখানে যাওয়া হত মাঝে মাঝে।হাওড়ায় বা হাওড়া থেকে রেললাইনের দু-ধারে অজস্র কারখানা বা ইন্ডাস্ট্রি। পশ্চিম বঙ্গ তখন এক শিল্পোন্নত রাজ্য। ভাবতাম পড়াশোনা শেষ করে এখানে কোনও এক জায়গায় নিশ্চয়ই চাকরি পেয়ে যাব। সেটা আর সম্ভব হয়নি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যখন চাকরির খোঁজে রাস্তায় নামলাম, তখন সব কারখানা হয় বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার মুখে। সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে।

কলকাতা
২০ জুলাই ২০১৯

Saturday, 6 January 2018

ভ্রান্তিবিলাস – এ যুগে

আচ্ছা দু-জন মানুষের কি এক চেহারা হতে পারে? আমি যমজ ভাই বোনদের কথা বলছিনা। আমি বলছি দু’টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অনাত্মীয় মানুষের কথা। আমরা যে সব কাহিনী টিভিতে বা সিনেমায় দেখি, - এই যেমন, উত্তম কুমারের ঝিন্দের বন্দী বা দেব আনন্দের হম দোনো। অদ্ভূত ব্যাপার, তাই না? এ সব ঘটনা বাস্তব জীবনে কখনও ঘটে না বলেই সবার ধারণা। কিন্তু আমার জীবনে কিছু ঘটনা ঘটেছে যাতে আমার মনে হয় আমার মত চেহারার এক বা একাধিক লোক এই শহরেই আছে।

প্রথম থেকেই বলি।

আজ থেকে বছর ষাটেক আগের কথা। আমি তখন স্কুলে। বয়স ১০ বা ১২। আসামে থাকতাম। বাবার চাকরি ছিল সেখানেই। আমার ও আমার ছোট বোনের পূজোর ছুটি শুরু হলে বাবাও ছুটি নিতেন। আমরা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসতাম। এসে উঠতাম রাজাবাজারে আমার কাকার বাড়ি। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে বালিগঞ্জের ফার্ন রোডে আমার বড়ো পিসীমার বাড়ি। তারপর ক’দিন পর চুঁচুড়ায়, - আমার জন্মস্থান ও মাতুলালয়। সেখানে খুব ধুমধাম করে পূজো হত। পূজো শেষ হলে আবার কলকাতায়। আবার বড়ো পিসীমার বাড়ি, কাকার বাড়ি হয়ে ফেরত।

পিসীমার সহকারী ছিলেন হরিকাকা। হরিকাকা বহুদিন ধরে পিসীমার পরিবারে। তিনি সবার হরিকাকা। পিসেমশায়, আমার পিস্তুতো দাদা ও দিদি, আমার মা ও বাবা ও আমাদেরও তিনি হরিকাকা। তাঁর বয়স কেউ জানত না, একটু ন্যুব্জ, কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণকায় চেহারা। তাঁর তত্ত্বাবধানে আমার  বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। একদিন সকালে আমি হরিকাকার সঙ্গে বাজারে গেছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি, হরিকাকার শক্ত হাতে আমার হাত। এমন সময়, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোক, ফর্সা, লম্বা দোহারা চেহারা, পরনে ধবধবে ধুতি ও পাঞ্জাবী, আমায় দেখে একগাল হেসে বললেন ,- একি? তোমরা কলকাতায়? কবে এসেছো? মা, বাবা, বোন সবাই এসেছেন নিশ্চয়ই। আমি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির। অচেনা  লোক দেখে বাক্যিহারা হয়ে যাই, মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভদ্রলোকের আবার প্রশ্ন, - কেমন লাগছে কলকাতা? আমি মিনমিন করে বললাম, - ভাল লাগছে। এর পরের প্রশ্নে আমি একেবারে দিশাহারা। উনি জিজ্ঞেস করলেন, - দিল্লী থেকেও ভাল? দিল্লীতে আমার এক মাসী থাকতেন, সেখানে একবার যাওয়ার কথাবার্তা চলছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমি কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক আবার বললেন, - কি? দিল্লী ভাল না কলকাতা ভাল? আমি মিনমিন করে বললাম, - কলকাতা। ভদ্রলোক খুশি হয়ে থুতনি ধরে আদর করে চলে গেলেন। এর পর অবশ্য ওনার সঙ্গে দেখা হয়নি। উনি নিশ্চয়ই অন্য কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়েছিলেন।

পরবর্তী ঘটনা ঘটে অনেক দিন পরে। আশির দশকের প্রথম দিকে। বাবা কাজ থেকে অবসর নিয়ে তখন কলকাতায়। আমি সদ্য চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছি এক বছর আগে। প্রথম ছুটিতে দেশে ফিরেছি। খুব ফুরফুরে মেজাজে। কলকাতা পৌঁছেই বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে যোগাযোগ করছি। প্রথম ফোন করলাম দেবু মানে দেবরাজের বাড়ি। ফোন ধরল রত্না, দেবুর স্ত্রী। দেবুর মা হাসপাতালে। দেবু ছুটি নিয়েছে। ডাক্তার, বদ্যি, ওষুধ-পত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত। রত্না জানাল দেবুর বাড়ি আসার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে ভিজিটিং আওয়ারে হাসপাতালে গেলে দেখা হবে। রত্না জানিয়ে রাখবে আমার কথা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাসীমা খুব স্নেহশীলা। ছাত্রজীবনে অনেকবার দেবুর বাড়ির ছাদে আড্ডা মেরেছি। মাসীমা দফায় দফায় চা, জলখাবার পাঠাতেন।

ভাবলাম হাসপাতালে একা না গিয়ে আরও কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই। অনিন্দ্যকে ফোন করলাম। অনিন্দ্য ব্যস্ত মানুষ। এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কম বয়সে খুব উন্নতি করেছে। শহরের কয়েকটি তথাকথিত অভিজাত ক্লাবের সদস্য, গলফ-টলফ খেলে। পরের দিন রবিবার। অনিন্দ্য জানালো বিকেলের দিকে আমরা হাসপাতালে যাবো একসঙ্গে। ওকে ওর ক্লাব থেকে তুলে নিতে হবে, ওর ব্রিজ ম্যাচ আছে। ওর গাড়ি থাকবে না। গাড়ি নিয়ে শ্বেতা, মানে ওর স্ত্রী, বন্ধুদের নিয়ে শপিং-এ যাবে।

পরের দিন বিকেলের দিকে একটি গাড়ি ভাড়া করে আমি অনিন্দ্যর ক্লাবে পৌঁছলাম। অনিন্দ্যের নির্দেশ মত ক্লাবের রিসেপশনে গিয়ে ওর নাম বললাম। সেকালে তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা। রিসেপশনের ভদ্রলোক আমায় বসতে বললেন। সামনে কয়েকটি সোফা সাজানো ছিল, - গিয়ে বসলাম। হঠাৎ দেখি বছর পঁচিশের একটি ছেলে, গলায় টাই, বোধহয় ঐ ক্লাবেরই কর্মচারী, আমায় দেখে বলল, - গুড আফটারনুন। স্যর আপনি? আমি একটু ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে আবার প্রশ্ন, - অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম স্যর। আপনি কি এখন এখানে থাকেন না? আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার স্মৃতি হাতরে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কুল কিনারা পাচ্ছি না। মিনমিন করে জানালাম, - না এখন বাইরে থাকি। ছেলেটি একগাল হেসে বলল, - তাই আপনাকে আজকাল ক্লাবে দেখিনা। আমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করার আগেই অনিন্দ্য পৌঁছে গেল। ছেলেটি অনিন্দ্যকেও গুড আফটারনুন জানালো। অনিন্দ্য একটু মৃদু হেসে আমাকে বলল, - চল রওনা হই।

গাড়িতে উঠে অনিন্দ্যকে বললাম। কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বলল, - অন্য কারও সঙ্গে গোলমাল করেছে বোধহয়। যা নন-ডেসক্রিপটিভ চেহারা তোর!

যাক, সংক্ষেপে বলি মাসীমা মানে দেবুর মা সে যাত্রা সেরে উঠেছিলেন।

এবার তৃতীয় ঘটনা।

বছর পাঁচেক আগে কাজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরেছি। গিন্নীকে যথা সম্ভব সাহায্য করছি নতুন সংসার সাজিয়ে নিতে। সাংসারিক ব্যাপারে আমার কোনও রকম সুনাম নেই। যাই হোক, একদিন গিন্নীর দেওয়া লিস্ট পকেটে নিয়ে বাজারে বেরোলাম। আবাসনের পাশে আধুনিক শপিং মল। সেখানে বিশাল এক সুপার মার্কেট। কেনা কাটা করে বিল মেটাতে ডেবিট কার্ড বের করলাম। বিল হয়েছে ৮৩৮ টাকা। পেমেন্ট কাউন্টারের ছেলেটি কার্ড ঢুকিয়ে কি টেপাটেপি করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, - এরর মেসেজ আসছে স্যর। আমি দ্বিতীয় বার চেষ্টা করতে বললাম। এবার কোনও গোলমাল হলনা। বিল পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাগ হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পকেটে মোবাইল ফোন দু-বার কুঁক কুঁক করে উঠল, - বের করে দেখি ব্যাংক থেকে এসএমএস এসেছে, - ৮৩৮ টাকা দু-বার ডেবিট হয়ে গেছে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে দেখালাম। ছেলেটির তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা, - স্যর আপনার সামনেই তো এরর মেসেজ এসেছিল, আপনাকে তো দেখালাম। শেষ অব্দি ছেলেটিই বলল, - ম্যানেজারের কাছে যাই চলুন।

একটি মাঝারি আকারের সুসজ্জিত অফিস ঘরে ম্যানেজার আসীন। মহিলা বেশ আকর্ষণীয়া; বছর পঞ্চাশের মত বয়স। এককালে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন, - স্যর আপনি? বুঝলাম আবার সেই ভ্রান্তিবিলাস। ভদ্রমহিলা এক নাগারে বলে যাচ্ছেন – আমাকে চিনতে পারছেন না স্যর, আমি সেই যে মিউজিকাল ওয়ার্লডে ছিলাম। পার্ক স্ট্রীটে। আপনি ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল রেকর্ড কিনতে আসতেন। নতুন কিছু এলে আমি আপনাকে ফোন করে খবর দিতাম...। পার্ক স্ট্রীটের মিউজিকাল ওয়ার্লডে আমি এক আধবার গেছি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী গানের সিডি কিনতে। পাশ্চাত্য ধ্রূপদী সঙ্গীত আমি কস্মিন কালেও শুনিনি।  আমি একটু দেঁতো হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম এনার সাহায্য যখন দরকার তবে আমার আসল পরিচয় না দেওয়াই ভাল।

ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে এত খুশি হয়েছিলেন যে সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। আমাকে সযত্নে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে উনি বেশ কয়েকটা ফোন করলেন এদিন ওদিক। তিন দিন পর ৮৩৮ টাকা আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেল।

এখনও সেই সুপার মার্কেটে গেলে আমার সঙ্গে দেখা হয় মহিলার। আমি খুব ব্যস্ততার ভান করে পাশ কাটিয়ে সরে যাই।

এর পরের ঘটনা গত পূজোর সময়কার।

অষ্টমীর দিন সকালে কয়েক জন প্রবীণ নাগরিক কলকাতা শহরে বনেদি বাড়ির পূজো দেখতে বেরিয়েছিলাম। সবাই আমাদের আবাসনের। কয়েকটি অচেনা মুখও দেখলাম। আলাপ পরিচয় করে জানতে পারলাম এঁরা কলকাতায় থাকেননা। এঁদের ফ্ল্যাট বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে এখানে এসে ছুটি কাটিয়ে যান। সারা দিন ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে যখন ফিরে আসছি, আবাসনের কাছাকাছি এসে, আমাদের পাশের সীটে বসা দম্পতীর সঙ্গে আলাপ হল। বছর ষাটেক বয়স। প্রেসিডেন্সীতে সহপাঠি ছিলেন। এক সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। এখন দু-জনেই আমেরিকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বিষয় অর্থনীতি। দুই ছেলে সেদেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত।

ওনাদের পরিচয় নিয়ে আমি বললাম, - আচ্ছা এবার আমার পরিচয় দিচ্ছি। তাতে ওঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে ও শুনে আমার ভির্মি খাওয়ার মত অবস্থা। দুজনেই হাতজোড় করে সসম্ভ্রমে বলে উঠলেন, - লজ্জা দেবেন না স্যর, আপনাকে কে না চেনে, - কত অনুষ্ঠানে গান শুনেছি আপনার। আমার তখন হেঁচকি টেচকি উঠে ভয়ঙ্কর অবস্থা। ভাবলাম এ রকম ভাবে চলতে পারেনা। আসল পরিচয় দিয়ে দেওয়া উচিৎ , এবং এখনই। কিন্তু সেই সময়েই আমাদের গাইড বলে উঠলেন আপনাদের বাড়ি পৌঁছে গেছি, এবার আস্তে আস্তে নেমে যান। আমি সামলে উঠে কিছু বলার আগেই ওঁরা বাস থেকে নেমে গেলেন। আমার সঠিক পরিচয় আর দেওয়া হলনা।

পরে খোঁজ খবর করেছিলাম। শুনলাম ওঁরা আমেরিকায় ফিরে গেছেন। সামনের বছর এলেই ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসল পরিচয়টা দিতে হবে নইলে বিবেকের দংশনেই জ্বলে পুড়ে মরব।

আপনারা যারা আমাকে চেনেন তাঁদের অনুরোধ যদি আমার মত দেখতে কারও সঙ্গে আলাপ হয় যিনি শহরের কোনও অভিজাত ক্লাবের সদস্য, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীতের ভক্ত, সুগায়ক এবং ছোটবেলায় দিল্লীতে ছিলেন, তবে দয়া করে আমাকে জানাবেন।

শুভেচ্ছা রইল।

কলকাতা ৬ই জানুয়ারি ২০১৮ 


Monday, 5 June 2017

আতাতুর্কের দেশে



যাত্রা হল শুরু
মুম্বাই থেকে বাহরেইন হয়ে গালফ এয়ারলাইন্সের প্লেন যখন ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে এসে নামল, তখন সকাল প্রায় দশটা চড়া রোদ উঁকি মারছে প্লেনের জানলা দিয়ে ক্লান্ত লাগছে খুব আগের দিন বিকেলে বেরিয়েছি কলকাতা থেকে, ইন্ডিগোর ফ্লাইটে মুম্বাই পৌঁছেছি  রাত আটটায়,- তারপর ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কেঠো চেয়ারে সারা রাত অপেক্ষা। ইস্তানবুলের প্লেন ছাড়ল ভোর সারে ছটায়। প্লেন থেকে নামার সময় মনে হচ্ছিল শরীর আর চলছে না।

ইস্তানবুল আতাতুর্ক বিমান বন্দর তুরস্কের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ত বিমান বন্দর। বেশ বড়, কিন্তু দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মত অত ঝকঝকে বা বিলাস বহুল নয়। ভিসা আগেই করা ছিল। ইমিগ্রেশনে বেশি সময় লাগল না। অনেকগুলো কাউন্টার। এক অতি সুদর্শণ যুবক কাগজ পত্র দেখে খুব গম্ভীর মুখে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে গুড মর্নিং, থ্যাঙ্ক ইউ ইত্যাদি বললাম কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম না। মনে হল কি জানি বাবা, এখানকার লোক বোধহয় এরকমই গোমড়ামুখো। পরে অবশ্য ধারণা পালটে গিয়েছিল। তুরস্কের লোকজন খুবই অমায়িক ও বন্ধুসুলভ। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

দশ জনের দল আমাদের। সবাই আমাদের আবাসনেরই বাসিন্দা এবং প্রবীন নাগরিক। প্রত্যেকের একটি করে মাঝারি সাইজের ব্যাগ। মালপত্র নিয়ে কাস্টমস ছাড়িয়ে বেরিয়ে দেখলাম দুটি কমবয়সী ছেলে হাতে বিরাট প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাতে বেশ স্পষ্ট হরফে বড় বড় করে লেখা টমাস কুক ওয়েলকামস দ্য গ্রুপ ফ্রম কোলকাট্টা (ইংরিজিতে লেখা বানান Kolkatta), - কবে যে লোকে আমাদের শহরের নামটা শুদ্ধ ভাবে লিখতে বা বলতে পারবে

ছেলে দুটি সাদর অভ্যর্থনা জানাল আমাদের একটি ভারতীয়, - নাম বলল সুর্জিৎ (সুরজিৎ), এখানেই থাকে স্ত্রী কন্যা থাকে দিল্লীতে দ্বিতীয় ছেলেটি স্থানীয়, - নাম ওসগুর, যে রকম ভাবে নামটা উচ্চারণ করল, - মনে হল পেটের ভেতর থেকে আর গলার গভীরতম জায়গা থেকে বেরোচ্ছে আমরা সবাই বার কয়েক চেষ্টা করে রণে ভঙ্গ দিলাম ওকে জানিয়ে দিলাম, - তোমায় ভাই আমরা অস্কার বলে ডাকবো ছেলেটি সহাস্যে রাজি হল।

সুরজিৎ জানালো আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে কারণ দিল্লী থেকে আরেকটা ফ্লাইটে আরও ছজন আসছেন ওঁরাও আমাদের দলে, দিল্লী থেকে বুক করেছেন অগত্যা এয়ার পোর্টে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই ঘন্টা খানেক পর দিল্লীবাসীদের সঙ্গে আমরা রওনা হলাম শহরের দিকে সুন্দর আরামদায়ক বাস, সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত

ইস্তানবুল – অতীত ও বর্তমান
সুরজিৎ ও অস্কার আমাদের গাইড প্রথমে সুরজিৎ, তারপর অস্কার মাইক হাতে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল এই ঐতিহাসিক শহরের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপ, দুটি মহাদেশে বিস্তৃত এই শহরের মোট জনসংখ্যা এখন প্রায় দেড় কোটি। ঝকঝকে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় ছুটে চলেছি শহরের দিকে। ডুয়েল ক্যারেজওয়েরর মাঝখানের ডিভাইডারে সুন্দর ফুলের বাগান। সেই ফুল কেউ ছেঁড়ে না। শহরের সৌন্দর্যের ব্যাপারে নগরিকেরা খুব সচেতন।

রাস্তার ডিভাইডারে ফুলের বাগান

ইস্তানবুলের বর্তমান আধুনিক চেহারা দেখলে কে বলবে যে এই শহরেই রোম সম্রাট কনস্টানটাইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর রাজধানী, - কনস্টানটিনোপোল, ৩৩০ খৃষ্টাব্দে। অস্কার জানালো, এই শহরের ইতিহাস আরও পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে যে  তিন হাজার বছর আগেও এখানে এক প্রাচীন উপজাতির বসবাস ছিল। সেই সময়ের এর নাম ছিল লাইগস। পরবর্তী কালে গ্রীক সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এই শহর, নাম দেওয়া হয় বাইজান্টিয়াম। অত্যন্তঃ জটিল এই ইতিহাসের খুঁটিনাটি। আমরা খেই হারিয়ে ফেললাম। শুধু এইটুকু জানলাম যে পরবর্তী কালে এই শহর অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে ও ঘোষিত হয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। নাম হয় ইস্তানবুল। তবে ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজধানী স্থানান্তরিত হয় আঙ্কারা শহরে। ইস্তানবুল হারায় তার রাজনৈতিক গড়িমা। তবে এখনও এই শহরের বানিজ্যিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এখনও অক্ষুন্ন।

এই দেশের লোকেরা নিজেদের দেশকে বলে তুর্কিয়া। ইংরিজিতে বলে টার্কি। আমরা কেন তুরস্ক বলি সেই রহস্য ভেদ হলনা। আমাদের গাইড দু’জনও এ ব্যাপারের কোনও আলোকপাত করতে পারল না। দিল্লীবাসী আমাদের সহযাত্রীরাও জানালেন তুরস্ক শব্দ ওঁদের অপরিচিত। যাই হোক, এ নিয়ে আলোচনা আরেক দিন করা যাবে।
তুরস্কবাসীদের আচার ব্যবহার, চেহারা, পোষাক আষাক সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যমুখী। নারী ও পুরুষ গতানুতিক পশ্চিমী জামা কাপড়েই সচ্ছন্দ্য। কিন্তু এঁরা ধর্মপ্রাণ মুসলিম। এক’শ বছর আগেও এঁরা ছিলেন ইতিহাসের অন্যতম খিলাফতের নাগরিক।

রাস্তার দু-ধারে একটু পর পরই চোখে পড়ে নানা আকারের মসজিদ। মসজিদের স্থাপত্য আমাদের পরিচিত স্থাপত্য থেকে একটু আলাদা। মসজিদের সামনে সুন্দর বাগান ও গাড়ি পার্ক করার সুব্যবস্থা। এখানে বলে রাখা ভাল যে তুর্কি স্থাপত্যের জগৎ জোড়া খ্যাতি ছিল এক কালে। ভারত ও উপমহাদেশের বহু শহরেও তার নিদর্শন রয়েছে।

মসজিদের স্থাপত্য একটু স্বতন্ত্র
রাস্তায় বেশ ভীড়। বুধবার, - কাজের দিন। শহরের কাছে এসে বাসের গতি কমে এলো। বেশ ট্র্যাফিক। অবশেষে পৌঁছোলাম হোটেলে। এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও স্নানাহার। হোটেলটি ইস্তানবুল শহরের কেন্দ্রেই। আশেপাশে অনেক দোকানপাট আর রেস্তোরাঁ।

বিকেলের দিকে মনে হল নতুন দেশে এসেছি যখন, হোটেলে বসে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে। দিল্লীবাসীরাও সাগ্রহে রাজি হলেন। আমাদের গাইডদ্বয়ও দেখলাম খুব উৎসাহী। যে বাসে করে এয়ারপোর্ট থেকে এসেছিলাম, সেই বাসটি হোটেলের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এটিই এখন আমাদের বাহন। বাসে উঠে বসলাম সবাই। ঘুরে ঘুরে দেখলাম শহরটা, যতটা সম্ভব।

ইস্তানবুলের এক তৃতীয়াংশ লোক বাস করেন এশিয় অঞ্চলেবাণিজ্যিক কর্মকান্ড কিন্তু ইউরোপিয়ন অঞ্চলেই বেশিএশিয় অঞ্চল থেকে প্রচুর লোক প্রত্যেক দিন ইউরোপিও অঞ্চলে আসেন পেশাগত কারণে। এশিয়া আর ইউরোপিও অঞ্চলের মাঝখানে বয়ে চলেছে বসফরাস প্রণালী (Bosphorus Strait) স্বচ্ছ, পরিস্কার, টলটলে জলরাশি দেখলেই বোঝা যায়, এই প্রণালী খুব সযত্নে লালিত। জলে ভাসছে প্রচুর ছোট ও মাঝারি আকারের স্টীমার। তাতে রয়েছে লাঞ্চ, স্ন্যাক্স ও ডিনারের ব্যবস্থা। পর্যটকদের কাছে জায়গাটি খুব প্রিয়।

বসফরাস প্রণালী

আমাদের প্রশ্নের জবাবে অস্কার জানালো যে বসফরাস প্রণালীর একপ্রান্তে কৃষ্ণ সাগর (Black Sea) আর অন্য প্রান্তে মার্মারা সাগর (Sea of Marmara) এই সাগরেই অবস্থিত মার্মারা দ্বীপ, সেই নামেই সাগরের নাম এই দ্বীপেরমার্বেলজগদ্বিখ্যাত এবং মার্বেলের জন্যেই দ্বীপের নাম মার্মারা; - ওদের ভাষায় মার্বেলকে বলে মার্মারা! কি আশ্চর্য তাই না? মর্মরের সঙ্গে মার্মারার কি অদ্ভুত মিলতবে কি কোনও এক প্রাচীন যুগে সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক লেনদেন ছিল আমাদের দুই দেশের মধ্যে? তখনই কি আমাদের দেশবাসীরা এই দেশের নাম রেখেছিলেন তুরস্ক?

ইউরোপিয় অংশের বাণিজ্যিক অঞ্চল গমগম করছে পড়ন্ত বিকেলে। রাস্তার দু-পাশে অসংখ্য দোকানপাট, পর্যটকদের ভীড়ই বেশি। নানা রকম পণ্যতুরস্ক বেশ শিল্পোন্নত দেশ। এদের চর্ম ও বস্ত্র শিল্প পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের দলের মহিলারা সাগ্রহে ঢুকে গেলেন বিভিন্ন দোকানে। শুরু হল দরদাম। দোকানদারেরাও দেখলাম সাদরে নিমন্ত্রণ জানালেন সম্ভাব্য ক্রেতাদের।
 
রাস্তার দু-ধারে দোকান ও রেস্তোরাঁ
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা এইটুকুই। সন্ধ্যের পর সবাই দেখলাম খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন। একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম সবাই। বিছানায় পড়া মাত্রই গভীর নিদ্রা।

প্রাচীন স্থাপত্য
দ্বিতীয় দিন সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার উঠলাম বাসে। সুরজিৎ আর অস্কারও দেখলাম তৈরী। আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থল হল সুলতান আহমেদ মসজিদ। সারা বিশ্বে এই মসজিদ “ব্লু মস্ক” বা নীল মসজিদ নামে পরিচিত। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত এই মসজিদ এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পর্যটন কেন্দ্র। এর ভেতরে ও বাইরের সাজ সজ্জা ও অলঙ্করণ থেকে এক নীলাভ দীপ্তি ভেসে আসে। সেই থেকেই এর নাম। ভেতর ও বাইরের সব সুক্ষ্ম কারুকার্য কিন্তু পুরোটা হাতে করা। এই মসজিদের আরও একটি বৈশিষ্ট হল এর ছ’টি মিনার, পাঁচটি বিশাল গম্বুজ ও আরও আটটি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ। দুর্ভাগ্য যে ক্যামেরায় ছ’টি মিনারের ছবি ফ্রেমে আনতে পারলাম না। তাই বাধ্য হয়ে পিকচার পোস্টকার্ড থেকে একটি ছবি দিলাম। অনন্য এর স্থাপত্য। ভেতরে চারদিকের দেওয়ালে অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি। এই বিশেষ স্থানটি একটি ধর্মীয় সৌহার্দেরও প্রতিক। ২০০৬ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এখানে এসেছিলেন অতিথি হিসেবে। সঙ্গে ছিলেন এই মসজিদের ইমাম। দু-জনে এক সঙ্গে প্রার্থনা করেন এই ঐতিহাসিক মসজিদে।
   
নীল মসজিদ                                ছ’টি মিনার
Related image 
মসজিদের ভেতরে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম            ছাদ বা সিলিং-এ অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি

নীল মসজিদ থেকে হাঁটা পথে পৌঁছলাম আয়া সোফিয়া (তুর্কী উচ্চারণ) বা হ্যাগিয়া সোফায়া (Hagia Sophia)এই ঐতিহাসিক নীল মসজিদ থেকে অন্ততঃ এক হাজার বছর আগে নির্মিত। যাঁরা আধুনিক ইংরিজি সাহিত্য নিয়ে একটু আধটু চর্চা করেন তাঁরা নিশ্চয়ই “দা ভিঞ্চি কোড” খ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউনের “ইনফার্নো” পড়েছেন। সেই বইটিতে এই ভবনটির খুব বিশদ বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। এর একটি বৈশিষ্ট হল যে এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদের ধর্ম চর্চার জায়গা ছিল। আমাদের গাইড অস্কারের কাছে শুনলাম যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে এখানে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল। পরে গ্রীক আমলে এখানে নতুন করে এক বিরাট গির্জা নির্মিত হয়, গ্রীক অরথোডক্স মতালম্বীদের তত্ত্বাবধানে। পরে কোনও এক সময়ে এটি রোমান ক্যাথলিকদের নিয়ন্ত্রনে আসে। পরবর্তী কালে যখন এই অঞ্চল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে, তখন এটি একটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়। আয়া সোফিয়ার স্থাপত্য শিল্প কিন্তু নীল মসজিদের কাছাকাছিও আসে না। দেখে কেমন যেন মনে হয় যে এটি বেশ জোড়াতালি দিয়ে বানানো হয়েছে। আমাদের মত অনভিজ্ঞ চোখেও ধরা পড়ে যে এর চারটি মিনার আলাদা ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল মসজিদের ঐতিহ্য অনুযায়ী। এখন অবশ্য এটি আর মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। এটি এখন একটি মিউজিয়াম বা সংগ্রহশালা। নানা রকম অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরের দেওয়ালে এখনও রয়ে গেছে খ্রীস্টান ও ইসলামি সভ্যতার নানা কালজয়ী নিদর্শন।
আয়া সোফিয়া – মিনার গুলো পরে বসানো হয়েছে।

তুরস্কের ইতিহাসে অটোমান সাম্রাজ্য বা খিলাফতের প্রসঙ্গ আসবেই। এই “অটোমান” শব্দটির সম্বন্ধে কিছু  তথ্য জানাই এবারএই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওসমান গাজী বা প্রথম ওসমান। তাঁর নামেই এই বংশ বা সাম্রাজ্যের নাম। ব্যাকরণ-গত কারণে আরবরা ওসমান শব্দটির উচ্চারণ করেন ওথমান বা উথমান। এ রকম উদাহরণ প্রচুর আছে। যেমন আরবরা রমজানকে বলেন রামাদান বা আজানকে বলেন আদান। এই ওথমান বা উথমান থেকেই ইংরিজি ভাষায় অটোমান শব্দের উৎপত্তি। যেহেতু আমরা এই অঞ্চলের ইতিহাস শিখেছি ইংরেজদের কাছে, আমরাও এই অটোমান শব্দটি ব্যবহার করি। নিয়ম মত আমাদের কিন্তু ওসমান সাম্রাজ্যই বলা উচিৎ। কালক্রমে এই সাম্রাজ্যের বিরাট বিস্তৃতি ঘটে এবং এই বংশের সুলতানরা খলিফা বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান মুসলিম জগতে। ১৯২৪ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ওসমান বা অটোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

বাজার হাট - সংক্ষেপে শপিং
ইতিহাস সমৃদ্ধ যে কোনও দেশ বা শহরে অজস্র সংগ্রহশালা বা মিউজিয়াম দেখা যায়। গাইডরাও খুব উৎসাহের সঙ্গে সেখানে পর্যটকদের নিয়ে যান। কিন্তু যাঁদের ইতিহাসে সচেতনতা কম তাঁরা কিছুক্ষণ পরে অধৈর্য হয়ে পড়েন। তাই কয়েকজনের আগ্রহ সত্ত্বেও আমাদের দলের গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্যের ইচ্ছেয় আমাদের গাইড বন্ধুরা আমাদের নিয়ে গেলেন এক বিশেষ আকর্ষনীয় জায়গায়। ইস্তানবুলের বিখ্যাত গ্র্যান্ড বাজারেএই বাজারের খ্যাতি জগৎ জোড়া। অস্কারের কাছে জানলাম যে প্রতি বছর নয় থেকে দশ কোটি লোক এখানে বাজার করেন। এই বাজারের আদলটা অনেকটা কলকাতার নিউ মার্কেটের মত, কিন্তু বিশাল। এ বাজার বহু পুরনো, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চলছে রমরমিয়ে। হেন জিনিষ নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। তুর্কীরা গর্ব করে বলে, - এটা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শপিং মল। কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়

সাহস করে একটা কথা বলেই ফেলি। এখানে ঢোকার পর দেখলাম মহিলাদের মুখ চোখ কেমন চকচক করে উঠল। কিন্তু তাঁদের কর্তারা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেলেনআমাদের এক বন্ধু তো আমার কানে ফিসফিস করে বলেই ফেললেন, - এবার হল, এখান থেকে কখন বেরোতে পারব তা ঈশ্বরই জানেন। দিল্লীবাসী এক সহযাত্রী বেশ সশব্দেই তাঁর ধরমপত্নীকে বললেন, - সুনো জি, ফজুলকী চীজ মত খরিদ না। কিন্তু সেই আবেদন মহিলাটির কানে পৌঁছল বলে মনে হল না।

মহিলারা নানা দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দোকানে ঢুকে গেলেন। সবার কাছেই কিছু তুর্কী মুদ্রা বা লিরা রয়েছে। এক তুর্কী লিরা আমাদের মুদ্রায় ২০ টাকার কাছাকাছ। ইউরোও চলে। শুরু হল শপিং। এখানে দেখলাম সবাই মোটামুটি ইংরিজি জানে। যথা সময় মহিলারা জানালেন এখানে সব কিছু নাকি খুব সস্তা। সেই শুনে কর্তারা প্রমাদ গুনলেন। অস্কার ও সুরজিৎ দু-জনেই সাবধান করে দিয়েছিল যে এখানে প্রচন্ড দরাদরি করতে হয়। কিন্তু কতটা দরাদরি করতে হয় তা আমি টের পেলাম একটু পরে। আগেই বলেছি এখানকার চর্মশিল্প খুব বিখ্যাত। এক দোকানদার একটি চামড়ার টুপি হাতে নিয়ে আমার পেছনে পড়ল। টেক স্যর ভেরি গুড স্যর করতে করতে আমার পিছু নিল। আমি টুপি পরি না; কাউকে পরানোর ইচ্ছেও আমার নেই। কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। ওর হাত থেকে বাঁচবার জন্য দাম জিজ্ঞেস করলাম, - বলল ওনলি হান্ড্রেড লিরা মানে আমাদের হিসেবে প্রায় দু-হাজার টাকা। আমি বললাম, - টু মাচ। লোকটি নিরাশ হল না, জিজ্ঞেস করল, - হাও মাচ ইউ পে? আমি ওকে কাটানোর জন্য বললাম, - পঁচিশ লিরা। লোকটা বিষন্ন মুখে বলল, - আই মেক বিগ লস। বাট ইউ মাই গেস্ট। আই গিভ ফর টুয়েন্টি ফাইভ। লোকটি আমার হাতে টুপিটা গুঁজে দিল। আমি বোকার মত পঁচিশ লিরা বের করে দিলাম। আমাকে টুপি পরানো যে এত সোজা আগে বুঝিনি কখনও

যাই হোক, অবশেষে গাইড দু’জনের তাড়ায় মহিলারা বাজারে ক্ষান্ত দিলেন। আমরাও কিচ্ছু জামা কাপড় কিনলাম, নাতি নাত্নীদের জন্য। আমাদের জন্য আর কিই বা নেব? আর দু-বাক্স টার্কিশ ডিলাইট কিনলাম। হালুয়া জাতীয় এই তুর্কী মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়; স্বর্গীয়।
 
              ইস্তানবুলের গ্র্যান্ড বাজার               নানা রকমের পসরা সজানো

এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে হোটেলে ফিরতে বেশ রাতই হল।

রাজকীয় আঙ্কারা
তৃতীয় দিন। সকাল বেলা উঠেই ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে ফেলতে হল। আজ ইস্তানবুলের হোটেল ছেড়ে আমরা বাসে রওনা হব আঙ্কারার উদ্দেশে। দূরত্ব সাড়ে চার’শ কিলোমিটার। যদিও খুব সুন্দর হাইওয়ে, কিন্তু ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার বেগে ছুটলেও পাঁচ ঘন্টা তো লাগবেই। তা ছাড়া মাঝে মাঝে বিরতিও দরকার, - খাওয়া দাওয়া, বাথরুম ইত্যাদির জন্য।

ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে উঠতে উঠতে প্রায় ন’টা বেজে গেল। আমরা অনেকেই গাইডদের পরামর্শ অনুযায়ী আটটায় তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম।  কিন্তু সব দলেই কিছু লোক থাকে যারা কখনই সময় মেনে চলে না। শুধু তাই নয়, দেরির জন্য দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা, ভাল সীট খালি নেই বলে মেজাজ দেখাতেও ছাড়ে না। কিছু করার নেই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলাই হল জীবনযাত্রার মন্ত্র।

অপূর্ব ছয়-লেনের হাইওয়ে। আমাদের বাস ছুটে চলেছে এক’শ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার গতিতে। তুরস্ক যে কতটা শিল্পোন্নত তার উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তার দু-ধারে। অসংখ্য কারখানা। একটার পর একটা। আর সব ক’টি ঝকঝকে তকতকে। তুরস্কের ইস্পাত, মোটর গাড়ি বা অটোমোবাইল, জাহাজ নির্মান সবই খুব উন্নত মানের। অস্কার জানালো তুরস্কে নির্মিত গাড়ির শতকরা ৮০ ভাগ রপ্তানী হয়।

আমাদের আঙ্কারা পৌঁছতে বিকেল ৪টে হয়ে গেল। মাঝখানে একটি ছোট্ট শহরে লাঞ্চ সারা হল অত্যন্ত উৎকৃষ্ট কাবাব ও রুটি সহযোগে। তুর্কী কাবাব এক কথায় লা-জওয়াব।

হোটেল পৌঁছে সেই সন্ধ্যাটা দল বেধে খাওয়া দাওয়া আড্ডা মেরেই কেটে গেল। কোথাও আর বেরনো হল না, বাসের ড্রাইভারও খুব ক্লান্ত। বিশ্রাম দরকার। সুরজিৎ এসে জানিয়ে গেল আমরা যেন সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে নি। পরের দিন আঙ্কারা শহরের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। আর দেখা হবে আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে।

আতাতুর্ক
চতুর্থ দিন। গত রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ায় সকালে সবাইকে খুব তরতাজা দেখাচ্ছিল। যথারীতি কয়েক জন বিশিষ্ট লেট-লতিফের কৃপায় বেরোতে বেরোতে সোয়া ন’টা হয়ে গেল।

প্রথম গন্তব্য স্থান মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের  সমাধিসৌধ। মুস্তাফা কামাল আধুনিক প্রজাতন্ত্রী তুরস্কের জনক। ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তিনি দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত, আমৃত্যু তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর শাসন কালে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনেন। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়, - যার ফলে দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। নারী পুরুষের বিভেদ দূর করে, নারীদের পূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার দেওয়া হয়, - ফলস্বরূপ তুরস্কের মেয়েদের সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে, এমন কি সামরিক বাহিনীতেও। তাঁর এই অভূতপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে “আতাতুর্ক” বা তুরস্কের জনক হিসেবে সম্মানিত করা হয়।

সমধিসৌধের পরিবেশ খুব শান্ত ও গম্ভীর। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কৃষ্ণ বর্ণ অথবা শ্বেত শুভ্র পোষাকে পাহাড়ায় রত। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সবাই। চোখের পলক পর্যন্ত পড়েনা। ছবি তুললাম কিছু। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি একটা বাস এসে দাঁড়ালো। নেমে এলে দলে দলে ছাত্র ছাত্রীপ্রত্যেকের পরনে গ্র্যাজুয়েশন গাউন। সার বেঁধে দাঁড়ালো সবাই তারপর ধীর পদক্ষেপে ও নীরবে এগিয়ে গেল সৌধের দিকে। অস্কার জানালো এটি এখানকার একটি ঐতিহ্য। সদ্য স্নাতক বা গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের পর সোজা এখানে চলে আসেন আতাতুর্ককে সম্মান জানাতে।  সেদিন যারা গিয়েছিলেন তাঁরা সব সদ্য পাশ করা ডাক্তার অর্থাৎ মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট।

আতাতুর্ক এই সৌধেই সমাধিস্থ। নীরবে দর্শন করে বেরিয়ে এলাম আমরা।
 
 সমাধি সৌধের সামনে ছাত্ররা   সমাধির পাদদেশে পুষ্পস্তবক       অতন্দ্র প্রহরী

সমাধিসৌধের চত্ত্বরেই রয়েছে এক বিরাট সংগ্রহশালা। সেখানে তুরস্কের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসের প্রচুর সাক্ষী অতি যত্নে রক্ষিত। সীমিত সময়ের মধ্যে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব ছিলনা। তবে তুরস্কের ইতিহাস নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে চান তবে এই সংগ্রহশালা একটি স্বর্ণখনি।

রাতের আহার সারলাম এক বিশেষ রেস্তোরাঁয়। স্থানীয় খাদ্যএর সঙ্গে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা ছিলসন্ধ্যেটা ভালই কাটল।

পাতাল নগরী
পঞ্চম দিন সকালে আবার তল্পি তল্পা গুটিয়ে রওনা হলাম। আবার খুব লম্বা সফর। প্রায় তিন’শ কিলো মিটার; অন্ততঃ ঘন্টা চারেক তো লাগবেই। গন্তব্য স্থান ক্যাপাডসিয়া, তুর্কী উচ্চারণে কাপাদকিয়া। আমাদের গাইড অস্কার ও সুরজিৎ দু-জনেই উচ্চারণ করল ক্যাপাডসিয়া। তাই আমিও তাই বলছি।

বিস্তৃত অঞ্চল। পর্যটকদের প্রিয় জায়গা। নামটা শুনেই মনে হয় এই অঞ্চলে এক কালে গ্রীক সভ্যতার প্রভাব ছিল। অস্কারকে জিজ্ঞেস করাতে জানালো শুধু এই অঞ্চলই নয়, তুরস্কের বহু জায়গায় গ্রীক ও তার পূর্ববর্তী রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবও রয়েছে।

ক্যাপাডসিয়া অঞ্চলের এক বিশেষ আকর্ষণ বিশাল পাহাড়ি অঞ্চলের নীচে এক বিশাল ভূগর্ভস্থ শহর। মাটির নীচে অসংখ্য ঘর বাড়ি ও রাস্তা ঘাট। এই শহরের গোড়াপত্তন হয় রোমান অঞ্চলে। তখন খৃষ্ট ধর্মের শৈশবরোমান সম্রাটদের রোষে বহু খৃষ্ট ধর্মালম্বী পালিয়ে গিয়ে এই ভূগর্ভস্থ গহ্বরে লুকিয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে এখানে এক গোপন শহর গড়ে ওঠে। পরে রোমান সাম্রাজ্যের শক্তিক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শহরের বাসিন্দারা ওপরে উঠে আসেন এবং ভূতলেও এই শহরের বিস্তার ঘটে। এক আশ্চর্য জায়গা এই ভূগর্ভস্থ শহর। এটা যে কেন সপ্তম আশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত নয় কে জানে। এখনও সেই শহর অটুট, যদিও পরিত্যক্ত। এত রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও এখনও নিখুঁত রয়েছে এই আশ্চর্য শহর।

এমন আকর্ষনীয় জায়গা; ঘুরে দেখতে কেটে গেল সারা দিন। গাইডের তাড়া খেয়েও কেঊ নড়ল না ওখান থেকে।


 
               পাথর কেটে শহর                       এই শহর মাটির তলায় বিস্তৃত

উষ্ণ প্রস্রবন
ষষ্ঠ দিনের সকালে মনে হল সবাই যেন খুব ক্লান্ত। আগের দিন প্রচুর হাঁটা হয়েছে। আমাদের দলের সবাই প্রবীন নাগরিক। হাঁটু, কোমর বহু ব্যবহারে জীর্ণ। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে একমত হল যে এ দেশে আসা উচিৎ ছিল কুড়ি বছর আগে, যখন শরীরে কিছু জোর ছিল।

আমাদের সম্মিলিত মতামত গাইডদের জানানো হল নেহাৎই ঠাট্টার ছলে। গাইডদ্বয় গম্ভীর মুখে আমাদের বক্তব্য শুনে নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করে নিল। কিছুক্ষণ পরে জানালো আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে এমন এক আকর্ষণীয় জায়গায় যেখানে সারাটা দিন খুব উপভোগ করব স্রেফ বিশ্রামের মাধ্যমে। জায়গাটির নাম পামুক্কলে। অস্কার জানালো তুর্কী শব্দ পামুক্কলের অর্থ কটন কাসল।

কেন এই নাম সেটা বুঝতে পারলাম একটু পরেই। জায়গাটি হট স্প্রিং বা উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য পর্যটকদের অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। ভূগর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত উষ্ণ জল বয়ে চলেছে অবিরাম। সেই জলস্রোতের সঙ্গে মিশ্রিত নানা রকম খনিজ পদার্থ মাটির ওপর কয়েক হাজার বছর ধরে স্তরে স্তরে জমে উঠেছে। এখন মাটির ওপর সাদা রঙে ঢেউ খেলানো সেই স্তর বা প্রলেপন দূর থেকে বিশাল তুলোর পাঁজার মত মনে হয়। তাই এই অঞ্চলের নাম পামুক্কলে বা কটন কাসল। সে এক অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মানতেই হবে যে প্রকৃতিই জগতের সবচেয়ে বড় শিল্পী।

হট স্প্রিং বা প্রস্রবণের জলের ধারাকে সিমেন্টের বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়েছে, অনেকটা বহমান সুইমিং পুলের মত। সেখানে গা ডুবিয়ে বসে ছিলেন অসংখ্য নারী পুরুষ। আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না কারণ আমরা তৈরি ছিলাম না। আগে জানা থাকলে সাঁতারের পোষাক নিয়ে আসতাম। যাই হোক, সেই অবস্থাতেই প্যান্ট গুটিয়ে বসে রইলাম হাঁটু অব্দি পা ডুবিয়ে। আঃ সে কি স্বর্গীয় অনুভূতি।

 
                      কটন কাসল                           উষ্ণ জলে গা ডুবিয়ে

এই অঞ্চলের আশেপাশে রয়েছে রোমান সভ্যতার প্রচুর নিদর্শন। সবই প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত। ইদানীং তুরস্ক সরকারের প্রত্নতাত্মিক বিশেষজ্ঞরা এই ঐতিহাসিক স্থানটির হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। ষাটের দশকে পর্যটকদের ভীড় দেখে এখানে বেশ কয়েকটি বড় হোটেল তৈরি হয়। হোটেলের মালিকরা এই উষ্ণ জলপ্রবাহের গতি পরিবর্তন করে হোটেলের সুইমিং পুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন যে তাতে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সরকারী আদেশে সব হোটেল ভেঙে দেওয়া হয়।

কুসাদাসি
সপ্তম দিন। আমাদের তুরস্ক ভ্রমণ শেষ পর্যায়ে। আমরা এসে পৌঁছলাম কুসাদাসি, সমুদ্রের উপকুলে ছবির মত এক সুন্দর শহর। এর বীচ বা সমুদ্র সৈকত খুব জনপ্রিয়। আমরা গাইডের মুখে শুনে অবাক হলাম যে এই শহরর জনসংখ্যা মোটে ৬৫ হাজার। কিন্তু গ্রীষ্মকালে টুরিস্টদের ভীড়ে এই সংখ্যা ৫ লক্ষতে গিয়ে দাঁড়ায়। অসংখ্য হোটেল, যা নাকি সারা বছর খালি পড়ে থাকে, কিন্তু টুরিস্ট মরশুমে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।

বিশাল এক বন্দর এই শহরের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। এখান থেকে ছাড়ে নানা রকম বাণিজ্যিক ও যাত্রী জাহাজ। এখন থেকেই শুরু হল আমাদের বেরানোর দ্বিতীয় পর্ব। সমুদ্র ভ্রমণ। ক্রুজ শিপে বিভিন্ন গ্রীক দ্বীপ ছুঁয়ে শেষে এথেন্স।

 
কুসাদাসি বন্দর

আমার এই কাহিনী তুরস্কেই সীমাবব্ধ থাক। গ্রীসের গল্প না হয় আরের দিন হবে। সংক্ষিপ্ত এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এইটুকুই বলতে পারি যে এক সপ্তাহের মধ্যে তুরস্কের মত ঐতিহাসিক দেশে ঘোরা বা দেশটিকে জানা সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় স্বল্প সময়ে আমাদের দেশের হৃদয়কে স্পর্শ করা। তবে যা পেয়েছি তাতে আমি নিজে খুব তৃপ্ত ও নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান বলে মনে করি।


***************