২০১৩ ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে শেষবারের মত অফিস গিয়েছিলাম। তারপর থেকে অবসর জীবনের শুরু। বেশ লাগছে। হাতে বেশ অনেকটা সময়। ইচ্ছে মত বই পড়ে, টিভি দেখে, শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছি। তবে সেই যে বলে না, যে অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। মাঝে মাঝে অসংলগ্ন কিছু চিন্তা মাথায় আসে। কাউকে বলাও যায় না। লোকে ভাববে চুপচাপ ঘরে বসে থেকে মাথাটাই বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। তাই ভাবলাম কাউকে বিরক্ত না করে যা মাথায় আসে চুপচাপ লিখে ফেলাই ভাল। সময় মত নিজেই পড়ব। অনেকটা নিজের সঙ্গে আড্ডা মারার মত। পাগলের প্রলাপ? বোধহয় তাই!
Saturday, 12 September 2020
প্রলাপ: নানা রঙের দিনগুলি
একটি সুপাত্র
একটি সুদর্শন যুবক। পেটানো, মেদহীন চেহারা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী। কলেজ জীবনে খেলাধূলো করেছে প্রচুর। নানা বিষয়ে পড়াশোনা ও জ্ঞান। বাংলা, হিন্দী, ইংরিজি সব ভাষাতেই সচ্ছন্দ। বয়সটা ঠিক জানিনা। পঁচিশ থেকে এই একত্রিশ বত্রিশের মধ্যে। এই ছেলের কি কোনও পাত্রী জুটবেনা? বা একটি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী বান্ধবী?
আপনারা বলবেন নিশ্চয়ই জুটবে। কিন্তু জোটেনি।
ছেলেটি কিন্তু বাংলার গর্ব। পেশায় একজন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝে পিস্টল বা রিভলভার
ব্যবহার করে, কিন্তু আসল অস্ত্র হল মগজাস্ত্র।
প্রদোষ মিত্র। বা আমাদের সবার প্রিয় ফেলুদা। সব
ভাল কিন্তু কেমন যেন প্রেমহীন জীবন। এত লোকের সঙ্গে আলাপ, কত মক্কেল, প্রচুর
অনুরাগী, কিন্তু কোথাও কোনও নায়িকার দেখা পাওয়া গেলনা। কিন্তু ফেলুদার
পূর্বসুরীদের দেখুন। কিরিটী রায়ের একটি
সুন্দরী স্ত্রী ছিল, - কৃষ্ণা। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ তো আত্মপ্রকাশের কিছু পরেই অর্থমনর্থম
রহস্য সমাধান করে সত্যবতীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ব্যোমকেশ বাবু অবশ্য বিশেষ ভাগ্যবান।
এক চিরকুমার বন্ধু আজীবন বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর সংসারের দেখশোনা করে জীবন কাটিয়ে
দিলেন।
কত লোকের সঙ্গে আলাপ ফেলুদার। কত বড় বড় শিল্পপতি,
আইনজীবি, বিশাল জমিদার। কারও বাড়িতেই একটি সুলক্ষণা পাত্রী পাওয়া গেলনা। শুধু
নায়িকা কেন? ফেলুদার জীবনে কোনও মাসীমারও আবির্ভাব হয়নি। বেশির ভাগ মক্কেল হয়
অবিবাহিত কিংবা বিপত্নীক। যাঁরা বিপত্নীক, তাদের সবারই পুত্র সন্তান। অবিবাহিতদের
ভাইপো বা ভাগ্নে। আশ্চর্য! কি কপাল! এত মক্কেল, পুলিস অফিসারদের সঙ্গে আলাপ,
কিন্তু কারও বাড়িতেই তোপসের একজন বৌদি পাওয়া গেলনা। এই যে সিধু জ্যাঠা? তাঁর
পরিচিত একটি সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েও কি ছিলনা? লালমোহন বাবুও বা কেমন? সাহিত্যিক মানুষ, - এই
ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর তো নিতেই পারতেন।।
অনেকে হয়তো বলবেন, - বিয়ে হয়নি তো কি
হয়েছে? শার্লক হোমসেরও তো বিয়ে হয়নি। সে না হোক, ওদের সঙ্গে আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি
মেলেনা। অবশ্য শুধু ফেলুদা কেন? অনেক বাঙালি হিরোই অবিবাহিত থেকে
গেছেন। যেমন জয়ন্ত-মাণিক, বিমল-কুমার, দীপক চ্যাটার্জি-রতন লাল ইত্যাদি। তার আগে শ্রী
পাঁচকড়ি দে দেবেন্দ্র বিজয় ও অরিন্দম বাবুর কথা বলেছিলেন। কিন্তু এঁদের সম্বন্ধে আমি
কিছুই জানিনা। সবাইকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়েই বলছি, এঁদের মধ্যে শ্রী প্রদোষ মিত্রই
সবচেয়ে সুপাত্র হিসেবে গন্য হবেন। ফেলুদার সত্যিই একটা বিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল।
ফেলুদার অভিভাবক বেঁচে থাকলে সবাই মিলে দাবী জানাতাম,
- ফেলুদার বিয়ে দিন। এখন তো আর তা সম্ভব নয়।
এই একটা বাসনা অপূর্ণই থেকে গেল।
কলকাতা ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০
Tuesday, 23 July 2019
নানা রঙের দিনগুলি
নানা রঙের দিনগুলি
বাবা আসামে চাকরি করতেন। ছোটবেলা সেখানেই কেটেছে। বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন থাকতেন কলকাতা ও তার আশেপাশে। তাই বছরে একবার কলকাতায় আসা হতই। আমাদের স্কুল ছুটি হলে বাবাও ছুটি নিতেন, - হয় গরমে বা পূজোর সময়।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। আমার বছর দশেক বয়স। হাঁ করে কলকাতার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, দোকানপাট দেখতাম।
সবসময়ের সাথী ছিল আমার মাস্তুতো ভাই। আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। কিন্তু ছোট হলে কি হবে, কলকাতার ছেলে যে। অনেক কিছু জানে। আমাকে অনেক কিছু শেখাতো, - “ঐ যে দেখছিস বাস, সব পাঞ্জাবী (শিখ) ড্রাইভার আর কনডাক্টার, ঐ বাসগুলো এমনি বাস। আর যেগুলো খুব নতুন আর ঝকমকে, সেগুলো স্টেট বাস। ড্রাইভার, কনডাক্টার সব বাঙালি।
কথাগুলো খুব খাঁটি। ডাঃ বিধান রায় তখন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। চালু করেছেন স্টেট ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন। আধুনিক বাস এল বাইরে থেকে। কর্মচারিরা বেশির ভাগ পূর্ব বাংলা থেকে আগত। দোতলা বাসে চড়ার খুব শখ ছিল। রাস্তায় বেরোলেই বাবাকে বলতাম, - দোতলা বাসে যাব। স্টেট বাসের গায়ে দরজার কাছে ইংরিজিতে লেখা থাকত, - Wait till the bus stops. ঠিক নীচেই লেখা থাকত, - বাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। এই নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হয়। অনেক বিদগ্ধ নাগরিক জানালেন যে বাংলা অনুবাদটি ভুল। আসলে লেখা উচিৎ, - বাস না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। অনেক তর্কাতর্কি লেখালেখির পর একজন জানালেন যে “বাস থামলে ওঠানামা করুন” লিখলে কোন বিতর্কের অবকাশ থাকেনা। যাই হোক কর্তৃপক্ষ এসব তর্ক বিতর্কে কর্ণপাত করেন নি।
ট্রামে চড়ার আকর্ষণ ছিল খুব। বেশ ট্রেনের মত অথচ ট্রেন নয়। সামনের কামরা ছিল প্রথম শ্রেণী, গদি মোড়া আসন। পেছনেরটি দ্বিতীয় শ্রেণী, কাঠের আসন। ভাড়া কত ছিল জানিনা। আমি তো আর ভাড়া দিতাম না, বাবা দিতেন।
ট্যাক্সি ডাকলেই দাঁড়াতো। কখনও কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যাবনা বলতে দেখিনি। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বেশির ভাগ ছিলেন শিখ। শহরের পরিবহন অনেকটাই এঁরা নিয়ন্ত্রন করতেন।
১৯৬১ সালে স্কুলের পাট চুকিয়ে কলকাতায় পড়তে আসি, সে কি আনন্দ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হই প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে। তখন ধীরে ধীরে স্কুলগুলোতে এগারো ক্লাস শুরু হচ্ছে। দশ ক্লাসের স্কুল ফাইনাল থেকে এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি। হায়ার সেকেন্ডারির পর বি-এ, বি-কম, বিএসসি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলের পড়াশোনা। যে সব স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি চালু হয়নি, তাদেরকে স্কুল ফাইনালের পর এক বছর প্রি-ইউনিভার্সিটি করতে হত।
সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হলেও হস্টেলে ঠাঁই হলনা। খোঁজ খবর করে এক জায়গার সন্ধান পাওয়া গেল। বিবেকানন্দ রোড ও কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের মোড়ে অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে সীট খালি আছে। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হল। সেই বাড়ীটি এখনও আছে। তবে নাম পালটে গেছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রীটও আরও কয়েক বছর নাম পালটে বিধান সরণী হয়ে গিয়েছিল।
কলেজে যাবার জন্য মোড়ের মাথা থেকে ২বি বাস ধরতাম। চৌরঙ্গী রোড (তখনও জহরলাল নেহরু রোড হয়নি) আর পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে নেমে যেতাম। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর মুর্তি ছিল। মেট্রো রেলের কাজের সময় সেটি স্থানান্তরিত হয়। ভাড়া ছিল ২০ পয়সা। ক’দিন পর এক সহপাঠী জানালো যে আমি মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করছি। আমি যদি ২বি তে না এসে ৮বি বাস ধরি, তবে পার্কস্ট্রীট আর সার্কুলার রোডের মোড়ে, মানে পার্কস্ট্রীটের অন্য প্রান্তে নামব। ভাড়া ১৫ পয়সা। আমার ৫ পয়সা বেঁচে যাবে। তার মানে সপ্তাহে, মানে ছ-দিনে ৩০ পয়সা। এক মাসে ১টাকা ২০ পয়সা। একটা সিনেমার টিকিট, তাও বেশ ভাল সীটে। দারুণ ব্যাপার।
কোনও নেশা ছিল না। তবে একটি বিলাসিতা রপ্ত করেছিলাম। শণিবার একটু আগে ছুটি হত। হস্টেলে ঢোকার মুখে একটা পান, বিড়ি সিগারেটের দোকান ছিল। তার কোনটারই আকর্ষণ আমার ছিলনা। তবে সেখানে বরফ ঠান্ডা কোকাকোলা পাওয়া যেত। একটি বোতলের দাম ২৫ পয়সা। হস্টেলে ঢোকার আগে এক বোতল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে, তারিয়ে তারিয়ে সেই ঠান্ডা পানীয় উপভোগ করতাম। সেই আনন্দ আর কোনও দিনও পাইনি।
রাত্রে দশটার সময় হস্টেলের লাইট নিবিয়ে দেওয়া হত। সকালে খুব ভাঙত কিছু বর্ষীয়ান কীর্তনিয়ার কল্যাণে। খোল করতাল নিয়ে সূর্যোদয়ের আগেই এঁরা বেরিয়ে পড়তেন রাস্তায়। উদাত্ত কন্ঠে গাইতেন, - রাধে রে গোবিন্দ রাধে, রাধে রে গোবিন্দ। সেই সুরের ঝংকার এখনও কানে লেগে আছে।
মাসে একটা সিনেমা দেখতাম। প্রত্যেকটি সিনেমা মুক্তি পেত কয়েকটি বিশেষ হলে। যেমন “রূপবাণী, অরুণা, ভারতী” বা “শ্রী, ইন্দিরা, প্রাচী” বা “মিনার, বিজলী, ছবিঘর”। বেশ ভীড় হত। ভাল সিনেমার রজত জয়ন্তী, সুবর্ণ জয়ন্তী সপ্তাহ ফলাও করে ছাপা হত খবরের কাগজে।
আইন শৃঙ্খলার সমস্যা বরাবরই ছিল। কিন্তু সেটা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না কখনও। একদিন হস্টেলের ঘরে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারছি। হঠাৎ শুনলাম বাইরে প্রচুর সোরগোল, চিৎকার। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি দু-দলের মধ্যে প্রচন্ড মারামারি চলছে। সেকালে বোমাবাজি দেখিনি। সোডার বোতলই চলত বেশি। গন্ডগোল দেখলেই পান, সিগারেট, ঠান্ডা পানীয়র দোকানদারেরা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিতেন। যাই হোক। মিনিট পনেরোর মধ্যে পুলিসের গাড়ি এসে পৌঁছল। লাফিয়ে নামল আধ ডজন কন্সস্টেবল, হাতে লাঠি, মাথায় লাল পাগড়ি। সঙ্গে এক সাদা উর্দি পরা অফিসার। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিক শুনশান। যারা মারামারি করছিল তারা কর্পূরের মত উবে গেল। একজন কন্সস্টেবলকে দাঁড় করিয়ে ফিরে গেল পুলিসের গাড়ি। একটু পরে দেখি সেই একলা পুলিস সামনের এক ছোট্ট চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসেছেন। আমরা গুটি গুটি পায়ে গিয়ে আলাপ জমালাম। জিজ্ঞেস করলাম, - আবার গোলমাল হলে আপনি একা কি করবেন? ভদ্রলোক হেসে বললেন, - আমি তো কিছু করব না। করবে তো এ; - বলে নিজের পাগড়ি দেখিয়ে দিলেন। এই পাগড়ি দেখলে কেউ কাছে আসার সাহস পাবে না। এমনি ছিল সেকালে পুলিসের দাপট। কিছুক্ষণ পরে পুলিস ভদ্রলোক পকেট থেকে ব্যাগ বের করে চায়ের দাম মেটালেন। দোকানদারও হাত পেতে পয়সা গুণে নিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই।
বেহালার পর্ণশ্রীতে থাকতেন আমার স্নেহশীলা বড়মাসী। বাড়ির জন্য মন কেমন করলে বাসে উঠে রওনা দিতাম। রবিবার বা অন্যান্য ছুটির দিনে। তারাতলায় দেখতাম অজস্র কারখানা, সারি সারি। কখনও হাওড়া স্টেশনে উঠে চুুঁচুড়া, আমার মাতুলালয় ও জন্মস্থান। বর্দ্ধমানে কাকা থাকতেন, সেখানে যাওয়া হত মাঝে মাঝে।হাওড়ায় বা হাওড়া থেকে রেললাইনের দু-ধারে অজস্র কারখানা বা ইন্ডাস্ট্রি। পশ্চিম বঙ্গ তখন এক শিল্পোন্নত রাজ্য। ভাবতাম পড়াশোনা শেষ করে এখানে কোনও এক জায়গায় নিশ্চয়ই চাকরি পেয়ে যাব। সেটা আর সম্ভব হয়নি। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যখন চাকরির খোঁজে রাস্তায় নামলাম, তখন সব কারখানা হয় বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার মুখে। সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে।
কলকাতা
২০ জুলাই ২০১৯
Saturday, 6 January 2018
ভ্রান্তিবিলাস – এ যুগে
প্রথম থেকেই বলি।
আজ থেকে বছর ষাটেক আগের কথা। আমি তখন স্কুলে। বয়স ১০ বা ১২। আসামে থাকতাম। বাবার চাকরি ছিল সেখানেই। আমার ও আমার ছোট বোনের পূজোর ছুটি শুরু হলে বাবাও ছুটি নিতেন। আমরা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসতাম। এসে উঠতাম রাজাবাজারে আমার কাকার বাড়ি। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে বালিগঞ্জের ফার্ন রোডে আমার বড়ো পিসীমার বাড়ি। তারপর ক’দিন পর চুঁচুড়ায়, - আমার জন্মস্থান ও মাতুলালয়। সেখানে খুব ধুমধাম করে পূজো হত। পূজো শেষ হলে আবার কলকাতায়। আবার বড়ো পিসীমার বাড়ি, কাকার বাড়ি হয়ে ফেরত।
পিসীমার সহকারী ছিলেন হরিকাকা। হরিকাকা বহুদিন ধরে পিসীমার পরিবারে। তিনি সবার হরিকাকা। পিসেমশায়, আমার পিস্তুতো দাদা ও দিদি, আমার মা ও বাবা ও আমাদেরও তিনি হরিকাকা। তাঁর বয়স কেউ জানত না, একটু ন্যুব্জ, কৃষ্ণবর্ণ, শীর্ণকায় চেহারা। তাঁর তত্ত্বাবধানে আমার বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। একদিন সকালে আমি হরিকাকার সঙ্গে বাজারে গেছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি, হরিকাকার শক্ত হাতে আমার হাত। এমন সময়, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোক, ফর্সা, লম্বা দোহারা চেহারা, পরনে ধবধবে ধুতি ও পাঞ্জাবী, আমায় দেখে একগাল হেসে বললেন ,- একি? তোমরা কলকাতায়? কবে এসেছো? মা, বাবা, বোন সবাই এসেছেন নিশ্চয়ই। আমি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির। অচেনা লোক দেখে বাক্যিহারা হয়ে যাই, মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভদ্রলোকের আবার প্রশ্ন, - কেমন লাগছে কলকাতা? আমি মিনমিন করে বললাম, - ভাল লাগছে। এর পরের প্রশ্নে আমি একেবারে দিশাহারা। উনি জিজ্ঞেস করলেন, - দিল্লী থেকেও ভাল? দিল্লীতে আমার এক মাসী থাকতেন, সেখানে একবার যাওয়ার কথাবার্তা চলছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমি কিছুই বললাম না। ভদ্রলোক আবার বললেন, - কি? দিল্লী ভাল না কলকাতা ভাল? আমি মিনমিন করে বললাম, - কলকাতা। ভদ্রলোক খুশি হয়ে থুতনি ধরে আদর করে চলে গেলেন। এর পর অবশ্য ওনার সঙ্গে দেখা হয়নি। উনি নিশ্চয়ই অন্য কারও সঙ্গে আমাকে গুলিয়েছিলেন।
পরবর্তী ঘটনা ঘটে অনেক দিন পরে। আশির দশকের প্রথম দিকে। বাবা কাজ থেকে অবসর নিয়ে তখন কলকাতায়। আমি সদ্য চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছি এক বছর আগে। প্রথম ছুটিতে দেশে ফিরেছি। খুব ফুরফুরে মেজাজে। কলকাতা পৌঁছেই বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে যোগাযোগ করছি। প্রথম ফোন করলাম দেবু মানে দেবরাজের বাড়ি। ফোন ধরল রত্না, দেবুর স্ত্রী। দেবুর মা হাসপাতালে। দেবু ছুটি নিয়েছে। ডাক্তার, বদ্যি, ওষুধ-পত্র নিয়ে খুব ব্যস্ত। রত্না জানাল দেবুর বাড়ি আসার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে ভিজিটিং আওয়ারে হাসপাতালে গেলে দেখা হবে। রত্না জানিয়ে রাখবে আমার কথা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাসীমা খুব স্নেহশীলা। ছাত্রজীবনে অনেকবার দেবুর বাড়ির ছাদে আড্ডা মেরেছি। মাসীমা দফায় দফায় চা, জলখাবার পাঠাতেন।
ভাবলাম হাসপাতালে একা না গিয়ে আরও কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই। অনিন্দ্যকে ফোন করলাম। অনিন্দ্য ব্যস্ত মানুষ। এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কম বয়সে খুব উন্নতি করেছে। শহরের কয়েকটি তথাকথিত অভিজাত ক্লাবের সদস্য, গলফ-টলফ খেলে। পরের দিন রবিবার। অনিন্দ্য জানালো বিকেলের দিকে আমরা হাসপাতালে যাবো একসঙ্গে। ওকে ওর ক্লাব থেকে তুলে নিতে হবে, ওর ব্রিজ ম্যাচ আছে। ওর গাড়ি থাকবে না। গাড়ি নিয়ে শ্বেতা, মানে ওর স্ত্রী, বন্ধুদের নিয়ে শপিং-এ যাবে।
পরের দিন বিকেলের দিকে একটি গাড়ি ভাড়া করে আমি অনিন্দ্যর ক্লাবে পৌঁছলাম। অনিন্দ্যের নির্দেশ মত ক্লাবের রিসেপশনে গিয়ে ওর নাম বললাম। সেকালে তো আর মোবাইল ফোন ছিলনা। রিসেপশনের ভদ্রলোক আমায় বসতে বললেন। সামনে কয়েকটি সোফা সাজানো ছিল, - গিয়ে বসলাম। হঠাৎ দেখি বছর পঁচিশের একটি ছেলে, গলায় টাই, বোধহয় ঐ ক্লাবেরই কর্মচারী, আমায় দেখে বলল, - গুড আফটারনুন। স্যর আপনি? আমি একটু ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে আবার প্রশ্ন, - অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম স্যর। আপনি কি এখন এখানে থাকেন না? আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার স্মৃতি হাতরে যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই কুল কিনারা পাচ্ছি না। মিনমিন করে জানালাম, - না এখন বাইরে থাকি। ছেলেটি একগাল হেসে বলল, - তাই আপনাকে আজকাল ক্লাবে দেখিনা। আমি ব্যাপারটা পরিষ্কার করার আগেই অনিন্দ্য পৌঁছে গেল। ছেলেটি অনিন্দ্যকেও গুড আফটারনুন জানালো। অনিন্দ্য একটু মৃদু হেসে আমাকে বলল, - চল রওনা হই।
গাড়িতে উঠে অনিন্দ্যকে বললাম। কোনও গুরুত্ব না দিয়ে বলল, - অন্য কারও সঙ্গে গোলমাল করেছে বোধহয়। যা নন-ডেসক্রিপটিভ চেহারা তোর!
যাক, সংক্ষেপে বলি মাসীমা মানে দেবুর মা সে যাত্রা সেরে উঠেছিলেন।
এবার তৃতীয় ঘটনা।
বছর পাঁচেক আগে কাজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরেছি। গিন্নীকে যথা সম্ভব সাহায্য করছি নতুন সংসার সাজিয়ে নিতে। সাংসারিক ব্যাপারে আমার কোনও রকম সুনাম নেই। যাই হোক, একদিন গিন্নীর দেওয়া লিস্ট পকেটে নিয়ে বাজারে বেরোলাম। আবাসনের পাশে আধুনিক শপিং মল। সেখানে বিশাল এক সুপার মার্কেট। কেনা কাটা করে বিল মেটাতে ডেবিট কার্ড বের করলাম। বিল হয়েছে ৮৩৮ টাকা। পেমেন্ট কাউন্টারের ছেলেটি কার্ড ঢুকিয়ে কি টেপাটেপি করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, - এরর মেসেজ আসছে স্যর। আমি দ্বিতীয় বার চেষ্টা করতে বললাম। এবার কোনও গোলমাল হলনা। বিল পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাগ হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পকেটে মোবাইল ফোন দু-বার কুঁক কুঁক করে উঠল, - বের করে দেখি ব্যাংক থেকে এসএমএস এসেছে, - ৮৩৮ টাকা দু-বার ডেবিট হয়ে গেছে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে দেখালাম। ছেলেটির তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা, - স্যর আপনার সামনেই তো এরর মেসেজ এসেছিল, আপনাকে তো দেখালাম। শেষ অব্দি ছেলেটিই বলল, - ম্যানেজারের কাছে যাই চলুন।
একটি মাঝারি আকারের সুসজ্জিত অফিস ঘরে ম্যানেজার আসীন। মহিলা বেশ আকর্ষণীয়া; বছর পঞ্চাশের মত বয়স। এককালে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন, - স্যর আপনি? বুঝলাম আবার সেই ভ্রান্তিবিলাস। ভদ্রমহিলা এক নাগারে বলে যাচ্ছেন – আমাকে চিনতে পারছেন না স্যর, আমি সেই যে মিউজিকাল ওয়ার্লডে ছিলাম। পার্ক স্ট্রীটে। আপনি ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল রেকর্ড কিনতে আসতেন। নতুন কিছু এলে আমি আপনাকে ফোন করে খবর দিতাম...। পার্ক স্ট্রীটের মিউজিকাল ওয়ার্লডে আমি এক আধবার গেছি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী গানের সিডি কিনতে। পাশ্চাত্য ধ্রূপদী সঙ্গীত আমি কস্মিন কালেও শুনিনি। আমি একটু দেঁতো হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম এনার সাহায্য যখন দরকার তবে আমার আসল পরিচয় না দেওয়াই ভাল।
ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে এত খুশি হয়েছিলেন যে সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়িই হয়ে গেল। আমাকে সযত্নে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে উনি বেশ কয়েকটা ফোন করলেন এদিন ওদিক। তিন দিন পর ৮৩৮ টাকা আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে গেল।
এখনও সেই সুপার মার্কেটে গেলে আমার সঙ্গে দেখা হয় মহিলার। আমি খুব ব্যস্ততার ভান করে পাশ কাটিয়ে সরে যাই।
এর পরের ঘটনা গত পূজোর সময়কার।
অষ্টমীর দিন সকালে কয়েক জন প্রবীণ নাগরিক কলকাতা শহরে বনেদি বাড়ির পূজো দেখতে বেরিয়েছিলাম। সবাই আমাদের আবাসনের। কয়েকটি অচেনা মুখও দেখলাম। আলাপ পরিচয় করে জানতে পারলাম এঁরা কলকাতায় থাকেননা। এঁদের ফ্ল্যাট বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে এখানে এসে ছুটি কাটিয়ে যান। সারা দিন ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে যখন ফিরে আসছি, আবাসনের কাছাকাছি এসে, আমাদের পাশের সীটে বসা দম্পতীর সঙ্গে আলাপ হল। বছর ষাটেক বয়স। প্রেসিডেন্সীতে সহপাঠি ছিলেন। এক সঙ্গে আমেরিকা গিয়েছিলেন পিএইচডি করতে। এখন দু-জনেই আমেরিকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বিষয় অর্থনীতি। দুই ছেলে সেদেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত।
ওনাদের পরিচয় নিয়ে আমি বললাম, - আচ্ছা এবার আমার পরিচয় দিচ্ছি। তাতে ওঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে ও শুনে আমার ভির্মি খাওয়ার মত অবস্থা। দুজনেই হাতজোড় করে সসম্ভ্রমে বলে উঠলেন, - লজ্জা দেবেন না স্যর, আপনাকে কে না চেনে, - কত অনুষ্ঠানে গান শুনেছি আপনার। আমার তখন হেঁচকি টেচকি উঠে ভয়ঙ্কর অবস্থা। ভাবলাম এ রকম ভাবে চলতে পারেনা। আসল পরিচয় দিয়ে দেওয়া উচিৎ , এবং এখনই। কিন্তু সেই সময়েই আমাদের গাইড বলে উঠলেন আপনাদের বাড়ি পৌঁছে গেছি, এবার আস্তে আস্তে নেমে যান। আমি সামলে উঠে কিছু বলার আগেই ওঁরা বাস থেকে নেমে গেলেন। আমার সঠিক পরিচয় আর দেওয়া হলনা।
পরে খোঁজ খবর করেছিলাম। শুনলাম ওঁরা আমেরিকায় ফিরে গেছেন। সামনের বছর এলেই ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসল পরিচয়টা দিতে হবে নইলে বিবেকের দংশনেই জ্বলে পুড়ে মরব।
আপনারা যারা আমাকে চেনেন তাঁদের অনুরোধ যদি আমার মত দেখতে কারও সঙ্গে আলাপ হয় যিনি শহরের কোনও অভিজাত ক্লাবের সদস্য, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীতের ভক্ত, সুগায়ক এবং ছোটবেলায় দিল্লীতে ছিলেন, তবে দয়া করে আমাকে জানাবেন।
শুভেচ্ছা রইল।
কলকাতা ৬ই জানুয়ারি ২০১৮
Monday, 5 June 2017
আতাতুর্কের দেশে



















